কার্তিকের মাঝামাঝিতে যেন শ্রাবণের ঢল নেমেছে। সারারাত অঝোর ধারা বইয়ে যাওয়ার পর সকালেও আকাশ চুইয়ে ফোটায় ফোটায় বৃষ্টির জল নামছে। জানালার একটা কপাট খুলে দিল অর্পা। জানালার সামনেই কার্নিশে কয়েকটা টবে পর্তুলিকা লাগিয়েছে সে৷ হলুদ, লাল, গোলাপী, সাদা ফুলগুলো বৃষ্টির তালে তালে মাথা দুলিয়ে মহানন্দে ভিজছে। অর্পার চোখ ফুলগুলো ছাপিয়ে নিচে রাস্তার ওপাশে টং দোকানে পড়ল। দোকান খোলা, তবে মানুষজন নেই।
একটা বেঞ্চিতে এক বুড়ো রিকশাওয়ালা বসে পায়ের ওপর পা তুলে চা দিয়ে ভিজিয়ে রুটি খাচ্ছে। তার রিকশাটা পাশে ভিজছে। যাত্রী বসার সিটটা হালকা নীল পলিথিন কাগজ দিয়ে ঢাকা। ওপরে কালো আকাশটা মুখ ভার করে খানিক পর পর গুমগুম শব্দে জানান দিচ্ছে সে ভীষণ অভিমান করে বসে আছে। ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকা দালানগুলোতে দিনের বেলাতেও আলো জ্বলছে৷ ছুটির দিন বলে বৃষ্টির ভোগান্তি থেকে মুক্তি পেয়ে লোকজন আরামের ঘুম দিচ্ছে। মায়ের ডাকে ঘোর ভাঙলো অর্পার। “ভিজতেছিস কেন?” সুরমার কপালে ভাজ। হেঁটে এসে অর্পার জানালাটা বন্ধ করে দিলেন তিনি। অর্পার খেয়াল হলো সে ভালোই ভিজেছে। মায়ের হাতে খুন্তি। রান্না বসিয়ে রেখে এসেছেন। সুরমা বললেন, “খিচুড়ি বসাইছি। তুই একটু ধনেপাতার ভর্তা বানা। মোতির মা আসব না আজকে।”
অর্পা চুপচাপ রান্নাঘরের দিকে গেল। মনটা বিষন্ন তার। গলা থেকে বুক বেয়ে পেটের ভেতর পর্যন্ত একটা কষ্ট মুচড়ে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। “তুই কি আজকে উঠবি না?” উজান ধাক্কা দিল অভীকে। আগেও কয়েকবার ডেকেছে। অভী বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। উজান বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। উজান বেরিয়ে যাওয়ার একটু পর অভী উঠে বসল। মাথাটা ফাঁকা লাগছে। চোখ ডলে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এল। একটা পুরানো ম্যাগাজিন নিয়ে পাতা ওল্টালো কিছুক্ষণ। ভালো লাগছে না। সে মোবাইলটা নিয়ে কয়েকবার সেঁজুতিকে ফোন করল। সেঁজুতি ফোন করছে না। আবার কিছু হলো না তো?
উঠে হোস্টেল থেকে বের হয়ে এল অভী। ক্যান্টিনে আজ ভিড় কম। পাশে হোটেলে সকালে খিচুড়ি রান্না হয়েছে, দুপুরে তেহারি হবে। ছুটির দিনটাতে হোস্টেলের ছাত্ররা সেখানেই ভিড় জমায়। উজানও সেখানেই গেছে হয়তো। আজ পকেট এক্কেবারে ফাঁকা। এই মাসে কয়েকটা দরকারি বই কেনার ছিল বলে বাবাকে টাকা পাঠাতে পারেনি। কিন্তু গত পরশু বোনের কান্না দেখে থাকতে না পেরে যা টাকা ছিল পাঠিয়ে দিয়েছে৷ এখন এই মাসটা কষ্ট করে কাটাতে হবে। এক বেলা খেয়ে থাকলে বোধহয় চলে যাবে। ধার করার আর জায়গা নেই তার। উজান তার জন্য অনেক করে। কিন্তু নিজের কতটা ভালো লাগে নিতে?
টং দোকানটাতে এসে বসল অভী। সকালের নাস্তা সে এখানেই করে। একটা পাউরুটি, চা, বিষ্কুট এই দিয়ে। আজ চা খেয়ে উঠে পড়ল। পাশের বাড়ির তিনতলা থেকে একজোড়া চোখ তার দিকেই সেটে আছে। সেটা জানলেও সেদিকে তাকাতে ইচ্ছে হলো না অভীর। এমনিতে সকালের সময়টাতে এই জায়গায় বসে চোখে চোখে খুব কথা হয়। আজ দেরিতে আসায় হয়তো ওপাশের চোখে অভিমান জড়ো হয়েছে। সেই অভিমানী চোখদুটো দেখতে প্রচন্ড ইচ্ছে হলেও দাঁত চেপে রইল অভী। এখানে আসাই উচিত হয়নি। তার যা অবস্থা তাতে এই মেয়েকে কোনোরকম পাত্তা দেওয়া হবে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। খালি পেট হয়তো জীবনের কঠিন সত্যগুলো অনুধাবন করিয়ে দেয় সহজেই।
জিনিয়া কোন ফাঁকে বেরিয়ে গেছে বাড়ির কেউ দেখেনি। পুরো সকালটা কাটিয়ে দুপুর হওয়ার মুখে একগাদা শাপলা নিয়ে ঢুকেছে বাড়িতে। তার মুখভর্তি হাসি আর পায়ের হাঁটু পর্যন্ত কাদা। ভিজে সপসপে জামাকাপড় লেপ্টে আছে শরীরের সাথে। এবার এগারোতে পড়ল জিনিয়া। শরীর বেড়ে গেলেও বুদ্ধি হয়নি একেবারেই। সেঁজুতি এতক্ষণ দুশ্চিন্তা করছিল, মেয়ের এই অবস্থা দেখে ভীষণ বিরক্ত হয়ে তার চুলের মুঠি ধরে আচ্ছামতো কয়েকটা চড়-থাপ্পড় দিয়ে নিল। শাপলাগুলো ততক্ষণে উঠোনে ছড়িয়ে গেছে। মেয়ের চুল ধরে টেনেই সেঁজুতি তাকে কলপাড়ে নিয়ে গেল।
মেয়েকে গোসল করিয়ে শুকনো জামাকাপড় পরিয়ে নিজের ঘর বের হয়ে দাওয়ায় এসে দাঁড়াতেই চাপা অথচ ক্রুদ্ধ গলাটা কানে এলো তার। রুমকির গলা। সেঁজুতি জানালার আড়াল থেকে ভেতরের দিকে চাইল। ঘরের মেঝেতে তার বাবা খেতে বসেছে। রুমকি সেঁজুতির সৎ মা। সে এক হাতে পাখার বাতাস করছে, অন্য হাতে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। রান্না হয়েছে আজ সামান্যই। বাড়ির গাছের লাউশাক, পটলের তরকারি আর ডাল। সেঁজুতির বাবা দরিদ্র। পরের জমিতে চাষ করে যা সামান্য আয় হয় তাতে সংসার চলতে চায় না। বাবার গায়ের গেঞ্জিটা ঢলঢল করছে। শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া মানুষটার শরীরের হাড়গুলো বের হয়ে এসেছে। বাবার দিকে ভালো করে তাকালেই কান্না পায় সেঁজুতির। সারাটা জীবন খেটে খেটে আজ নিজেই ভেঙেচুরে বেঁচে আছে। তবুও দায়িত্বের অন্ত নেই।
রুমকি সম্পর্কে সেঁজুতির মা হলেও বয়সে তার চেয়ে মাত্র বছর তিনেকের বড় হবে। নিজের মেয়ের বয়সী মেয়ে বিয়ে করার ইচ্ছে সেঁজুতির বাবার কোনো কালেই ছিল না। সেঁজুতির মা যেবার মারা গেল, সেই বছরই ওর ভাই অভী ঢাকায় চলে গেল পড়তে। সেঁজুতি তখন শ্বশুরবাড়ি। একা এই মানুষটা বাইরে কাজ করে আবার ঘরে এসে সংসারের কাজকর্ম করতে পারত না৷ একটা মানুষ প্রয়োজন ছিল তার। গ্রামের লোকের সাথে সাথে অভী আর সেঁজুতিও তাকে বলেছিল বিয়ে করে নিতে। সেঁজুতির বাবার ইচ্ছে ছিল মধ্যবয়সী কোনো মহিলাকে বিয়ে করার। কিন্তু গ্রামের কিছু লোকের কারসাজিতে কেমন করে যেন রুমকির সাথে বিয়েটা হয়ে গেল তার। রুমকির বাপের বাড়ি হতদরিদ্র। যৌতুকের অভাবে মেয়ের বিয়ে হচ্ছিল না। এদিকে বয়স বাড়ছিল হু হু করে। তাই বিনা যৌতুকে পার করতে পারবে এমন পাত্র পেয়ে বাছবিচার ছাড়াই কন্যা পাত্রস্থ করেছিল তারা।
রুমকি বউ হিসেবে কেমন, সেঁজুতির কোনো ধারণা ছিল না সে ব্যাপারে। মাত্র দেড় বছর হয়েছে বিয়ের। এর মধ্যে কেমন এক লজ্জায় সে বাপের বাড়ি মাড়াতে পারেনি। এবার এসেছে বাধ্য হয়ে। সেঁজুতির শ্বশুরবাড়িতে বিশাল গেরস্থ। কাজের শেষ নেই। সকাল থেকে ঝড় শুরু হয় সেঁজুতির ওপর। শেষ হয় অনেক রাতে। খাটতে খাটতে কাহিল হয়ে এবার একেবারে বিছানায় পড়ে গিয়েছিল সে। বিছানায় পড়েও তবু শান্তি নেই। শ্বশুরবাড়িতে শুয়ে বসে থাকা যায় না। তাই ওর স্বামী ক’টা দিন থাকার জন্য রেখে গিয়েছিল এখানে। সপ্তাহখানেক ভালোই ছিল, সমস্যাটা শুরু হয়েছে দু’দিন ধরে।
সেঁজুতি আসার পর রুমকি ইনিয়ে বিনিয়ে কয়েকবার জিজ্ঞেস করে ফেলেছে সে কবে ফিরবে। নিজেদের সংসারের নানা দুঃখের কথা শুনিয়েছে থাকে। সে থাকাতে যে তাদের বোঝার ওপর শাকের আঁটি চেপে বসেছে তা জানাতে বাকি রাখেনি। সেঁজুতি চাইছিল জলদি ফিরে যেতে। কিন্তু স্বামী না নিতে এলে একা মেয়েকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ফেরাও সম্ভব না। ফোনে কয়েকবার স্বামীকে আসতে বলেছে সে। সব তো আর বলা যায় না, শুধু বলেছে সে ফিরতে চায়। স্বামী তার কথা পাত্তা দেয়নি৷ তার বক্তব্য, কয়েকদিন থেকে আরাম করে আসো। এখানে এলে আবার কাজ।
গত পরশু থেকে রুমকি মুখ কালো করে আছে। খুব প্রয়োজন ছাড়া কথাবার্তা বলছে না। স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছে, এই সংসারে তুমি অযাচিত। সেঁজুতি হয়ে গেছে নিজের বাড়িতেই পর। এই কষ্ট ভাগ করে নেয়ার জন্য সে একটা ভাই ছাড়া কাউকে পায়নি। অভীকে ফোন করে তাই সব জানিয়ে অনেক কান্নাকাটি করেছে। অভী পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করে। নিজের খরচ চালিয়েও আবার কিছু বাড়ির জন্য পাঠিয়ে দেয়। সেঁজুতি সেদিন কান্নাকাটি করার পর রাতেই অভী বাবার বিকাশে টাকা পাঠিয়ে ফোন করে জানিয়েছে যতদিন আপা থাকবে ততদিন যেন তাকে যত্ন করে রাখা হয়। টাকাটা পাওয়ার পর রুমকি আবার স্বাভাবিক হয়েছিল। কিন্তু এখন এই দুপুরবেলা সেঁজুতি দেখল রুমকি কী সুন্দর করে তার বাবার কানে বিষ ঢালছে।
“হুনেন, আপানের মাইয়া আমারে দুই পয়সার দাম দেয় না। হেয় বড়লোক বাড়ির বউ, এই খাওন দেখলে তার মুখ কালা হইয়া যায়। আপনের নাতিন তো খাইতেই চায় না। একটা কামে হাত দেয় না আপনের মাইয়া। উল্টা বাড়িঘরের বেহাল দশা বানাইতাছে। একটু আগেও দেহি কতগুলান শাপলা আইনা দুয়ারে ফালায় রাখছে। তাও যদি খাওয়ানের মতো হইত বুঝতাম! আপনের সংসারে আইয়া একটা দিনও শান্তিতে থাকতে পারলাম না। শখ আহ্লাদ তো পূরন করতে পারেনই না৷ তার উপ্রে কতডি ভেজাল আইসা জুটে। একবার আপনের পোলা, একবার মাইয়া! এমনেও কয়দিন ধইরা শরীলডা কাহিল লাগে।”বলতে বলতে স্বামীর পাতে ডাল তুলে দেয় রুমকি।
সেঁজুতি দেখল তার বাবা কিছু বলছে না, চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। বাবা অবশ্য এমনই। মা থাকতে মায়ের ঝগড়ার জবাবেও কোনোদিন একটা কথা বলত না। তবুও সেঁজুতির ভীষণ কষ্ট হলো। মুখে আঁচল চেপে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল নিজের ঘরে। স্বামীকে ফোন করে বলল তাকে যেন এক্ষুনি নিয়ে যায়। নয়তো তার মরা মুখ দেখবে। ওপাশে সেঁজুতির স্বামী কী বুঝল কে জানে! শুধু স্ত্রীর কান্না দেখে ধারণা করতে পারল, গুরুতর কিছু হয়েছে। অর্পা দুপুরের খাবার মুখেই তুলতে পারল না। ছেলেটা গতকাল এমুখো হয়নি। আজ এসেই কোনোরকম চা মুখে দিয়ে চলে গেল। তার দিকে একটিবার তাকানোর প্রয়োজন মনে করল না। সে কি এতটাই অবহেলা পাওয়ার যোগ্য?
