কথা ছিল যদি জমজ সন্তান হয়, তাহলে একটি সন্তান নীলার বোনকে দেয়া হবে। আর এই কথাটি ওর স্বামী তারেকের নয়, স্বয়ং নীলারই। ওর বড় বোন নিতু বিয়ের ৮ বছর পরেও নিঃসন্তান। একটি সন্তানের আশায় বুক বেঁধে রয়েছেন দীর্ঘদিন। সেই আশা দিনদিন হতাশায় রূপ নেয়। ভীষণ রকম মুষড়ে পড়েন তিনি। বোনের এই অবস্থা দেখেই নীলা সিদ্ধান্ত নেয়, যদি জমজ সন্তান হয় তাহলে একটি সন্তান তার বড় বোনকে দিয়ে দেবে।
বিয়ের দু বছরের মাথায় নীলা অন্তঃসত্ত্বা হয়। ডাক্তারের কাছে চেকআপের জন্য গেলে জানা যায় নীলার গর্ভে জমজ সন্তান। তারেক আশ্চর্য হয়। এটাও কী সম্ভব! অবশ্য নীলা সবসময়ই চেয়ে এসেছে তার যেন জমজ সন্তান হয়। সৃষ্টিকর্তার কাছে দু’হাত তুলে মিনতি করেছে, বারংবার। সৃষ্টিকর্তা মুখ ফিরিয়ে নেননি। নীলার ইচ্ছে পূরণ করেছেন।
সৃষ্টিকর্তা মুখ ফিরিয়ে না নিলেও সময়ের ব্যবধানে নীলা বদলে যায়। উল্টো সেই মুখ ফিরিয়ে নেয়, নিজের কথার উপর। তারেকের কাছে ঘুরেফিরে জমজ সন্তানদের নিয়ে কথা বলে। ওর কথাগুলোতে কিসের যেন শঙ্কা, কেমন যেন অস্থিরতা। নিজ গর্ভে থাকা অনাগত সন্তানদের নিয়ে এক ধরণের দুশ্চিন্তা বিরাজ করছে নীলার মাঝে। তারেক সেটা বুঝতে পারে। কিন্তু কী করবে ভেবে পায় না। নীলার কাছে প্রশ্ন করে লাভ নেই, কোন উত্তর মিলবে না। সত্যি বলতে, নীলা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। শুধু তারেকের কাছ থেকে নয়, সবার কাছ থেকেই।
‘তুমি বড় আপুকে কল দিয়েছিলে?’
‘হ্যা। হঠাৎ করেই জরুরি একটা কাজ এসে পড়েছে। তাই আপুকে বলেছি তোমাকে যেন ডাক্তারের কাছে চেকআপের জন্য নিয়ে যায়।’
‘তুমি এক্ষুনি আপুকে কল দিয়ে আসতে নিষেধ করো।’
‘কেন? কোন সমস্যা?’
‘তোমাকে কোন কৈফিয়ত দিতে পারবো না। আপুকে আসতে নিষেধ করে দাও।’
‘তাহলে ডাক্তারের কাছে তোমাকে কে নিয়ে যাবে? আমি তো কাজে আটকা পড়ে গেছি।’
‘আমি একাই যাবো। কাউকে দরকার পড়বে না।’
‘নীলা। তুমি এই অবস্থায় একা কিভাবে যাবে? আমার কথা শোনো, আজকের মতো আপুর সাথে যাও।’
‘আর একটা কথাও নয়। যদি আমার ভালো চাও, আপুকে আসতে নিষেধ করে দাও। এই বাসায় আমি না চাওয়া পর্যন্ত কেউ আসবে না। এটাই আমার শেষ কথা।’ তারেক কথা বাড়াতে পারে না। একটা বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পেয়ে যায়, নীলা একেবারে বদলে গেছে। বড় বোনকে নিয়ে ওর ভেতরে যে আতঙ্ক-সঙ্কোচ, সেটা এখন আর আড়াল নেই। তারেক নীলার বড় বোনকে কল করে আসতে নিষেধ করে। নিতু আপু আসার জন্য জোরাজুরি করলেও শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়তে বাধ্য হয়।
নীলার ডেলিভারির সম্ভাব্য তারিখ ঠিক হয়েছে। এক মাস পর ওর সিজার অপারেশন। তারেকের ভাবনা-চিন্তার শেষ নেই। কাজকর্মের চাপও অনেক। তবুও নীলার জন্য সময় বের করতে ভুল হয় না। যতটা সম্ভব নীলার কাছে কাছে থাকে। গল্প হয় দুজনের মাঝে। রাজ্যের যত গল্প, সব। গল্পের ফাঁকেই তারেক নিতু আপুর প্রসঙ্গ আনে। নীলা সাবধানে সেটা এড়িয়ে যায়। বিন্দুমাত্র শব্দ তোলে না এ ব্যাপারে। তারেক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার মোবাইলে একের পর এক কল আসতে থাকে। কিন্তু রিসিভ করা হয় না। কারণ তারেকের কাছে নিতু আপুকে বলার মতো কোন শব্দ নেই।
ছোট্ট একটা কাজে তারেক শহরে যায়। কাজ শেষে নিতু আপুর সাথেও দেখা করতে হয়েছে। নিতুর হাজারটা প্রশ্ন। নীলাকে নিয়ে, নীলার গর্ভে থাকা সন্তানদের নিয়ে। তারেক যথাসম্ভব উত্তর দেবার চেষ্টা করে। এরপর বিদায় নিয়ে বাসায় চলে আসে। অথচ বাসায় এসে কোথাও নীলাকে পাওয়া যায় না। গোটা বাসা তন্নতন্ন করে খুঁজেও লাভ হলো না। নীলা নেই। তবে ওর লেখা একটি চিরকুট পাওয়া গেছে। সেটা পড়ার পর তারেক হতভম্ব হয়ে যায়। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। একচুলও নড়তে পারে না। চিরকুটে স্পষ্টাকারে লেখা- ‘তারেক, আমার সন্তানদের ছাড়া আমি এক মুহূর্ত বাঁচবো না। কারও হাতে আমার সন্তানকে কখনো তুলে দিতেও পারবো না। এটা অসম্ভব। প্লিজ আমাকে কখনো খুঁজতে চেষ্টা করো না।’
গল্পের বিষয়:
গল্প