সাড়ে তিন বছর আগে নরসিংদী শহরে বিয়ে হয়েছিল শানুর। ওর নাম শাহিনুর, আমি শানু বলে ডাকি। আজ যখন ফিরে আসছে তখন সে বিধবা। যদিও তার গায়ে কোনো সাদা শাড়ি নেই। আগের দিনের মেয়েরা স্বামী মারা যাবার পর থেকে সাদা শাড়ি পরত। এখন আর কয়জনে মেনে চলে? শানুর কোলে তার দেড় বছর বয়সের মেয়েটি চুপটি করে বসে আছে। শানুর মতো চঞ্চল হবে না হয়তো। বেশ শান্ত মনে হচ্ছে। শানু আমার নৌকায় বসে থাকলেও একটিবারের জন্য আমার দিকে ফিরে তাকায়নি। আমাকে কি শানু আজকাল ঘৃণা করতে শুরু করেছে? তা হবে কেন? হঠাৎ স্বামী মারা যাবার কারণে নিশ্চয় মনমরা হয়ে আছে। তার পাশেই বসে আছে শানুর একমাত্র ভাই শাহআলম। যে নাকি একবার আমাকে মারার জন্য দা নিয়ে ঘুরঘুর করছিল। এখন তাকেও বেশ শান্ত মনে হচ্ছে। বিধবা বোনকে তার স্বামীর বাড়ি থেকে নিয়ে ফিরছে। এখন তার শান্ত থাকারই কথা।
নৌকা ভাড়া চার টাকা করে আট টাকা। শাহআলম দশ টাকার নোট দিয়ে দুই টাকা ফেরত না নিয়েই নেমে গেল। শানু তার মেয়েকে কোলে নিয়ে হাঁটছে। পেছনেও ফিরে তাকায়নি একবার। মানুষ মানুষের কাছে সময়ের ব্যবধানে কত অচেনা হয়ে যায়। অথচ শানুদের বাড়ি আমাদের ঘরের দুইটা ঘর পরেই। গতকাল যখন শাহআলমের মা কান্না করছিল, তখন এলাকার অনেকের মতো আমিও গিয়েছিলাম ঘটনা কী জানার জন্য। তিনি কেঁদে কেঁদে বলছিল, “আমার মেয়েটার এখন কী হবে? আমার নাতনিটাকে কে দেখবে?” দুই মহিলা উনাকে শান্তনা দিচ্ছিলেন। তখন জানতে পারি, শানুর স্বামী স্ট্রোক করে মারা গেছে। এত অল্প বয়সে চলে যাবে কেউ ভাবতেও পারেনি। কিন্তু উপায় নেই। আমাদের সবারই আসার সিরিয়াল থাকলেও যাবার কোনো সিরিয়াল নেই। শানু আর আমি একই স্কুলে পড়তাম। তখন এই পারাপারের নৌকাটি চালাতেন আমার বাবা। রাধাগঞ্জ বাজার থেকে নয়াচর ঘাটের পারাপার।
আমি যখন ক্লাস টেনে, তখন বাবার প্যারালাইজড হয়। সংসারের হাল ধরার মতো কেউ নেই বলে এই নৌকার হালটিই ধরতে হয়েছে আমাকে। স্কুলে থাকতে একবার শানুকে বলেছিলাম আমার ভালোবাসার কথা। তখন সে বলেছিল, “আমরা ভালো বন্ধু। এর চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারব না। তবে যদি কখনো কারো সাথে প্রেম করি, তাহলে তোর সাথেই করব।” আমিও সেই আশায় রইলাম। শানু যদি ভালোবাসে তবে আমাকেই ভালোবাসবে। তার মানে এখন শুধু অপেক্ষা। বাবার অসুখের পর নৌকার হাল ধরার জন্য এসএসসি দিতে পারিনি আমি। শানুসহ যারা যারা পরীক্ষা দিত তাদের আমি পার করে দেয়ার সময় অপলক চোখে তাকিয়ে থাকতাম। আমার পরীক্ষা দেয়া হলো না।
নৌকার জন্য শানুর সাথে প্রতিদিন দেখা হতো না। পরীক্ষার পর ফলাফলের জন্য তিনমাসের অপেক্ষা। ততোদিন তো শানু বাড়ির দিকেই থাকবে। ঐদিকে আমি তো অপেক্ষায় আছি শানু কবে আমাকে ভালোবাসবে। চাচাতো ভাইকে সাথে নিলাম ঘন্টা চারেক নৌকা চালানোর জন্য। সেই চার ঘন্টা আমি বাড়ির দিকে থাকি। শানু এত বড় হয়েও বাড়ির আঙ্গিনায় বাচ্চাদের সাথে কুতকুত খেলত। একসময় আমিও খেলতাম শানুর সাথে। দড়ি লাফে শানু আমাকে হারাতে পারত না কখনোই। এখন সে অনেক বড় হয়ে গেছে। আমাদের একসাথে খেলার বয়স এখন নেই। আমি চুপি চুপি ডাকতাম শানুকে। ফিস ফিস করে জানতে চাইতাম, “অনেকদিন তো হলো, এখন কী আমাকে ভালোবাসবি?”
সে উত্তর দিত, “এতদিন কোথায়? গতকালই না মাত্র না করেছি?” দুঃখভরা মন নিয়ে ফিরে আসতে হতো। শানুর এসএসসি পাশের মিষ্টি আমিও পেয়েছি। কলেজে ভর্তি হবার পর থেকে প্রতিদিনই তাকে পার করতে হতো। সে হাসিখুশি মনে কলেজে যেত। আসার সময় বলত, কলেজ কত সুন্দর। কত ভালো লাগে তার পড়তে।আমার মনে ভয় ঢুকত। আমি শানুকে বলতাম, “শানু, কলেজে অনেক সুন্দর সুন্দর ছেলে পড়ে। প্রেমে পড়িস না কিন্তু। তুই আমাকে কথা দিয়েছিস, আমাকে ভালোবাসবি।” শানু বলল, “আমি তোকে ভালোবাসব সেই আশা নিয়ে থাকিস না। কারণ আমি কাউকেই ভালোবাসব না।”
-কিন্তু যদি কাউকে ভালোবাসিস, তাহলে তো আমাকে ভালোবাসবি?”
-হ্যাঁ।
আমি সেই অপেক্ষাতেই রয়েছি। একদিন না একদিন শানু আমাকে ঠিকই ভালোবাসবে। শানুর যখন বিয়ে ঠিক হয় তখন আমি পাগলের মতো হয়ে যাই। শানুর সাথে দেখা করে কেঁদে দেই। “শানু আমি তোকে ভালোবাসি। তুই অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারিস না।”
শানু আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “কিছুদিন পর আমার বিয়ে। তুই এমন করলে আমার বিয়ে ভেঙ্গে যাবে। আমি বলেছিলাম কাউকে ভালোবাসলে তোকে ভালোবাসব। আমি এখনো কাউকে ভালোবাসিনি। ভাই আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আত্মীয় স্বজন সবাইকে দাওয়াত করা হয়েছে। আর তুই যদি এভাবে আমাকে ডেকে এনে কান্না করিস তাহলে মানুষ কী ভাববে? এই কান্না যেন আর কখনো না দেখি।” শানু আর কখনো আমার চোখে কান্না দেখেনি। শানুর বিয়ে হলো। স্বামী নিয়ে কতবার আমার নৌকা করে নদী পার হলো। আমার চোখে আর পানি দেখেনি। বিয়ের পর থেকে শানু আর আমার চোখের দিকে কোনোদিন তাকায়নি ভালো করে। আমার চোখ শানুর চোখকে সবসময় ডেকে বলত, “দেখ শানু, আমার চোখে পানি নেই। আমি একটুও কান্না করছি না। শুধু জানি জীবনে তুই কাউকে ভালোবাসলে আমাকে ভালোবাসবি।”
আর আজ যখন স্বামী মারা গেল। দেড় বছরের মেয়েটি নিয়ে ফিরে এলো। তার চোখে আমি তাকিয়েছি। তার চোখদুটো পানি শূণ্যতায় ভোগছে। সেও মনে হয় আমার মতো কাঁদতে ভুলে গেছে। কিন্তু শানুর কান্না করা ভুললে চলবে না। তার কেঁদে বুক ভাসানো উচিত। স্বামী হারানোর জন্য কান্না। মেয়েটার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। অল্প বয়সে বিধবা হয়েছে, সেজন্য কেঁদে তার বুক ভাসানো উচিত। কিন্তু শানু আর কান্না করেনি। শানুর যখন দ্বিতীয়বার বিয়ে ঠিক হয় তখন আবারো ছুটে গিয়েছি শানুর কাছে। তার মেয়ের বয়স তখন তিন বছর। আমি সেদিনও কান্না করিনি। শুধু বলেছি, “আমি তো তোকে ভালোবাসি। তুই আবারো বিয়ে করলে আমাকে বিয়ে কর। অন্য কাউকে করবি কেন?”
শানু বলেছিল আমি নাকি তাকে করুণা করে বিয়ে করতে চাই। কিন্তু আমি তাকে সেদিনও বুঝাতে পারিনি আমি তাকে অনেক ভালোবাসি। শানু সেদিনও বলেছিল সে আমাকে ভালোবাসে না। যদি কোনোদিন কাউকে ভালোবাসে তাহলে আমাকেই ভালোবাসবে। এটা কেমন কথা? সে কি তার স্বামীকেও কখনো ভালোবাসেনি? নাকি বাবা হারা শানু শুধু বড় ভাইয়ের ইচ্ছেতে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিল। শানুর আবার বিয়ে হলো লন্ডন প্রবাসী এক ছেলের সাথে। বিয়ের পর শানু তার স্বামীর সাথে লন্ডন চলে গেল। তার মেয়েটাকে রেখে গেল ভাইয়ের কাছে। তার ভাইয়ের বউ কখনো শানুর মেয়েটাকে নিজের মেয়ে বলে মানতে পারেনি।
আমি আর বিয়ে করিনি। বাবা মারা যাবার পর মা আর নৌকাটি হয়ে গেল আমার সংসার, আমার আপনজন। এই নৌকায় কতশতবার শানু উঠেছিল। শানুর ভাই আর ভাবির মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো শানুর মেয়েটাকে নিয়ে। শাহআলমের নিজেরও এক ছেলে এক মেয়ে। তাই হয়তো তার বউ শানুর মেয়ে তানিশাকে মেনে নিতে পারে না। একদিন আমি শাহআলমকে বুঝিয়ে বললাম, “তানিশাকে আমার কাছে দিয়ে দেও। আমি তো আর বিয়ে শাদি করিনি। আমিই তানিশাকে লালন পালন করব।”
আমি শাহআলমের চোখে সেদিন পানি দেখেছি। তিন বছরের তানিশাকে আমি আমার বাড়িতে নিয়ে এসেছি। আমার মা তানিশাকে নিজের নাতনির মতো করেই দেখে শুনে রাখেন। মা আমাকে অনেকবার বিয়ের কথা বললেও আমি করিনি। মা’কে বললাম, “এই যে দেখো, আজ থেকে আমার একটি মেয়ে আছে। আমাকে আর বিয়ের কথা বলবে না।” সাত বছর পরের কথা। দশ বছরের তানিশা অনেক কিছুই বুঝতে শিখেছে। আমি না বললেও এলাকার মানুষজন, সঙ্গী সাথী অনেকের কাছেই জানতে পেরেছে তার পূর্ব ইতিহাস। তার বাবা মারা যাওয়ার পর তার মা আরেকজনকে বিয়ে করে বিদেশে চলে গেছে। এতকিছু জানার পরও আমার মেয়েটা বলত, “আমার বাবা আছে, মা আছে। শ্রাবণ মাঝি আমার বাবা, আমার মা।”
গর্বে আমার বুক ভরে উঠে। তবুও আমার চোখে আর পানি আসেনি কখনো। শানু বলেছিল আমার চোখে যেন কখনো পানি না আসে। একদিন শানু দেশে এলো। তার এক ছেলে এক মেয়ে এখন। আমার চাচাত ভাই ফোন করে বলল তাদের দেশে আসার কথা। সে নিজে নৌকায় করে পার করেছে। আমি পাশের গ্রাম থেকে এক প্রকার দৌড়ে বাড়ি এলাম। এসে দেখি শানু আমাদের বাড়িতে। তার সাথে ছোট একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। তার স্বামী শাহআলমদের ঘরে বসা। শানু তানিশাকে দেখতে এসে জানতে চাচ্ছে, “তানিশা আমি তোমার মা। আমার সাথে তুমি যাবে? বিমান দিয়ে নিয়ে যাব।” তানিশা সরাসরি মুখ ফুটে বলছে, “শ্রাবণ মাঝি আমার বাবা, আমার মা। আমি অন্য কারো মেয়ে নই।”
শানু কেঁদে দিল। আমার দিকে তাকিয়ে চোখের পানি মুছল। অথচ আমাকে বলেছিল আমার চোখে যেন কখনো পানি না আসে। বলেছিল কখনো ভালোবাসলে আমাকে বাসবে। শানু এখনো তার স্বামীকে ভালোবাসেনি?
শানুকে পার করে দিতে হবে নদীর ঐ পাড়ে। শানুর স্বামী বাচ্চা দুটিকে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে। তার পেছনে শাহআলম ব্যাগ এগিয়ে দিচ্ছে। তার পেছনে আমি আর শানু। তানিশা আসেনি, সে বাড়ির কাছেই দাড়িয়ে আছে। শানু আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলছে, “শ্রাবণ আমি তোকে ভালোবাসিরে।” নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। এই একটি কথা শোনার জন্য জীবনটাই পাড়ি দিয়ে দিলাম আমার নৌকার মতো করে। শানু আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোকে না বলেছি আর যেন কখনো কাঁদতে না দেখি?”
খেয়াল করলাম, এগারো বছর পর আমার চোখে পানি এল। চাচাতো ভাইকে বলে দিয়েছি ওদের পার করে দিতে। সবাই নৌকায় উঠে গেছে। শানু নৌকায় উঠতে যাবার আগে আবারো ফিসফিস করে বলল, “আজ আমি তোকে ভালোবাসি বললাম, তুই বলবি না?” আমি বললাম, “আমি আমার মেয়েটাকে ভালোবাসি। আমি আমার মেয়ে তানিশাকে ভালোবাসি।” কথাটি বলেই ঘাট থেকে চলে এলাম। বাড়ির দিকে আসতেই দেখি তানিশা দৌড়ে আসছে আমার দিকে। আমার সব ভালোবাসা আমার এই মেয়েটা। শ্রাবণ মাঝির ভালোবাসা শুধু তার মেয়ে।
গল্পের বিষয়:
গল্প