ভদ্র মহিলা আমার চেম্বারে ঢুকেই হকচকিয়ে গেলেন। সম্ভবত আমাকে এখানে আশা করেননি। চেয়ার টেনে বসতে বসতে খুব অবাক হয়ে বললেন, ” আপনিই বিখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর মুনিরা ম্যাডাম ?!! আমি হেসে দিয়ে বললাম, ” বিখ্যাত নই, তবে আমিই ডাক্তার মুনিরা, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ।
ভদ্র মহিলা খুব লজ্জা পেয়ে বললেন, ” কি যে বলেন। এই শহরে সবাই আপনার নাম জানে। আমার কখনো ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন পড়েনি, তাই আমিই আপনাকে চিনতে পারিনি। ” এতক্ষণে তার লজ্জা পাওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারলাম। গত মাসেই আমরা নতুন ফ্ল্যাট এ উঠেছি। ফ্ল্যাট বাসা একটু বেশি নিরাপদ মনে হয়। তাই শহরের নামকরা টাওয়ার এ একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেললাম। নিজেদের বাড়িটা ভাড়া দিয়ে গতমাসেই ফ্ল্যাট এ উঠেছি। আমার স্বামী ডা. রাশেদ বললো, ” মুনি, তুমি কিন্তু খুব অসামাজিক। সারাক্ষণ হাসপাতাল আর চেম্বার নিয়ে ব্যস্ত থাকো। আশেপাশের মানুষজনের সাথে একদমই মিশতে পারো না। ফ্ল্যাট বাসাতে আশেপাশের সবার সাথে একটু পরিচিত হতে হয়। “
কথা সত্যি। আমি মানুষজনের সাথে নিজ থেকে তেমন মিশতে পারি না। সত্যি কথা বলতে কি, মেশার তেমন সময়ও পাই না। অফিস, চেম্বার, ছেলে মেয়ে, সংসার এসব নিয়ে সময় কোনদিক দিয়ে চলে যায়, টেরই পাই না। তাই কারো বাসায় যাওয়ার বা কারো সাথে বসে গল্প করার সময় পাই না। কিন্তু রাশেদ এটা ঠিক পছন্দ করে না। সে সবার সাথে গল্পগুজব, আড্ডা দেওয়া বেশ পছন্দ করে। রাশেদের পরামর্শ মতোই একদিন পাশের ফ্ল্যাটে পরিচিত হতে গেলাম। কলিং বেল বাজিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ পরে কাজের মহিলা দরজা খুললো। তাকে বললাম, ” আমরা পাশের ফ্ল্যাটে নতুন এসেছি। ভাবিকে বলেন, তার সাথে দেখা করতে চাই। ” কাজের মহিলা আমাকে দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখে ভিতরে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বললো, ” ম্যাডাম ঘুমাচ্ছেন, এখন দেখা করা যাবে না। “
আমি বেশ অবাক হয়ে চলে এসেছিলাম। ভাবলাম, সত্যি সত্যিই হয়তো ঘুমাচ্ছেন। তাই দুই তিনদিন পরেই আবার একবার গেলাম। মুল উদ্দেশ্য ছিল, রাশেদকে বোঝানো যে, আমি অসামাজিক নই। এবার আসলেই অবাক হলাম। এবার কাজের মহিলা ভিতর থেকে এসে বলে দিল, উনি ব্যস্ত আছেন, দেখা করতে পারবেন না। রাগ না হয়ে মনে মনে খুশি হয়েছিলাম এই ভেবে যে, এরপর রাশেদ আর কখনো আমাকে কারো সাথে মিশতে পারিনা বলে টিজ করতে পারবে না। এরপর ভদ্র মহিলার সাথে মাঝে মাঝেই লিফট এ দেখা হয়েছে। বেশ গর্জিয়াস চেহারা মহিলার। সব সময় দারুণ ফিটফাট থাকেন। মেয়েকে যখন স্কুলে দিতে যান, তখনও দেখে মনে হয়, কোন পার্টিতে যাচ্ছেন। জমকালো শাড়ি, মেকাপ সব সময়। দামী পারফিউম এর গন্ধে লিফটা মৌ মৌ করে। মহিলা জব করেন কিনা জানি না। তবে টাকা পয়সা যে ভালোই আছে, সেটা শাড়ি দেখলেই বোঝা যায়। খুবই দামী দামী শাড়ি, অর্নামেন্টস পরেন।
সেদিন ব্যস্ততার দোহায় দিয়ে দেখা করে নাই। তাই আমিও আর লিফট এ হাই, হ্যালো করে পরিচিত হই না। সেও করে না। কিন্তু যেটা বিরক্তকর লাগে, সেটা হলো তার দৃষ্টি, তার ভাবসাব। মনে হয়, সে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এর স্ত্রী অথবা ভিন গ্রহের কোন এলিয়ন আর আমরা পৃথিবীর ঘৃন্য মানবজাতি। হতে পারে, তার মত সব সময় খুব দামী ড্রেস পরে থাকি না বা তারমত সাজগোজ করে থাকি না বা তারমত চামড়া ফর্সা নয় আমার। কিন্তু তাই বলে মানুষের দৃষ্টি এমন হবে কেন, যেখানে আর একজনকে মানুষ বলেই মনে হবে না ? আমি ইগনোর করি। এটা তার ব্যর্থতা, সে তার দৃষ্টিকে সুন্দর করে নাই। এটাতে আমার রাগ করার কিছু নেই। এজন্যই আজ সে আমাকে এখানে দেখে অবাক এবং লজ্জিত হয়েছে। আমি তার প্রতি আমার মনোভাব বুঝতে না দিয়ে, অন্য রোগীদের যেমন হাসিমুখে দেখি, তাকেও তেমনি দেখে দিলাম। ফিস যখন দিতে গেল, বললাম, ফিস বাইরে আমার এসিস্ট্যান্ট এর কাছে দিবেন। কিছুক্ষণ পরেই সে আবার আমার রুমে ঢুকলো। আমি হাসি মুখে বললাম,
– কিছু বলবেন ?
– আপনার এসিস্ট্যান্ট আমার কাছে এক হাজার টাকা চাচ্ছে।
– জ্বি, আমার ফিসতো এক হাজার টাকাই। বাইরে লেখা আছে, নতুন রোগী এক হাজার টাকা।
– না, মানে, আমি তো আপনার প্রতিবেশী। আমাদের তো ফ্রি ই হওয়া উচিত। সেখানে কিছু কনসিডার তো করবেন।
আমি মনে মনে হাসলাম। আমি জানি, সেদিন যদি সে ভদ্রতা করে অন্তত দরজার সামনে এসে হলেও আমার সাথে কথা বলতো, তাহলে শুধু তাকে কেন, তার চৌদ্দ গোষ্ঠীকে আমার ফ্রি দেখতে হতো। এবং দিনে বা রাত একটা দুইটায়, বাসায় এসে বা মোবাইলে – ছোলার ডাল খাবো না মসুরের ডাল খাবো ? পায়খানা নরম হলো কেন বা কষা হলো কেন ? চিনি দিয়ে চা খাব না চিনি ছাড়া চা খাব ? এইসব হাবিজাবি বিষয়ে পরামর্শ দিতে হতো।
আমি হাসি মুখে বললাম, ” আপনি বোধ হয় খেয়াল করেননি, দরজার সামনে লেখা আছে। আমি ফ্রি রোগী দেখি শুধু মাত্র শুক্রবারে। গরীব রোগীদের জন্য সম্পূর্ণ ফ্রি। কিন্তু তার জন্য আগে থেকে টিকিট কালেক্ট করতে হয় আমার এসিস্ট্যান্ট এর কাছ থেকে। কিন্তু আপনি এই পোশাকে আসলে তো সে ঐ টিকিটও আপনাকে দেবে না। ড্রেস চেন্জ করে আসতে হবে। ” ভদ্র মহিলা এবার আমার দিকে এমন অবাক হয়ে তাকালেন, যেন উনি নন, আমিই এলিয়ন।
গল্পের বিষয়:
গল্প