আজ দুপুরে আমাকে একটা মিথ্যা কথা বলতে হল। সব সময় যারা মিথ্যা বলে না, তারা হঠাৎ করে মিথ্যা বললে খুব নার্ভাস হয়ে যায়। আর মিথ্যার সমস্যা হলো একটা বললে ,সেটার কারণে আরও দশ টা মিথ্যা বলতে হয়। যে একটা মিথ্যা বলার সময় নার্ভাস হয়ে যায়, সে দশ টা মিথ্যা কিভাবে বলবে? আর তাই অ্যাসিস্টেন্ট হেড স্যারের রুমে ঢুকে অসুস্থতার মিথ্যা দরখাস্ত দিয়ে দরদর করে ঘামতে থাকলাম আমি। বারবার মনে হচ্ছিলো হালদার স্যার এই বুঝি জিজ্ঞেস করবেন,” কিরে তোর কি হয়েছে? তাড়াতাড়ি বাড়ি যাচ্ছিস কেন?” মেয়ে হয়ে জন্মানোর অনেক অসুবিধার সাথে সাথে কিছু সুবিধাও রয়েছে। শরীর খারাপ হয়েছে শুনলে অনেকেই মেয়েলি ব্যাপার মনে করে বেশী ঘাটায় না। স্যারেরাও এর ব্যাতিক্রম না। হালদার স্যার আমার দরখাস্ত মাথা নিচু করে সাইন করতে করতে বললেন ,”কোন দিকে যাবি না, একটা রিক্সা নিয়ে সোজা বাসায় চলে যাবি।”
আমি হালদার স্যারের কথামতো ঠিক তাই করলাম। কিন্তু বাসায় এসে আমার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।বাসায় ফিরে আমি প্রথম যে কাজটা করি তা হল দেখি সিঁড়িঘরে রবিন ভাইয়ের লাল হোন্ডাটি আছে কিনা?হোন্ডাটা কদিন আগে খালাম্মা খালু উনাকে কিনে দিয়েছেন এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করবার জন্য। না দিলেই বোধহয় ভালো করতেন। এটি পাওয়ার পর থেকে উনাকে বাসায় পাওয়া ভার। সারাক্ষণ টোটো কোম্পানি, অসহ্য! আজকে উনার একমাত্র বোনের গায়ে হলুদ। আমাদের সবার দুপুর বেলা একটা কোষ্টারে করে নারায়ণগঞ্জ যাবার কথা ছেলেকে হলুদ দিতে। অথচ ওনার কোন খবর নাই। এমন কাজের দিনে কেউ বাইরে থাকে? আমি খালাম্মার পাঠানো হলুদের শাড়ি পড়ে তিন তলা থেকে দোতালায় নেমে দেখি রবিন ভাই মাত্র ফিরেছেন। আমি শুধু শুধুই উনার উপর রাগ করছিলাম। বেচারি গিয়েছিল আমাদের জন্য কোষ্টার ভাড়া করতে। আমি দোতালায় ওনাদের ফ্লাটে গিয়ে সোজা উনার রুমে গেলাম। উনি কখনো আমাকে শাড়ি পড়া দেখেননি। আমি আশা করেছিলাম উনি প্রশংসাসূচক দু একটা কথা বলবেন। উনি সেই সবের ধারে কাছে গেলেন না। শেষে আমি লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“আমাকে কেমন লাগছে?”
“কেমন আবার লাগবে?”
“এই যে আজকে শাড়ী পড়েছি, আপনিতো কখনো আমাকে শাড়ি পড়া দেখেননি।”
উনি কিছু বলার আগেই ডাইনিং স্পেস থেকে খালুর গলা ভেসে এলো,”তুমি ওর রুমে চলে যাও, ও রুমেই আছে।”
খালু কাকে এই কথা বলল, কৌতূহলী হয়ে দরজার দিকে তাকাতেই দেখি সেখানে মিতুর আবির্ভাব। মেয়েটিকে আমি একদম সহ্য করতে পারি না। মিতু, রবিন ভাইয়ের সাথে এক ক্লাসে পড়ে। মেয়েটিকে আজকেই যে প্রথম দেখলাম তা না, আগেও একদিন দেখেছি।রবিন ভাইয়ের এসএসসির রেজাল্ট উপলক্ষে বিশাল একটা মিলাদের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেদিনও মেয়েটি এসেছিল। মিলাদের শেষে দাওয়াতি মেহমানরা সবাই চলে গেলে , আমরা কয়েকজন মিলে গল্প করছিলাম। হঠাৎ করে উনার এক কাজিন বললো ,”রবিন আমাকে একটু এগিয়ে দে তো!” উনি তখন বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো, “মিতু তুমি একটু বসো ,আমি বেবি আপাকে রিক্সায় উঠিয়ে দিয়ে আসি।”
কথাটার মধ্যে রোমান্টিক কিছু নাই, কিন্তু আমার কাছে মনে হলো কেউ যেন আমার হৃৎপিন্ডটা টেনে ছিড়ে নিয়ে আসছে। আজকেও একই ঘটনা ঘটল। মিতু যখন দরজায় এসে দাঁড়ালো, উনি তখন উনার সেই ভুবনমোহিনী হাসি দিয়ে মেয়েটিকে স্বাগতম জানালেন। আমার সাথে সাথে মনটা ভার হয়ে গেল। আমার বাবা একটা কথা খুব বলেন,”Morning says the day .” কথাটা তিনি খুব একটা ভুল বলেন নাই। সেটা ছিল আমার দুর্ভাগ্যের শুরু। আমি ভেবেছিলাম জিগাতলা থেকে চাষাড়া, পুরোটা পথ আমি উনার পাশে বসে যাব। কোষ্টারে এ উঠে দেখি মিতু রবিন ভাই এর পাশের সিটে বসে গেছে।
সবার ভেতরে থাকে কিনা জানিনা ,আমার ভিতর একটা আত্মবিনাশী বীজ রয়েছে। নিজেকে কষ্ট দিয়ে আমি এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ পাই। আমি খুব সহজেই উনাদের পাশের সিটে বসতে পারতাম। কিন্তু আমি তা না করে গিয়ার বক্সের সাথে লাগানো যে ইঞ্জিনের ঢাকনাটি রয়েছে , দেখতে অনেকটা কবরের মতো , আমি গিয়ে তার উপর বসলাম। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ বেশ অনেকটাই পথ । এই পুরোটা পথ, আমি সেই উত্তপ্ত ইঞ্জিন এর উপর বসে কাটিয়ে দিলাম আড় চোখে ওদের দেখে।
রবিন ভাই যে এত মজার মানুষ তা আমার জানা ছিল না। আমার সাথে উনি কখনো কোন রসিকতা করেন নাই। কিন্তু পুরোটা পথ , উনি যাই বলছিলেন, তাই শুনে মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠছিল। আর আমি মনে মনে মেয়েটিকে একটি কুৎসিত গালি দিচ্ছিলাম। গালি টা কি তা আমি আপনাদের বলব না, তবে একটু হিন্টস দিতে পারি। গালি টা তিন অক্ষরের,আপনি যদি কাউকে আপনি সম্বোধনে জিজ্ঞেস করেন সে কি খাচ্ছে, তাহলে সে প্রশ্নটি শুনতে এই গালিটির মত শুনাবে।তবে প্রশ্নটিই করবার সময় ক্রিয়াপদটি কে প্রথমে দিতে হবে।
গিয়ার বক্সের এত কাছে বসার কারণেই কিনা জানিনা, ড্রাইভার সাহেব যতবার গিয়ার বদলাচ্ছিল, কোস্টারের শো শো শব্দে কানে তালা ধরে যাবার জোগাড়।তবু আমি সেই শব্দ ছাপিয়ে উনারা কি নিয়ে কথা বলছেন তা শোনার চেষ্টা করলাম। যা জানতে পারলাম তা আমাকে বিস্মিত করল। রবিন ভাইয়ের বিদেশে চলে যাবার সব কাগজপত্র তৈরি হচ্ছে।উনি বলছেন ,ফিরে যখন আসবেন ততদিনে মিতুর বিয়ে হয়ে চার পাঁচটা বাচ্চার মা হয়ে যাবে। এটা একটা আশার কথা। তার মানে ওদের দুজনের মাঝে কিছু নাই। কিন্তু রবিন ভাই বিদেশ চলে যাবে, উনাকে আর প্রতিদিন দেখব না ভাবতেই আমার মনটা আরও খারাপ হয়ে গেলো।এমনিতেই সূর্য ডোবার সময় কোন এক বিচিত্র কারণে আমার মন খারাপ হয়ে যায়, নতুন জানা তথ্যটি আমাকে আরো বিমর্ষ করে দিল। আসলে এই জীবনে কিছুই ধরে রাখা যায় না।
বছর খানেক পরের কথা। রবিন ভাইয়ের বিদেশে যাবার সেই দিনটি নির্ধারিত হয়ে গেছে। তিনি যাত্রার আগের রাত্রে আমাদের বাসায় আসলেন আমাদের সাথে দেখা করতে। উনি ড্রইং রুমে বাবার সাথে দেখা করে চলে যাচ্ছিলেন, আমি আমার পিঠাপিঠি ভাইটিকে দিয়ে উনাকে আমার রুমে ডেকে পাঠালাম। আমি ভীষণ চেষ্টা করলাম যেন চোখে পানি না আসে। মানুষ আসলে চেষ্টা করলে পারে না এমন কিছুই নেই।যতবার আমি কল্পনায় এই বিদায়দৃশ্যটির কথা চিন্তা করেছি, আমার দুচোখ ভিজে উঠেছে জলে। অথচ সে রাত্রে আমি দুচোখের পানি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম।”রবিন ভাই গিয়ে কিন্তু আমাদের কথা ভুলে যাবেন না। সম্ভব হলে চিঠি দিবেন।আপনার চিঠিতে নতুন ঠিকানা আসলে তখন আমি আপনাকে চিঠি দিব।”
অ্যারিস্টোটল একদা বলেছিলেন,”Hope is a waking dream.” আমার দিবা স্বপ্ন দেখার পালা শুরু হলো।যখনই ডাক পিয়ন টিকে দেখতাম চিঠি বিলি করতে এসেছে, আমার বুকের ভিতরে একশ প্রজাপতি উড়তে শুরু করত।কিন্তু সেই চিঠি কোনদিনই আসলো না যার অপেক্ষায় আমি কাটাতাম প্রতিটি প্রহর। এর মাঝে বেশ অনেক দিন পার হয়ে গেল। খালাম্মার কাছে প্রায়ই রবিন ভাইয়ের বিভিন্ন খবর শুনতে পেতাম। যথা সময় উনি পড়ালেখা শেষ করলেন। উনি যে এটা করবেন তা আমি জানতাম। কিভাবে জানতাম ,তা আপনাদের বলি। উনার বোনের বিয়ের কিছুদিন পরের কথা। এক সকালে উনি কলেজ যাবার সময় আমি দেড় সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে উনার অপেক্ষা করছিলাম। উনি আমাকে দেখে একটু চমকে উঠলেন। আমি উনাকে বললাম “আমি এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছি জানেন?”
“না।”
“আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি কারণ আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। কি কথা, আপনি অনুমান করতে পারবেন?”
“আমি বোধহয় কথাটা জানি।”
“কিভাবে জানেন?”
“নাসরিন ভাবী যে দিন তোমাদের বাসায় আপির হলুদের দিন গোসল করতে গিয়েছিল, সেদিন কি তুমি উনাকে কিছু বলেছিলে?”
“হ্যাঁ বলেছিলাম, আপনি আমাকে এভাবে ইগনোর করেন এটা আমার সহ্য হয় না।” “দেখো আমি বিদেশে চলে যাচ্ছি। আমার একটাই উদ্দেশ্য, পড়ালেখা করে নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া।এই সময় তোমার সাথে কোন ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া আমার জন্য কি ঠিক হবে? ১৪হাজার মাইল দূরে বসে আমি সারাদিন তোমার কথা ভাববো, সেটা কি আমার পড়ালেখার জন্য ভালো হবে?” এই কথাটা থেকেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম উনি কতটা ফোকাসড।উনার জীবনে যে সাফল্য আসবে সে ব্যাপারে আমার মনে কোন সন্দেহ ছিল না।
সাফল্যের সাথে অনেক ছেলেই পুরোনো দিনের কথা ভুলে যায় , বাবা মাকে ভুলে যায়। উনি অবশ্য তা করলেন না।উনি ওনার বাবা মার জন্য নতুন একটি সুন্দর ফ্ল্যাট কিনলেন । উনাদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য খুব সুন্দর একটি গাড়ি কিনলেন । এইসব সুখবর এর মাঝেই এক দিন সেই বিশেষ খবরটি শুনতে পেলাম, যার জন্য আমি চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করছি আজ ছয়টি বছর। উনি ঈদ করতে দেশে ফিরছেন শেষ রোজার দিন। এমনিতেই চাঁদ রাতে একটা আনন্দের ব্যাপার থাকে, তার সাথে বাড়তি আনন্দ হিসেবে যোগ হলো রবিন ভাইয়ের দেশে ফিরার খবরটি।
আমি ঈদের দিন উনাদের বাসায় যখন পৌছালাম, নামাজ পড়ে তখনো উনি বাসায় ফেরেন নি। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। খুব আশা করেছিলাম , ওনাদের বাসায় পৌঁছেই উনাকে দেখতে পাবো। তবে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলোনা। ঘরে ঢুকেই উনি উনার সিগনেচার সেই ভুবনমোহিনী হাসিটি দিলেন। এরকম কারো হাসি দেখেই কি কবিগুরু বুকের ভেতর সুখের মত ব্যথা অনুভব করেছিলেন? আমি জানিনা ,জানতে চাইও না।তবে আমার বুকের ভেতর যে কি হচ্ছিলো তা আমি আপনাদের ভাষায় বুঝিয়ে বলতে পারবোনা। অতীতে লেখকরা বুকের মধ্যে টেনিস বল দাপাদাপির কথা বলেছেন, আমার বুকের মধ্যে একটা আস্ত ফুটবল দাপাচ্ছিল। সৌজন্য বিনিময়ের পরে একসময় উনি আমাকে নিয়ে খেতে বসলেন। বিশেষ একটা মানুষের পাশে বসে খাওয়া যে এত আনন্দের একটা ব্যাপার হতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। আমার মনে হচ্ছিলো আমি আর এই পৃথিবীতে নেই, স্বর্গ যেন আমার এই ছোট্ট পৃথিবীতে নেমে এসেছে।
খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে উনি টুকটাক কথা বলছিলেন। এক সময় উনি বাবা-মায়ের কথা জানতে চাইলেন। বললেন উনি আমাদের বাসায় আসতে চান মায়ের সাথে দেখা করবার জন্য। ওনাকে যখন আমি আমাদের নতুন বাসার ঠিকানাটা লিখে দিচ্ছিলাম আমার হাত ঠক ঠক করে কাঁপছিল। উনি আমাকে বললেন ,”এই অব্লিক দেয়া ঠিকানা মনে হয় না আমি খুঁজে বের করতে পারব। তুমি বরঞ্চ ড্রাইভারকে নিয়ে যাও। ও চিনে আসুক।আমি সন্ধ্যার পরে মেহমানের চাপ কমলে খালাম্মার সাথে দেখা করতে যাব।
আমি অবশ্য ড্রাইভার না নিয়ে এমনি বের হয়ে আসলাম।আমি যে ড্রাইভের না নিয়ে কেন এমনি বের হয়ে আসলাম তার পিছনে আমি কোন যুক্তি দাঁড় করাতে পারলাম না। গল্পের শুরুতে আপনাদের বলেছিলাম না আমি কিছু আত্মবিনাশী কাজ করি।আপনারা আমার এই ব্যবহারটিকে তারই অন্তর্ভুক্ত মনে করতে পারেন।আসলে অবচেতন মনে আমি হয়তো জানতে চেয়েছিলাম উনি আমার জন্য অব্লিক দেয়া জটিল একটি ঠিকানা খুঁজে বের করেন কিনা। আমার জন্য এটা জানা জরুরী ছিল। ঈদের দিন বৃষ্টি হলে আমার খুব মন খারাপ হয়ে যায়। তার মাঝে আজকের ঈদটি খুবই অন্যরকম একটি ঈদ। আজকে রবিন ভায়ের আমাদের বাসায় আসার কথা, সন্ধ্যার পর পর। কিন্তু বিকেল থেকেই আকাশে মেঘ জমতে শুরু করে দিল। সন্ধ্যাটা তাই বিকেলেই নেমে গেল। আমি সন্ধ্যার পর থেকেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে। আটটার পর পর মা বারান্দায় এসে বলল,”ঝড় বৃষ্টির সময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকিস না মা, ভিতরে এসে বস।”
আমার তখন এই পৃথিবীটাকে অসহ্য মনে হচ্ছে।কেন যে ড্রাইভারটাকে সাথে নিয়ে এসে বাড়িটা চিনিয়ে দিলাম না, সেই রাগে এখন নিজের হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে।ঈদের অনুষ্ঠানমালায় টিভিতে যখন আনন্দ মেলা শুরু হল, তখন আমি আশা ছেড়ে দিলাম। আমি এখন নিশ্চিত এই ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে উনি আর আসবেন না।ঈদের সালোয়ার কামিজ খুলে যখন ঘরের কাপড় পড়বো ভাবছি, ঠিক তখনই নিচের বড় গেটের ভিতরে যে ছোট্ট একটা গেট থাকে, তা খোলার শব্দ পেলাম।দেখি লম্বা একটা মানুষ মাথা গলিয়ে সেখান দিয়ে ঢুকছে। বাংলাদেশের দ্রুততম মানবীর নাম কি আমি জানিনা, তবে তা সে যেই হোক,আমি তার চাইতে দ্রুত গতিতে নিচের মেইন গেটের কাছে পৌঁছে গেলাম। রবিন ভাই খুবই বিব্রত ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,”এই চম্পা, কিছু মনে করো না, তোমার কাছে কি ২০টা টাকা হবে? রিকশাওয়ালাকে দিতে হবে। আমার সাথে কোন বাংলাদেশী টাকা নেই।”
“রিক্সা কেন , আপনার গাড়ির কি হয়েছে?”
“সন্ধ্যার পর ড্রাইভার ছুটি চাইল। ভেবেছিলাম হেঁটেই তোমাদের বাসায় চলে আসব। মাঝে হঠাৎ করে বৃষ্টি আসায় রিকশা নিতে হলো!”
আমি উনাকে নিয়ে যখন উপরে আসলাম তখন বৃষ্টি খানিকটা ধরে এসেছে। পার্স খুলে টাকা বের করতে গিয়ে আমি কিছুই ঠিকমতো দেখতে পারছিলাম না। আমার দু’চোখ তখন ঝাপসা হয়ে গেছে চোখের জলে।বহু বছর আগে উনার বিদেশ যাবার আগের রাতে শেষ বিদায়ের সময় আমি খুবই চেষ্টা করেছিলাম আমার কান্না নিয়ন্ত্রণ করতে।আজকে অবশ্য আমার তা করবার প্রয়োজন পড়লো না। উনি আমার চোখের পানিকে বৃষ্টির পানি ভেবে ভুল করলেন!আপনাদের বলেছিলাম দুঃখ যখন আসে একটার পর একটা আসতেই থাকে। এবং সকাল থেকেই এদের আগমনী বার্তা টের পাওয়া যায়। আনন্দের ব্যাপারটাও কিন্তু একইরকম। এরাও হাত ধরাধরি করে ভাই বোনের মত আসতে থাকে। আজ সকালে আমি যখন উনার সাথে খাচ্ছিলাম তখন আমার প্রচন্ড সুখ অনুভূতি হয়েছিল।আমি ভাবতেই পারিনি আমার সেই আনন্দের অভিজ্ঞতা আমি দ্বিতীয়বার উপলব্ধি করতে পারব, তাও একই দিনে।
ঈদের দিন সারাদিন প্রচুর খাওয়া দাওয়া হয় বলে রাতের দিকে যেসব মেহমানরা আসে তারা কখনও খেতে চায় না। তবু আমি ভদ্রতা করে উনাকে খেতে বললাম। উনি যখন হাত ধোবার জন্য বাথরুম কোন দিকে জিজ্ঞেস করলেন, তখন আমি একটু আশ্চর্য হলাম। তবে মনে মনে প্রচন্ড খুশি হলাম। এই প্রথম উনি আমার হাতের রান্না খাবেন।প্রিয়জনকে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়ানোর যে সুখ , এই পৃথিবীতে অন্য কিছুতে সেই সুখ আছে ,আমার তা মনে হয় না। খেতে খেতে টুকটাক কথা হচ্ছিল। একসময় আমি উনার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
“করো।”
“সত্যি বলবেন কিন্তু।”
“তুমি বোধহয় জানো না আমি কখনো মিথ্যা বলি না।”
“এই ছয় বছরে আপনার কি একবারও আমার কথা মনে পড়েছিল?”
উনি আমার এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ডাইনিং রুমের কোনার বেসিন টাতে হাত ধুতে ধুতে বললেন,”তোমার এই প্রশ্নের উত্তর আমি এখন দিব না। অনেক রাত হয়েছে। আমি এখন বাড়ি যাব।”“এত রাতে একা একা হেঁটে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না, আমি বরঞ্চ রফিককে দিয়ে দেই। ও আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসুক।” “তারপর তোমার ভাই আবার এতটা পথ একলা হেঁটে ফিরবে? কোন দরকার নাই ,আমি চলে যাব।” আমার নিজের উপর খুবই রাগ হলো। কেন যে প্রশ্নটা করতে গেলাম, নাহলে হয়তো উনি আরো কিছুক্ষণ থাকতেন।
আমি উনাকে বিদায় দিয়ে এসে আবার বারান্দায় দাঁড়ালাম।আশা এই ,উনি যাবার আগে আরেকবার উনার সেই সিগনেচার হাসিটা দেখতে পাবো। ছোট্ট দরজাটা খুলবার আগে বারান্দার দিকে তাকিয়ে নিশ্চয়ই উনি আরেকবার হাসবেন। বেশ অনেকটা সময় পার হয়ে গেল, কিন্তু উনার দেখা নেই।দোতলা থেকে একতলায় নামতে এতোক্ষন সময় লাগাবার কথা না। তবে কি দারোয়ানটা এক তলার কলাপসিবল গেটে তালা দিয়ে দিয়েছে। উনি সিঁড়িতে আটকে গেছেন কিনা এটা দেখতে যেয়ে আমি এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম।দেখি উনি দেড় সিঁড়িতে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে বলে উঠলেন,”চম্পা তোমার মনে আছে বহু বছর আগে তুমি একবার এরকম দেড় সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলে আমার জন্য। তারপর আমাকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করেছিলে। আজকে আমি তোমাকে সেই প্রশ্নটা করতে চাই।তুমি কি জানো আমি কেন এখানে দাঁড়িয়ে আছি?”
আমি ওনাকে ছোট্ট গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে যে তীব্র গতিতে নিচে নেমে এসেছিলাম ,তার চাইতেও দ্রুততায় আমি সেই অন্ধকারচ্ছন্ন সিঁড়িতে উনার বুকের উপর ঝাপিয়ে পড়লাম। আমি জানি আমার এই ব্যবহারের জন্য আপনারা অনেকেই আমাকে খুব খারাপ মেয়ে ভাবছেন। তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। আমি আমার এই এক জীবনে একাগ্রভাবে যাকে চেয়েছিলাম ,আজ তাকে পেলাম। এই পৃথিবীর কাছে আমার আর কিচ্ছু চাইবার নেই।
গল্পের বিষয়:
গল্প