ঠিক ২০ বছর বয়সে বিয়ে হয় আমার। বাবা এক প্রকার জোর করেই বিয়েটা করান আমাকে! যাইহোক, সে কথায় পরে আসছি বিয়ের প্রথম-প্রথম শেষ রাতে বউয়ের ডাকে ঘুম ভাঙত আমার । সে এক প্রকার আদেশ করেই বলত, “আযান দিচ্ছে, নামাজে পড়ে আসেন।” আমার বাবা মাদ্রাসার একজন শিক্ষক।টানা ৩০ বছর ধরে মসজিদে ইমামতি করছেন। যেদিন ফজরের নামাজে মসজিদে আমায় দেখতে পাননা, সেদিন অর্ধেক বেলা কপালে খাবার জুটে না আমার। বাবা এমনিতেই খুব কঠোর প্রকৃতির মানুষ। দাদি ব্যতীত, তার হুকুম ছাড়া বাড়ির একটা মানুষও লড়াচড়ার সাহস রাখে না ।
ছোট বেলা ফজরের নামাজ মিস হলে কয়েকটা বের্তাঘাত পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। বড় হওয়ার পর থেকে এই কড়া নিয়ম। মা অবশ্য চুপিচুপি খেতে দিতেন। কিন্তু বাবা আমায় বিয়ে করিয়ে দেয়ায় হয়েছে আরেক ঝামেলা। বাবা যার সাথে আমার বিয়ে দেন তার নাম আফিয়া। বাবার ছাত্রী । আমি সারাদিন কী করি না করি বাবার কাছে নালিশ দেয়াই তার প্রধান কাজ। হঠাৎ কোন কারণে ফজরের নামাজ মিস হয়ে গেলে সে কুটকুট করে হেসে বলত, “আজ কিন্তু খাওয়া বন্ধ।” সত্যিই তাই, বিয়ের পর থেকে নামাজ মিস হলেই দুপুর পর্যন্ত খাওয়া বন্ধ থাকে আমার। এখন নিশ্চয়ই বুঝতেই পারছেন কেমন ফ্যামিলি তে বড় হয়েছি আমি। বাবার অবশ্য এই কড়া নিয়মের পিছনে একটা যুক্তি ছিল। তিনি বলতেন, ” ক্ষণস্থায়ী আরামের ঘুমের জন্য যে অনন্তকাল চিরনিদ্রার ঘুমের বেঘাত ঘটায় সে বোকা। আর বোকাদের শাস্তি দিয়ে চোখ-কান খুলে দিতে হয়।”
আমরা চার ভাই বোন। পিঠাপিঠি বড় দুই ভাই কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আল কুরআন ও ইসলামী শিক্ষা’ বিভাগে পড়া লেখা করছে। তারাও বিবাহিত। বড় বোন কুরানে হাফেজ।বছর খানেক আগে তারও বিয়ে হয়। আমি পরিবারের সবার ছোট। বাবার ইচ্ছে ছিল,মাদ্রাসায় পড়ে বড় মাওলানা হই। ৮ বছর বয়স পর্যন্ত সেখানেই ছিলাম। একদিন বাবা সন্ধার পর বাড়ি আসলেন। দাদি আমাকে দিয়ে খবর পাঠালেন বাবাকে ডেকে নিয়ে আসতে। বাবা সালাম দিয়ে দাদির পাশে এসে বসলেন। দাদি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ”খলিল তোর আব্বা কী অসুখে মরছিল তোর মনে আছে?” কথা শুনে বাবা থমথম খেয়ে গেলেন। তিনি হয়তো এমন কথা আশা করেননি। কারণ দাদি সবসময় তার নাতিনাতনি দের উপর কড়া শাসনের জন্য বাবাকে নানা রকম কথা শুনাতেন।তিনি হয়তো ভেবেছিলেন সেরকম কোন কথাই হবে।
বাবা অপ্রস্তুত কণ্ঠে বললেন, ” জ্বী আম্মা মনে আছে। আব্বার কলেরা হয়েছিল, এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় মারা যান।” দাদি চোখমুছে বললেন, “সাত গেরামের মধ্যে কোন ডাক্তার আছিলো না। যদি থাকতো তোর আব্বা হয়তো আজো বাঁইচা থাকত।” “হ্যাঁ। আম্মা। আল্লাহ চাইলে হয়তো বেঁচে থাকতে পারত।” এই বলে বাবা পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে চোখ মুছলেন। আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম।দাদি আমাকে পাশে এনে বসালেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বাবাকে বললেন, “আমি চাই বংশের এক পোলা ডাক্তার হোক। মানুষের সেবা করুক।” দাদি একটু থেমে, বাবার চোখের দিকে তাকালেন। “তুই আবদুল্লাহ কে মাদ্রাসায় না পড়িয়ে স্কুলে ভর্তি করে দে।”
দাদির এক কথাতেই পরদিন বাবা আমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আমার লাইফ স্টাইলে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেল! সাদা পাঞ্জাবি টুপি ছেড়ে প্যান্ট-শার্ট পড়ে স্কুলে যেতে লাগলাম। এস.এস.সি’র পর বন্ধু দের পাল্লায় পড়ে ক্লিন শেইভ করে বাড়ি এসে ছিলাম। বাবা বাড়িতে ঢুকতে দেননি। অগ্নিমূর্তি ধারণ করে কড়া কণ্ঠে বলতে লাগলেন, “ইহুদী খিষ্টান চাল-চললে যে চলা ফেরা করে সে আমার ছেলে হতে পারে না। তুই বের হয়ে যা।” মাথা নিছু করে আছি। মুখ দিয়ে আমার কোন কথা বের হচ্ছিল না। ভাবছিলাম, হোস্টেল বন্ধ, কোথায় যাব কী করব। বাবা হঠাৎ মাটিতে পড়ে থাকা আমার ব্যাগটা তুলে আমার হাতে দিলেন। বের হওয়ার রাস্তাটা দেখিয়ে বললেন,
” যেদিন মুখে দাড়ি উঠবে,সেদিন পরিপূর্ণ সুন্নত নিয়ে বাড়ি আসবি তার আগে না।” হৈ চৈ শুনে দাদি বের হয়ে আসলেন। তীক্ষ্ণ গলায় বললেন,
“খলিল কী হইছে রে, কারে বাড়িত থাইক্যা বের করস?”
“আম্মা আপনি এই শরীরে বাইরে বের হলেন কেন? ভিতরে যান।”
“তোর সাহস তো কম দেখতাছি না, আমার নাতিরে তুই বের করে দিবি। এই বয়সে তোর তো ঠিক মত দাড়িই ওঠে নাই।”
দাদি আমার দিকে তাকালেন। থুরথুর করে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে ঘরের ভিতর নিয়ে গেলেন। এমনিতেও বাবার সাথে আমার কথা খুব কম হত। কোন প্রয়োজন পড়লে তিনিই আমাকে ডেকে পাঠাতেন। সেদিন রাতে বাবা নিজেই আমার রুমে আসলেন। আমি তখন অজানা ভয়ে কাঁপছি। মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, উনার কথা গুলো হজম করার। তিনি নরম গলায় বললেন, ” ভাত খেয়েছিস বাবা?”তাঁর কথা বলার আন্তরিকতায় আমি কিছুটা হচকিয়ে গেলাম। মাথা নেড়ে দুর্বল কণ্ঠে বললাম, “হ্যাঁ। “তোকে কেন এত বেশি শাসন করি তা জানিস? আমি চুপ। জবাব দিচ্ছিনা। বাবা আবার বললেন, ” বাবা’রা কোন দিন সন্তানের খারাপ চায় না। তুই যেন বাজে সঙ্গীদের পাল্লায় পড়ে নষ্ট না হয়ে যাস তাই এত শাসন করি। “
“বাবা ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দাও।”
“দেখ, মানুষের ভুল হবেই। তবে জেনেশুনে এমন কিছু ভুল করা ঠিক না; যেগুলোর নিজের সাথেই বেঈমানি করা, নিজেকে ঠকানো, এসব ভুল খুব মারাত্মক। তুই কী জানিস কোন আমলটা পুরুষরা সরাসরি কবরে সাথে করে নিয়ে যাবে?” “না বাবা।”
বাবা মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, ” দাড়ি হচ্ছে একমাত্র সুন্নাত, যেটা একজন পুরুষের সাথে কবর পর্যন্ত যাবে।”
আমি কিছু বলতে চাইছিলাম, বাবা থামিয়ে দিয়ে বললেন, “ক্লিন শেইভ মানেই স্মার্ট টা। আদর্শ মুসলিমদের স্মার্টনেস মানেই যুবক থেকেই দাড়ি রাখা।অনেকে বলে বিয়ে করি সন্তানাদি হোক, তারপর দাড়ি রাখবো। আরে বেটা,তুই যে কাল পর্যন্ত বেঁচে থাকবি সে ভরসা কি আছে?” ছাত্র হিশেবে খারাপ ছিলাম না। এইচ.এস.সি’র পর এক চান্সেই মেডিকেলে ভর্তি হলাম। প্রথম ছুটিতে বাড়ি এসেই দেখি সবার মুখে এক ধরনের চাপা হাসি। ঈদ ছাড়া ভাইবোন কখনো একত্রিত হতে পারিনা। কিন্তু সবাই এখন বাড়িতে।কিছুটা অবাক হয়েছি, ভেবেছিলাম আমি মেডিকেলে চান্স পেয়েছি,এজন্য প্রথম বাড়ি আসার খবর শুনে সবাই হয়তে এসেছে। কিন্তু সে ভুল ভাঙে আমার রাতে। দাদি সাথে কথা বলার ফাঁকে তিনি হঠাৎ বললেন,
” তোর মা গিয়ে দেখে এসেছে, মেয়ে নাকি অনেক সুন্দর। “
“কোন মেয়ে? কী বলছ এসব!”
“তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে। তোর বাবা বাড়ি ফিরুক ওর মুখেই সব জানতে পারবি।”
দাদির কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম।বুঝতে পারছি বিয়ের জল হয়তো অনেক টুকু গড়িয়েছে। যেভাবেই হোক এবার বাবাকে থামাতেই হবে। এমনিতেই মেডিকেলের পড়া পড়তে-পড়তে পাগল হয়ে যাবার দশা, তার মাঝে ছাত্র অবস্থায় আবার বিয়ে? ভোরবেলা ফজরের নামাজের পর বাবা সাথে দেখা। বড় দুই ভাই মুচকি একটা হাসি দিয়ে, বাবার সামনে আমাকে একা রেখে বাড়ির দিকে যেতে থাকল। বাবা মুখে হাসি এনে বললেন,
“কী খবর তোমার সালাত ঠিক মত পড়া হয় তো?”
“জ্বী, পড়া হয়।”
“খবর তো নিশ্চয় শুনেছ, সামনে শুক্রবার তোমার বিয়ে।”
চোখমুখ শক্ত করে বললাম, ” না বাবা আমি এখন বিয়ে করব না।” বাবা শব্দ করে হাসলেন। কৈফিয়তের স্বরে বললেন, “কেন বিয়ে করবে না শুনি?”
বললাম, ” ছাত্র অবস্থায় কেউ কী বিয়ে করে? আর আমি তো এখনো এক-পয়সাও কামাই করি না। তাছাড়া হঠাৎ বাবা আমাকে থামিয়ে দিয়ে, খালি-পায়ে হাঁটতে লাগলেন। আমিও তার পিছুপিছু হাঁটছি। বেশ কিছুক্ষণ পর আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার বয়স কত এখন? ” উত্তর দিলাম, “এই তো বাবা বিশ।” “হুম তার মানে তুমমি যতেষ্ট বালেক। বিয়ে করার বয়স হয়েছে।” অসহায় ভাবে বললাম, “তার মানে এই না যে এখনি বিয়ে করতে হবে।” কথাটা শুনে বাবা নড়েচড়ে দাঁড়ালেন। আমার পাঞ্জাবির পকেটে থাকা ফোনটার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ” স্মার্ট ফোন তো সাথেই আছে। নিশ্চয়’ই পেপারের আগে সব খবর আগেই পেয়ে যাও।” আমি বাবার দিকে তাকালাম, কিছু বললাম না। বাবা বললেন, ” এই যে হারাম রিলেশনশিপ, জিনা, ধর্ষণ, আরো অজানা আরো অনেক খারাপ কাজ পত্রিকা খুললেই দেখতে পাই।
