একটা বন্ধ দোকানের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি একটা ফাঁকা আসনের গাড়ির খোঁজে। ডান হাতে লাগেজ আর বাম হাতে ছাতা। ওড়না দিয়ে ভালো করে মাথা ও মুখটা ঢেকে রেখেছি। পরিচিত কেউ চলে এলেন কিনা এই ভয়ে ভিতরে চুপসে যাচ্ছি। একের পর এক গাড়ি যাচ্ছে কিন্তু একটাতেও আসন ফাঁকা নেই। একটা রিকশারও দেখা নেই। ঝুম বর্ষার দিনে রিকশা পাওয়া যেন খুব দুর্লভ বিষয়।
যে রাস্তায় দাঁড়াতেই একের পর এক রিকশা আসতে থাকে সেই রাস্তায় আমি আর জুলিয়া ত্রিশ মিনিট যাবৎ দাঁড়িয়ে থাকার পরে একটা অটোগাড়ি পেলে জুলিয়াকে বিদায় দিয়ে লাগেজ নিয়ে অটোতে উঠে পড়লাম। তারপর এখানেই নেমে যেতে হলো, কেননা গাড়িটা আমার গন্তব্য অব্দি যাবে না। শহর জুড়ে ঝরছে শ্রাবণের ঝুম বরষা। অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে পুরো শহর সাদা দেখাচ্ছে। খুব প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া কেউ’ই বাহিরে নেই। গুটি কয়েক দোকানপাট ছাড়া বাকিগুলো বন্ধ করে দিয়ে বাড়ি চলে গেছেন দোকানদারেরা। রাস্তায় একটা কাক অথবা কুকুর বেড়ালকেও দেখা যাচ্ছে না। অথচ এমন সময় বৃষ্টি না থাকলে ডাস্টবিনের পঁচা খাবার খাওয়ার জন্য হয়তো কুকুর বেড়াল আর কাকে কাড়াকাড়ি লেগে যেত।
এমন দিন অলস মানুষদের ঘুমের জন্য আশীর্বাদ। কর্মজীবীরা তাড়াতাড়ি নিজেদের কাজ শেষ করে সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফেরার তাগেদা অনুভব করেন ভেতর থেকে। বাড়ির গৃহিণী পরিবারের লোকজনদের জন্য ঝাল ঝাল ভুনা মাংস, ইলিশ মাছ ভাজা, তেলের উপর বেগুন ভাজা, শুঁকনো ঝাল ভর্তাসহ মজার সব খাবার প্রস্তুত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন রান্নাঘরে। সদ্য প্রেমে পড়া কিংবা প্রেমে ডুবে থাকা প্রেমিক বা প্রেমিকারা এমন সময় প্রিয়জনকে খুব মনে করতে থাকে আর বাড়ির লোকের চোখ ফাঁকি দিয়ে মুঠোফোনেই কথা চালাচালি করতে থাকে। বাচ্চারা খুব খুশি হয় কারণ স্কুল কোচিং থেকে দূরে থাকার জন্য এমনও ঘন বরষা তাদের জন্য আনন্দের সংবাদ বয়ে আনে। বয়স্ক লোকেরা বৃষ্টির সময়ে প্রার্থনা করতে বেশি ভালোবাসেন।
সম্প্রতি কোনো সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া বা বিষন্নতায় আচ্ছন্ন হওয়া মানুষটি আরও বেশি বিষাদ খুঁজে পায় এই বরষাতে, আরও বেশি একলা হয়ে পড়ে ভেতরে, একাকিত্বে ভোগে খুব গোপনে। কিন্তু এই বরষাতে যাদের বাড়ি বিয়ের আয়োজন থাকে, তারা বেশ ভোগান্তি’তে পড়েন। প্রতি মুহুর্তে প্রার্থনা করেন বৃষ্টি থামবার। অনবরত পড়তে থাকা বর্ষার পানি রাস্তার মধ্যে ছোট ছোট গর্তগুলোতে জমে যাচ্ছে। হঠাৎ’ই একটা গাড়ি এত দ্রুত গতিতে এলো যে, জমে থাকা পানি আমার গায়ে ছিটিয়ে দিয়ে চলে গেল। রাগে শরীররটা জ্বলতে লাগলেও আমার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়। বেশ জোরে চেঁচিয়ে উঠলেও বৃষ্টির শব্দে সে আওয়াজ গাড়ি অব্দি পৌঁছায়নি আমি নিশ্চিত। লাগেজটা রেখে ছাতার সাহায্য হাতের তালুতে বরষার পানি জমা করে তার সাহায্যে আস্তে আস্তে জামায় লেগে থাকা কর্দমাক্ত পানির ছাপগুলো মুছে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছি।