অর্পাদের বাসার গলিতেই ছেলেদের হোস্টেল৷
অভীর সাথে অর্পার প্রথম কথা হয় এমনই এক বৃষ্টির দিনে। সেদিন রাস্তায় হাঁটুপানি জমে গিয়েছিল। অর্পা কলেজ থেকে ফেরার সময় ওর পা অজান্তেই পড়ে গিয়েছিল একটা গর্তে। কিছুতেই গর্ত থেকে পা বের করতে পারছিল না অর্পা। তখন সন্ধ্যা হব হব করছে। রাস্তায় লোকজন ছিল না প্রায়৷ অভী তখন তাকে দেখতে পেয়ে টেনে তুলেছিল৷ ভাঙা ইটের খোঁচায় অর্পার পা ভালোমতোই জখম হয়েছিল। কিছুতেই হাঁটতে পারছিল না সে। অভী তাকে ধরে নিয়ে এসেছিল পুরোটা রাস্তা। একটা অচেনা ছেলে তাকে প্রায় তুলে নিয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা দারুণ অস্বস্তির হলেও সেদিন অর্পার একটুও খারাপ লাগেনি। ওদের দরজার সামনে অর্পাকে রেখে এক প্রকার পালিয়ে গিয়েছিল অভী। সেদিন একটাও কথা হয়নি তাদের। ধন্যবাদ দেয়ার সুযোগও পায়নি অর্পা। কিন্তু তারপর থেকেই সে লক্ষ্য করত অভী তার জানালা বরারব টং দোকানটাতে প্রতিদিন এসে বসে।
বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়। আর সুযোগ পেলেই চেয়ে থাকে তার জানালার দিকে। অর্পাও ওই সময়টা জানালা থেকে সরতে পারে না। মুগ্ধ চোখের চাহনিতে সপে দেয় নিজেকে। কাজল চোখের শ্যামলামতো ছিপছিপে গড়নের ছেলেটার জন্য তার বুকের ভেতর অজস্র মায়া জমে গেছে। অর্পা জানে, সে খুব একটা সুন্দরী নয়। তবুও এই ছেলে মুগ্ধ হয়ে কী দেখে এত? জানতে ইচ্ছে হয় খুব। কিন্তু অভীর সাথে রাস্তায় দেখা হলে সে কিছুই বলতে পারে না।
বিকেলের দিকে অর্পা আর থাকতে না পেরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। বাড়ির সবাই ঘুমাচ্ছে। কেউ এখন খেয়াল করবে না যে সে নেই। রাস্তায় অভীর দেখা পেলে বোঝাপড়া করে ছাড়বে আজ।
রাস্তায় বের হয়ে গলি দিয়ে হাঁটতে থাকল অর্পা। ছেলেদের হোস্টেলের সামনে এসে চোখের কোণা দিয়ে দালানটা দেখে নিল। অভীর ছায়া দেখলেও সে চিনতে পারবে। কিন্তু দেখা পেল না তার। ফেরার পথে দেখা হয়ে গেল অভীর বন্ধু উজানের সাথে। অভীর সব বন্ধুদের নাম সে জানে। ওরা টং দোকানে বসে আড্ডা দেয়ার সময় একে অপরকে ডাকে বলে নামগুলো জানা হয়ে গেছে অর্পার। অর্পাকেও হয়তো চেনে তারা। উজান ওকে দেখে থমকে দাঁড়াল। একটু হেসে বলল, “ভালো আছেন ভা..সরি, আপু।”
“জি। আপনি?”
“ভালো। এখানে কাউকে খুঁজছেন?” মাথা নিচু করে রইল অর্পা। খানিকক্ষণ পর বলল, “ও কি হোস্টেলে আছে?”
“আছে। ডেকে দেব?”
“রাস্তায় তো কথা বলা যাবে না। ভেতরে যাওয়া যাবে?”
“ভেতরে মেয়েদের যাওয়ার নিয়ম নেই। তবে ভিজিটার্স রুমে দেখা করতে পারেন। আমি ডেকে দিচ্ছি।”
অর্পা বলল, “আচ্ছা তার আগে একটা কথা বলতে পারেন? ওর কী হয়েছে আপনি জানেন?” উজান ইতস্তত করে বলল, “জানি। কিন্তু সেসব শুনতে আপনার ভালো লাগবে না।”
রুমকি গিয়েছিল পাশের বাড়িতে আমেনাবুর কাছে। সে রুমকিকে নিয়মিত পানিপড়া দিচ্ছে। আমেনাবুর স্বামী হুজুর, আর সে হুজুরাইন। কোরআন মুখস্থ তার। গ্রামের মহিলারা অসুখ-বিসুখ, বালা মুসিবতে আমেনাবুর দ্বারস্থ হয়। রুমকি দুই মাস ধরে যাচ্ছে নিজের জন্য পানিপড়া নিতে। রুমকির জীবনটাই কেটেছে এক সাগর অপূর্ণতা নিয়ে। ছোটবেলা থেকে অভাব অনটনে বড় হয়েছে। কোনোদিন একটা ভালো জিনিস মুখে তুলতে পারেনি। ভালো কাপড় পরতে পায়নি। সৎ মায়ের সংসারে অকথ্য অপমান আর নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। যে সময় তার সমবয়সীদের বিয়ে, বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গিয়েছিল, সে বয়সে সে ছিল আইবুড়ো।
এই এতদিন পর তার বিয়ে হয়েছে তাও বাপের বয়সী লোকের সাথে। সেই সংসারে আবার দুটো বড় বড় ছেলেমেয়েও আছে৷ তাও মেনে নিয়েছিল রুমকি। কিন্তু নিজের সন্তান না হওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। এই দেড়টা বছর ধরে সে চাইছে তার কোল আলো করে কেউ আসুক। কিন্তু বিধি বাম। এবার তাই আমেনাবুর শরণাপন্ন হয়েছে সে। যদি কিছু হয়। এমনিতে সেঁজুতি আর অভী কেউই খারাপ নয়, রুমকি জানে। তারা তাকে যথেষ্ট সম্মানও করে। কিন্তু কেন যেন সতীনের সন্তানদের সে বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না। সেটা তার নিজের সৎ মায়ের কাছ থেকে পাওয়া যন্ত্রণার কারনে, নাকি নিজের কোল খালি থাকায়, জানে না রুমকি।
সেঁজুতি দুপুরে না খেয়ে কেঁদেকেটে সেই যে ঘুম দিয়েছিল, তার ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যায়, চেঁচামেচির শব্দে। অশুভ কিছুর আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল তার। ঘরে বাতি জ্বালানো হয়নি। সন্ধ্যার আঁধারটা জেকে বসেছে একেবারে।
সেঁজুতি এক দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। বাবার ঢুকতে নিয়েই ধাক্কা খেল নিজের স্বামীর সাথে। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। “তুমি কখন এলে?” অবাক হয়ে বলল সেঁজুতি। “এইতো একটু আগেই।” বলে বের হয়ে গেল সে। ঘরের ভেতর চৌকিতে রুমকিকে শুয়ে থাকতে দেখল সেঁজুতি। তার মাথার কাছে বসে আমেনাবু। পাশে দাঁড়িয়ে জিনিয়া। সেঁজুতি গিয়ে পাশে বসতেই চোখ খুলল রুমকি। আমেনাবু হাসিমুখে বলল, “ঘরে নতুন মেহমান আইতাছে।”
লজ্জায় এক মুহূর্তে চোখ বুজে ফেলল রুমকি। তারপর বন্ধ চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সেঁজুতি ঠিক বুঝতে পারল না কী বলবে। সে উঠে এল সেখান থেকে। নিজের ঘরের সামনে যেতেই আঁধার থেকে একটা হাত টেনে নিল তাকে। স্বামীর বুকের ওপর আছড়ে পড়ল সেঁজুতি। কেঁদে ফেলল হু হু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবটা বলা হয়ে গেল তার। হালকা লাগতে লাগল নিজের ভেতরটা। সেঁজুতির স্বামী তার চোখদুটো মুছে দিয়ে মাথায় হাত রেখে বলল, “যাও, তোমার মায়ের কাছে। উনার শরীর ভালো নেই। কাল সকালে আমরা ফিরে যাব।” সেঁজুতি ইতস্তত করে বলল, “তুমি খবরটা জানো?”
“হ্যাঁ। আমি আসার পরেই তো উনি জ্ঞান হারালেন। আমি আর জিনিয়া গিয়ে আমেনাবুকে খবর দিয়ে আনলাম।”
সেঁজুতি ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে পা বাড়াল বাবার ঘরের দিকে। আমেনাবু চলে গেছে। জিনিয়া শুধু রুমকির শয্যার পাশে বসে হাত নেড়ে গল্প করছে। রুমকি বোধহয় ভালো বোধ করছে একটু। উঠে আধশোয়া হয়ে বসেছে। সেঁজুতি কাছে গিয়ে বসতেই রুমকি হঠাৎ জড়িয়ে ধরল তাকে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, “আমারে মাফ কইরা দিও তুমি।” অভী ঘর অন্ধকার করে শুয়েছিল। হঠাৎ উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল তার। ভুঁরু কুঁচকে তাকাল সে। উজান আচমকা এসে তার হাত ধরে টেনে তুলল। বলল, “চুলটা একটু আঁচড়ে মুখ ধুয়ে একটু মানুষ হ। একজন দেখা করতে এসেছে তোর সাথে৷”
“কে?” অবাক হলো অভী।
“গেলেই দেখবি।”
ভিজিটার্স রুমে গিয়ে বিষ্ময়ে হা হয়ে গেল অভী। এই মেয়ে এখানে কী করছে? অর্পা খুব স্বাভাবিকভাবে তার সামনে এসে বলল, “কেমন আছ?” অভী উত্তর দিতে পারল না। অর্পা কোনো সংকোচ ছাড়াই তার একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে বসালো। অভী এতক্ষণে খেয়াল করল ছোট্ট টেবিলটার ওপর একটা টিফিনবাক্স রাখা। বাক্সটা খুলল অর্পা। খাবারের ঘ্রাণে ঘরটা ভরে গেল। অর্পা ভাত মাখিয়ে অভীর মুখের সামনে ধরে বলল, “খাও।” অভী মুখ খুলল না। কেমন যেন সব ঘোট পাকিয়ে যাচ্ছে। সে নিশ্চিত স্বপ্ন দেখছে। খুব জোরে চিমটি খেয়ে লাফিয়ে উঠল অভী। “এটা কী হলো?”
“বুঝিয়ে দিলাম আমি সত্যি।” অর্পা হাসিমুখে বলল। চিমটি দিতে পেরে মজা পেয়েছে সে৷ “তুমি কি খাবে না বলো? বাড়ি থেকে অনেক কষ্টে খাবার নিয়ে এসেছে। মেয়েদের কত ঝামেলা সেসব জানো? এখন লক্ষী ছেলের মতো খাও তো।” অভী আর কথা না বলে বাড়িয়ে রাখা গ্রাসটা মুখে তুলে নিল। বাচ্চা মেয়েটা হুট করে যেন পাকা গিন্নি হয়ে গেছে। অর্পার মুখ থেকে কিছুতেই তার চোখ সরছে না।
খাওয়া শেষে সব গুছিয়ে যাওয়ার আগে অর্পা অভীর হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, “এখন রাখো, পরে সব সুদে-আসলে শোধ করে দিও।” অভীকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে পড়ল অর্পা। ওড়না দিয়ে মাথা মুখ ভালো করে ঢেকে বাড়ির দিকে পা বাড়াল। অভী চেয়ে রইল সেদিকে, যতক্ষণ তাকে দেখা যায়। বৃষ্টি আবার নামল ঝমঝমিয়ে। বৃষ্টি নয়, যেন এক পশলা প্রশান্তি।
গল্পের বিষয়:
গল্প