এক ভালো থাকার গল্প

এক ভালো থাকার গল্প
বাবা ফ্রান্স থেকে একেবারে ফিরে এসেছেন মাত্র কদিন হল। প্রতিদিন আমাদের সব বোনদের ডেকে নিয়ে উনার কাছে বসান আর এক এক করে সবার চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকেন। এরকম করার কারণ টা ঠিক কি তা জানি না।
আমরা পাঁচ বোন। বাবা যখন ই এমন করেন আমরা একজন আরেক জনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আজও ঠিক তেমনি আমরা বসে আছি বাবার সামনে। আমার সব ছোট বোনটা ক্লাস নাইনে পড়ে। বাবা খাম হাতে বসে আছেন। কিছুক্ষণ নিরবতা ভেঙ্গে বললেন,, ” তোমাদের কার বিয়ের বয়স হয়েছে? ” আমাদের সব ছোট বোনের জন্মের পর বাবার ব্যবসার অবস্থা খারাপ হতে লাগল। তাই সব ছেড়ে প্রবাসে পাড়ি দেন। বেশ কয়েক বছর থেকে সব সামলে আবার দেশে ফিরলেন এখন ফিরে রোজ রোজ এই কান্ড কেমন জানি অবাক করার মত। এরকম অদ্ভুত প্রশ্নে আমরা হা করে তাকিয়ে আছি। মা তো এরকম প্রশ্ন শোনে রেগে বাবার দিকে কটমট দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন। বললেন, এসব প্রশ্নের মানে কি? মাথা কি পুরো খারাপ হয়ে গেছে..?
বাবা অতি শান্ত গলায় বললেন গত পরসু তোহা না আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছে পার্লারে গিয়ে চুল কাটার জন্য? সোহা তুমিও গিয়েছিলে চুল কাটতে? সোহা আমার ৩য় বোন সে ইন্টার পরিক্ষা দিয়েছে। সে মাথা নিচু করে বলল হ্যা বাবা। তোমাদের পরিক্ষার রেজাল্ট দেখলাম। খুব একটা ভালো না। TT পাস। TT পাস বুঝো? মানে টেনেটুনেপাস শুধু।আমি বড় আমার ছোট তোহা আর সোহা। কথাগুলো শুনে তারা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের চেহারায় এখনো বিস্ময় কাটে নি। আমি বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছি। কম হলেও বাবার ২/৩ ঘন্টা এভাবে বসিয়ে রাখেন। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। হুট করে বলে বসলাম, বাবা টাকা দাও আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। লাইব্রেরি যাব এরপরে আমার ক্লাস আছে।
বাবা মিষ্টি করে হেসে ৫০০ টাকার একটা নোট এগিয়ে দিলেন। যা মাঝখানে কিছু খেয়ে নিস। ক্ষিধে নিয়ে থাকবি না। ৫০০ টাকার নোট দেখে আমিও অবাক হলাম যেখানে আমাকে রোজ চার ভাগের এক ভাগও দেয়া হয় না। টাকাটা নিয়ে আসতে আসতে ভাবলাম কি ব্যাপার? কিছু ই বুঝলাম না। বিকেলের দিকে বাসায় ফিরলাম। ঘরে ঢুকতে ই বুঝতে পারলাম কিছু একটা ওলটপালট হয়েছে। রুমে যেতে ই গিয়ে দেখি তোহা কাঁদছে। কেন কাঁদছে জিজ্ঞেস করতে ই কান্নার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়ে বলল সে এখন বিয়ে করবে না আর সে অন্য কেউ একজনকে পছন্দ করে। হুট করে এসব শোনে মনে হল ধাক্কা খেলাম।
কার বিয়ে কিসের বিয়ে সবকিছু জানতে চাইলে পিছন থেকে বাবা জবাব দিলেন হ্যা, যে যার উপযুক্ত তাকে সেখানে দেওয়া উচিত। তাই তোহার বিয়ে ঠিক করেছি। ছেলে আমার পছন্দ হয়েছে। এতক্ষণ মা চুপ করে ছিলেন পরে ই বললেন,, তা আত্মীয় স্বজন লোকজন কি ভাববে সে খেয়াল আছে? বড় মেয়েকে রেখে তার ছোটটাকে বিয়ে দিচ্ছো। মানুষ নিশ্চিত ভাববে বড় মেয়ের কোনো দোষ আছে..?? পরে কি করবে। বাবা অনেকটা ধমক দিয়ে মাকে থামালেন। আমি ছোট থেকে ই দেখে এসেছি আমার বাবা স্বাধিনচেতা মানুষ। কে কি বলল তাতে কান কম দেন। অবশ্য এরকম ডিসিশনে আমারো অনেক ভালো হল। মাত্র অনার্স শেষ করলাম। খুব ইচ্ছা নিজের মত কিছু একটা করি নিজের পায়ের তলার মাটিটা শক্ত করি। তাই একাডেমিক পড়াশোনায়ও আমি খুব ভালো ভাবে শেষ করেছি। যদিও মাঝখানে আবেগের কিছু টানাপোড়ন ছিল কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়েছি। আমি আমার পথ আমার গন্তব্য নিজের মত তৈরি করবো একটা ই লক্ষ্য।
মাঝখানে মা উঠেপরে লেগেছে বিয়ে বিয়ে বলে। আমি না করলে ইমোশনাল কথা বাড়িয়ে দেন। আরো বোন আছে তাদের বয়স হচ্ছে এসব কত কি! বাবা মাকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে বললেন যে যেখানের না সেখানে তাকে দিয়ে অযথা সময় নষ্ট করার মানে ই হয়। আমি দেখেছি আমার সব মেয়েদের। আরো দেখেছি তাদের স্বপ্ন আর চলাফেরা। আমার বড় মেয়ে সামিয়া সে নিজের মত একটা জায়গা বানাতে চায় আমাদের উচিত তাকে সাহায্য করা সময় তো আহামরি ফুড়িয়ে যাচ্ছে না। একজন টাকা নিয়ে পার্লারে যায় আর আরেকজন টাকা নিয়ে লাইব্রেরি যায় বুঝতে পারছো কে কোথায়!
সবসময় সংসারের ভিতর না থেকে একটু বাইরে চোখ রাখো দেখবে কোথায় নতুন আলোর আভা দেখা যায়। তোহাকে আমি বিয়ে দিয়ে দিব। ছেলের সব ঠিক আছে। আর সামিয়া নিজের মত একটা জায়গা করে নিক দেখবে কি হয়। আমার ছেলে নেই তো কি হয়েছে..! মেয়ে তো আছে। আমি না হয় বুক ফুলিয়ে আমার মেয়ের কথা বলে বেড়াব। কি মা পারবি না আমার এমন মেয়ে হতে? বাবার কথায় আমি অনেক অনেক খুশি হয়েছি কিন্তু কেন জানি চোখ ভরে জল আসলো। শুধু ভাবলাম,, পারব তো একটা ছেলের অভাব পূরণ করতে!! মা আর কিছু না বলে চুপ হয়ে গেলেন। আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম শুধু কিছু বলতে পারলাম না। তোহা অনার্সে পড়ে তার কোনো কথা ই শুনলেন না। গ্রেজুয়েট কমপ্লিট করতে চাও বিয়ের পর করে নিও সমস্যা নেই।
তবে পড়ালেখা নিয়ে তোহার মাথা ব্যথা নেই ব্যথা অন্য জায়গায়..! সে তার পছন্দের ছেলেকে ছাড়া অন্যকোথাও বিয়ে করবে না। কিন্তু করার কিছু ই নেই ওদের সেইম এইজ রিলেশন আমার যে বাবা কখনো মানবে না। আস্তে আস্তে বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসলো। সবদিকে কত কাজ! কেন জানি না কিরকম একটা করছিলো মনের মধ্য। হুট করে পুরনো কিছু আবেগ এসে ভর করছিল বার বার। এরকম একটা দিনের কত স্বপ্ন দেখে ছিলাম দুজন মিলে। হুট করে সবকিছু ভেঙ্গে গেল সব। হাতটা ভালো করে ধরার আগে ই সে হাতটা ছেড়ে দিল। এমন ই যদি করবে তাহলে আসবে কেন জীবনে। না আসা টা ই তো ভালো ছিল যদি সারা জীবন পাশে থাকতে না পারে!
আমি বলেছিলাম শুধু তুমি কি ভালো থাকবে?? সে জবাব দিয়ে ছিল ‘ সময় বলে দিবে সেটা।’ খুব অভিমান নিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরে ছিলাম। একবারো আটকায় নি। একবারো মানুষটা যোগাযোগ করেনি। নাম্বার বন্ধ বাসায় তালা। সবকিছুর মধ্যে যেন পাগল হয়ে গিয়ে ছিলাম। তবে সামলে নিয়েছি নিজেকে। খুব করে আগলে নিয়েছি নিজেকে নিজের মাঝে। তাই আবেগের গল্পে এখন হাসি পায়। কাল ই বিয়ে বোনটাকে হলুদের সাঁজে দারুণ লাগছে আমিও একটু সেঁজে নিলাম। বোনটা রাগ করে ছেলের ছবি পর্যন্ত দেখেনি। আর ছেলেপক্ষ শুধু মেয়েকে দেখে গেছে ছেলে নিজে এসে দেখেনি মেয়েকে।
সামনে কয়েকটা জব এক্সাম কাজের মাঝেও খুব করে প্রিপারেশন নিতে হল। আর সাথে তো বাবা ছিলেন ই। বিয়ের থেকে আলাদা রেখে আমাকে সাহায্য করলেন পড়ালেখায়। খুব তাড়াহুরোর মধ্যে বিয়ে বাবাও মানা করেননি। হলুদ শেষে খাওয়াদাওয়া করে বিছানায় গেলাম। আজ সব বোনরা মিলে গল্প করব আমাদের মধ্যে থেকে একজন চলে যাচ্ছে ভাবতে ই কষ্ট হচ্ছিল। গল্পের মধ্যে ই হটাত ফোন টা হাতে নিতে ই দেখি একটা টেক্সট এসেছে ” চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা সত্যি– আর থাকতে হবে না দূরে কাল সময় ই বলে দিবে কি আছে কার লিখনে। মানে কি!! ম্যাসেজটা দেখে পুরো মাথা ঘুরছিলো আমার। সাথে সাথে উঠে গিয়ে বাবার কাছে ছেলের ছবি দেখলাম।। সবকিছু যেন ঘোর লাগছিল!
কান্না আসছিলো কিন্তু কাঁদতে পারছি না কি অদ্ভুত..! বাবার কাছ থেকে ফিরে এসে জবার দিলাম,, বেলা চিনেছে তার রাস্তা খুঁজে পেয়েছে তার আস্থা। নিখোঁজের বিজ্ঞপতিতে থাকে না আবেগ সস্তা। ” আর কোনো কিছু ই সম্ভব না শুধু বাবার ভরসা মাখা ছলছল চোখ দুটো ই আমার ঠিকানা গন্তব্য লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছে। সময়ের আবর্তে ভালো থাকার চাওয়া গুলো বদলে গেছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত