বিষাদের রঙ কালো

বিষাদের রঙ কালো
আজকের দিনে ফোন রিসিভ করবেন ভাবিনি। বিয়ের দিনে, নতুন বউকে রেখে কেউ ফোন রিসিভ করে?’ ফোন রিসিভ করতেই নীলিমার কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পেলো শুভ্র। ফোনের ওপাশ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে নীলিমা আবার বলল, ‘বিয়ে কি হয়ে গেছে? নতুন বউ কোথায়? আশেপাশে আছে? কথা বলা যাবে?’ শুভ্র চুপ করে আছে। শুভ্রের বুক ভারি হয়ে আসছে৷ খুব কান্না পাচ্ছে। সম্পূর্ণ শরীর কাপছে। কথা বলার মত শক্তি পাচ্ছে না৷ ফোনের ওপাশ থেকে শুভ্রের কন্ঠ শুনতে না পেয়ে কিছুটা অবাক হলো, সাথে কিছুটা টেনশন হতে লাগলো নীলিমার।
শুভ্রের ফুফুর মেয়ে নীলিমা। কলেজে পড়ার সময় শুভ্রের বাবা-মা গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যায়। শুভ্রের আত্মীয় বলতে এই এক ফুফু। শুভ্রের মামাদের সাথে শুভ্রদের কোন সম্পর্ক নেই। সে কখনো তার মামা, খালা, নানা-নানীদের দেখেওনি। শুভ্রের মা, বাসা থেকে পালিয়ে এসে শুভ্রের বাবাকে বিয়ে করে। সেই থেকে শুভ্রের নানা, রাগে কখনো মেয়ের কোন খোঁজ খবর রাখেনি। এমনকি মরে যাওয়ার খবর পাঠালে একবার দেখিতেও আসে নি। শুভ্রের বাবা-মা মারা যাবার পর সে ফুফুর বাসায় উঠে। এখান থেকেই কলেজের পড়াশোনা করতে থাকে। নীলিমা তখন ক্লাস নাইনে পড়তো৷ শুভ্রের থেকে দুই বছরের ছোট নীলিমা। কলেজ শেষে, ভার্সিটিতে উঠলে ভার্সিটির হলে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। শুভ্র যেদিন বাসা ছেড়ে চলে যার, সেদিন নীলিমার খুব মন খারাপ হয়েছিলো। সেদিন সকালে, কতক্ষণ ওয়াশরুমের পানির ট্যাপ ছেড়ে কান্না করেছে সে কথা কখনো কেউ জানেনি, হয়তো জানবেও না। কাউকে বুঝতেও দেয়নি সেদিন তার কতটা মন খারাপ ছিলো। তবে রাতে কান্না চেপে রাখতে পারেনি। সারারাত কাঁদতে কাঁদতে ভোরে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে।
ভার্সিটি পড়াশোনা শেষ হলে শুভ্র একটা মেসে উঠে৷ দু-তিনটে টিউশনি করিয়ে নিজের চলে যায়। তবে যে মাসগুলোতে টিউশনির টাকা পেতে দেরি হয় সে মাসগুলোতে অনেক সমস্যায় পরতে হয়। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে নীলিমা বুঝতে পারে। শুভ্রের হঠাৎ টাকার প্রয়োজন হলেই নীলিমা ফোন করে দেখা করার কথা বলে। দেখা করে, চলে যাবার সময় একটা হলুদ খাম এগিয়ে দিয়ে বলে, এই নিন। শুভ্র জানে, এই খামের অর্থ কি। শুভ্র প্রতিবার না নেওয়া সিদ্ধান্ত নেয়, তবে নীলিমার জেদের কাছে প্রতিবার হেরে যায়। শুভ্র মাঝে মাঝে অবাক হয়, এই মেয়েটা কীভাবে বুঝে, যে আমার টাকার প্রয়োজন? শুধু টাকা নয়, কিছু খেতে ইচ্ছে হলে সেদিন বিকালে নীলিমা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে চলে আসে দেখা করতে। হঠাৎ একদিন, শুভ্রের গরুর মাংশ দিয়ে চালের গুঁড়ার রুটি খেতে ইচ্ছে হল, সেদিন বিকালে নীলিমা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে উপস্থিত।
শুভ্র জানে, অনেক আগে থেকেই নীলিমা তাকে পছন্দ করে৷ তাকে খুব ভালোবাসে৷ নীলিমা কখনো বলেনি ভালোবাসার কথা৷ তবুও শুভ্র জানে নীলিমার ভালোবাসা কতটুকু। নীলিমা কখনো শুভ্রকে কোন কিছুতে বাধা দেয়নি, কোন কিছুতে জোর করেনি। এমনি ভালোবাসার কথাটাও কখনো বলেনি। তবুও নীলিমা বুঝে, শুভ্র জানে তার ভালোবাসার কথা। সে এটাও বুঝে, শুভ্রের বাবা-মা মারা গেলে যারা তাকে আশ্রয় দিয়েছে তাদের কখনো সে অ-সম্মান করবে না। তাদের অপমান হোক এমন কোনো কাজ কখনো করবে না। তবুও মাঝে মাঝে শুভ্রের উপর খুব অভিমান হয়। রাগ হয়। ‘বিয়ে কি ভেঙে গেছে?’ অনেকক্ষণের নিস্তব্ধতা নীলিমার করা প্রশ্নে ভেঙে গেলো৷ ‘বিয়ে হয়েছে।’ শুভ্র উত্তর দিলো।
‘বিয়ে হয়েছে’ কথাটা তীরের মত এসে নীলিমার বুকে বিধলো। সে রাগান্বিত চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশে কোথাও একটুও মেঘ নেই। নীলিমার খুব রাগ হচ্ছে আকাশের উপর, মানুষের মত আকাশও স্বার্থপর। সে ভাবলো, মেঘটুকু আমার বুকে দিয়ে আকাশ সুখেই আছে। নীলিমার হঠাৎ মনে হলো, ‘শুভ্রের দেওয়া কষ্টগুলো ঠিক মেঘের মত, না চাইতেই হুটহাট বৃষ্টি নামে চোখে। চোখও খুব স্বার্থপর। আমার কথা শুনতেই চাই না। অবাধ্য হয়ে, সে শুধু বৃষ্টি নামাতে ভালোবাসে। এই যে আকাশ, চোখ, মানুষ তার সাথেই কেনো এমন করে? এই উত্তর নীলিমা খুঁজে পায়না। শুভ্রের বিয়ে হয়ে গেছে কথাটা ভুলে, তার ইচ্ছে করে মেঘ ছাড়া আকাশ দেখতে, আকাশের দিকে তাকাতেই আবার বিচ্ছিরি ভাবে সব কিছু মনে পরে যায়। শুভ্রের বিয়ে হয়ে গেছে! বিয়ে হয়ে গেছে! নীলিমা সব ভুলে, সব কষ্ট লুকিয়ে, কথাবার্তা কিছুটা স্বাভাবিক করার জন্য বলল, ‘এটা তো খুশির খবর। তাহলে আপনার এই অবস্থা কেনো? ভয় লাগছে এখন?’
‘বিয়ে হয়েছে৷ তবে আমার সাথে না।’ এই কথাটা বলার সময় শুভ্রের মনে হলো একটা আস্ত পাহার তার বুকের উপর এসে পড়েছে। বুকে ঘুমন্ত মেঘদলেরা হঠাৎ উথাল-পাতাল ঝড় শুরু করেছে। চোখ দিয়ে বেড়িয়ে আসতে চাচ্ছে কয়েক লক্ষ্য বৃষ্টির ফোটা। নীলিমা কিছুই বুঝতে পারলো না। নীলিমা যতটুকু জানে, আজকে নীলুর সাথে শুভ্রের বিয়ে হবার কথা। তাহলে শুভ্র এসব কি বলছে? অন্য কারো সাথে বিয়ে হয়েছে। নীলুর সাথে শুভ্রের পরিচয়টা খুবই নাটকীয়। নীলিমার কারণে নীলুর সাথে শুভ্রের দেখা হয়। দুই বছর আগে।
‘আমাকে বইমেলায় নিয়ে যাবেন?’ সব সময়ের মতই নীলিমা ‘হ্যালো’ না বলে প্রথমেই শুভ্রকে প্রশ্নটা করলো।
‘আচ্ছা, তবে একটু ব্যস্ত আছি। কয়দিন পর গেলে সমস্যা নেই তো?’
‘না, সমস্যা নেই। আচ্ছা, কয়দিন পর-ই যাবো।’ নীলিমা মন খারাপ করেই বলল কথাটা।
নীলিমা অপেক্ষা করতে থাকে শুভ্রের ফোনের। সে জানে, শুভ্র কখনো প্রয়োজন ছাড়া তাকে ফোন দেয় না। এই নিয়ে নীলিমার অনেক মন খারাপ হয়, তবে শুভ্রকে কখনো কিছু বলে না। কিছু বলার মত অধিকার নেই যে!
শুভ্রের ফোনের অপেক্ষায় থাকতে না পেরে, সে শুভ্রকে দুইদিন কল দিয়েছে। শুভ্র রিসিভ করেনি। মানুষ ব্যস্ত থাকতেই পারে, তাই বলে পরে একবার কল ব্যাক করবে না? সেদিন নীলিমার অনেক কান্না পেয়েছিলো। রাতে ঘুমানোর সময় অনেক কেঁদেছে। চোখের জলে বালিশের একটা সাইড ভিজে গিয়েছিলো। অনেক দিন পর নীলিমা আবার ফোন করলো। এবার শুভ্র সাথে সাথে রিসিভ করলো। সে বলল, ‘আপনি কি আমাকে সত্যি বইমেলায় নিয়ে যাবেন?’
‘কেনো নিয়ে যাবো না। ব্যস্ত আছি বলে কল দেওয়া হয়ে উঠেনি। ফ্রি হলেই নিয়ে যাবো।’
‘আচ্ছা, তবে আপনি আমাকে আজ থেকে যতদিন পর্যন্ত বইমেলায় নিয়ে যাবেন না, ততদিন পর্যন্ত আমি কিছুই খাবো না। না খেয়েই থাকবো।’ নীলিমার কন্ঠ শুনে শুভ্র বুঝতে পারলো- কন্ঠের মধ্যে রাগ, অভিমান, অভিযোগ মিশ্রিত। শুভ বলল, ‘পাগলামি করো না।’
‘আমি কখনো আপনার কাছে কিছু চেয়েছি? কখনো কিছুতে জোর করেছি? জেদ ধরেছি? না কিছুই করিনি। এই প্রথম একটা ইচ্ছের কথা বললাম আর আপনি আমাকে সব সময়ের মত এবারও এড়িয়ে যাচ্ছেন।’ কথাগুলো বলার সময় নীলিমার কন্ঠ ভারি হয়ে উঠলো, নীলিমা কান্না করে দিলো। কিন্তু সে জানে, এই যে এখন সে কান্না করছে এই কান্নার কথা শুভ্র জানবে না!
শুভ্র অনেক বুঝিয়ে বলার পরও এবার নীলিমা কোন কথাই শুনতে রাজি না। নীলিমা প্রচন্ড রাগে, কল কেটে দিয়ে ফোন বন্ধ করে রাখলো। কল কেটে গেলে শুভ্র বারকয়েকবার ফোন দিলো নীলিমাকে। প্রতিবার ওপাশ থেকে মিষ্টি কন্ঠের একটা মেয়ে জানিয়ে দিলো, এই মুহুর্তে কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। শুভ্র বুঝে উঠতে পারছে না, সে কী করবে? খানিক পরে নীলিমার জন্য টেনশন হতে লাগলো। শুভ্র জানে, পাগলি মেয়েটা সত্যিই পাগলামি করবে। ঘন্টাখানেক পর নীলিমাকে এক লাইনের ছোট্ট একটা মেসেজ পাঠালো।
নীলিমা ঘরের দরজা বন্ধ করে, বারান্দায় বসে আছে। শেষ দুই ঘন্টায় বারান্দার সামনের রাস্তা দিয়ে ৫৯৮ টা রিকশা যাওয়া আসা করেছে। এই শহরের মানুষ এতো এতো ব্যস্ততা কাধে নিয়ে ঘুরে কেনো? নাকি মানুষ ব্যস্ত আছে সেটা অন্যকে দেখাতে ভালোবাসে? সে জানেনা উত্তর। শুধু সে চাই, এই যে এতো এতো ব্যস্ততার মধ্যেও মানুষ তার প্রিয় মানুষটাকে একটু সময় দিক, তাদের সাথে মন খুলে কথা বলুক। তাদের কথা শুনুক। তাদের কথায় গুরুত্ব দিক।
রাতে নীলিমা খেলো না। ফোন এখনো বন্ধই আছে। কয়েকবার ফোন খুলবে ভেবেও রাগের কারণে বন্ধ করেই রেখেছে। মন খারাপ করে ঘুমের জন্য শুয়ে রইলো। তবে, সে জানে, মন খারাপ নিয়ে চাইলেও কেউ সহজে ঘুমাতে পারে না। সেও পারবে না। নীলিমা যদি সেদিন ফোন খুলতো তাহলে তাকে সারা রাত মন খারাপ করে থাকতে হতো না।
‘আপনি কোথায়?’
‘পাঁচ মিনিট লাগবে। তুমি একটু অপেক্ষা করো।’
এই বলে শুভ্র ফোন কেটে দিলো। নীলিমা শাড়ি পরে গেটের সামনে দঁড়িয়ে আছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে মনের ভুলে ফোন চালু করতেই শুভ্রের মেসেজ দেখে অবাক-খুশিতে চমকে উঠেছে।
‘কালো শাড়ি?’ নীলিমার কাছে এসেই শুভ্র জিজ্ঞাসা করলো।
‘ইচ্ছে হলো কালো শাড়ি পরতে। ভাল করে দেখুন, আজ সব কিছু কালো পড়েছি।’
নীলিমা জানতো, শুভ্র এই প্রশ্নটা করবে। কারণ শুভ্র কালো রঙের শাড়ি খুব পছন্দ করে। শুভ্রের মনে হল, নীলিমাকে কালো শাড়িতে আজ অনেক বড় বড় লাগছে। পিচ্চি মেয়েটা দেখতে দেখতে অনেক বড় হয়ে গেছে। সেই সাথে দিন দিন প্রচন্ড সুন্দর হচ্ছে। আজ শাড়িতে এতো সুন্দর লাগছে যে, একবার দেখলে মন ভরে নি। শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। দূর থেকে দেখেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করলেও সে তা করতে পারেনি। নীলিমা কী ভাবে সে কথা ভেবে। ইশ! বাচ্চা মেয়েটা, দিন দিন এতো সুন্দর হচ্ছে কেনো?
‘যাবেন না? নাকি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন? তবে দাঁড়িয়ে থাকতে সমস্যা নেই আপনার সাথে যে কোন জায়গায় অকারণে দাঁড়িয়ে থাকতেও ভালো লাগে।’ কথাটা বলে নীলিমা হেসে দিলো।
‘হ্যাঁ, চলো।’ নীলিমার কথা শুনেই শুভ্র দ্রুত অন্য দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল।
‘আজকে বড্ড ভীড়।’ শুভ্র কিছুটা বিরক্ত জড়ানো কন্ঠে বলল।
‘শেষের সপ্তাহে একটু ভীর থাকেই।’
‘কোন বইতো কিনলে না। শুধু ঘন্টাখানেক ধরে এমাথা থেকে ওমাথা হাঁটছি।’
‘আপনি পছন্দ করে একটা কিনে দিন।’ নীলিমা কিছুটা অধিকার দেখানো ভঙ্গীতে বলল। ‘তুমি জানো, আমিতো গল্প উপন্যাসের বই পড়িনা। পছন্দও করিনা। শুধু শুধু সময় নষ্ট করে মানুষ যে কেনো এতো মোটামোটা বই পড়ে সেটাই জানিনা। তুমি পড়ো। তুমি জানো কোন বইটা ভাল। নিজে পছন্দ করে বলো কোনটা কিনবে।’
শুভ্রের কথাগুলো শুনে নীলিমার কিছুটা মন খারাপ হয়ে গেলো। মানুষটা এমন কেনো? ভেতরে কোন রস-কষ নেই। বোরিং এবং আন-রোমান্টিক। ‘তুমি ঐ দোকানটা ঘুরে দেখো কোন বই পছন্দ হয় কি না। আমার জরুরি একটা ফোন এসেছি। আমি কথা বলে আসছি।’ এই বলে শুভ্র কিছুটা দূরে গিয়ে ফোন রিসিভ করে কথা বলতে থাকল। নীলিমা মেজাজ খারাপ করে দোকানে সামনে সাজানো বইগুলো দেখতে লাগলো।
‘চলো, আমার এক জায়গায় যেতে হবে। খুব আর্জেন্ট।’ শুভ্র ফোনে কথা শেষ করে, দ্রুত হেঁটে এসে, পিছন থেকে নীলিমার হাত ধরে ভীরের মধ্যে থেকে টেনে নিয়ে, হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলো বলল। অনেকক্ষণ পর! ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ অপরিচিত একটা মেয়ের কন্ঠে প্রশ্নটা শুনে, শুভ্র পেছনে তাকিয়েই বিব্রত বোধ করলো। সেই সাথে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
মেয়েটা অচেনা একটা ছেলের পিছে পিছে হাঁটছে। ছেলেটা তার হাত ধরে আছে। সে কিছু বলছে না। ছেলেটা এতো সুন্দর এবং কিউট কেনো? সেই কথাই ভাবছে। সিমসাম একটা পুরনো শার্ট পরা, চোখে চশমা, হাতে একটা ঘড়ি, তবে ঘড়ির সেকেন্ডের কাটা থেমে আছে। ছেলেটাকে কি জিজ্ঞাসা করা ঠিক হবে ঘড়িটা নষ্ট কি না? না থাক। কি মনে করে আবার। সে ভাবছে, ছেলেটা এতো আলতো করে কীভাবে অপরিচিত একটা মেয়ের হাত ধরে হাঁটছে? মনে হয় ছেলেটার মেয়েদের হাত ধরে হাঁটার অনেক অভিজ্ঞতা আছে। তার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, ছেলেটার সত্যিই কি মেয়েদের হাত ধরে হাটার অভিজ্ঞতা আছে কি না! অনেকক্ষণ পর!
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ অপরিচিত একটা মেয়ের কন্ঠে প্রশ্নটা শুনে, শুভ্র পেছনে তাকিয়ে বিব্রত বোধ করলো। সেই সাথে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। হাত ধরা ছিলো, দ্রুত হাত ছেড়ে দিলো।
‘হাত ছাড়লেন কেনো?’ মেয়েটা হাসিমাখা কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো।
‘সরি, সরি!’ শুভ্র লজ্জিত ভঙ্গীতে বলল।
‘সমস্যা নাই। বললেন না তো, আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ মেয়েটা আবার প্রশ্ন করলো।
শুভ্র কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কালো শাড়িতে মেয়েটাকে দেখতে একদম নীলিমার মতো লাগছে। তারাহুরো করতে গিয়ে চেহারা না দেখে, নীলিমা ভেবে ভুলে হাত ধরে টেনে নিয়ে এসেছে। এখন কি বলবে?
‘কী ভাবতাছেন?’
‘সরি, অন্যকারো সাথে আপনাকে গুলিয়ে ফেলার জন্য। আপনি কালো শাড়ি পরা, সেও কালো শাড়ি পরা ছিলো। এই জন্য মিস্টেক হয়েছে।’
‘কোন মেয়ে কালো শাড়ি পরলে, তাকেই কি সে ভাববেন?’ মেয়েটা রাগি কন্ঠে বলল।
‘দুঃখিত, সত্যি মন থেকে দুঃখিত।’
মেয়েটা কিছুক্ষণ ভেবে, হঠাত করে শুভ্রের হাত ধরে হাঁটা শুরু করলো। শুভ্র বাকরুদ্ধ হয়ে মেয়েটার পিছে পিছে হাঁটছে। থেমে যাওয়া উচিত নাকি পিছে পিছে যাওয়া উচিত? কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। মেয়েটাকে বুঝার চেষ্টা করছে। মনে হয়, নির্ঘাত পাগল!
‘মনে মনে আমাকে পাগল ভাবছেন তাইনা?’ মেয়েটার প্রশ্ন শুনে শুভ্র ভড়কে গেলো। ভেবে পেলো না কীভাবে মনের কথা বুঝে ফেলেছে।
‘না না পাগল ভাববো ক্যান!’ নিজেকে প্রটেক্ট করার মত করে দ্রুত উত্তর দিলো।
‘আমাকে পাগল না ভাবলে, আপনি শিওর পাগল। এখানে ভুল নাই। আপনি কি সত্যি পাগল? পাগল!’ কথাটা বলে মেয়েটা কিছুটা জোরে হেসে দিলো।
‘না, না…’ শুভ্র কথাটা শেষ করতে পারলো না। মেয়েটা আবার বলল, ‘এই, আপনি শুধু নানা নানা করতাছেন ক্যান? আপনার নানাকে কি খুব মিস করতাছেন?’ নানা শব্দটা শুনতেই শুভ্রের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। হাঁটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়লো। কিছুটা জোর গলায় বলল, ‘হাত ছাড়ুন।’ শুভ্রের কথা শুনে, আশে পাশের কিছু মানুষ হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘দেখুন, সব কিছুর জন্য আমি সত্যি সরি। এখানে ভুল করে একটা ভুল বোঝাবোঝি হয়েছে। আমি অন্য কারো সাথে আপনাকে গুলিয়ে ফেলেছি। সেই জন্য আমি মন থেকে সরি বলছি। আমার কোন খারাপ উদ্দেশ্য ছিলো না। এমনকি আপনার হাত ধরার কোন ইচ্ছেই ছিলো না। সবটা একটা ভুল বোঝাবুঝি এই কালো শাড়ির কারণে।’ শুভ্র একটানা কথাগুলো বলে গেলো।
‘সে কে? যার সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলেছেন? আপনার গার্লফ্রেন্ড বুঝি।’
‘সে কে, আপনার সেট জানার দরকার আছে কি? না নেই!’ শুভ্র মেয়েটার উপর খুব বিরক্ত। আজকাল মেয়েগুলো ঠিক কেমন তা বুঝতে পারে না। শুভ্রের ফোন বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে নীলিমার নামটা ভেসে উঠলো।
‘আপনি কোথায়?’ নীলিমা ধমকের সুরে জিজ্ঞাসা করলো।
‘বাইরে এসেছি, তুমি বাইরে চলে এসো। গেটের সামনে আমাকে পাবে।’
‘আমাকে না নিয়ে চলে গেছেন? আপনি…! কথাটা শেষ করতে পারলো না। তার আগে শুভ্র ফোন কেটে দিলো। নীলিমা ইচ্ছে করতাছে ফোনটা এক আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলতে। তবে সে নিজেকে সামলে নিলো।
‘সে ফোন দিয়েছে?’
‘কে ফোন দিলো সেটা আপনার জেনে কি লাভ।’
‘আপনার কি মেজাজ খারাপ?’
‘না, আমি ঠিক আছি।’
‘আচ্ছা, আমিও সরি। আপনার সাথে মজা করার জন্য। আমি বুঝেছিলাম আমাকে অন্য কারো সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন।’
‘আসলে ভুলটা আমারই। তারাহুরোর মধ্যে না দেখে এভাবে…!’ কথা শেষ হবার আগেই মেয়েটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি নীলু, আপনি?’ ‘আমি শুভ্র।’ নীলিমা গেটে সামনে এসে শুভ্রকে একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখেই তার মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেলো। কাছে আসতেই লক্ষ্য করলো মেয়েটাও তার মত কালো শাড়ি পরেছে। মেয়েটাকে দেখতে ভীষণ সুন্দর লাগছে। নিজের সাথে নিজেই তুলনা করলো। হঠাত নীলিমার কান্না পেয়ে গেলো। নীলিমা জানেনা, কেনো হুটহাট মন খারাপ হয় আর কেনোই বা কান্না পেয়ে যায়। নিজেকে অনেক কষ্ট করে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। ‘মেয়েটা কে?’ নীলিমা এসেই প্রশ্নটা করলো।
শুভ্র উত্তর দেওয়ার আগেই মেয়েটা বলল, ‘আমি নীলু, কালো শাড়ি পরেছি বলে, আপনার সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলে। জানেন, আপনাকে ভেবে, ভুল করে আমাকে দোকান থেকে হাত ধরে টেনে এখানে নিয়ে এসেছে।’ ‘হাত ধরে এনেছে’ এটুকু শুনে নীলিমার সব কিছু এলোমেলো হয়ে যেতে শুরু করলো। গলা, বুক ধীরে ধীরে ভারি হয়ে আসছে। শুভ্রকে ইচ্ছেমতো বকে দিতে ইচ্ছে করছে, সেই সাথে মেয়েটিকেও। হ্যাঁ, ভুল করে ধরেছে তাই বলে এতো দূর আসতে হবে হাত ধরে! নীলিমা কিছু করতে পারলো না। শুধু কান্না করলো। এই কান্না কেউ দেখেনা, এই কান্নায় চোখের পানি বের হয়না তবে বুক ভেষে যায় পানিতে।
‘মেয়েটাকে আপনার নাম্বার দিলেন কেনো?’ রিকশায় যেতে যেতে নীলিমা প্রশ্নটা করলো।
‘মেয়েটা একটা পাগল। নাম্বার চেয়েছে, না দিলে পাগলামি করতো। এমনিতেই ভুলে হাত ধরেছি ,এবং সরি বলার পরও যে পাগলামি করেছে। নাম্বার দিতে না চাইলে কি করতো কে জানে।’
নীলিমা আর কোন কথা বলল না সেদিন। শুভ্রও কিছু বলল না। শুভ্র বুঝেছে নীলিমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তাই আর নিজ থেকে কোন কথা বলেনি। নীলিমাকে নিজের মত থাকতে দিতে চেয়েছে। কিন্তু নীলিমা মনে মনে চেয়েছিলো, শুভ্র কিছু বলুক। নীলিমার সেদিন প্রচন্ড মন খারাপ হয়েছিলো নিজের উপর। কেনো সে কালো শাড়ি পরতে গেলো, সে জন্য। সেদিন ঠিক করলো সে আর কখনো কালো শাড়ি পরবে না। সেদিন রাতে অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে অনেক কান্না করেছে। ‘কার সাথে বিয়ে হয়েছে?’ নীলিমা ভাবনার জগত থেকে ফিরে এসে জানতে চাইলো।
‘জানিনা কার সাথে বিয়ে হয়েছে। তবে গতকাল বিয়ে হয়ে গেছে। আজ সকালে চলে গেছে সে তার নতুন ঠিকানায়।’
শুভ্র কথাগুলো বলার সময় নীরবে চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি ঝড়ে পড়লো মাটিতে।
‘কীভাবে কি হলো? আপনার সাথে না আজকে বিয়ে হবার কথা ছিলো। নীলুর মা নিজেই-তো আজকের দিন ঠিক করেছে?’ নীলিমা কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলো। শুভ্র বলতে লাগলো, ‘নীলুর মা আমাকে কখনোই পছন্দ করেনি। বেকার, অনাধ এমন একটা ছেলেকে কেইবা পছন্দ করবে, এবং একমাত্র মেয়ের সাথে বিয়ে দিবে? সব কিছু নীলুর মার সাজানো ছিলো। আমার সাথে নীলুর বিয়ে তারিখ ঠিক করেছে শুধু নীলুর পাগলামির জন্য। নীলুকে কিছুটা স্বাভাবিক করার জন্য, খাওয়া দাওয়া করানোর জন্য। সব কিছু যখন স্বাভাবিক তখন হঠাত গতকাল নীলুর মা খুব অসুস্থ হয়ে পরে। হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এবং অসুস্থতা দেখিয়ে গতকাল রাতেই নীলুর মার পছন্দের ছেলের সাথে নীলুর বিয়ে দিয়ে দেয়।’
শুভ্র কথাগুলো বলে চুপ করে আছে। নীলিমাও চুপ। হঠাত শুভ্র বলল, ‘আমার সাথে কেনো এমন হলো, বলতে পারিস? যাকে ভালোবাসা উচিত ছিলো৷ তাকে ভালোবাসতে চেয়েও নানান কারণে ভালোবাসতে পারিনি। অবশেষে, নীলু হুট করে জীবনে এসে স্বপ্ন দেখতে সাহস যোগালো, ভালোবাসতে বাধ্য করলো। ভালোবাসলাম। বাবা-মার মত করে আজ সেও আমায় ছেড়ে দূরে চলে গেলো। আমি যাদের খুব করে আমার কাছে রাখতে চাই, তারাই আমাকে ফাঁকি দিয়ে দূরে চলে যায় কেনো? বলতে পারিস? নীলিমা কি বলে শান্তনা দিবে সে জানেনা। কি বলা উচিত সেটাও বুঝে উঠতে পারছে না।
‘এতো মন খারাপ করবেন না। সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই আপনার জন্য ভাল কিছু ভেবে রেখেছে। দেখবেন, একদিন আপনি খুব সুখে থাকবেন, আনন্দে থাকবেন।’
‘আমার জন্য বা নীলুর জন্য খারাপ লাগছে না। আমার খারাপ লাগছে, আমার জন্য ফুফু-ফুফাদের অপমানিত হতে হলো। এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। নগন্য, জঘন্য মনে হচ্ছে।
‘বাবা-মার কথা ভেবে এতো মন খারাপ করবেন না। এখানে তো আপনার কোন দোষ ছিলো না। আপনিতো ইচ্ছে করে তাদের অপমানিত করতে চাননি।’
‘তবুও খুব খারাপ লাগছে। ইচ্ছে করে না চাইলেও সবটা আমার ভুলের কারণে হয়েছে। আমার আগে থেকে বোঝা উচিত ছিলো আমার মত একটা জঘন্য মানুষকে কেইকা পছন্দ করবে।’
‘নিজেকে এতো ছোট ভাববেন না। আপনি যেমন তেমনই ভাল।’ নীলিমা এবার কিছুটা রাগ করেই কথাটা বলল।
‘আচ্ছা, এখন রাখি। ভাল লাগছে না।’
‘কি করবেন এখন? কোথায় যাবেন?’
‘জানিনা কোথায় যাবো, কি করবো। যেদিকে যেতে ইচ্ছা হয় সেদিকে চলে যাবো। দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। যেখানে কেউ নেই। শুধু আমি। একমাত্র আমি।’ এই বলে শুভ্র ফোন কেটে দিলো। নীলিমার খুব করে ইচ্ছা হচ্ছিলো শুভ্রের সাথে আরো অনেকক্ষণ কথা বলা চালিয়ে যেতে। তার কষ্টগুলো ভাগ করে নিতে। কিন্তু নীলিমা জানে, শুভ্রের সকল কষ্ট নিজের বুকের ভেতর চাপা দিয়ে রাখবে। এবং পরে সেই সব কষ্ট তাকে একটু একটু করে ক্ষয় করতে থাকবে। শুভ্র এমন কেনো? নীলিমা জানেনা। তবে সে শুধু শুভ্রের কষ্টগুলো ভাগ করে নিতে চাই। খুব করে চাই। কারণ, সে যে শুভ্রকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে। শুভ্রকে সে মরে গেলেও বলতে পারবে না যে তাকে কতটা ভালোবাসে। মাঝে মাঝে নীলিমার ইচ্ছে করে মরে যেতে। খুব করে ইচ্ছে করে। শুভ্র ছন্নছাড়া, পাগলের মতো, এলোমেলো হয়ে হাঁটছে। হঠাত পা কিছুতে আটকে গিয়ে পরে গেলো। কোন অনুভূত হলো না। স্বাভাবিক ভাবেই উঠে আবার হাটা শুরু করলো।
এখন অন্ধকার। শভ্র অন্ধকারের মধ্যেই একা একা বসে আছে। ক’টা বাজে সে জানেনা। জানতে আগ্রহি নয়। কেটে যাক আজকের রাতটা এই অন্ধকারের মধ্যে। কি এমন হবে? সে কোথায় সে নিজেও জানেনা। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে, যাত্রা বিরতি একটা বাসে উঠে শেষ সিটে বসে ছিলো। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে সে নিজেও জানেনা। ঘুম থেকে উঠে দেখে চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। কেনো তাকে কেউ ডাকেনি সে বুঝে উঠতে পারলো না। গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে এই অচেনা এক বনের মধ্যে চলে এসেছে। বসে আছে একা।
শুভ্র আকাশের দিকে তাকালো। আকাশে কোথাও একটা তারা নেই। চাঁদ নেই। একদম অন্ধকার আকাশ। আকাশের বুক থেকে চাঁদটা কোথায় গেছে? তার খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। নাকি তার মত করে আকাশের বুক থেকেও চাঁদটা হারিয়ে গেছে। তবে আকাশের বুক থেকে চাঁদটা যত দূরেই হারিয়ে যাক না কেনো, আকাশ জানে চাঁদ আবার ফিরে আসবে। তবে শুভ্রের চাঁদটা কি আর ফিরে আসবে? না, শুভ্র জানে, তার চাঁদ আর কখনো ফিরে আসবে না। তার বুকের অন্ধকার দূর করে তাকে আলোকিত করতে সে আর আসবে না। এই অন্ধকার, চাঁদ বিহীন একটা জনম কেটে যাবে তার!
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত