আজ সোবহান সাহেবের দ্বিতীয় বিয়ে। মানুষের প্রথম বিয়ে যেমন ধুমধাম করে হয় দ্বিতীয় বিয়ে তেমন হয় না। সোবহান সাহেবের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে। বিয়েতে রসকস নেই, বাদ্য-বাজনা নেই, সাদামাটা বিয়ে! তারিন অবশ্য চেয়েছিল বাবার বিয়ে খুব আয়োজন করে হোক। বিয়েতে ঘর ভর্তি লোকজন আসুক। সানাই বাজার সাথে সাথে ফুফুরা ভাইয়ের গায়ে হলুদ মাখুক। তারিনের ছোট দুই ভাই বোন ‘রৌদ্র’ এবং ‘রোদেলা’ আনন্দ উৎসাহে ছোটাছুটি করুক। বড় মেয়ে হিসেবে যে দায়িত্বটা পালন করবে বলে ভেবে রেখেছিল সেই দায়িত্বটা আর পালন করা হলো না।
বিয়ের দিনে সকাল থেকে সোবহান সাহেব গম্ভীর হয়ে আছেন। আগে কখনও তাকে এতটা গম্ভীর থাকতে দেখা যায়নি। উনার প্রথম স্ত্রী শাহনাজ বেঁচে থাকতে তিনি মন খুলে হাসতেন। সেই হাসির শব্দ বাড়ির সামনের চায়ের দোকান থেকে শোনা যেত। সকালবেলা নিউজপেপারের গুরুত্বপূর্ণ খবর বাড়ির সবাইকে উচ্চস্বরে পড়ে শুনাতেন। শুক্রবার বড় রকমের বাজার করে আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত করে খাওয়াতেন। এখন আর তিনি হাসেন না, প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেন না। হঠাৎ হঠাৎ বড় মেয়েকে ‘তারু’ ‘তারু’ বলে ডাক দিয়ে আগের মতো বলেন না, “মামুনি তোর কোনো কাজ না থাকলে আমাকে এক কাপ চা করে দে!” সুন্দর সময় সুন্দর হয়ে চলে গেছে, দিন বদলে গেছে। শাহনাজ বেগমের মৃত্যুর সময়কাল একবছর দু’মাস পেড়িয়ে গেছে। সোবহান সাহেবও একসময় স্ত্রী শোক ভুলে দ্বিতীয় বিয়েতে মত দিয়েছেন।
তারিন আজ চোখে গাঢ় করে কাজল পরল। ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপিষ্টিক দিল। বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার সময় আগেও যেমন হালকা সাজগোজ করতো আজও তেমনি করল। হোক না সেটা তার বাবার বিয়ে তাতে কী আসে যায়? সে আলমারির ড্রয়ার খুলে মায়ের ছোট কানের দুল জোরা বের করে পরল। মায়ের পছন্দের কালো রঙের শাড়ির সাথে সবুজ শালটা শরীরে জড়াল। এখন মায়ের শরীরের গন্ধ যেন ধীরে ধীরে তার নাকে স্পষ্ট হয়ে আসছে।
বাইরে সানাই বেজে উঠেছে। সানাইয়ের লোকজন কে খবর দিল? তারিনের মেজ ফুফু এই কাজটা করেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মেজ ফুফু হাসিখুশি, রসিক মানুষ। তার রসিকতার মাত্রা এতই তীব্র যে তার স্বামীর মৃত্যুর দ্বিতীয় দিনই নাকি পাড়াপড়শির সাথে তাকে হাসিতামাশা করতে দেখা গেছে। তবে সেটা কতটুকু সত্যি তারিন জানে না। আজ তো ফুফুর ভাইয়ের বিয়ে। আশ্বিন মাসের হালকা শীত। অথচ আষাঢ় মাসের মত টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। তারিনের হৃদয়ের ভিতরে ঝড়-তুফান বইছে। সেই অবস্থায় ঘর থেকে বের হয়ে সে বলল, “ফুফু বাবা বউ নিয়ে এসে পড়েছেন নাকি?” ফুফু বললেন, “বাহ ! তারিন তোকে তো খুব সুন্দর লাগছে। কপালে টিপ পরলি না কেন? কালো শাড়ির সাথে লাল একটা টিপ পরতি।”
তারিন হেসে বলল, “ফুফু শুধু সানাই বাজছে কেন? ব্যন্ডপার্টি কই?” ফুফু উৎসাহিত কন্ঠে বললেন, “তুই সবকিছু এত সহজভাবে মেনে নিচ্ছিস আমার খুবই ভালো লাগছে তারিন। তোর জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলে চাচা-ফুফুদের সাথে ঝগড়া করতো। বাবার গায়ে থুঁ থুঁ ছিটাত।” “যার হায়াত শেষ হয়ে গেছে সে চলে গেছেন ফুফু। তাই বলে জীবন তো আর থেমে থাকবে না। বাবা একজন পুরুষ মানুষ তার মানসিক এবং শারীরিক উভয় শান্তির প্রয়োজন।” ফুফু তারিনের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বললেন, “তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে তুই হঠাৎ করেই বড় হয়ে গেছিসরে তারিন। তোর এখন বয়স কত?”
“সেপ্টেম্বরের পনেরো তারিখ ঊনিশ বছর পূর্ণ হবে।”
“রৌদ্র আর রোদেলা কে ‘নীলিমা’ আপন করে নিলেই আমি তোর জন্যেও ভালো ছেলে দেখব।”
“আমাদের নতুন মায়ের নাম বুঝি নীলিমা?”
“হ্যাঁ।”
“সুন্দর নাম। আমাদের পুরোনো মায়ের নাম ছিল ‘শাহনাজ’। পুরোনো মায়ের পুরোনো দিনের নাম। নতুন মায়ের নামটাও নতুন।” – বলেই সে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল। তারিনের সাথে ফুফুর কথার মাঝখানেই সোবহান সাহেবের বিয়ের গাড়ি চলে এল। তারিন একবার বাবার বিয়ের গাড়ির দিকে তাকিয়ে দূরে মায়ের কবরস্থানের দিকে চোখ রাখল। তার চোখ ছলছল করে উঠল।
‘নীলিমা বেগম’ বউ হয়ে বাড়িতে পা রাখার পর থেকে তারিন বাবার সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলা বন্ধ করে দিল। ভার্সিটির সেমিস্টারের টাকা পয়সা সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া আর কোনো কথা শেষ কবে বলেছে তার মনে পরল না। সময় সময়ের মত পাড় হয়ে গেলেও সে তার গর্ভধারিনী মায়ের স্থানটা অন্য কাউকে দিতে পারছে না। রৌদ্র আর রোদেলা অন্যকাউকে যখন আম্মু বলে ডাকে তার সমস্ত শরীর শিউরে উঠে। রোদেলা রৌদ্রের চেয়ে এক বছরের ছোট আর তারিন রৌদ্রের চেয়ে ন’বছরের বড়। রোদেলার জন্মের পর থেকেই শাহনাজ বেগম অসুস্থ দিন কাটিয়েছেন। এমন কোনো অসুখ বাকী ছিল না যে তার শরীরে বাসা বাঁধেনি। সেই অসুস্থ শরীরে ছোট ছেলেমেয়েকে নিয়ে তিনি স্কুলে যেতেন, সেখান থেকে প্রাইভেট টিউটর এর কাছে পড়তে নিয়ে যেতেন। বাসায় এসে আবার রান্নাবান্নাসহ সব কাজকর্মগুলো করতেন।
তারিন ছোটবেলা থেকেই বদমেজাজি এবং অলস প্রকৃতির মেয়ে। কখনও এক গ্লাস পানি ঢেলে খেতেও যেন খুবই কষ্ট হত তার। সকালে নাশতা না করে কলেজে চলে যেত। রাতের খাবার খেতে খেতে বারোটা-একটা বাজিয়ে দিত। শাহনাজ বেগম অসুস্থ গলায় বড় মেয়েকে নিজের শরীরের খেয়াল রাখতে বলতেন, ভাই বোনদের পড়াশুনার খোঁজ খবর নিতে বলতেন, বাড়ির ছোটবড় কাজকর্মে হাত দিতে বলতেন। সেই কথা কোনোদিনও গুরুত্ব সহকারে সে শোনেনি! কিন্তু আজ সে সবই পারে একা একা করতে। একটা বছর ধরে সে রোদেলা আর রৌদ্রকে স্কুলে দিয়ে আসছে। রান্নাবান্না করতে গিয়ে তরকারিতে লবন কম দিচ্ছে বা হলুদ বেশী দিয়ে ফেলছে। ভার্সিটির ক্লাশ করে দুটো টিউশুনি করে বাসায় ফিরছে। দিনশেষে ক্লান্ত হয়ে রাতেরবেলা কাঁদতেও ভুলে যাচ্ছে। কান্না না করতে পারার যন্ত্রনাটা আরো যন্ত্রনাময় হয়ে শরীরে বাসা বাঁধতে বাঁধতে একসময় তাকে পাথর করে দিয়েছে। আজ সে হাসিমুখে তাই নতুন মায়ের বরন করেছে।
শাহনাজ বেগমের মৃত্যুর পর থেকে শুধু যে তারিন বদলে গেছে তা কিন্তু নয়। বদলে গেছে বাড়ির অবস্থা। বদলে গেছেন সোবহান সাহেব। বদলে গেছে তারিনের চাচা আর ফুফুদের ব্যবহার। রৌদ্র আর রোদেলা’র দিকে তো তাকানোই এখন কষ্টকর। প্রায় ছ’মাস ধরে সোবহান সাহেবকে বিয়ে করানোর জন্য তার ভাই বোনেরা জীবন দিয়ে দিচ্ছেন। এতদিন কী ভেবে তিনি রাজি হননি কে জানে? হয়ত কারনটা ছিল তারিন। এতবড় মেয়ের সামনে তার বিয়ে করাটা কি লজ্জাকর ছিল? নাকি শাহনাজের স্মৃতি তাকে ডুকরে ডুকরে খেত? একটা সময় গিয়ে তিনি রাজি যখন হয়েই গেলেন আগে রাজি হলে কী এমন অপরাধ হত? এমন হাজারটা প্রশ্ন মনে জেগে উঠে তারিনের।
বাবার বিয়ের কারনে নয়, তার মন খারাপের কারন আজ ভিন্ন। নীলিমা বেগমকে শাহনাজ বেগমের শাড়ী চুড়ি দেওয়া হয়েছে। সেগুলো সে পরে বাসার মধ্যে হাঁটবেন। চুড়ির রিনিঝিনি আওয়াজ করবেন। এই ঘর এই সংসার তিনি আপন করে নেবেন। যা তাকে প্রত্যেক মুহূর্তে কষ্ট দিবে। যেই কষ্টের কাছে তার মৃত্যু যন্ত্রণা সহজ বলে মনে হবে। মৃত্যুর কথা মনে হতেই হাসপাতালে মায়ের অসুস্থ অক্সিজেন মাক্স লাগানো চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠল। মায়ের বলা শেষ কথাগুলো কানের কাছে যন্ত্রের মত বাজতে থাকল। তারিন যে মাকে কথা দিয়েছিল, ভাই বোনদের ছেড়ে কোনো অবস্থায় কোথাও যাবে না। রৌদ্র আর রোদেলা’র সকাল-বিকেল ‘আম্মু’ ডাককে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করল সে। ছোট মানুষ ওরা। কি দরকার এই বয়সে ‘মা’ আর ‘সৎ মায়ের পার্থক্যর পোঁকা মাথার ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়ার? বহুদিন পর ওরা কাউকে ‘আম্মু’ ডাকতে পেরে যেন আনন্দের সীমা নেই। সেই আনন্দ সে নষ্ট করতে চাচ্ছে না। তবে ‘নীলিমা’ বেগমকে সে আন্টি বলেই সম্বোধন করে।
‘নীলিমা বেগম’ স্কুল শিক্ষিকা মানুষ। সোবহান সাহেবের সাথে বিয়ের আগে তিনি অন্যের স্ত্রী ছিলেন। তার আট বছরের ‘জেরিন’ নামের এক মেয়েও আছে। বিয়ের রাতে শুধু এক ঝলক তারিন তাকে দেখেছে। তবে পূর্বের স্বামীর সাথে নীলিমা বেগমের কেন ডিভোর্স হল মাঝেমধ্যে সেই বিষয়টা তার জানতে খুব ইচ্ছে করে। তিনি বাড়িতে আসার পর থেকে তারিন যান্ত্রিক জীবন ইচ্ছে করেই অনেকটা কমিয়ে দিয়েছে। ভাই বোনদের চোখে চোখে রাখলেও তাদের সব দায়িত্ব ‘নীলিমা বেগমকে’ বুঝিয়ে দিয়েছে।
দিনদিন তারিনের সৎ মা সম্পর্কে যে ধারণা ছিল সব তার উল্টো হতে লাগল। তিনি রৌদ্র এবং রোদেলাকে খেয়াল রাখার পাশাপাশি তারিনকেও ‘আম্মু’ ‘আম্মু’ করত। তারিনের এইসব বিষয় তখন অভিনয় মনে হত। প্রত্যেক সৎ মা শুরুর দিকে ভালো থাকলেও একটা সময় গিয়ে ঠিকি আসল চেহারা দেখিয়ে দেন। দিনের পর মাস পেড়িয়ে গেল। নীলিমা বেগমের আসল চেহারার পরিবর্তন এল না। বরং সংসারের প্রতি তার দায়িত্ব কর্তব্য যেন ভালোবাসায় পরিনত হচ্ছে। কারন ছাড়াই তিনি তারিনের ঘরে চলে আসতেন। কখনও শরীরের খবর নিতেন তো কখনও পড়াশুনার খবর নিতেন। একদিন রাতে কী মনে করে তিনি চিরুনী নিয়ে তারিনের ঘরে গিয়ে বললেন, “তোমার চুলের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে। এসো আমি চুলে তেল লাগিয়ে দেই। কাল আবার সেম্পু করে ফেলো।” তারিন সাথে সাথে রেগে গিয়ে বলল, “আপনাকে না বলেছি আমার কাছ থেকে দূরে থাকবেন। বলেছি কী বলিনি?”
“বলেছ।”
“তাহলে হুটহাট করে আমার ঘরে ঢুকে পড়েন কেন? রৌদ্র আর রোদেলার খেয়াল রাখছেন সেই যথেষ্ট।”
“তুমিও আমার মেয়ে। তোমার খেয়ালও রাখা দরকার।”
তারিন ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলল, “আমার কাছ থেকে দূরে থাকবেন আন্টি। আমার মায়ের জায়গা নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করবেন না।” “শুধু শুধু আমি তোমার মায়ের জায়গা নিতে চাইব কেন? যিনি তোমার মা ছিলেন তিনিই তোমার মা থাকবেন। সেটা ইহকালে হোক কিংবা পরকালে। আমি শুধু চাই তোমার ভাই বোনদের মত তুমিও আমাকে আপন করে নাও।” “রৌদ্র আর রোদেলা এখনও ছোট তাই ‘মা’ আর ‘সৎ মায়ে’র পার্থক্য বোঝে না। যেদিন বুঝতে পারবে সেদিন আর আপনাকে মায়ের জায়গা দিবে না।”
“তারিন পার্থক্য তুমিও বোঝো না। মা তো মা হয়। সৎ মা বলতে কিছু নেই, সবসময় রক্তের সম্পর্কই সবকিছু না।”
“যথেষ্ট জ্ঞান দিয়েছেন। এবার আপনি আসতে পারেন।” নীলিমা বেগম সেদিনের মতো চলে এলেন। তারিন তখনও রাগে ফোপাঁতে লাগল। আজ সকালে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়ছে! ভার্সিটিতে যাওয়ার উদ্দেশ্য তারিন রিকশায় উঠে শালটা শরীরে ভালো করে জড়িয়ে নিল। আনমনে নানারকম তার ভাবনা চলে আসছে। মা তাকে সবসময় বড়দের সাথে তর্ক করতে নিষেধ করেছেন সেই কথা গতরাতে সে রাখতে পারে নি। তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। নীলিমা বেগম তো সব সৎ মা’য়ের মতন নাও হতে পারেন। এমনটা কী হতে পারে না? সে ভার্সিটি থেকে ফিরল দুপুরবেলা। বাড়িতে আট ন’বছরের এক মেয়ে কান্নাকাটি করছে। নীলিমা বেগম তার সামনে ভাত নিয়ে বসে খাওয়ানোর চেষ্টায় আছেন।
“লক্ষী সোনা চাঁদের কণা মামুনি আমার। এই যে ‘মা’ ভাত মেখেছি এখন ভাত মুখে দাও। আর যাবে না আম্মু তোমাকে ছেড়ে।”
“প্রমিজ?”
“তিন প্রমিজ।”
মেয়েটি ভাত মুখে তুলল। তারিনের বুঝতে বাকি রইল না মেয়েটি নীলিমা বেগমের মেয়ে। তার অসম্ভব রাগ লাগল। সোবহান সাহেব বহুদিন পর বসার ঘরে বসে পত্রিকার পাতা উল্টাচ্ছেন। তারিন ঝড়ের গতিতে তার সামনে গিয়ে বলল, “এসব কী হচ্ছে বাবা বাড়িতে? ওই মেয়েটা কে?” বাবা তারিনের দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলেন,
“তুমি তাকে চেনো না, সে কে?”
“না চিনি না।”
“তোমার আন্টির মেয়ে। মাকে ছাড়া থাকতে পারে না তাই সে নিয়ে এসেছে। রোদেলার ঘরে থাকবে তোমাকে বিরক্ত করবে না।”
“এখন থেকে এই বাড়িতেই থাকবে?”
“হ্যাঁ”
“তুমি তোমার প্রথম স্ত্রী’কে ভুলে যেতে পারো বাবা। আমি আমার মা’কে ভুলে যেতে পারি না। এভাবে আমি একই ছাদের নিচে থাকতে পারব না।”
“আমি তোমার মা’কে ভুলে গেছি কথাটা ভুল। বরং তোমার মা মারা যাওয়ার পর থেকে আমি কীভাবে বেঁচে আছি। সবকিছু কিভাবে মেনে নিচ্ছি তা কখনও তুমি বুঝতে চাওনি।” “তা তো দেখতেই পাচ্ছি বাবা। তোমার নতুন স্ত্রী, নতুন মেয়ে আর নতুন সংসার দেখে।” সোবহান সাহেব চুপ হয়ে আবার পত্রিকার পাতা মুখের সামনে ধরলেন। তারিন নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। কান্নার নিঃশ্বাসের সাথে সাথে বলতে লাগল, “মা! আমাকেও তুমি নিয়ে যাও মা! তোমার কাছে আমাকেও নিয়ে যাও।” রোদেলার রাতে ঘুম আসছে না। সে কিছুক্ষণ বিছানায় টেডিবিয়ার নিয়ে এপাশ-ওপাশ করল। তারপর বড় বোনের ঘরের দরজায় টোকা দিল। তারিন বলল, “কে?”
“আমি আপু”
“আমার ঘরে আসতে তোর আবার দরজা টোকা দিতে হয় নাকি? আয় ভিতরে আয়।”
রোদেলা ভিতরে এল। “তোমার মেজাজ খিটখিটে থাকে আপু তাই কোনো কথা বলতে ভয় করে।” তারিন অবাক হয়ে বলল, “কখন দেখলি আমার মেজাজ খিটখিটে?” “সেদিন রাতে আম্মুর সাথে চেঁচামেচি করেছ আজ আবার আব্বুর সাথে।” তারিন চুপ করে থেকে বলল, “তোর হাতের টেডিবিয়ার টা তো সুন্দর। কে কিনে দিয়েছেন, বাবা?”
“না। আমাদের যে নতুন বোনটা এসেছে সে কিনে দিয়েছে। ওর নাম জেরিন। জানো ওর অনেকগুলো পুতুল।”
তারিন তখন অদ্ভুত একটা কাণ্ড করে বসল। রোদেলার গালে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে বলল, “নতুন বোন কিরে? ও আমাদের বোন টোন কিছু না। ওর বাবা মা আর আমাদের বাবা মা কি এক?” রোদেলা তখন চাঁপা স্বরে কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে গেল।
তারিন এখন ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে। সে নিজের কথা ভেবে নিজেই অবাক হয়। এইতো কিছুদিন আগের কথা। কত সুন্দর একটা পরিবার ছিল তার। রোদেলাকে মারার জন্য বাবা তাকে খুবই বকাঝকা করলেন। জেরিনকে পরিবারের সদস্য হিসেবে মেনে নিতে বললেন। তখন সে নিশ্চুপ হয়ে রইল। আজকাল প্রায়ই তার আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসে। কিন্তু ভাইবোনদের কথা ভেবে সেই ইচ্ছেকে আবার মনের মাঝে দাফন করে ফেলে। বহুদিন পর তার মনের মাঝে সামান্য চিন্তা এল নীলিমা আন্টি মানুষ হিসেবে ভালো। কিন্তু তাকে ‘মা’ ডাকা সম্ভব নয়। কিভাবে সম্ভব হবে? সবকিছু তো সবার জন্য এত সহজ নয়। অনেকেই অনেক কিছু মেনে নিতে পারে আবার অনেকে পারে না। তারিন তার একমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বন মানুষটাকে হারিয়ে ফেলেছে। সেই মানুষটাকে যে নামে ডাকত সেই নামে কি অন্য কাউকে ডাকা যায়?
জেরিনকে নিয়ে আজ পরিবারের সদস্য পাঁচজন থেকে ছ’জন হয়েছে। রৌদ্র, রোদেলা এবং জেরিন একই ঘরে পড়াশুনা করতো, নানারকম খেলনা নিয়ে খেলতো আবার একজন আরকজনের জামা টান দিয়ে ছুটাছুটি করে হিহি করে হাসিতে বাড়ি মাথায় তুলত। তারিনকে ওরা কেউই বিরক্ত করতো না। হঠাৎ করেই যেন সে একা হয়ে যায়, নিজের মাঝে শূন্যতা অনুভব করে। নীলিমা আন্টি পূর্বের মতই তার ঘরে এসে কিছু লাগবে কিনা জানতে চেয়ে চলে যান। তারিন যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখনই সোবহান সাহেবও একবার তার ঘরে আসেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘুমন্ত মেয়েকে দেখেন। তারপর কাঁথাটা শরীরে টেনে দিয়ে চুপিচুপি চলে যান। তারিন না ঘুমিয়ে এই ব্যপারটা ঠিকি বুঝতে পারে।
একসময় তারিন আরও বুঝতে পারে এই পরিবারে তার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু সবকিছু থেকেও কী যেন নেই। সেই সবকিছুর মাঝে তারিন মায়ের ঘ্রাণ, মায়ের বকুনি আর ভালোবাসা খুঁজে বেড়াচ্ছে। এই শূন্যতা কি কখনো সে কাটিয়ে উঠতে পারবে? নীলিমা বেগম যে স্কুলের শিক্ষিকা সেই স্কুলেই রৌদ্র আর রোদেলা পড়ে। আর হ্যাঁ জেরিনও! শাহনাজ বেগমের মৃত্যুর পর ভাই বোনদের স্কুল বদলানোর পাশাপাশি আজ বদলে গেছে পড়াশুনা, খাবার এবং ঘুমানোর রুটিন। যিনি চলে গেছেন তিনি সাংসারিক মহিলা ছিলেন আর যিনি সংসারে এসেছেন তিনি চাকুরিজীবী। সবকিছুতে পরিবর্তন আসাটাই স্বাভাবিক।
এক পড়ন্ত বিকেলে তারিন মন খারাপ করে পার্কে খানিকটা সময় একা একা হাঁটল। হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা পেড়িয়ে গেল। তখনই তার মনে হল মা আজ বেঁচে থাকলে এত বেলা পর্যন্ত বাইরে থাকার জন্য কত কথাই না শুনাতেন। মাগরিবের আযানের পরপরই সে বাড়িতে ঢুকল। সাথে সাথে নীলিমা বেগম তাকে খানিকটা কড়া গলায় বললেন, “তারু তুমি প্রতিদিন টিউশুনি করে পাঁচটার মধ্যে বাড়িতে ফিরে আসো। আজ এত দেরি করলে কেন?”
“আপনি জেনে কী করবেন? আর আপনি আমাকে ‘তারু’ নামে ডাকবেন না। তারু নামে শুধু আমাকে কাছের মানুষরা ডাকে।” “একটা কথা মন দিয়ে শোনো। তুমি আমাকে পছন্দ করো না তাতে আমার অসুবিধা নেই। তুমি ভার্সিটি আর টিউশুনি ছাড়া অন্য কোথাও গেলে অবশ্যই আমাকে ফোন করে জানাবে এবং নিজের ফোন সবসময় খোলা রাখবে।”
“আপনার চিন্তা হয় বুঝি?”
“অবশ্যই হয়। আমি এই বাড়িতে শুধু তোমার বাবার বউ হয়ে আসিনি তোমাদের ও মা হয়ে এসেছি।রৌদ্র, রোদেলা, জেরিন এবং তুমি সবাইকে আমি সমান চোখেই দেখি।”
“তাহলে তো আমারও জেরিনকে রৌদ্র আর রোদেলা’র মত সমান চোখে দেখা উচিৎ।”
“সেটা তোমার উপর নির্ভর করছে। ফ্রেশ হয়ে এস। খাবার দিচ্ছি।”
“আমি খাব না।” – তারিন অভিমানী কন্ঠে বলল।
“জিদ করোনা তারু। চলো একসাথে নাশতা খাই। তোমার তিনজন ভাই বোন একসাথে খাবার খায়। তোমার কি তাদের সাথে খেতে ইচ্ছে করে না? সবসময় মন মরা হয়ে থেকো না। হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করো। কারো জীবন পারফেক্ট হয় না। অনেক সময় অনেক কিছু ভাগ্যের কারনে মেনে নিতে হয়। আমিও নিয়েছি। তুমিও নাও।”
আজ তারিন নীলিমা বেগমের সাথে আর তর্ক করেনি। সে হাতমুখ ধুয়ে সত্যি সত্যি ভাইবোনদের সাথে নাশতার টেবিলে বানানো সমুচা আর পিজা খেল। শাহনাজ বেগম এত ভালো খাবার তৈরি করতে পারতেন না। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা তিনি রং চা ছাড়া অন্যকিছু বানাতেনও না। তবুও তারিনের মনে হল, “ইস! একবার যদি মা আবার ফিরে আসতেন। আরেকবার যদি তার বানানো রং চা খেতে পারতাম।”
তারিন তর্ক করা কমিয়ে দিল। দিনদিন নীলিমা বেগমের প্রতি মায়া জন্মাল। নীলিমা বেগম সারাদিন স্কুলে ক্লাশ নিয়ে বাসায় এসে আবার সংসারের কাজ করতেন। তার কখনও কখনও ইচ্ছে করত আন্টিকে সাহায্য করতে কিন্তু কী ভেবেই আবার করা হত না। মনে মনে বলত, “কি দরকার? সংসার এখন তার। সে যা ইচ্ছে করুক আমার কী?”
একদিন রান্নাঘর থেকে জোরে আওয়াজ এল। নীলিমা বেগম ‘উঁহ’ করে কেমন একটা শব্দ করলেন। তারিন ছুটে এসে বলল, ” হাত কীভাবে পুড়লেন?” “ভাতের মাড় হাত ফসকে পড়ে গেল কীভাবে বুঝতে পারলাম না।” তার বলার মাঝেই তারিন ঠাণ্ডা পানি ফ্রিজ থেকে বের করে তার হাতে ঢালল। ডিম ভেঙে সাদা অংশ হাতে মাখিয়ে দিয়ে বলল, “দাঁড়ান দেখছি আমার ঘরে হয়ত মলম আছে।”
“হাত ঠিক আছে তারিন। ফোস্কা পড়েনি।”
“আরেকটু হলেই তো পড়ে যেত। আপনি এখন বিশ্রাম নিন।”
“সমস্যা নেই তুমি পড়তে যাও। ভাতের মাড় গালতে হবে। তরকারিটা চুলোয় বসাতে হবে।”
“ভাতের মাড় আমিও গালতে পারি। তাছাড়া আমার আজ তেমন পড়াশুনা নেই। বাকি রান্নাও করে দিচ্ছি। আপনি বরং বসার ঘরে বসুন।” এই কথার পরও নীলিমা বেগম দাঁড়িয়ে রইল। তারিন ভাতের মাড় গেলে তেলের কড়াইয়ে কাটা পিঁয়াজ ছেড়ে দিল। হঠাৎ কী মনে করে বলে উঠল, “মা বেঁচে থাকতে এসব ছোটখাটো কাজ আমি করতাম। করতে না চাইলেও মা জোড় করে করাতেন। বলতেন, মেয়ে মানুষকে সংসারের সব কাজকর্ম শিখতে হয়। আপনি আসার পর থেকে অভিমানে আর রান্নাঘরে আসা হয় না। “অনেক মিস করো মা’কে তাই না?”
“খুব মিস করি।”- বলতে গিয়ে তারিন কেঁদে ফেলল। জল ভরা চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝড়ল। নীলিমা বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে তারিনের চোখের জল মুছে দিতে যাবে ওমনি তারিন তার দিকে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে জরিয়ে ধরে কিছুক্ষণ হাউমাউ করে কাঁদল।
জেরিন ছোট ছোট বিষয়গুলোতে খুব রাগ করে। সে আজকাল সুযোগ পেলেই তারিনের ঘরে এসে বোনকে এটা-ওটা গল্প শুনায়। সেই গল্পের মাঝে থাকে তার স্কুল বান্ধবীদের গল্প, আর্ট ক্লাশের গল্প, বানিয়ে বানিয়ে রুপকথার রাজা-রানির গল্প। তারিন শুনতে না চাইলেও সে বকরবকর করতে থাকে। সেদিন রোদেলার সাথে তার কি হল কে জানে? তারিনের ঘরে এসে সে গাল ফুলিয়ে বসে রইল। তারিন তখন বলল, “কী হয়েছে?”
“তারু আপু আমি তোমার কাছে ঘুমোবো।”
“কেন?”
“রোদেলার সাথে রাগ করেছি।”
“কেন রাগ করেছ?”
“কারনটা বলব না।”
“আচ্ছা।”
“তুমি কি তোমার সাথে আমাকে ঘুমোতে নিবে না?”
“নিবো।”
জেরিন হাত পা ছড়িয়ে তারিনের গা ঘেষে ঘুমোল। সে কিছু বলল না। জেরিনের বাবা মাঝেমধ্যে মেয়েকে দেখতে আসেন। যখন আসেন এক গাদা চকলেট নিয়ে আসেন। সেই চকলেট জেরিন ভাই বোনদের ভাগ করে দেয়। তারিন অবাক হয়ে সবকিছু দেখে একা একা ভাবে, “আমি কি পারিনা জেরিনকেও রোদেলার মত ভালোবাসতে?”
অজানা একটা মায়া তখন জেরিনের জন্যও তার জন্ম নেয়। সকাল-বিকাল সে তারিনকে যতবার ‘আপু’ ‘আপু’ করে ততবার ‘রৌদ্র’ আর ‘রোদেলা’ও করে না। রৌদ্র সেই কথা বলা শেখার পর থেকেই চুপচাপ স্বভাবের ছেলে। তাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় এখন ভাত খাবে? সে শুধু ‘ঘাড়’ নাড়িয়ে ‘ হ্যাঁ ‘ সূচক জবাব দেয়। বাকিসময় পড়াশুনা করেই সময় কাটায়। পরীক্ষায় রেজাল্টও খুব ভালো করে। তার বন্ধু টন্ধু তেমন নেই বললেই চলে। নীলিমা বেগম কখনও কখনও কারো সাথে ফোনে কথা বলার সময় বলেন, “আমার ছেলে এবারও ফাষ্ট হয়েছে।” – আবার কখনও বলেন, “আজ আমার বড় মেয়ের শরীরটা ভালো না। আজ কোনভাবেই স্কুলে যাওয়া সম্ভব না।” এসব শুনতে প্রথম দিকে তারিনের যে খারাপ লাগাটা কাজ করতো এখন আর করে না। সে একটা সময় সব মেনে নিলেও চার দেয়ালের মাঝে মায়ের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়ানো ভুলে যায়নি।
সোবহান সাহেব একদিন মেয়ের কাছে এসে বললেন, “তারু আমরা নতুন একটা বাসা নিয়েছি। তোমার ভাই বোনদের স্কুলের কাছে। তুমিসহ আমরা সবাই সেখানে উঠতে চাই। তোমার এই বিষয়ে কিছু বলার আছে?” “নতুন বাসা কেন বাবা? এই বাড়ির বারান্দা থেকে মায়ের কবরটা দেখা যায়। সব স্মৃতি মা’য়ের এখানে। আমি কোথাও যাব না।” “তারু আমি বুঝি তুমি তোমার মা’কে খুব ভালোবাসতে। কিন্তু আমাদের এই বাসাটা খুব ছোট। শহর থেকেও বেশ দূরে। তোমার ভাইবোনদের স্কুল থেকে যাওয়া আসা করতে কষ্ট হয়। কথা দিচ্ছি, প্রতি শুক্রবার তোমাকে নিয়ে এসে তোমার মায়ের কবর জেয়ারত করে যাব।”
“নতুন বাসাটা কি অনেক বড়?” “হ্যাঁ, বড়। তোমার নীলিমা আন্টিও চান সেখানে উঠতে। এই বাড়িতে তোমাকে তোমার মায়ের স্মৃতি সারাক্ষণ কষ্ট দেবে। রোদেলা আর জেরিন বড় হচ্ছে। তাছাড়া রৌদ্ররও আলাদা একটা ঘর দরকার।” তারিন চুপ করে রইল। সোবহান সাহেব বিষন্ন গলায় বললেন, “চুপ করে আছ যে? তুমি কি বুঝতে পেরেছ কী বলছি? তুমি কি যেতে চাচ্ছ না মা?” “আমি বুঝতে পেরেছি বাবা। তুমি যাওয়ার প্রস্তুতি নাও।”
হয়তো তারিন সেদিন আবারও জিদ করতে পারত। বলতে পারত, “মা’য়ের স্মৃতি রেখে আমি কোথাও যাব না। কিন্তু সে তা করেনি। সেদিন তার কষ্টের চেয়ে রৌদ্র আর রোদেলার সুখ বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নীলিমা বেগম বা সোবহান সাহেব কেউই বুঝবেন না আজ তারিন পৃথিবীর কোথাও গিয়ে শান্তি পাবে না। বাসা ছাড়ার জন্য গোছগাছ শুরু হল। তারিনের শরীরটা খারাপ লাগছে। মন খারাপ হয়ে আছে। শরীর প্রাণ শূন্য হয়ে আছে। মায়ের জিনিসগুলো গুছাতে দেখে তার প্রচণ্ড মাথা ব্যথা শুরু হল। নীলিমা বেগম বললেন, “কী হয়েছে? তোমার শরীর কি খারাপ লাগছে?”
তারিন যন্ত্রের মতো বলল, “না” পরক্ষনেই আবার বিড়বিড় করে বলল, “আমি মরে যাচ্ছি না কেন? যেখানে সবচেয়ে আপন মানুষটাই নেই সেখানে বেঁচে থেকে কী লাভ?” শেষবার বাড়ির দিকে আর কবরস্থানে চোখ বুলিয়ে তারিন ব্যগ হাতে বাড়ি থেকে বের হল। নতুন বাসায় আসার পর থেকে জ্বরের ঘোরে শুধু ‘মা’ ‘মা’ বলে ডেকেছে সে। যখনই চোখ মেলে তাকিয়েছে নীলিমা বেগমকে পাশে দেখেছে। তার শরীরের অবস্থা দিনদিন আরও অবনতি হল। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। ডেঙ্গু জ্বর তার শরীরকে দূর্বল করে দিয়েছে। নীলিমা বেগম অস্থির হয়ে উঠলেন। রাত জেগে তার পাশে বসে থাকতেন। বাথরুমে ধরে ধরে নিয়ে যেতেন। নিজের হাতে স্যুপ খাইয়ে দিতেন। তারিন যখন মুখ ফিরিয়ে নিত তিনি কানের কাছে ফিসফিস করে বলতেন, “খেয়ে নাও মা। দিনরাত তোমার জন্য দোয়া করছি। আল্লাহ সুস্থ করে দিবেন। আমি তোমার পাশেই আছি। নিজেকে কখনো একা ভেবো না।”
তারিন সুস্থ হয়ে উঠল। এক বিকেলে হাসিমুখে নীলিমা আন্টিকে বলল, “আমার ছোঁট মাছ দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে।” নীলিমা বেগম ছোঁট মাছ রান্না করে তারিনকে মুখে তুলে ভাত খাইয়ে দিলেন। প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায়। তারিন সবসময় তার মায়ের বৈশিষ্ট্যগুলো নীলিমা আন্টির মাঝে খুঁজে বেড়িয়েছে। যা বাস্তব হবার নয়। তারিনের মা যেমন ছিলেন তেমন তিনি নন। কিন্তু তার ভালোলাগা চাইলেই ভালো লাগাতে পারে সে। হ্যাঁ জেরিনকেও আপন করে নিতে পারে। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার তাগিদে অনেক কিছু মেনে নিতে হয়। তারিনও না হয় নিল। নিজের জন্য না হোক নিজের ভাইবোনদের জন্য কিংবা বাবার জন্য। যখন থেকে সবকিছু সে মেনে নিতে পারবে তখন থেকে তার সব কষ্ট ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে।
হাসপাতাল থেকে ফেরার পর তারিনের রাতে ঘুম হয় না। ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমোতে হয়। আজ ঘুমের ঔষধ খেয়েও তার ঘুম আসছে না বরং ঘুম কেটে যাচ্ছে। রোদেলা আর জেরিনের পড়ার শব্দ কানে আসছে। অসময়ে ওদের পড়ার শব্দ যন্ত্রের মতন কানে বাজে। সাধারণত ঘুম না আসলে মানুষের মাঝে বিরক্তি ভাব চলে আসে তারিনের ক্ষেত্রেও তাই হল। আগামীকাল তার ‘ফরহাদের’ সাথে দেখা করতে হবে। অনেকদিন ভালোবাসার মানুষটার সাথে কথা হয় না। পাশাপাশি পার্কে বসে বাদাম খাওয়া হয় না। সে চকলেট রঙের কাঁথাটা শরীরে জড়িয়ে আবার শুয়ে পরল। মনে মনে বলল, “আমার কীসের এত কষ্ট?” কষ্ট নেই দুঃখ নেই এমন একটা ভাব করে সে পাশ ফিরল। ঘুম না আসলে তার আজ আরও ঘুমের ঔষধ খেতে হবে। “তারু” “তারু” – বহুদিন পর সোবহান সাহেব আবার তাকে ডাকছেন।
তারিন সাথে সাথে উঠে বসল। বাবা কি আজ পূর্বের মত আবার চা খেতে চাইবে? তারিনকে ‘মামুনি’ বলে ডাকবে? সে খাট থেকে নামতে গিয়ে খাটের পাশে আলমারির সাথে ধাক্কা খেল। ‘রোদেলা’ আর ‘জেরিনের’ পড়ার শব্দ হঠাৎ করেই থেমে গেল। সে বাবার শোবার ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ঘরের মাঝে নীলিমা বেগমকে দেখা যাচ্ছে না। তিনি কি আজ তার ছোট দুই মেয়ের ঘরে ঘুমোচ্ছেন? তারিন বলল, “বাবা ডেকেছ?” “ঘুম আসছে না মামুনি। এক কাপ চা খাওয়াতে পারবি?” তারিনের চোখ আনন্দে ভরে উঠল। সে সাথে সাথে বলল, “পারব বাবা।” তারাহুরো করে ‘চা’ বানাতে গিয়ে সে চায়ের কেটলি নিচে ফেলে দিল। নীলিমা বেগম শব্দ শুনে রান্না ঘরে ছুটে আসলেন। কেটলি তুলতে গিয়ে ভুল করেই তারিন বলে উঠল, “কেটলি পরে গেছে ‘আম্মু’। দেখো না, বাবা এই অসময়ে চা খেতে চাইলেন।”
নীলিমা বেগম এবং তারিন দু’জনেই খানিকটা সময় চুপ হয়ে রইলেন। তারিন কাঁপা গলায় বলল, “সরি আন্টি। আমি ঘুমানোর জন্য আজ ঘুমের ঔষধ খেয়েছি। মাথায় কোনো কাজ করছে না।” নীলিমা বেগম কিছু না বলে চলে গেলেন। সোবহান সাহেব চা খেতে চেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। তারিন আস্তে করে ‘বাবা’ বলে ডাক দিল। সেই ডাক সে নিজেও ঠিকমত শুনল না। নীলিমা বেগম রৌদ্র’র ঘরে ঘুমোলেন। তারিন ঠাণ্ডা চা নিয়ে সারারাত ঘুমন্ত বাবার পাশে বসে রইল। শেষ রাতের দিকে তার চোখ জুড়ে ঘুম নেমে এল। তখন সে নিজের ঘরে চলে এল। পাঁচ বছর পর। আজ তারিনের বিয়ে। তার পছন্দের ছেলে ফরহাদের সাথেই তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। এত জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ের কথা কখনোই সে ভাবেনি।
‘রোদেলা’ আর ‘জেরিন’ হুট করেই যেন বড় হয়ে গেছে। বিয়ের দিন একই রকম বেগুনী শাড়ি পড়ে দু’জনে একইভাবে চুল বেঁধেছে। কে বলবে আজ? এরা দু’বোন আলাদা বাবা মায়ের সন্তান। লোক চোখের বাইরে মানুষ একে অন্যের সাথে অনেক কিছু বললেও নীলিমা বেগমের সামনে কেউ প্রশ্ন করার সাহস জন্মাতে পারেনি। তারিন লাল বেনারশী পরে অস্থির হয়ে বসে আছে। যেন এখুনি সে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। নীলিমা বেগম তার পাশে এসে বসলেন। তার হাতে গয়নার বাক্স। তিনি বাক্স খুলতে খুলতে বললেন, “এগুলো তোমার মায়ের সব গয়না তারু। এতদিন সব যত্ন করে তুলে রেখেছিলাম। তোমার বাবার কাছে শুনেছি তোমার মা তোমার আর রোদেলার বিয়ের জন্য এগুলো বানিয়েছিলেন। তাছাড়া তার সোনার জিনিসের শখও নাকি ছিল অনেক। এখন সময় এসেছে এগুলো তোমাকে দেয়ার।”
তারিন বলল, “কিন্ত আমরা তো তিন বোন, নিয়ম অনুযায়ী এগুলো তিন ভাগ হবে আন্টি।” “কি বলছ তারু? তোমার বাবা আজ তোমাকে এগুলো দিয়ে দিতে বলেছেন।” “অনেক কিছু বদলে গেছে আন্টি। সবকিছুই এখন আমাদের তিন বোনের আর হ্যাঁ আপনি চাইলে আপনার ছেলে রৌদ্রের বউ এর জন্যও এগুলো রেখে দিতে পারেন।” নীলিমা বেগমকে তারিন কখনও কাঁদতে দেখেনি। তবে সেদিন সে শাড়ীর আঁচলে চোখ মুছলেন। তিনি বললেন, “আমি একটু আসছি তারু।” কিছুক্ষন পর তিনি ফিরে এলেন এক জোড়া সোনার বালা হাতে নিয়ে। “তারু এই সোনার বালা অনেক পুরনো ডিজাইনের। আমার মা আমাকে দিয়েছিলেন। আর আমার মা’কে আমার নানী। বলতে পারো জেরিনের বিয়ের জন্য রেখেছিলাম। আমি তো সোনার জিনিস একদমই পরি না। আজ থেকে এগুলো তোমার।- বলতে বলতে তিনি বালা তারিনের হাতে ঢুকিয়ে দিলেন। তারিন বলল, ” কিন্তু আন্টি।”
“কোনো কিন্তু নয়। বাড়ির বড় মেয়ে হিসেবে এগুলোর অধিকার এখন তোমার।” তারিনের অল্পতেই কান্না পায়। তাই সে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই বলল, “আন্টি আজকের এই দিনে আমি কি আপনাকে একবার ‘আম্মু’ বলে ডাকতে পারি? আজ যে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।” “শুধু আজ নয়। তুমি চাইলে সারাজীবন ডাকতে পারো।” বলেই নীলিমা বেগম তারিনকে জড়িয়ে ধরল। আজ বহুদিন পর তার মনে হচ্ছে সত্যি কষ্ট অনেক কমে গেছে। মায়ের জন্য বুকের বাম পাশে যে চিনচিনে ব্যথাটা হত সেটা আজ আর অনুভূতি হচ্ছে না। কষ্টগুলো তো এমনই হয়, যখন আমরা অন্যের কষ্ট ভাগ করে নেই তখন নিজেদের কষ্ট কমে যায়।
তারিনের বিদায়ের সময় জেরিন এমন ভাবে কাঁদছিল যেন সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে। রোদেলা অনেক চাপা স্বভাবের মেয়ে, কান্না করলেও কাউকে দেখাবে না। আর রৌদ্র বাবার মতন কষ্ট পেলে আরও বেশী চুপ হয়ে যায়। এক এক করে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলো সে। সোবহান সাহেব অশ্রুশিক্ত চোখে মেয়ের বিয়ের গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলেন। শ্বশুর বাড়ির গাড়িতে উঠার আগে আবার একবার ফিরে তাকিয়ে তারিন পরিবারকে দেখে নিল। বাবা, রৌদ্র, রোদেলা আর জেরিন আজ সবাইকে খেয়াল রাখার জন্য মা আছেন। হোক না সে ‘সৎ মা’। আজ যে তিনি পরিবারের সবচেয়ে আপন।
গল্পের বিষয়:
গল্প