মধ্যবিত্ত

মধ্যবিত্ত
ভাই ৩০০টাকায় মাছটি দিবেন? ভ্রুকুচকে আমার দিকে তাকালেন মাছওয়ালা, বিড়বিড় করে বলল মাছ কেনার টাকা নেই আর আসছে মাছ কিনতে! আমি কিছু না বলে চলে এসেছি কারণ কিছু কথার উত্তর দিলে যে বিপদ। মহাবিপদ মধ্যবিত্ত হয়ে এরকম সব কথার জবাব দেয়া তার চেয়ে সন্মান বাঁচিয়ে যে ফিরে এসেছি এটাই ঢেড়। অফিস থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম বাজারে, হিমা অনেকদিন ধরেই বলছিলো শাক-সবজি অনেকদিন ধরে খেতে কষ্ট হচ্চে তার। হবে নাই বা কেনো সে তো বাবার বাড়িতে ভাতই কম খেয়েছে বলা যায়। ওর সাথে সম্পর্কের সময় শুনতাম সে বাহিরের রেষ্টুরেন্ট গুলোতে খেতো বেশি। আমিও ওর কথায় তেমন কিছু বলিনি শুধু বলছিলাম “একটু কষ্ট করো সোনা ভালো মাছ পেলে আসার সময় নিয়ে আসবো ” হিমাও বলল “থাক ওইদিক(বাজারে) গিয়ে সময় নষ্ট করতে হবে না তুমি ক্লান্ত শরীর নিয়ে হাঁটাহাঁটি না করে বাসায় এসে পরবে।”
আমি উত্তরে শুধু হেসে দিলাম। যে চাকরিটা আমি করি এটা অনেক ভালো কাজ কিন্তু এর পারিশ্রমিক আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়। মাসে ১৯দিন খেতে হয় ডাল আলুভর্তা আর তার সাথে মাঝে মাঝে শাক-সবজি। মাংস বলতে কিস্তিতে কেনা ফ্রিজে রয়েছে পারা-প্রতিবেশিদের দেয়া গরুর মাংস যা তারা কোরবানিতে দিয়েছেন আমাদের। তাও তেমন খাওয়া হয়না পাছে বাসায় মেহমান আসলে তখন সমস্যায় পরতে না হয় তাই হিমা ওটা রেখে দিয়েছে। বাসায় ফিরছি আমি এমন সময় সামনেই নজরে পরলো এক বৃদ্ধ চাচা সাজিতে কিছু পুটি মাছ নিয়ে বসেছেন। হিমা দরজা খুলে সুন্দর ভাবে মুচকি হাসি দিয়ে,
হিমাঃ আস-সালামুয়ালাইকুম মি.
আমিঃ ওয়ালাইকুম আস-সালাম মিসেস(মুচকি হাসি দিয়ে, জুতা খুলতে খুলতে)
হিমাঃ হাতে ওগুলো কি?
আমিঃ অহ এগুলো পুটি মাছ। চিনো তুমি?(ঘরের ভিতর ঢুকেছি)
হিমাঃ হুম চিনিতো অনেক খেয়েছিলাম নানু বাসায়।
আমিঃ বাসার সামনে দেখলাম এক চাচা বিক্রি করছেন তাই নিয়ে এলাম।
হিমাঃ ভাল করেছো। আজই রান্না করবো নাকি কাল?
আমিঃ রান্না করবে? রান্নায় ঝামেলা পোহাবে কে? এই ভরদুপুরের গরমে চুলোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে কে?
হিমাঃ আমি?
আমিঃ তাইলে রান্না করবেন কিনা এই সিদ্ধান্তটাও আপনার।
হিমা মুচকি হেসে, আমার হাত থেকে মাছের পলিথিনটা নিয়ে সোজা হাঁটা দিলো রান্নাঘরে। “গোসল সেড়ে নামাজ আদায় করে আসেন জনাব” কিছুটা চেচিয়ে বলল হিমা। “হ্যাঁ যাচ্ছি যাচ্ছি” আমিও কিছুটা চেচিয়ে বলে চলে গেলাম গোসলে। নামাজ আদায় করে বাসায় ফিরেছি। হিমা নামাজ আদায় করছে আর আমি বিছানায় বসে তা দেখছি ওর নামাজ আদায় শেষ হলেই খেতে বসবো দুজন মিলে। খাবার খাওয়ার মাঝে স্পষ্ট ভাবে খেয়াল করলাম হিমার খেতে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু ওরে জিজ্ঞেস করতেই, “আরে না কষ্ট হচ্ছে না, তুমি কি আমাকে এখনো পিচ্চি মনে করো নাকি?” আমি হেসে দিলাম কিছু বলিনি। ভাবছি পিচ্চি কিভাবে ভাববো!
স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট হলেও খেয়ে নিচ্ছে যতোটা পারছে কষ্ট ঢেকে রাখার চেষ্টায় সে ব্যাস্ত, তাকে পিচ্চি ভাবাটা আমার জন্য পিচ্চিসুলভ চিন্তা হয়ে যাবে যে। মেয়েটা আমার জন্য যে কতটা ত্যাগ শিকার করেছে তা আমি আন্দাজ করতেও পারবো না। বিয়ে করেছে নিজের বাবাকে কতো বুঝিয়ে যে সুখী হবে সে, তারপর আমার এরকম পরিস্থিতিতে আমাকে দিন দিন অভয় দিয়ে যাচ্ছে, আমার কষ্ট কমাতে নিজের সব ইচ্ছের হত্যা, প্রভাবশালী বা বিত্তবান আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখা, কোনো রকম আবদার না করা, যা হবে তাতেই সুখের সর্বোচ্চ ঠিকানা খুজে নেয়া। মাঝে মাঝে নিজেরই কষ্ট হয় যে কেনো এই মেয়েটারে নিজের সাথে জড়ালাম আমি! আমার জন্যই তো এতো কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে ওর কিন্তু তারপর আর ভাবতে পারিনা। কয়েকদিন পরে অফিসে বসে আছি হঠাৎ হিমার ফোন,
হিমাঃ আস-সালামুয়ালাইকুম।
আমিঃ ওয়ালাইকুম আস-সালাম। জনাবা কেমন আছেন?
হিমাঃ আল-হামদুলিল্লাহ আপনি?
আমিঃ আল-হামদুলিল্লাহ। এতো খুশি খুশি লাগছে এর কারণ?
হিমাঃ বাসায় এসো জলদি কথা আছে।
আমিঃ আচ্ছা। আমিও অফিস শেষ করে চলে গেলাম বাসায়। এই মুহূর্তে হিমার সামনে বসা আমি আর সে বসা মাটিতে(ফ্লোরে)।
হিমাঃ সেদিন যে চাকরির জন্যে ইন্টারভিউ দিয়ে আসলাম ওইটা হয়ে গেছে আমার। (মুখ ভার করে)
আমিঃ তাইলে তো খুশির খবর এতে তুমি মুখ ভার করে আছো কেন?
হিমাঃ তুমি যদি খুশি না হও তাই।
আমিঃ আরে সমস্যা কি! কোনো সমস্যা নেই আমি খুশি।
হিমাঃ সত্যি?
আমিঃ হুম।
হিমাঃ তাইলে আমি চাকরিটা করছি?
আমিঃ তোমার যদি ভালো লাগে তবে করতে পারো।
হিমাঃ আচ্ছা আমি তাইলে বোরকা পরে অফিস যাওয়া আসা করবো পর্দার সাথে চাকরি করবো। তুমি সব সময় আমার পাশে থেকো প্লিজ?
আমিঃ হুম অবশ্যই সোনা।
নিজের কাছে কষ্ট লাগছে যে ও চাকরি করবে কিন্তু এই কষ্ট স্থায়ী ভাবে পুষে রাখতে চাইনা আমি। দুটো কারণে তা চাইনা; এক, তার ইচ্ছেতে হস্তক্ষেপ করতে চাইনা। দ্বিতীয়, ইসলামে নারীরা পর্দার সাথে চাকরি বা দূর দূরান্তে গিয়ে পড়াশোনা করতেও পারবে এটা ভেবে। আর হিমা কতটা বুঝতে চেষ্টা করছে আমায় তা দেখে আমি ওর প্রতিদান কিভাবে দিবো বুঝতে পারিনা। সে একবারও আমাকে বলেনি যে এই ভাবে তার সংসার করতে কষ্ট হয় এজন্য সে চাকরি নিচ্ছে! অথচ চাকরি পাওয়ার পরেও সে আমার মতের জন্য নিজের ইচ্ছে বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলো। আমার খশিতে সে চাকরি করবে নয়তো না।
কি ভালবাসা কতটুকু ভালবাসা আমি তাকে দিয়েছি জানিনা তবে ওর ভালবাসার কাছে ঋণী হয়ে যাচ্ছি দিন দিন দুবছর পরে, হিমা অফিস থেকে আমার আগেই আসে। আজ বাসায় গিয়ে দেখি সে দরজায় একটা পেপার লাগিয়েছে তাতে লিখা। খান সাহেবের ঠিকানা, দরজা খুলে ভিতরে গিয়ে দেখি ঘর অন্ধকার। “হিমা কই তুমি লাইট অফ করে আছো কেন?” আমার কথায় কোনো সাড়া শব্দ নেই ঘরের ভিতর ঢুকতে অন্ধকারে কে যেনো দরজা লাগিয়ে দিলো। হয়তো কোনো বাচ্চার অবয়ব ছিলো কিছুটা ভয় পাচ্ছি কারণ বাচ্চা আসবে কোথা থেকে তাও এই অন্ধকার ঘরে! হঠাৎ লাইট জলে উঠলো আর আমার বাবা-মা, বোন, দুলাভাই সাথে ভাগ্নে-ভাগ্নী সবাই উচ্চস্বরে বার বার বলছে জন্মদিন শুভ জন্মদিন তোমার।
আমি অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে আছি কিছু বলছি না। আজ জন্মদিন ছিলো তা মনে ছিলো কিন্তু এভাবে উপহার পাবো বুঝিনি। পরে জানতে পারি এসব হিমার বুদ্ধি ওই এসব করেছে। ওর চাকরির শুরুতে আমাকে অনেকেই বলেছে বউরে চাকরি করতে দিয়েন না পরে সমস্যা হবে হ্যান ত্যান কিন্তু আমি আমার বউয়ের প্রতি যে বিশ্বাস স্থাপন করেছি তার মর্যাদা হিমা রেখেছে। সে আজও বিয়ে করে প্রথম যেভাবে তাকে এনেছি ঠিক সেরকম আছে নিজের চাকরি করার জন্য বিন্দুমাত্র পরিবর্তন তার মাঝে নেই। তার সাথে ওর ভাবখানা এমন যেনো ও এখনো আমার উপর নির্ভরশীল। উপরওয়ালার কাছে লাখো লাখো শুকরিয়া মধ্যবিত্ত বানিয়েছেন আর এতো সুন্দর ভাগ্য দান করার সাথে এই আদর্শ পরিবার আমাকে দান করেছেন, কারণ এই তিনটি বিষয়ই আমার এই ভাল সময়ের জন্য মূখ্য।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত