পাত্রপক্ষদের সামনে বসে আছে ইশা। মুখে তার লজ্জা মাখা হাসি। পাত্রপক্ষদেরও ইশাকে বেশ ভালোই লেগেছে। পাত্রের মা রাহেলা বেগম এইবার বলে উঠে,
— মা তুমি কি রান্না করতে পারো?
এমন প্রশ্নে ইশার পরিবারের সকলেই যেন আতঙ্কের মধ্যে পরে যায়। তারা ইশারায় ইশাকে চুপ থাকতে বলে কিন্তু ইশা ঝট করে বলে উঠে,
— হ্যাঁ আমি রান্না পারি। আসলে আমার রান্না করতে ভীষণ ভাল্লাগে না। ইশার এমন উত্তরে পাত্রের মা ভেবাচেকা খেয়ে যায়। মানে তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না ইশা ঠিক কি বলতে চাচ্ছে। তখনই পাশ থেকে ইশার মা বলে উঠে,
— ওর মানে হচ্ছে ও রান্না করতে ভীষণ ভালবাসে। নার্ভাসনেস এর জন্য হয়তো ওইটা বলে দিয়েছে।
— অহহ আচ্ছা। তা মা তোমার কি করতে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে?
— আমার সব কিছুই করতে ভাল্লাগে না। যেমন রান্না করতে ভাল্লাগে না, গান গাইতে ভাল্লাগে না, নাচতে ভাল্লাগে না, আঁকতে ভাল্লাগে না, খেলতে ভাল্লাগে না। রাহেলা বেগম এইবার ড্যাবড্যাব করে ইশার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ইশার মা আবার ঝটপট উত্তর দিলেন,
— কিছু মনে কইরেন না আপা। মেয়েটা ভীষণ চঞ্চল প্রকৃতির তো। সব জায়গায় খালি মজা করে।
— অহহ আচ্ছা। তা আমার কিন্তু এমনই একটা চঞ্চল বউমা চাই। আমি ইশাকে আমার ছেলে হিমেলের বউ করতে চাই। আপনারা চাইলে আজই এংগেইজমেন্টটা করতে চাই। আপনাদের কোন আপত্তি আছে কি? তখন ইশার বাবা রহিম সাহেব বলেন,
— না না আপা! কি যে বলেন না। আজ থেকে আমার মেয়ে আপনাদেরই।
এরপর ইশা আর হিমেলের এংগেইজমেন্ট হয়ে যায়। আর এর ১ মাস পরেই ওদের বিয়েও হয়ে যায়। এই ১ মাসে তাদের মধ্যে তেমন কথা হয় নি। হিমেল চেয়েছিল কথা বলতে কিন্তু ইশার কিছু সমস্যা থাকায় সে মানা করে দেয় আর তাই তাদের কথা বলা হয়ে উঠে নি। আজ ইশা আর হিমেলের বাসর রাত। হিমেল বুক ভরা সাহস নিয়ে রুমের ভিতরে ঢুকে। ভিতরে ঢুকতেই ইশা এসে হিমেলকে সালাম করে। হিমেল এইবার ওকে তুলে দাড়া করায়। তারপর তাকে বসিয়ে বলে,
— দেখুন আমার আপনার সাথে কিছু কথা আছে। ইশা মাথা নিচু করেই লজ্জা মাখা কণ্ঠে বলে,
— জ্বী বলুন।
— আপনি আর আমি দুইজনের জন্য একদমই অপরিচিত। দুইজনেই দুইজনের সম্পর্কে তেমব কিছু জানি না। তাই আমি চাচ্ছি আমরা আগে নিজেদের বুঝি জানি তারপর না হয় আমরা এই সম্পর্কটা আগে টানবো।
— জ্বী আচ্ছা। এর পর দুইজনই বেশ পরিচিত হলো। বিভিন্ন কথা বলতে থাকলো। হিমেল এইবার জিজ্ঞেস করে উঠে,
— আপনার কোন নায়ককে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে?
— আমার সারুকখানকে অনেক বেশি ভাল্লাগে না।
— তা বুঝলাম কিন্তু কাকে ভালো লাগে শুনি? ইশা এইবার কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে বলে,
— সারুকখানকে ভাল্লাগে না।
— আচ্ছা ঠিক আছে বুঝলাম। তা আমাকে আপনার কেমন লেগেছে? ভালো লেগেছে তো! ইশা এইবার লজ্জায় মাথা নিচু করে বলে,
— আপনাকে আমার অনেক বেশি ভাল্লাগে না।প্রথম দেখাতেই আমার আপনাকে ভাল্লাগে নাই। হিমেল এইবার অবাক চোখে ইশার দিকে তাকিয়ে বলে,
— যখন আমার আপনাকে ভালোই লাগে নি তাহলে আপনি এই বিয়ে মত দিলেন কেন?
— ভাল্লাগে না তাই মত দিয়েছি। লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে।
— মানে যাকে আপনার ভালো লাগেই নেই তাকে নিজের জীবনসঙ্গী করে নিলেন? মানে কারণটা কি? বিষ্ময়কর চোখে। ইশা এইবার মাথা তুলে বলে,
— বলছি তো আপনাকে আমার ভাল্লাগে না তাই মত দিয়েছি। মিষ্টি সুরে। হিমেল এইবার মাথা ঘুরে উঠে। সে কোন মতে নিজেকে সামলিয়ে বলে,
— এই ভাল্লাগে না মানেটা কি? ইশা এইবার হেসে উঠে বলে
— এইটাও জানেন না। ভাল্লাগে না মানে ভাল্লাগে না।
হিমেলের এইবার যায় যায় অবস্থা। সে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না তার বউ এইসব কি বলছে। তখনই তার ফোন বেজে উঠে। সে ফোন হাতে নিয়ে দেখে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এসেছে। সে ফোনটি ধরতেই ওপাশ থেকে একজন মধ্য বয়সী মহিলার কন্ঠ ভেসে উঠে,
— আসসালামু আলাইকুম। হিমেল এইবার উত্তর দেয়,
— ওয়া-আলাইকুমাস আসসালাম। জ্বী কে বলছেন?
— বাবা আমি ইশার মা বলছি।
— অহ মা আপনি। তা সব ঠিক আছে তো? এত রাতে ফোন দিলেন যে।
— হ্যাঁ বাবা সব ঠিক আছে। তোমাকে আমার কিছু বলার ছিল।
— হ্যাঁ বলুন।
— আসলে বাবা ইশার না একটা সমস্যা আছে। ও একটা কথা একটু উল্টা বলে আর কি। যেমন ওর কিছু ভালো লাগলে ও তা “ভালো লাগে অথা ভাল্লাগে” বলে বরং সবসময় ” ভাল্লাগে না” বলে। মানে ওর যদি তোমাকে ভালো করে তাহলে ও বলবে তোমাকে ওর ভাল্লাগে না। তা বাবা ওর ভাল্লাগে না মানে ভালো লাগে। তুমি ওকে বুঝো কেমন!
— জ্বী আচ্ছা মা।
ফোন রেখে হিমেল এইবার ইশার দিকে তাকায়। হিমেল এতক্ষণে বুঝতে পারে ইশার এই ভাল্লাগে না মানে ভালো লাগা। কিন্তু সে কিভাবে এই বুঝটা বাকি সবাইকে দিবে আল্লাহ এই জানে। এই ভেবেই হিমেল মাথায় হাত দিয়ে বসে। পরেরদিন হিমেল বার বার ইশাকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে সে যাতে তার শ্বশুর আর শ্বাশুড়ির সামনে কোন ভাবেই “ভাল্লাগে না” কথাটি না বলে। যত যাই হোক! ইশাও মাথা দুলিয়ে বাইরে যায়। বাইরে গিয়ে সকলের সাথে নাস্তার টেবিলে বসতেই রাহেলা বেগম ইশার পাতে ৩ টা লুচি আর গরুর ভুনা দিলেন। ইশার এইবার চুপচাপ খেতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর রাহেলা বেগম ইশার দিকে তাকিয়ে বলে,
— মা খাবারটা কেমন লেগেছে? ভালো লেগেছে তো?
এইবার হিমেলের গলায় খাবার আটকে যায় আর সে কাশতে শুরু করে। হিমেল তারাতারি পানি খেয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই ইশা বলে উঠে,
— খাবার গুলো ভীষণ মজা। আমার ভাল্লাগছে না। রাহেলা বেগম আহাম্মকের মত ইশার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বুঝার চেষ্টা করলেন এর মানেটা কি? হিমেল তা দেখে বলে,
— ইশা আমি যা জিজ্ঞেস করবো তা শুধু হ্যাঁ বা নাতে উত্তর দিও কেমন? ইশা মাথা দুলায়। হিমেল এইবার জিজ্ঞেস করে,
— — খাবার ভালো লেগেছে? হ্যাঁ বা না! ইশা এইবার মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয়। তা দেখে মুচকি হেসে হিমেল বলে,
— দেখেছ মা তোমার রান্না ওর পছন্দ হয়েছে। এখন আর কোন কথা নেই তোমরা সবাই চুপচাপ খাও।
রাহেলা বেগম এখনো আগের মত আহাম্মক বনে বসে রইলেন। কি থেকে কি হলো তিনি কিছুই বুঝলেন না। অতঃপর খাবার শেষে হিমেল ওর বাবা মাকে সব বুঝিয়ে বলে। সব শুনে তাদের মাথায়ও হাত। সন্ধ্যায় পারাপ্রতিবেশি সকলেই আসলো বউ দেখার জন্য। ইশাকেও খুব সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়ে গিয়ে তাদের সামনে বসানো হলো। সকলেই যেন ইশাকে দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু তাও রাহেলা বেগম মনে মনে ভয়ে কুকড়িয়ে যাচ্ছেন যে ইশা যাতে এদের সামনে আবার ভাল্লাগে না বলে না দেয়। দেখতে দেখতেই সে ভয় সত্যি হয়ে উঠলো। একজন মহিলা ইশাকে জিজ্ঞেস করে উঠলেন,
— তা মা তোমার শ্বশুরবাড়ি কেমন লাগলো শুনি? ভালো লেগেছে তো।
— হ্যাঁ। ভীষণ ভাল্লাগে না। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
— তা কাকে কাকে ভালো লাগে না শুনি?
— শ্বশুরবাবা, শ্বাশুড়িমা আর উনাকে মানে সবাইকে ভাল্লাগে না। এইসব শুনে রাহেলা বেগম সেখানেই বেহুশ হয়ে পড়ে গেলেন। তারপর হুট করে একটু জেগে উঠে বলে উঠলেন,
— কিছুই ভাল্লাগে না তাই বিদায় পৃথিবী। এই বলে আবার বেহুশ।
গল্পের বিষয়:
গল্প