যেখানে সময়ের স্রোতে লুকায় অনুভূতিরা

যেখানে সময়ের স্রোতে লুকায় অনুভূতিরা

শাড়ি পড়ে যখন আয়নার সামনে দাঁড়ালাম ৷ নিজেকে দেখে বেশ অবাক হলাম, শাড়িতে একটা মেয়েকে কত ভালো লাগে ৷ বাবা তাড়া দিচ্ছিলো, লিপষ্টিক দিতেই পারি নি ৷ এ নিয়ে মায়ের কি আফসোস, সুন্দর করে সাজিয়ে তাদের সামনে নিয়ে যাওয়ার জন্য ৷ মাকে যখন বললাম, মা ছেলে পক্ষের সামনে যতো সিম্পল ভাবে যাবো ততোই পছন্দ হবে ৷ ছেলে পক্ষ সাধারনত সাজগোজ করা মেয়ে কমই পছন্দ করে ৷ মা তখন চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,

” মেয়েটা এতো বড় হইছে জানা ছিলো না বলেই কপালে আলতোভাবে চুমু দিলো ৷ যখন ওদের সামনে গেলাম, ভেবেছিলাম সবাই আমার দিকে হা করে তাঁকিয়ে থাকবে ৷

আমার ভাবনা ভুল প্রমানিত হলো, শুধু ছেলের মা নিজের জায়গার পাশে জায়গা করে বলল, “আয় মা এইখানে বসো এক নজরে ছেলের দিকে তাঁকালাম ৷ নিচে তাঁকিয়ে আছে, খোচা খোচা দাড়ি, সামনের দাত কিছুটা উচু ৷ হাতের আঙুল গুলো চিকন, নখ গুলো বেশ সুন্দর ৷ যদি বিয়ে হয় তার কাছ থেকে শিখে নিবো, কি করে নখ গুলো এতো সুন্দর করে কাটছেন ৷ খয়েরী রংয়ের একটা টি-শার্ট পরেছে ৷ বেশ মানিয়েছে এই রংটায় ৷ ছেলের মা বলল, এই হিমাদ্রি দেখেছিস তোর পছন্দ হইছে? তার মানে এই বোকা বোকা ছেলেটার নাম হিমাদ্রি? উফ কত বড় নাম ৷ দেখার পর্ব শেষ হলে, আমাকে অবাক করে দিয়ে হিমাদ্রি সাহেব বলল,

” আমি একটু আলাদা ভাবে কথা বলতে চাই রুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলাম, হিমাদ্রি কিছুটা অবাক হলো, সেটা তার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ৷

” ভয় পাওয়ার কিছু নেই জনাব, আমি আপনাকে খামছি দিবো না ৷ আবারও আমাকে অবাক করে বলল,

“লিপষ্টিক দিলেন না কেনো? লিপষ্টিক দিলে আপনাকে আরো ভালো লাগতো ৷

” আপনিতো বেশ লুইচ্চা ৷ হিমাদ্রি কিছুটা অপ্রস্তুত ভাবে বলল,

” মামানে ?

” আপনি আমার ঠোটের দিকে তাঁকাইছেন কেনো? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বলল,

” বিয়েতো আমি আপনাকেই করবো ৷ তা হবু বউয়ের দিকে কি ভালো করে তাঁকাবো না?

” এমনিতেই লুইচ্চা তার উপর তো বেশ পন্ডিত ৷ ভাবছি আপনি বোকা হবেন হয়তো ৷ এতো দেখছি মহাপন্ডিত ৷

প্রতিউত্তরে পন্ডিত মশাই আর কিছু বলল না, শুধুই হাসলো ৷ শোনেন আমার একটা সমস্যা আছে, যেটা জানলে হয়তো বিয়ে কথা ভেন্টিলেটর দিয়ে পালাবে ৷

” ভেন্টিলেটর দিয়ে কেনো?

” ওই দেখেন না, দরজা জানলা বন্ধ আছে ৷ যদি বিয়ের ভাবনা পালায় তো ওই ভেন্টিলেটর দিয়ে পালাতে পারে ৷ এবার পন্ডিত মশাই হো হো করে হেসে উঠলো ৷

” নিঝু আপনি পারেনো বটে

“নিঝ? আমার নাম নির্ঝরা

” ওতো বড় নামে ডাকতে পারবো না ৷

” আচ্ছা হিম

” হা হা হা, শোধ নিচ্ছেন বুঝতে পারছি ৷ যাই হোক আপনার সমস্যা কি এলার্জি? ভ্রুঁ কুঁচকে তাঁকিয়ে বললাম,

” কি করে জানলেন?

” ওই যে টেবিলে রাখা ওষুধ দেখে আন্দাজ করে নিলাম ৷

” হুম খুব সমস্যা, মানে শ্বাস করতে পারিনা তখন ৷

” বুঝলাম, তবে নিয়ম মেনে চললে সমস্যাটা কম হবে ৷ আর এই সমস্যার জন্য আমার বিয়ের ভাবনা ওই ভেন্টিলেটর দিয়ে যাবে না ৷ দরজা খোলা রাখলে হয়তো যেতে পারতো ৷ তা তো তুমি বন্ধ করে রাখছো বলেই হো হো করে হাসতে লাগলো ৷ ভ্রুঁ কুঁচকে তাঁকিয়ে আছি, এই ছেলে এতো বদ দেখে বুঝাই যায় না তবে হাসলে বেশ লাগে ৷

সেদিনের পর থেকে দিন গুলো খুব তাড়াতাড়ি কেটে যাচ্ছিলো ৷ ওই বদটাই আমার কপালে জুটেছে ৷ রাতভর পাগলামি, আর খুনসুটিতে ভালোই যাচ্ছিলো ৷ তবে একটা মেয়ে বিয়ে হলে যে এই ভাবে পাল্টে যায় নিজেকে না দেখলে বুঝতামনা ৷ যে আমি মা ভাত না বেড়ে দিলে খেতাম না সেই আমিটা সবাইকে ভাত বেড়ে খাওয়াই ৷ যে আমি পিরিয়ডের দিন গুলোতে শুয়ে থাকতাম ব্যথায় ৷ মা গরম দুধ খাওয়াতো ৷ গরম ভাত খাইয়ে দিতো ৷ সেই আমি এখন অসহ্য ব্যথা নিয়েও রান্না বান্না করতে হয় ৷ শাশুড়ি মা বলে দিছে, তোমার কি একাই ওইগুলো হয় ৷ দুনিয়ার সব মেয়ের হয় এতো আদিখ্যেতা ভালো না বাপু ৷ সত্যিইতো দুনিয়ার সব মেয়ে যদি সহ্য করতে পারে তো আমি কেনো পারবো না?

তবে এটা বুঝেছি শাশুড়ি কখনোই মা হতে পারে না ৷ এর মাঝেও মনে হতো আমি সব থেকে সুখি ৷ সারাদিন কাজের পরে যখন হিমের ভালবাসা পেতাম তখন শাশুড়ি মায়ের কটুক্তিও গায়ে লাগতো না ৷ তবে আমি যে সব সহ্য করারও মেয়ে না ৷ যেদিন শাশুড়ি মা যৌতুকের জন্য কথা শুনাচ্ছিলো ৷ মুখের উপর বলে দিয়েছি ৷ যদি আমার বাড়ি থেকে গয়না আর আসবাবপত্র দেয় তা কি আপনি ব্যবহার করবেন নাকি আমি? উত্তরে বলেছিলো, তুমি ব্যবহার করবা ৷

” তাহলে? আপনার ছেলের দায়িত্ব ৷ বিয়ের পরে আমি কি ব্যবহার করবো সেটা আমার বাপের বাড়ির লোক ঠিক করবে না মা ৷ আপনার ছেলেই ঠিক করবেন ৷ এতো চিন্তা করতে হবে না ৷ আর আমি গয়নাও পরতে চাই না আর বাপের বাড়ির খাটেও শুইতে চাই না ৷ আমার স্বামীর যা আছে তাতেই আমি খুশি ৷ আশা করবো এর পরে আর আমার বাপের বাড়ির জিনিসের প্রতি লোভ দেখাবেন না ৷ সেদিনি বুঝেছিলাম আমার স্বামী কত মা ভক্ত ৷ তার মায়ের মরা কান্নার কাছে আমি হেরে গেলাম ৷ হিম অনেক কথা শুনিয়েছে ৷ তার মাকে লোভী বলাটা ঠিক হয় নি ৷ সেটাই মেনেও ছিলাম ৷

শশুড়বাড়ি এসে শাশুড়ির কে লোভী বলা মানে জলে নেমে কুমিরের সাথে লড়াই করা একই কথা ৷ তবে সংসার করতে করতে একটা সময় কুমিরের সাথে লড়াই করে জলে কি করে টিকে থাকতে হয় সেটাও শিখে গেছি ৷ যেদিন টিউলিপের জন্ম হয় সেদিন হিমকে এতো খুশি আমি কখনোই দেখি নি ৷ কোলে নিতে পারছিলো এতো ছোট ছিলো টিউলিপ ৷ তাও বুকের সাথে মিশিয়ে বলল, “নিঝু আমি আমার রাজকন্যাকে পেয়ে গেছি ৷ আমার মাথা হিমের বুকের আরেক পাশে রেখে বলেছিলো, “দেখো নিঝু আমি পৃথিবীর সেরা সুখী ৷ আমার বুকে আমার সকল সুখ” বলেই কি কান্না ৷ ওই কান্না সুখের কান্না ছিলো ৷ কিন্তু সব থেকে অখুশি ছিলো শাশুড়িমা ৷ সে এসে বলেই দিলো, মেয়ে হইলো? একটা ছেলে জন্ম দিতে পারলা না ৷ আমার বাবুর বয়স হইছে, একটা ছেলে হইলে ওর একটা লাঠি হইতো ৷ কয়েকদিন কোলেই নেয় নি টিউলিপকে ৷ একদিন হিমের সামনেই মাকে বলেছিলাম,

” আপনি যদি আমার মেয়ে হইতেন , আর যদি জানতাম আপনি মেয়ে বাচ্চা পছন্দ করতেন না ৷ তো জন্মের সময় আপনার মুখে লবন দিয়ে মেরে ফেলতাম ৷ এরকম বদজাম মেয়ে জীবনে দেখি নি ৷ নিজে একটা মেয়ে হয়ে জন্মেছে আবার বড় বড় কথা ” কথাগুলো শুনে হিম মুচকি হাসি দিয়ে টিউলিপকে আদর করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো ৷

সেদিনের পর থেকে কখনো বলে নি যে, মেয়ে বাচ্চা কেনো জন্ম দিছি ৷ তবে একটা সময় টিউলিপ তার নয়নের মনি হয়ে ওঠে ৷ যেটা আমার একদম সহ্য হতো না ৷ ওইটুকু ছোট মেয়েটাকে মুখের পান খাওয়তো ৷ যখন খাওয়াতাম, টিউলিপ দৌঁড়ে গিয়ে তার কাছে লুকাতো ৷ আর সেও বলতো, “খেতে হবে না, ওর যখন খাইতে মন চাইবে এমনিতেই খাবে ৷ আমার বাবুরে কখনো এইভাবে খাওয়ানো লাগে নাই ৷ ফ্যান ভাত মেখে সামনে দিতাম তাই খাইতো ৷ তোমাদের মতো এতো জোর করে খাওয়ানো লাগতো না ৷ ” প্রতিউত্তরে কিছু বলতাম না, বিরক্তি লাগতো তার কথা শুনে ৷

মাঝরাতে শ্বাস কষ্ট হচ্ছে খুব, নিঃশ্বাসটা টেনে তুলতে পারছি না ৷ হিমকে ডাকতে গিয়েও ডাকলাম না ৷ মনে হচ্ছে বুকের মধ্যে কিছু আটকে আছে ৷ আচ্ছা আমি কি মরে যাচ্ছি? বিছানার চাদরটা খামচে ধরে আছি ৷ টিউলিপটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ৷ মরার আগে মেয়েটার মুখটা শেষবার যদি দেখতে পারতাম ৷ জল তেষ্টা পেয়ছে খুব ৷ একটু জল পেলে হয়তো বেঁচে যাবো ৷ ওমনি হিম ধরফর করে উঠে বসলো, অন্ধকার ঘর কিছু দেখা যাচ্ছে না ৷ তবে হিম উঠেই বিছানা হাতরে আমার মাথায় হাত রাখলো ৷

“নিঝু তোমার কষ্ট হচ্ছে নাকি?

বলতে বলতে লাইট জ্বালালো, আমি জানতাম হিম উঠবে, তবে এতো তাড়াতাড়ি সেটা ভাবি নি ৷ আমি অসুস্থ থাকলে কি করে জেনো বুঝে যায় পন্ডিত মশাই ৷ মাথাটা কোলে নিয়ে হাতের আঙুল গুলো টানা শুরু করলো, এবার খুব কান্না পাচ্ছে ৷ এই লোকটাকে ছেড়ে মোটেও যেতে ইচ্ছে করে না ৷ এতক্ষণ কষ্ট হলেও মরার জন্য ভয় হয় নি ৷ কিন্তু ওর এতো ভালবাসা দেখলে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না ৷ সে আমাকে খাটে শুইয়ে রান্না ঘরে গেলো দৌড়ে ৷ ও জানে এই অবস্থা কন্ট্রোল করার প্রথম ধাপ, গরম জল ‍কিংবা চা খাওয়া ৷ পাশের ঘর থেকে শাশুড়ি মায়ের কর্কশ গলা শোনা যাচ্ছে ৷ “খোকা বউয়ের কি আবার হাপানি উঠছে? ” হিমাদ্রি শান্ত ভাবে জবাব দিলো, হ্যা, তুমি চিন্তা করো না গরম জল খেলেই নিঝু ঠিক হয়ে যাবে ৷

— চিন্তা কি সাধে করি, তোর কপালে যে এমন একটা বউ জুটবে কল্পনাও করতে পারি নি ৷ বউয়ের বাপের বাড়ির লোক আমাদের এমন ভাবে ঠকাবে সাত জনমে ভাবি নাই ৷ ঘাটের মরা ঘারে দিয়ে তারা হাফ ছেড়েছে ৷ যা যা দেবার কথা ছিলো তা দিলো না ৷ মুখেই বলছে এটা দিবে ওটা দিবে ৷ দেবার বেলায় ঠনঠন ৷

— মা একটু চুপ করো, রাত জেগে অযথা কথা বলো না ৷ শাম্ত ভাবে জবাব দিলো হিমাদ্রি ৷ আমাকে উঠিয়ে ওর কাঁধে মাথা রাখতে বলল ৷ গরম জল খাইয়ে দিলো ৷

“খুব কষ্ট হচ্ছে বুড়ি?”

“না এখন ঠিক আছি, একটা কথা বলবো?

” শোনো বুড়ি তোমার শ্বাস কষ্ট জেনেই তোমাকে বিয়ে করেছি ৷ মায়ের কথা ধরে মন খারাপ করো না ৷ আগের যুগের মানুষ তো একদিন ঠিক বুঝবে দেখে নিও ৷

কি বলবো, এই ছেলেটা আমার মনের কথা গুলো কি করে যে বুঝে যায় কে জানে ৷ জানতে চাইলে বলে, “বুড়ি তোর মন পড়ে সব মুখস্থ করে নিয়েছি বহুবার, তোর সব কিছু মুখস্থ আমার” মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ওর কথা শুনতাম ৷ সকালে যখন শাশুড়ি মায়ের খাবার সামনে দিলাম ৷ ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,

” কি রান্না করছো বউ, কত বার বলছি এইসব পাচমিশালি তরকারি রান্না করবা না ৷ ঘরে ইলিশ মাছ নাই? কতদিন বলবো তোমায়? ইলিশ মাছ ভুনা করো ৷ বুড়ো হইছি তো এখন আর আমার কত কে শোনে?

” বুড়ো হইছেন ভালো কথা, শয়তানি ছাড়বেন কবে? আপনি ভালো করে জানেন ইলিশ মাছে এলার্জি, তাও আপনার বেছে বেছে যে সব তরকারিতে এলার্জি সেইসব তরকারি খেতো ইচ্ছে হয়? শোনেন আজ ঝগড়া করার মোটেও ইচ্ছা নাই বলতে বলতেই রান্না ঘরে চলে আসলাম ৷ সে ভালো করেই জানে আমার এলার্জি থেকে শ্বাস কষ্ট হয় ৷ তাও সে ওইসবই খেতে চায় ৷ কাল সকালে এই নিয়ে হিম আমাকে কত কথা শুনিয়েছে ৷ কাল যখন হিম ঘর থেকে বের হবে ঠিক তখনি, হিমাদ্রিকে ডাক দিয়ে শাশুড়ি মা বলল,

” বাবু তোর বউকে বলে দে একটু ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে বেগুনের তরকারি করতে ৷ উত্তরে বলেছিলাম, দুটোই এলার্জি আমার জন্য সমস্যা হবে ৷ ওমনি হিম ধমক দিয়ে বলল,

” তুমি কি চাচ্ছো নিঝু? তোমার এই সমস্যার জন্য মা তার পছন্দের খাবার খেতে পারবে না? এটা নিয়ে আমি আর কোনো কথা শুনবো না ৷ মা যা চায় তাই হবে ৷ ঠিক তখনি শাশুড়ি মা ন্যাকা গলায় বলল,

” সব কিছুই শরীরে সহায় নিতে হয় ৷ মেয়ে জাতির ওতো বাছা গোছা ভালো না ৷ কথা গুলো হিম শুনেছে তাও কোনো প্রতিবাদ করে নি ৷ চুপচাপ সরে গেলো বাড়ি থেকে ৷ হিম চলে যেতেই মা বলল, ” বেশ হইছে কথা শুনিয়েছে ৷

মেজাজটা খুব খারাপ লাগছে ৷ তাই রাগ করেই ওই এলার্জির খাবার খাওয়া ৷ ফলসরূপ রাতে ভয়ংকর শ্বাসকষ্ট ৷ যদিও বিকাল থেকেই কষ্ট হচ্ছিলো ৷ তবে রাতে যখন হিম কোন কথা না বলেই ক্লান্ত শরীরের অজুহাতে ঘুমিয়ে পরলো ৷ রাগটা সত্যি কন্ট্রোল করতে পারিনি আর রাগ উঠলেই কান্না পায় খুব ৷ একে তো শ্বাস করতে সমস্যা তার উপর কান্না৷ তাই একটু বেশিই সমস্যা হলো ৷ ওমনি মা করা গলায় বলল, “বউ গরম পানি করে দাও, আজ শীতটা একটু বেশি পরছে ৷” সামনে গিয়ে বললাম,

“কোন দিন আপনি গরম পানি ছাড়া গোসল করেন বলতে পারেন?

” আমি কিছু বললে তোমার এতো গা জ্বালা করে কেনো বউ? আমারে যদি সহ্য না হয় তো ধ্রুবর বাসায় দিয়ে আসো ৷

” জান না কেনো, গেলে তো বাঁচি, খাবেন পরবেন ছোট ছেলের কিন্তু গুন গাইবেন বড় ছেলের ৷ আমার বড় ছেলে এই করবে, ওই করবে কিন্তু অসুস্থ হলেও তো একবার চোখের দেখা দেইখা যায় না ৷ তা বড় ছেলে নিয়ে এতো কিসের আদিখ্যেতা? এই যে বিছানায় পরে আছেন একবার তো ফোন দিয়েও তো জানলোনা ৷

” আজ আসুক বাবু, সব বলবো যে তুমি আমার সাথে চোখ রাঙিয়ে কথা বলো ৷

” উফফ!! আপনাকে আর কত বার বলবো, ওর একটা নাম আছে ৷ বাবু বলবেন না ৷

” আমি ওরে ছোট বেলা থেকেই বাবু বলে ডাকি ৷

এর প্রতিউত্তর কি দিবো বুঝতে পারি না ৷ এই নিয়ে বহু বার বলছি, আরে হিমকে আমি ভালবেসে আদুরে গলায় বাবু বলি এটা কেনো সে ডাকবে ৷ ওমনি হিম বাসায় ঢুকলো,

“নিঝু খুব ক্ষুধা লাগছে খেতে দাও ৷ তাড়াতাড়ি খাবার বাড়তে গিয়ে হাতে লেগে কাচের গ্লাস পরে ভেঙে গেছে ৷ ওমনি মা বলল, বউ কি ভাঙলো? নিশ্চই কাচের কিছু ভাঙছে?

” গ্লাস ভাঙছে, (আমি)

” তুমি পারোও বটে ঠান্ডা মাথায় কোনো কাজ করতে পারো না ৷

কিছু বলতে যাবো ওমনি, হিমাদ্রি বলল,

” মা আমার হাতে লেগে ভাঙছে ৷ হিমের দিকে তাঁকালাম, শুধুই তাঁকালাম ৷ এই তাঁকানোর মানেটা শুধুমাত্র হিম বুঝেছে ৷ নিরবতা ভেঙে হিম শান্ত গলায় বলল,

” মায়ের সাথে এমন ঝগড়া করো না নিঝু ৷ তুমি তো একদিন বুড়ো হবে ৷

” শোনা বাবু আমি মোটেও ওইরকম একচোখা হবো না ৷ সে সব সময় ধ্রুবদার পক্ষ নেয় ৷ খাওয়াচ্ছি আমরা, হাতে ধরে টয়লেটে নিয়ে যাচ্ছি, ভালো ভালো কাপর দিচ্ছি তাও সে আমাদের একদম সহ্য করতে পারে না ৷ তুমি বলো সেদিন গয়না গুলো ভাগ করার সময় সীমা আপাকে (ননদ) আর ভাবিকেই গয়না দিলো ৷ কই আমাকে তো দিলো না৷ মুখের খাবার শেষ করে হাসি মুখে বলল,

” বাবা তোমাকে তো কখনো গয়নার প্রতি লোভ দেখি নি ৷ বিয়েতে যে গয়না দিলাম সেগুলো তো তখনো ছুতেও দেখি নি ৷ তাহলে মায়ের গয়না নিয়ে পরে আছো কেনো?

কিছু বলতে গিয়েও বললাম না ৷ গয়না পরি না তাই বলে ভাগের বেলায় আমি পাবো না এটা মানা যায় না ৷ তাও মেনে নিয়েছি ৷ যখন এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছি ৷ মা বার বার বলে দিছে, এটাই নাকি আমার আপন ঘর ৷ শাশুড়িকে মায়ের মতো ভালবাসতে ৷ তবে শাশুড়ি কখনো মা হতে পারে না এটা অনেক আগেই বুঝছি ৷ তবে সবইতো ঠিক ছিলো ৷ বউ শাশুড়ির খুনসুটির মাঝে সংসারটা ভালই চলে যাচ্ছে ৷ শাশুড়ির কটুক্তি শুনেও রাতে যখন হিমের ভালবাসা পেতাম সবটা ভুলে যেতাম ৷ তবে এর মাঝে যখন হিমের ব্যবসায় লোকসান দেখা দিলো ৷ তখনি আমাদের ভালবাসা ঘাটতি হতে লাগলো ৷ হিমের মাঝে পরিবর্তন আসতে লাগলো যে শাশুড়িমাকে আমি প্রতিদ্বন্দী ভাবতাম সেও আস্তে আস্তে পাল্টে গেলো ৷ এখন আর সে আমার সাথে ঝগড়া করে না ৷ যাই বলি তাই মেনে নেয় ৷ সকালে উঠে শাশুড়ির সাথে বকবক করতে হতো সেটা আর করা হয় না ৷ একদিন সকালে হিমকে চা দিলাম ৷ চায়ের কাপটা নিলো ভালভাবেই ৷ মুখে দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলো কিছু না বলেই বাইরে চলে গেলো হিম ৷ আমিও কাচের টুকরো গুলো উঠিয়ে রান্না করতে গেলাম ৷ একটু পর পাশে বসলো শাশুড়িমা৷

” বউ তোমার কাজে কি কোনো সাহায্য লাগবে? অবাক হয়ে তাঁকিয়ে ছিলাম, কিরকম কান্না পাচ্ছে ৷ এই প্রথম সে আমার সাথে রান্না ঘরে এসেছে তাও কাজে সাহায্য করতে ৷ নিজেকে সামলে বললাম,

” আপনি এই শরীরে কেনো আসতে গেলেন? আমারে কি বিরক্তি না করলেই হয় না মা?

” তোমার সাথে এখন আর ঝগড়া হয়না তো ভালো লাগে না ৷ তুমি বাবুর না না হিমাদ্রির আচরনে কিছু মনে করো না ৷ কিছু বলতে না দিয়েই মাকে জড়িয়ে ধরলাম ৷ খুব কান্না পাচ্ছে ৷

” মা আপনি ওরে বাবুই বইলেন ৷

” পাগলি মেয়েটার মন কি আজ খুব খারাপ?

কিছু বললাম না শুধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম ৷ সময় মানুষকে কত পাল্টে দেয় ৷ যখন শাশুড়ির সাথে ঝগড়া হতো তাও এতো কষ্ট হতো না ৷ আর এখন শাশুড়ি ভালবাসে তবে হিম পরিবর্তন হচ্ছে ৷ এটা মানতেই পারছি না ৷ খুব কষ্ট হচ্ছে ৷ আস্তে আস্তে হিমের আচরন খারাপ হতে লাগতো ৷ রান্না একটু খারাপ হলেই ছুড়ে ফেলে দিতো ৷ কখনো কখনো গায়ে হাত তুলতো যেটা কিছুতেই মানতে পারতাম না ৷ টিউলিপ উঠে দাঁড়ায়, সে আর কিছু শুনতে চায় না ৷ তার পরের কথা তার অজানা নয় ৷ তার বাবার কোন কথা সে শুনতে চায় না৷ মনে করতে চায় না সেই অতীত ৷

” না মা ওই সাইকো লোকটার কথা আমি শুনতে চাই না ৷

নিঝু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে, মেয়েটা আজও ওর বাবাকে ঘৃনা করে ৷ সেই ছোট বেলা যখন ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরিক্ষা দিবে৷ পরিক্ষার রাতে হিমাদ্রি খুব মারে নির্ঝরাকে সেটা টিউলিপ কিছুতেই মেনে নিতে পারে নি ৷ ভয়ে টেবিলের নিচে লুকিয়ে ছিলো ৷ মানুষিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরে ৷ একমাস একুশ দিন সে হসপিটালে ছিলো ৷ সবাই ধরেই নিয়েছিলো টিউলিপ বৃত্তি পাবে ৷ স্যারদের কত আশা ছিলো ৷ তবে সেই পরিক্ষা আর দিতে পারেনি ৷ সেইদিন থেকে ওর বাবাকে খুব ভয় পেতো ৷ সেই ভয়টা এখন ঘৃনায়ভরে গেছে ৷

টিউলিপের দিকে তাঁকিয়ে আছে নির্ঝরা ৷ মেয়েটি রাগে ফুসছে ৷ চোখ দিয়ে অনবরত জল পরছে ৷ এইরকম কান্না করতে সেই ছোট বেলায় দেখেছে নির্ঝরা ৷ মেয়ের পাশে বসতে বসতে বলল, আমার মেয়েটাকে আজ পরীর মতো লাগছে ৷ টিউলিপের কড়ে অাঙুলে একটা কামড় দিলো ৷ ওমনি টিউলিপ বিরক্তি নিয়ে বললো,

” উফফ!! মা এইসব আজগুবি চিন্তা মাথায় নিয়ে আছো ৷ ব্যথা দিয়ে নজর কাটে ৷ সত্যি আজ টিউলিপকে অপ্সরীর মতো লাগছে ৷

সকাল থেকেই নির্ঝরার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না ৷ একমাত্র মেয়েকে আজ শশুড়বাড়ি পাঠাবে ৷ তাই টিউলিপ ওর মাকে অন্যমনস্ক করার জন্যই মায়ের বিয়ের কথা জানতে চাইলো ৷ এতক্ষণ টিউলিপের কষ্ট হলেও এখন রাগ হচ্ছে খুব ৷ ওর বাবার জন্যই ওর অনেক কথা শুনতে হইছে ৷ স্কুলে যখন যেতো বাবার হাত ধরে অনেকেই স্কুলে আসতো ৷ টিউলিপ তখন বাবার ভয়ে মামা বাড়ি পালিয়ে বেড়াতো ৷ মামার বাড়ি থেকেই ওর বড়ো হওয়া ৷ ওর বাবার কথা আর মনে করতে চায় না ৷ নির্ঝরা মেয়ের দিকে তাঁকিয়ে আছে ৷ গয়না গুলো সত্যি মানিয়েছে টিউলিপকে ৷ লাইটের আলোয় সারা শরীর ঝলমল করছে ৷

” জানিস তোর গয়নার টাকা কে দিয়েছে? (নির্ঝরা)

” কে?

” আমার ঝগড়ুটে শাশুড়ি ৷ টিউলিপ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সব গয়নার দিকে হাত বুলিয়ে নিলো ৷ এতো অনেক টাকা খরচ হয়েছে মা ৷

” যেদিন সে মৃত্যুশয্যায় ছিলো, সেদিন সে আমার হাতে একটা পুটলি ধরিয়ে বলেছিলো

” এইখানে আমার টিউ দাদুভাইয়ের জন্য কিছু টাকা আছে ৷ চব্বিশ হাজার তিনশত বারো টাকা আছে ৷ এটা দিয়ে টিউর বিয়েতে একটা গয়না দিও ৷

” এতো টাকা আপনি কোথায় পেলেন?

” ধ্রব আর হিমাদ্রি ওরা দুই ভাই মাঝেমাঝে টাকা দিতো ৷ সেটাই খরচ হয় নি ৷ যা খরচ করেছো তো তোমরাই করছো ৷ ওটা জমাই ছিলো ৷ টিউলিপের চোখ দিয়ে জল পরছে তাও হাসি মুখে বলছে, বাদজাত বুড়ি মরার আগেও আমার নামটা ঠিকমতো বলতে পারলো না ৷ কতবার বলছি, টিউ না টিউলিপ ৷ উচ্চারণ করতে পারতো না ৷ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল,

” তবে এতো গুলো গয়না টাকা কোথায় পেলে? নির্ঝরা কিছু সময় নিয়ে বলল,

” হ্যা, মা যেদিন বুঝতে পারে হিমের টাকার দরকার ৷ টাকার জন্যই আমাদের সাথে তোর বাবার সম্পর্কের মাঝে দুরত্ব বাড়ছে ৷ তখন আমাকে ডেকে বলল,

” বউ তোমার শশুড় মরার আগে আমাকে তার সারাজীবনের সঞ্চয় আমাকে দিয়ে গেছে ৷ ওই টাকা গুলো আমি হিমাদ্রিকে দিতে চাই ৷ ও ওর ব্যবসা আবার দাড় করাক ৷ টিউলিপ করুণ দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

” টাকা গুলো পাওয়ার পরেও আমাদের সাথে এমন করতে পারলো বাবা ?

” না রে, সেদিন যখন হিমকে ফোন দিয়ে সব জানালাম ৷ হিমের কি খুশি, আমাকে ফোনে বলেছিলো

” নিঝু আমার রাজকন্যাকে আমার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে আর দূরে যেতে দিবো না দেখিস ৷ আমি এক্ষুনি আসতেছি এতোটুকু বলেই কাঁদতে থাকে নির্ঝরা ৷ টিউলিপ উঠে দাঁড়ায়, “তারপর কি হলো মা?” নির্ঝরা নিজেকে সামলে বলল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলো ৷ তাও হিম বাড়ি ফিরলো না ৷ কত জায়গায় খুজেছি কোথাও পাই নি ৷ পরের দিন রাত ১০ টার দিকে ফোন আসে হিম যে গাড়িতে বাড়ি আসছিলো সেটা এক্সিডেন্ট হয় ৷

টিউলিপ বসে পরলো খাটের উপর ৷ কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো ৷ নির্ঝরা বলল, পরে হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারি ডাক্তারের কাছে, মাথায় প্রচন্ড আঘাত পাওয়াতে মানুষিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে ৷ আমাদের কাউকে চিনতে পারে না ৷ শুধু বলে ” আমি খুব খারাপ, আমার কাছে আসলেই খুন করে দিবো” ডাক্তার দেখিয়ে কোন লাভ হয় নি, সেই অবশিষ্ট টাকা দিয়েই তোর গয়না কেনা ৷ টিউলিপ আনমনেই বলে উঠলো, “মা রাজকন্যা খুব খারাপ তাই না মা? ”

নির্ঝরা মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো, “না রে মা রাজকন্যাটা খুব ভালো ৷ ডাক্তার তোকে তোর বাবার এক্সিডেন্টের কথা বলতে নিষেধ করছিলো ৷ তখন তুই তোর বাবাকে দেখতেই পারতি না ৷ শুধু ভয় ছিলো তোর মনে ৷ তাই বলি নি ৷ তোর মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিছি ৷ ” মা আমি বাবার কাছে যাবো ৷ নির্ঝরা অবাক হয়ে বলল, না মা একটু পরেই বর পক্ষের লোকজন চলে আসবে ৷ এখন যাওয়ার কোন দরকার নেই ৷ টিউলিপ উঠে দাঁড়ায় এক পা দু পা করে এগিয়ে যাচ্ছে বাবার রুমের দিকে ৷

রুমটা আবছা অন্ধকার ৷ দরজা খুলে লাইট জ্বালালো টিউলিপ ৷ হিমাদ্রি চোখ খুলে দেখলো বউ সাজা কোন মেয়ে তার রুমের দাঁড়িয়ে আছে ৷ উঠে বসতে বসতে বলল, “আমি খুব খারাপ, আমার কাছে আসলেই খুন করে ফেলবো ৷ যা এখান থেকে” তাও টিউলিপ ভিতরে ঢুকছে আস্তে আস্তে, হিমাদ্রির পায়ে শিকল পড়ানো ৷ ওর বাবার পায়ের কাছে বসলো, হিমাদ্রি বার বার সরিয়ে দিচ্ছে ৷ আর বলছে, “খুন করে ফেলবো যা এখান থেকে” টিউলিপ বাবার পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলল, বাবা তোমার রাজকন্যা তোমার কাছে এসেছে বাবা ৷ আর দূরে যাবে না তোমার রাজকন্যা ৷ মাফ করে দাও না বাবা ৷

হিমাদ্রি আর কিছু বলল না, মনে হচ্ছে পাথরের কোন মূর্তি যার মন বলতে কিছুই নেই ৷ টিউলিপ ফ্লোরে বসে বাবার কোলে মাথা দিয়ে আছে ৷ হঠাও টিউলিপ চোখ মেলে তাঁকালো, কারন টিউলিপের গালে আর গলায় দু ফোঁটা জল পরলো ৷ টিউলিপ তাঁকিয়ে আছে তার বাবার দিকে ৷ বোঝার চেষ্টা করছে জলের ফোঁটা কি বাবার চোখ দিয়েই পরেছে? আর ওইদিকে নির্ঝরা রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আঁচলে মুখ গুজে কাঁদছেন ৷ বাইরে সবাই বলতেছে “বর এসেছে, বর এসেছে ” টিউলিপ বাবার পা জড়িয়ে আছে, আর বলছে ” একবার কথা বলো বাবা, তোমার রাজকন্যা চলে যাবে ৷ বিদায় কি দিবে না বাবা? এই দেখো বাবা আমি কানে ধরছি ৷ একবার কথা বলো বাবা প্লিজ ৷

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত