এই মুহুর্তে আমি অফিসের বসের সামনে বসে আছি। ফাইলটা খুলে বস আমাকে তখন নানা ভাবে বুঝাচ্ছেন আর আমি বসের কথায় তেমন একটা মনোযোগ না দিয়ে বারবার দেয়ালে ঝুলে থাকা ঘড়িটার দিকে লক্ষ্য করছি। হঠাৎ বস আমায় ধমক দিয়ে বললেন,
~পিয়াস সাহেব! আপনার সমস্যাটা কি? আমার কথায় মন না দিয়ে বারবার ঘড়ির দিকে কি দেখছেন? আমি তখন মাথা নিচু করে বললাম,
— স্যার, আমার খিদে পেয়েছে খুব। ১টা বেজে গেছে এখন যদি আমি কিছু না খাই তাহলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবো। আমার প্রেসার লো তো বস আমার কথায় বিরক্ত হয়ে বললো,
~যান যান, আগে কিছু খেয়ে আসুন আমি তড়িঘড়ি করে অফিস থেকে বের হয়ে রিকসায় উঠে রিকসাওয়ালাকে বললাম,
— তাড়াতাড়ি হলি চাইল্ড কিন্ডারগার্টেন স্কুলে নিয়ে যান স্কুলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ১টা বেজে ২৫মিনিট। তারমানে স্কুল ছুটি হতে আরো ৫ মিনিট দেরি আছে। তাই পাশের চায়ের দোকানে বসে এককাপ চা খেতে লাগলাম স্কুল ছুটি হবার কিছুক্ষণ পর এই স্কুলের একজন ম্যাডাম নাম শ্রাবণী বের হয়ে আসলো। শ্রাবণীকে দেখেই আমি হাসি হাসি মুখে বসা থেকে উঠে দাড়ালাম। অনেকদিন ধরে শ্রাবণীকে ফলো করছি কিন্তু কখনো কথা বলার সাহস হয় নি। কিন্তু আজ হঠাৎ শ্রাবণী আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
– আপনার সন্তান কি এইস্কুলে পড়ে? আমি অবাক হয়ে বললাম,
— আরে না না! আমি তো বিয়েই করি নি। তবে আমার ইচ্ছে আছে বিয়ের পর আমার সন্তানকে এই স্কুলেই ভর্তি করাবো শ্রাবণী কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললো,
– তাহলে কি আপনি কিডন্যাপার? কোন বাচ্চাকে কিডন্যাপ করার জন্য এইখানে ঘুরঘুর করছেন? আমি চমকে গিয়ে বললাম,
— আরে না না! আমি কোন কিডন্যাপার না। আমি খুব ভালো ছেলে। আমার নাম পিয়াস। একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করি। তাছাড়া আমার বাবা একজন হাজী এইবার শ্রাবণী রেগে গিয়ে বললো,
– তা হাজী সাহেবের পুত্র, আপনি প্রতিদিন এইসময় এইখানে দাঁড়িয়ে থাকেন কেন? আর আমায় দেখে মিচকে শয়তানারের মত হাসেন কেন? আমি মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললাম,
— না মানে! শ্রাবণী আমায় থামিয়ে দিয়ে বললো,
– আমি জানি আপনি কি বলবেন। দেখেই ভাই আমি একজন ডিভোর্সি মেয়ে। আর আমার ৩ বছরের একটা বাচ্চাও আছে। শুধু শুধু আমার পিছনে পরে থেকে লাভ নেই। তারচেয়ে বরং কোন মহিলা কলেজের সামনে অপেক্ষা করেন এতে লাভ হবে এইকথা বলে শ্রাবণী চলে গেলো আর আমি ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম এত রাতে আমার রুমে আলো জ্বালানো দেখে মা আমার রুমে এসে বললো,
~কিরে, তুই এখনো ঘুমাস নি? আমি মনমরা হয়ে বললাম,
— আর ঘুম, আমার সবঘুম নষ্ট হয়ে গেছে মা। আজ বাবা বেঁচে থাকলে নিজের সমস্যার কথা বাবাকে বলতাম কিন্তু তোমায় তো বলা যাবে না মা অবাক হয়ে বললো,
~কি এমন বিষয় যে আমাকে বলা যাবে না? আমি তখন বললাম,
— কয়েকদিন পর তোমায় সব খুলে বললো। এখন তুমি যাও আমি ঘুমাবো পরদিন দুপুরে আমি যখন আবার স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি তখন শ্রাবণী আমায় দেখে রেগে গিয়ে বললো,
– আপনাকে না বলেছি এইখানে দাঁড়িয়ে না থাকতে আপনি আবারও এসেছেন। তা আমার রুপ দেখে কি মনে কামনা জেগে উঠেছে? আপনারা পুরুষজাতিটাই খারাপ। কোন ডিভোর্সি মেয়ে দেখলেই সেটার সুযোগ নিতে চান। আপনাদের ধারণা ডিভোর্সি মেয়েদের চরিত্র খারাপ হয় তাই তাদের ডিভোর্স হয়েছে। একটু কিছুর লোভ দেখালেই ডিভোর্সি মেয়েরা আপনার সাথে শুয়ে যাবে। শুনেন ডিভোর্স শুধু মেয়েদের জন্য হয় না, ছেলেদের জন্যও হয়। কিন্তু আপনাদের এই ভদ্রসমাজ ডিভোর্সের জন্য ছেলেদের কোন দোষ দেয় না। সব দোষ মেয়েদের দেয়
আমি বিস্মিত হয়ে শ্রাবণীকে বললাম,
— আপনি তো নিজের মতই সব বলে যাচ্ছেন। আমায় তো কিছু বলার সুযোগ দিচ্ছেন না শ্রাবণী আরো রেগে গিয়ে বললো,
– আপনার ভাই কিছু বলতে হবে না। দয়া করে নেক্সট টাইম আমার সামনে আসবেন না শ্রাবণী চলে গেলো আর আমি আবারও ওর চলে যাওয়া পথের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইলাম এই ছেলের সাথে রাগে চেচামেচি করে শ্রাবণীর প্রচন্ডরকম মাথা ব্যথা করছে। তাছাড়া কয়েকদিন ধরে ওর শারিরীক সমস্যাও দেখা দিচ্ছে। তাই ও ভাবলো বাসায় ফেরার আগে ওর বান্ধবী ডাক্তার সানজিদার সাথে একটু দেখা করে যাবে সানজিদার চেম্বারের ভিতর ঢুকতেই সানজিদা শ্রাবণীকে দেখে অবাক হয়ে বললো,
~কিরে, তুই এতদিন পর। তা কেমন আছিস? শ্রাবণী মুচকি হেসে বললো,
– ভালো থাকলে নিশ্চয়ই তোর সাথে দেখা করতে আসতাম না শ্রাবণীর কথা শুনে সানজিদা হেসে দিয়ে বললো,
~ তুই কি চিন্তা করছিস সারাজীবন এমনি থাকবি? শ্রাবণী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
— ভালোবেসে বিয়ে করে একবার ঠকেছি আর ঠকতে চাই না এখন সময় পিয়ন ছেলেটা সানজিদাকে এসে বললো,
– ম্যাডাম, পিয়াস সাহেব আবার এসেছেন পিয়াসের নাম শুনে শ্রাবণী অবাক হয়ে বললো,
– পিয়াস কে? সানজিদা বিরক্ত হয়ে বললো,
~আর বলিস না, এই লোকটা কয়দিন ধরে আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। একটা নকল রিপোর্ট বানিয়ে দিতাম যে, উনার শারিরীক সমস্যা আছে। উনি কখনোই বাবা হতে পারবেন না। আচ্ছা তুই একটু পর্দার আড়ালে বসে থাক আমি উনার সাথে দুই মিনিট কথা বলি। তা নাহলে আমায় পাগল বানিয়ে দিবে। শ্রাবণী পর্দার আড়ালে বসলে সানজিদা পিয়নকে বললো,
~যাও উনাকে বলো আসতে চেম্বারে ঢুকে আমি ডাক্তার সানজিদা হককে বললাম,
— আমাকে আপনার রিপোর্ট বানিয়ে দিতে হবে না। আমি অন্য একজনের সহযোগিতায় রিপোর্ট বানিয়ে ফেলেছি। আসলে একমাস আগে স্কুলের একটা প্রোগ্রামে সেই স্কুলের একটা ম্যাডামকে দেখেই আমি ভালোবেসে ফেলি। পরে মেয়েটার খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারি মেয়েটা ডিভোর্সি আর মেয়েটার একটা ৩ বছরের মেয়েও আছে। মেয়েটা স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছিলো কারণ ওর স্বামী কাজের মেয়েকে ধর্ষণ করেছিলো। যখন জানতে পারি মেয়েটা ধর্ষিতা কাজের মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ওর প্রাক্তন স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে তখন মেয়েটার প্রতি ভালোবাসা আর শ্রাদ্ধা দুটোই বেড়ে যায়। কিন্তু আমাদের এই সমাজ ডিভোর্সি মেয়েদের স্বাভাবিক চোখে দেখে না। আমি যদি এই মেয়েকে বিয়ে করি তাহলে আমার মা আমার প্রতি অখুশি থাকবেন। আর আমার স্ত্রীকে খারাপ কথা শুনাবেন। তাই এই রিপোর্টটা দেখিয়ে আমি মাকে বুঝাবো আমার সমস্যা আছে আমি কখনো বাবা হতে পারবো না। আর তখন যদি মেয়েটাকে বিয়ে করি তখন আমার মার কোন আপত্তি থাকবে না। কথাগুলো বলে আমি চেয়ার থেকে উঠে দাড়ালাম। তারপর পকেট থেকে ফোনটা বের করে ওয়ালপেপারে থাকা ছবিটা ডাক্তারকে দেখিয়ে বললাম,
— এটা আমার ভবিষ্যৎ মেয়ে লাবণ্য। ওর মা শ্রাবণীর থেকে ৩ গুণ বেশি সুন্দর। এই পরীর মত মেয়েটা যদি আমার মেয়ে হয় তাহলে আমার আর কোন সন্তান চাই না। ভেবেছিলাম আমার বিয়েতে আপনাকে দাওয়াত দিবো কিন্তু আপনাকে দাওয়াত দিবো না। কারণ আপনি আমার কোন সাহায্য করেন নি কথাগুলো বলে যখন দরজা খুলে চেম্বার থেকে বের হয়ে যাবো তখন ডাক্তার সানজিদা হক মুচকি হেসে বললো,
~ আপনার বিয়েতে আপনি দাওয়াত না দিলেও আমি যাবো। কারণ আমি না গেলে কনের হাতে মেহেদী দেওয়া হবে না আমি উনার কথা না বুঝে চুপচাপ চলে গেলাম অফিসের একটা জরুরি কাজে খুব ব্যস্ত হয়ে গেলাম। কখন যে দুপুর ২টা বেজে গেলো আমার নিজের খেয়াল নেই। এমন সময় আমাদের অফিসের পিয়ন ছেলেটা এসে বললো, আমায় সাথে একজন দেখা করতে এসেছে আমি ফাইলের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম,
— ভিতরে পাঠিয়ে দাও আজ আপনি স্কুলের সামনে এলেন না কেন? এই কথা শুনে আমি ফাইলের থেকে চোখ সরিয়ে দেখি শ্রাবণী আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোটা গুলো দেখে মনে হচ্ছিলো যেন মুক্তার দানা আমি আমতা আমতা করে বললাম,
— কাজের খুব চাপ ছিলো তাই ভুলে গিয়েছিলাম শ্রাবণী আরো রেগে গিয়ে বললো,
– কাল থেকে স্কুল ছুটির পর গেইট থেকে বের হয়ে যদি দেখি আপনি নেই তাহলে কিন্তু আপনার ভবিষ্যৎ বউকে হারাবেন আমার আর শ্রাবণীর বিয়েটা মা স্বাভাবিক নিলেও আমার আত্মীয় স্বজন পাড়াপ্রতিবেশিরা ভালোভাবে নেয় নি। বিয়ের ৫দিন প্রথম যখন অফিসে যায় তখন বস আমায় ডেকে হাসতে হাসতে বললো,
~ আপনি তো দেখছি চার মেরেছেন৷ একের ভিতর দুই। বউয়ের সাথে বাচ্চা ফ্রি আমিও তখন বসের কথা শুনে হেসে বললাম,
— আপনিও তো স্যার চক্কা মেরেছেন। একের ভিতর তিন। বিয়ের পর বউয়ের সাথে বউয়ের দুই দুইটা বয়ফ্রেন্ডও পেয়েছিলেন আমার কথা শুনে বস মুখটা গোমড়া করে বললো ,
~পিয়াস সাহেব আপনি এখন আসতে পারেন লাবণ্যকে কোলে নিয়ে হাটছি তখন আমার এক দূরসম্পর্কের চাচাতো ভাই আমায় বললো,
~পরের রক্ত কখনো আপন হয় না। বড় হলে এই মেয়ে তোমাকে বাবা বলে স্বীকার করবে না আমি তখন চাচাতো ভাইকে বললাম,
— পরের রক্ত যেহেতু অস্বীকার করতেই পারে। যেখানে নিজের রক্তই নিজের বাবার সাথে বেঈমানী করে বাসা থেকে বের করে দেয়। চাচাতো ভাই কিছু না বলে চুপচাপ চলে গেলো আর আমি মাটিতে থুথু ফেললাম ছুটির দিন বিকালে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে ছাদে খেলছিলাম আর শ্রাবণী ছাদের কার্ণিশে হেলান দিয়ে আমাদের খেলা দেখছিলো। এমন সময় পাশের ফ্ল্যাটের সাকিব সাহেব আমায় একটু দূরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললো,
~ আপনার মত এত বুদ্ধিমান ব্যক্তির থেকে এমনটা আশা করি নি। আপনি চাইলে অনেক ভালো, সুন্দরী আর ভার্জিন একটা মেয়েকে বিয়ে করতে পারতেন। শুধু শুধু ইউজ করা জিনিসকে বিয়ে করলেন কথাটা শুনে আমার পায়ের রক্ত মাথায় উঠেগেলো। তবুও নিজেকে শান্তরেখে উনাকে বললাম,
— অন্য একটা সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করলে সেটা যে ইউজ করা হবে না তার কি গ্যারান্টি আছে? আপনার নিজের বোনওতো এক ছেলের সাথে রুমডেট করতে গিয়ে ধরা খেলো তারপর আপনারা অন্য ছেলের সাথে বোনকে বিয়ে দিলেন। আপনার বোনওতো ইউজ করা জিনিস। আমার বউ হালালভাবে ইউজ হয়ছে। তিনবার কবুল বলার পরেই আমার বউকে তার প্রাক্তন স্বামী স্পর্শ করতে পেরেছিলো। কিন্তু আপনার বোনকে তো কিছু না করেই স্পর্শ করেছিলো। সেই হিসাবে আপনার বোনের থেকে আমার বউ পিওর আর পবিত্র আছে। মেয়েদের একটু সম্মান দিতে শিখুন। মেয়েরা কোন পন্য না, যে তাদের ইউজ করা বলবেন ছাদের কার্নিশে হাত দিয়ে শ্রাবণী দূরের দিকে তাকিয়ে আছে। কাজলটানা চোখ দিয়ে যখন একফোঁটা কৃষ্ণবর্ণ জল গড়িয়ে পড়ছিলো তখন আমি ওর জলটা মুছে দিয়ে বললাম,
— পাগলি, আমি আছি তো তোমার পাশে..
গল্পের বিষয়:
গল্প