প্রতিটা যুবকের চরিত্র যদি ঠিক থাকত, নৈতিক আদর্শ ও পারিবারিক শিক্ষা যদি সঠিক ভাবে পেত এসব কী হত? আমি বলছি না তুমি এসব খারাপ কাজে লিপ্ত হবে। কিন্তু বাবা হিশেবে আমার দায়িত্ব হলো অজানা অনেক পাপ থেকে তোমাকে হেফাজত করা। বললে যে টাকা পয়সা কামাই কর না, বিয়ে করে খাওয়াবে কী? আরে খাওয়ানোর মালিক তো উপরওয়ালা। কেউ কি কারো রিজিক খেতে পারে।যার যত টুকু সে ততটুকুই খেতে পারে। পৃথিবীতে কেউ তো না খেয়ে আছে না। প্রয়োজনে তিন বেলার খাবার তুমি এক বেলা কম খাবে।” সেদিন বাবার মুখের উপর আর কোন কথা বলার যুক্তি আমার ছিল না। বিয়েটা হয়েই যায় আমার। বিয়ের পর বাবা বললেন আফিয়া কে সাথে নিয়ে যেতে। বুঝিয়ে শুনিয়ে বললাম, হঠাৎ তো নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। পরের বার এসে নিয়ে যাব।
আমার বিয়ের খবর শুনে বন্ধুরা অনেকে হাসাহাসি করল। কেউ অভয় দিয়ে বলল, “হ্যাঁ যা করেছিস, একদম ঠিক করেছিস। ” ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসে একা-একা বসে থাকি। বন্ধুরা অনেকেই গার্ল ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে বেড়ায় গল্প করে, চিল-মাস্তি করে। তখনি বাবার কথাটা মনে হয়ে যায়, ‘হারাম রিলেশনশিপ’। ভাবতে থাকি, রঙিন চশমা দিয়ে দেখলে হয়তো এসব ভালোই দেখায়। কিন্তু একজন মুসলিম হিশেবে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে এই ব্যাপার গুলো আসলেই অনেক স্পর্শকাতর জ্ঞানের স্বল্পত ও বুঝার অক্ষমতায় একসময় মনে হয়েছিল বাবা বুঝি আমার উপর খবরদারি বা অত্যাচার করছেন। আজকাল চিন্তা করি বাবা যা করেছেন সবি সঠিক ছিল।
পরের বার আফিয়া কে সাথে করে নিয়ে আসি। ছোট্ট একটি বাসায় আমাদের সংসারটা খুব ভালোভাবেই জমে যায়।
ক্লাস শেষে যখন বাসায় আসি, দেখি সে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতিদিন সে আমার জন্য এভাবেই অপেক্ষা করে। আজ আমাকে রিক্সা থেকে নামতে দেখেই এক ঝাটকায় সড়ে যায়। আমি জানি সে এখন কী কী করছে। প্রথমে দৌড়ে ওয়াসরুমে গিয়ে পানির কল ছাড়বে, আমার কাপড় গুলো আনবে, তারপর চুপিচুপি দরজার ওপাশে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে, এবং কলিংবেল টিপার আগেই আমার পায়ের আওয়াজ শুনে দরজা খুলে ফেলবে। ঠিক আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গোসল শেষ করে এসে খাওয়ার সময় বললাম, “এই যে প্রতিদিন তুমি আমার জন্য এত কিছু কর, বিনিমেয়ে আমি তো তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনা।”
সে মুচকি হেসে বলে, “কে বলে পারেন না? এই যে আপনি প্রতিদিন ক্লাস শেষে ঠিক সময়ে ফিরে আসেন। অযথা কোন বাজে আড্ডা দেন না। আমি সারাদিন খালিবাড়ি তে অপেক্ষা করে যখন আপনার মুখটা দেখতে পাই,তখনি তো সব পাওয়া হয়ে যায় আমার।” আফিয়ার কথা শুনে চোখ ভিজে যায় আমার। ভাবি, পুরুষদের জীবনে ঠিক সময়ে বিয়ে করাটা যতটা গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক ততোটা গুরুত্বপূর্ণ একজন পুণ্যবতী স্ত্রী পাওয়া।
গল্পের বিষয়:
গল্প