মলি শশুরবাড়িতে এসেছে মাসখানেক হলো । একেবারেই পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছে। ছুটির দিন দুপুরে শাশুড়ি আর স্বামী জনির সাথে ডাইনিঙ টেবিলে খেতে বসে মলি ভাতের সাথে কাঁচা মরিচ বাম হাতে রেখে কামড়ে খাচ্ছে। ভাত আর লাউয়ের তরকারির সাথে কাঁচা মরিচ কামড়ে খেতে ওর ভীষণ ভালো লাগে। তাছাড়া গরম ভাত তরকারির সাথে মাঝে মাঝে কাঁচা মরিচ খাওয়া ওর অনেক পছন্দের । তবে জনির সামনে আজই প্রথম এভাবে খাচ্ছে। ওর এই খাওয়া দেখে জনি ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলল,
— এভাবে কেউ খায় ? খুবই বাজে লাগছে দেখতে ,গ্রামের মানুষের মতো খাচ্ছো কেন ? ভদ্রভাবে খাও । এ বাসায়
এভাবে খাওয়া যাবে না। শাশুড়ির সামনে ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলো মলি তারপরও বিষয়টা মজার ছলে উড়িয়ে দিতে বলল,
— এখানে আর কে দেখছে? তুমিও ট্রাই করে দেখো , এভাবে হাতে ধরে কামড়ে খেতে কিন্তু ভীষণ মজা।
— থাক , আমার ছেলে কে আর তোমার খাওয়া শেখাতে হবে না ।
তুমি নিজেই শেখো আগে, কিভাবে ভদ্র ভাবে খেতে হয়? শাশুড়ি ও যে এভাবে কথা বলবে মলি একদম ভাবতেই পারেনি। জনিও আর কিছু বলল না । মলি ওর অর্ধেক খাওয়া কাঁচা মরিচটা রেখে প্লেটের খাবার টা কোন মতে শেষ করে উঠে পড়লো আর মনে মনে ভাবতে লাগলো বাবা মায়ের কথা। ছুটির দিন দুপুরে কোথাও লান্চ করতে গেলে যত বড় রেস্তোরাঁই হোক না কেন ? কাঁচা মরিচ যোগাড় করে দিতো ওর বাবা আর বলতো ,
— খা,যে যা মনে করে করুক । নিজের মনের আনন্দে খাবি । তোর যেটা ভালো লাগবে সেটাই করবি। মলি যখন কাঁচা মরিচ কামড়ে খেতো ,বাবা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখতো। ওর মাও অবশ্য এভাবে কাঁচা মরিচ কামড়ে খেতে ভীষণ পছন্দ করে। এসব ভাবতেই চোখ দিয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মলির মনে হচ্ছে , সামান্য কাঁচা মরিচ খেতে যদি এ বাসায় এতো সমস্যা হয় ,না জানি , সামনে আরো কত কিছু দেখা লাগবে। ঠান্ডা মাথায় জনির কাছে গিয়ে বলল,
— আচ্ছা , তোমাদের বাসায় কি কি করা যাবে আর যাবে না ? একটু বলে দিতে পারবা । তাহলে আমার খুব সুবিধা হতো। এই কদিনে খেয়াল করে দেখলাম, আমার অনেক কিছুই তোমাদের পছন্দ না ।
— ভেবেছিলাম ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছো , অনেক কিছুই জানো , এখন দেখি অনেক কিছুই জানো না। মায়ের কাছ থেকে সব শিখে নিও । তোমাকে নিয়ে চলাফেরা তো মুশকিল হয়ে যাবে ।
— তাই বলে আমার পছন্দ আর অপছন্দ বলে কিছু থাকবে না?
— থাকবে না কেন ? কিন্তু সেটা যেন আমাদের সাথে মানানসই হয় । তোমাকে বুঝতে হবে ,তুমি এখন এই পরিবারের বউ , সেইভাবেই তোমাকে আমাদের স্ট্যাটাস মেইনটেইন করে চলতে হবে।
— বউ বলে শুধু আমাকেই বদলে যেতে হবে?
— অবশ্যই কারন তুমি এ বাড়িতেই থাকবে। এখানে থাকতে হলে আমাদের মতো করেই থাকতে হবে।
— যদি বলি , তোমার অনেক কিছুই আমার পছন্দ না , তুমি কি নিজেকে বদলে ফেলতে পারবে?
— অবশ্যই না। আমার অপছন্দ করার মতো কিছু নেই। তাছাড়া আমার বাড়িতে আমি যেভাবে খুশি সেভাবে চলবো। তোমার সাথে কথা বলাও তো দেখি মুশকিল।
— ঠিক আছে । তোমার মুশকিল আসান হয়ে যাবে আর আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, বলে মলি ব্যাগ গুছিয়ে নিজের বাসায় চলে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো আর ভাবতে লাগলো,নিজেকে গিরগিটি বানিয়ে এখানে ও থাকতে পারবে না। ওর রেডি হওয়া দেখে জনি জানতে চাইলো ,
— হঠাৎ চলে যাচ্ছো যে, কোন কাজ আছে ? এভাবে হুটহাট আমাদের বাসা থেকে মন চাইলেই তুমি বের হয়ে যেতে পারো না? এই শিক্ষাটা ও তো পাওনি মনে হচ্ছে।
— কোন ফ্যামিলি থেকে যে আনলাম মেয়েটাকে বউ করে? একদম বেয়াড়া মেয়ে । বাবা মা তো তোমাকে কিছুই শেখায়নি মনে হচ্ছে। ছেলের সাথে তাল মিলিয়ে শাশুড়ি বললেন । তবে কথা শুনেও কোন উত্তর দিলো না মলি , জনির দিকে তাকিয়ে বলল,
— ঠিকই বলেছো , অনেক শিক্ষাই আমার বাকি আছে । যদি শিখতে পারি , তবেই ফিরে আসবো । নাহলে আর আসবো না । বলে ব্যাগটাও রেখে এক কাপড়েই চলে এসেছে।
বাবা মা বুঝিয়ে আবার পাঠাতে চেয়েছিলো দুই একবার কিন্তু মলির এক কথা , সামান্য কাঁচা মরিচ কামড়ে খাওয়াতে যে পরিবারের মানুষ এতো কথা বলতে পারে । নিজেকে বদলে ফেলতে বলে, তারা আরও কত কি করবে ? কে জানে ? তাছাড়া ওর কোন কিছুই যেন ওদের পছন্দ হয় না, কেমন যেন তাচ্ছিল্য করে । সবকিছুতেই ভুল ধরে ।এই ছোট ছোট বিষয় গুলোই প্রশ্রয় পেয়ে একদিন বড় আকার ধারণ করবে । তখন সমস্যা আরো বাড়বে । অথচ কিছু দিন আগে এরাই ওকে পছন্দ করে ঘরের বউ করে নিয়ে গেছে। এই একমাসেই ঘটা সব ছোট ছোট ঘটনা শুনে ,শেষ পর্যন্ত মলির মা বলল,
— খুব ভালো করেছিস , ধুঁকে ধুঁকে নিজের জীবন নষ্ট করার চেয়ে নতুন করে নিজের মতো বেঁচে থাকা ভালো। একটা সময় ছিলো যখন মেয়েরা সব কিছু সহ্য করে সংসার করতো । বাবাও মেয়ের সাথে একমত পোষণ করে বলল,
— অল্প সময়ের মধ্যে তাও বুঝতে পেরেছিস যে এটাই অনেক। আত্মসম্মান বিকিয়ে দিয়ে সংসার করার কোন দরকার
নেই ,মা । ভিতরে চাপা কষ্ট রেখে বাইরে হাসিমুখে সুখি সংসারের নাটক করার কোন মানে হয় না। কিছু দিন পর উকিল নোটিস পাঠিয়ে দিয়েছে আর নিজেও একটা চাকরি জোগাড় করে নিয়েছে মলি, শিক্ষিতা মেয়ে খুব একটা কষ্ট হয়নি চাকরি পেতে। সবার তো আর সুখের সংসার হয়না। কারো কারো সংসারই করা হয় না। মলিও তো একটা সুন্দর সংসার আশা করেছিলো কিন্তু পেলো না, ব্যর্থ হয়ে গেলো, নিজের সবকিছু বিকিয়ে দিয়ে সংসার সে করতে পারবেনা । সিঙ্গেল জীবন যাপন করছে , ইচ্ছে খুশি মতো বাবা মা কে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছোট্ট এইটুকুইতো জীবন আর কিছু চায় না। নিজের মতো করেই বাঁচবে , অন্যের কথা শুনে নয়।
যদিও আত্মীয় স্বজন আর পাড়া প্রতিবেশী ওকে নিয়ে আফসোস করতে করতে বেশ ভালোই কথা শুনিয়ে দেয় , ‘আহারে! মেয়েটা সংসার করতে পারলো না ।’ আরেকবার বিয়ের কথা বলে, অনেক পাত্রের খোঁজ খবর ও দেয় তারা আগ্রহ সহকারে। ওর আর খারাপ লাগে না, ছয়মাস না যেতেই এসব গা সওয়া হয়ে গেছে । তবে যদি সত্যিই কেউ ওর প্রাপ্য সম্মানটুকু দিয়ে সংসার করতে চায় ,না করবে না । সংসার তো দুজনের পছন্দ অপছন্দ মিলিয়ে বোঝাপড়ার বিষয় , কারো উপর কর্তৃত্ব ফলানো নয় । হয়তো খুঁজে পাবে তেমন কাউকে, নয়তো নয় । জীবন তো একভাবে না , একভাবে কেটেই যাবে । ভালোই কাটছিল এভাবে। বছর দুই না পেরোতেই ওর অফিসের কলিগ রনি বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো । এবার মলি ছেলেটাকে আগেই জানিয়ে দিলো,
— দেখুন , আমি কিন্তু ম্যানার কম জানি। অনেক বদ অভ্যাস আছে আমার। সহ্য করতে পারবেন কি না ? বলেন। তাছাড়া আমি নিজেকে বদলে ফেলতেও পারবো না। এসব কারনেই আমার আগে ডিভোর্স হয়েছে। এক ভুল বার বার করতে চাই না।
— আমি বউ বিয়ে করতে চাইছি না । একজন লাইফ পার্টনার খুঁজছি । যার সাথে সব কিছু শেয়ার করতে পারবো । বিপদে আপদে সবসময় একজন আরেকজনের পাশে থাকতে পারবো। আর আমি আগে বিয়ে না করলেও একজন প্রেমিকা ঠিকই ছিলো , বিয়ে করে দিব্যি সংসার করছে কানাডাতে।
— এখন ও খোঁজ রেখেছেন দেখছি ।
— না চাইলেও রাখা হয়ে যায় ফেসবুকের কল্যানে কারন সে আমার ক্লাসমেট ছিলো ,আমি ব্লক করে রাখলেও কোন না কোন বন্ধু খবর জানিয়ে দেয়। যাইহোক আমিও আপনাকে সবকিছু বলে দিলাম । এখন চিন্তা করে দেখেন।
আমার কোনো আপত্তি নেই বিয়েতে । আপনি যেমন আছেন ,ঠিক তেমনি থাকবেন। ছেলেটার কথা শুনে মলি আর কথা বাড়ালো না । ভাবছে , দ্বিতীয় বার ভুল নাও হতে পারে , তাছাড়া ছেলেটাকে খারাপ ও লাগছে না।আর একবার চেষ্টা করে দেখি , সংসার করতে পারি কিনা? বাবা মায়ের অনুরোধে আর একটু ভয়ে ভয়েই মলি বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলো। তবে সত্যিই এইবার সঠিক মানুষের সন্ধান পেয়েছে,মলি। ওর কোন কিছুই কটু দৃষ্টিতে দেখে না । এমনকি মলির মরিচ কামড়ে খাওয়াতেও আপত্তি নেয়। উল্টো ওর বাবার মতোই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখে। এই দ্বিতীয় বিয়ের পর পর ও আত্মীয় স্বজন আর পাড়া প্রতিবেশী কম কথা শোনায়নি, দেখো , সংসার করতে পারো কিনা? প্রথম সংসার টা তো একমাস ও টিকলো না।
মলি কোন উত্তর দেয়না , শুধু মনে মনে ভাবে, আমি কি আর প্রথম বিয়ের সময় ভেবেছিলাম যে এই বিয়ে টিকবে না। তাহলে তো আর বিয়েটা করতামই না। মলিও এবার স্বামী পাইনি , পেয়েছে একজন পার্টনার যার সাথে নিসংকোচে সবকিছু শেয়ার করতে পারে বন্ধুর মতো। আজ তাদের দশম বিবাহ বার্ষিকী। দুটো বাচ্চা ও হয়েছে। সঠিক মানুষ কে হয়তো প্রথম বার খুঁজে পায়নি তাই ঐ সংসারটা টেকেনি। এখন আর কেউ কিছু বলে না। ভালোই আছে ওরা। জীবন সঙ্গী নির্বাচনে সব সময় যে সবার প্রথম সিদ্ধান্ত সঠিক হবে ,তা কিন্তু নয়।
গল্পের বিষয়:
গল্প