নাবিলের একবার খোঁজ নেওয়া দরকার। মুঠোফোনটা হাতে নিতেই দেখি, একটা ক্ষুদে বার্তা জমা হয়েছে। নিশ্চয়ই সিম কোম্পানি থেকে বিদঘুটে সব অফারের বার্তাই হবে। এসব বার্তা ছেড়ে নাবিলকে কল দেওয়া এখন খুব প্রয়োজন। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে একবার কথা হয়েছিলো পরে আর কথা বলার সুযোগ হয়নি। নাবিলকে কল করলাম। মিষ্টি কন্ঠের ভদ্রমহিলা বললেন, ‘দুঃখিত। আপনার কাঙ্ক্ষিত নাম্বারে এই মুহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পরে আবার ডায়াল করুন।’ এমন জরুরী সময় ফোন বন্ধ পেলে দম আটকে আসার মত অবস্থা হয়ে যায়। হয়তো ফোনে চার্জ শেষ। যাইহোক, খানিক পরেই তো দেখা হচ্ছে। এটাই এখন বড় সান্ত্বনা। অবশেষে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো। একটা খালি রিকশা দেখে হাত ইশারা করতেই থেমে দাঁড়ায়। আমাকে দেখে তার মুখেও যেন হাসির রেখা ফুটলো।
‘মামা, যাবেন?’
‘হ যামু। কই যাইবেন?’
‘রেল স্টেশন।’
‘হ, যামু। ভাড়া কিন্তু পঞ্চাশ টেহা দেওন লাগবো।’ চোখ কপালে তুলে বললাম, ‘কিহ্! বিশ টাকার ভাড়া আপনি পঞ্চাশ টাকা চাচ্ছেন?’
‘না গেলে যাইয়েন না। এর কমে আমি যামু না।’
খুব রাগ হলেও নিজেকে সংবরণ করলাম। এই মুহুর্তে আমি ভীষণ বিপদে আছি, তার উপর এত বৃষ্টি, রাস্তাঘাটেও ফাঁকা গাড়ি পাওয়া খুব কষ্টকর। এখন কোনোভাবে রিকশাটাকে হাতছাড়া করলে ভীষণ পঁচতাতে হবে। রিকশাওয়ালাও সুযোগ বুঝে কাজে লাগালো। উপায়হীন হয়ে উঠে পড়লাম। নাবিলের মুঠোফোনটা এখনো বন্ধ রয়েছে। এতক্ষণে নাবিলের স্টেশনে পৌঁছে যাবার কথা। গিয়েই হয়তো দেখবো, হাসিমুখটা দাঁড়িয়ে আছে আমার অপেক্ষাতে।
আজ সন্ধ্যায় আমার গায়ে হলুদ আর আগামীকাল বিয়ে। বাড়ি জুড়ে বিয়ের আয়োজন চলছে। পার্লারে আসার বাহানা করেই জুলিয়ার সঙ্গে বাসা থেকে বের হয়েছিলাম। লাগেজটা আগেই রাখা ছিল জুলিয়ার এক আত্মীয়ের বাসায়। ওখান থেকেই লাগেজটা আনার ব্যবস্থা করেছি। স্টেশনে নেমে লাগেজ নিয়ে দ্রুত গতিতে হাঁটতে লাগলাম রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মের দিকে। নাবিলের মুঠোফোন এখনো বন্ধ। প্ল্যাটফর্মে খুঁজতে লাগলাম নাবিলকে কিন্তু কোথাও পেলাম না। হয়তো এখনো এসে পৌঁছায়নি। আমি দ্রুত রাজশাহী ট্রেনের দু’টো টিকেট কেটে নিয়ে এলাম। তারপর বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম নাবিলের। এখনো একনাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। পাশে থাকা এক বৃদ্ধা বললেন, ‘কয়েকদিনে আর মনে হয় এ বৃষ্টি থাইমবার নয়।’ আমি তার দিকে তাকিয়ে দু’ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে আনলাম। বৃদ্ধা প্রশ্ন করলেন, ‘কোথায় যাইবা তুমি?’
‘রাজশাহী’
‘আমরাও রাজশাহীতেই যাইবো। আমার মেয়ে জামাই বাড়ি ওইখানে।’
‘আচ্ছা।’
‘রাজশাহীতে কোন জায়গায় যাইবা?’
‘সদরেই।’
‘একলা যাইবা? নাকি আর কেউ আইবো?’
এই মুহুর্তে বৃদ্ধার এত প্রশ্নে আমার খুব বিরক্ত লাগলেও জোর করে হাসিমুখে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে।
‘হ্যাঁ, একজন আছে।’
‘তার জন্যই অপেক্ষা কইরতেছো বুঝি?’ মাথা ঝুকে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলাম।
এদিকে নাবিলকে একের পর এক কল করে চলছি। কিন্তু তার ফোনটা এখনো বন্ধ। বিষয়টা বৃদ্ধা বুঝতে পেরে বললেন, ‘কী হইলো? তার নাম্বার বন্ধ নাকি?’ আমি কোনো উত্তর দিলাম না। বৃদ্ধার পাশে একজন বৃদ্ধ এসে বসে বাদামের ঠোঙ্গা এগিয়ে দিলেন তার দিকে। বৃদ্ধা হাসিমুখে তাকে বললেন, ‘বাদাম আনার জন্যই তাইলে আপনি এতদূর গেইলেন।’ বৃদ্ধ লোকটা হাসলেন, উত্তর দিলেন না। বৃদ্ধা আমার দিকে ঠোঙ্গাটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘নাও, বাদাম খাও। বাদাম খাইলে চেহারা ভালো হয়।’ ‘আমি খাব না। আপনি খান।’ ‘কী যে কও না! তোমাগো বয়সের ছেলে-মেয়েরা বাদাম খাইবা বেশি কইরে। আমার তো বাদাম খুব পছন্দ, এই বয়সেও তোমার দাদু আমার জন্য খুঁইজে বাদাম নিয়ে আসেন।’ বলতে বলতে হেসে ফেললেন তিনি। তার হাসিতেই তার দাম্পত্য জীবনের সুখগুলো স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
বাদাম ছিলতে ছিলতে নাবিলের বন্ধ ফোনে কল করে চলছি। আমার আগের সিমটা ভেঙ্গে ফেলেছি। নতুন সিমটাতে নাবিল, জুলিয়া আর বাড়ির কয়েকজনের নাম্বার ছাড়া আর কারোর নাম্বারই নেই। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। এতক্ষণে বাড়িতে বিষয়টা জানাজানি হয়ে গিয়েছে নিশ্চয়ই। আমার খোঁজাখুঁজি চলবে এটাই স্বাভাবিক। জুলিয়াকে কল করাটা এই মুহুর্তে ঠিক হবে কিনা বুঝে উঠতে পারছি না। বাবাকে বেকার নাবিলের কথা যতবারই বলেছি তিনি হুংকার মেরে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। শেষমেশ এমন হয়ে দাঁড়ালো যে পড়াশোনা শেষ করার সময় অব্দিও বাবা দিলেন না। দুম করে বিয়ে ঠিক করে ফেললন। এটাই তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তাও জানিয়ে দিলেন। পালিয়ে আসা ছাড়া আর কোনো পথই বাবা খোলা রাখলেন না। ‘চলো, চলো।’ বৃদ্ধার কথায় হকচকিয়ে উঠে বললাম, ‘কোথায়?’ ‘ট্রেন ছাইড়বে তো এখনই।’
টিকেট কাউন্টার থেকেই শুনে এসেছিলাম এটাই আজকে রাজশাহী যাওয়ার শেষ ট্রেন । নাবিল এখনো আসেনি। ওকে ছাড়া ওর বোনের বাড়িতে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাড়াহুড়ো করে ফোনটা বের করে নাবিলকে অনবরত কল করেই যাচ্ছি, কিন্তু নাম্বারটা এখনো বন্ধ। বুকের ভেতর কেমন যেন অস্থির অনুভূতি জেগে উঠলো। চোখে জল জমে গেল। কী করা উচিৎ এই মুহুর্তে বুঝে উঠতে পারাটা ভীষণ কঠিন। বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা আমার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। আমি তাদের নিকটে গিয়ে বললাম, ‘আপনারা যান। আমাদের বোধহয় ট্রেনে যাওয়া হবে না। বাসেই যেতে হবে।’ আমার অস্থিরতা কিভাবে যেন অনুভব করে ফেললেন দু’জন। বৃদ্ধা ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে। আর যদি সে না আসে, তবে তুমি বাড়ি ফিইরা যাইয়ো।’ বৃদ্ধ লোকটা হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আসি আমরা।’
এই মুহুর্তে নিজেকে খুব অসহায় লেগে উঠলো। জুলিয়াকে কল করে ওদিকের ঘটনা জানতে চাইলে বললো, ভাবী ছাড়া বাড়ির লোক এখনো আসল ঘটনা সম্পর্কে কিছু জানতে পারেনি। তারা জানেন, আমি জুলিয়ার বাসায়। সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে যাব আর ফোনটা হারিয়ে ফেলেছি, তাই ফোন বন্ধ। ভাবীই বাড়ির সবাইকে এসব বুঝিয়ে আপাতত শান্ত রেখেছেন। শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ পেলেই তবে ভাবী আসল ঘটনা তুলবেন বাবার নিকট, তার আগে নয়। কেননা বাবা এখন জানা মাত্রই তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে বসবেন। ফোনটা হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে আসি। ট্রেনটা মাত্র স্টেশন ছাড়লো। চোখ ভিজে জল নামছে। দুশ্চিন্তারা মাথাটাকে কুঁড়ে খাচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো, ফোনের বার্তাগুলো একবার দেখা উচিৎ।ইনবক্সে চোখ রাখতেই দেখি দুপুরের সেই বার্তাটা সিম কোম্পানির ছিল না, নাবিলের ছিল।
‘আমার পক্ষে এভাবে তোমায় বিয়ে করা সম্ভব নয়। আমরা আমাদের পরিবারকে কষ্ট দিয়ে সুখি হতে পারবো না। আর তোমাকে ভালো রাখার সমর্থও আমার নেই। অনেক ভেবেই কথাগুলো লিখছি। মুখে বলার সাহস নেই বলেই লিখতে হচ্ছে। আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিও। তোমার ভবিষ্যৎ সুন্দর হোক, শুভ কামনা রইলো।’ বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। মেঘের ফাঁকে সূর্যের অস্তমিত হওয়ার লাল আভা ফুটে উঠেছে। শহরটাকে নিস্তব্ধ লাগছে। চেখের জল চোখেই শুকিয়ে যাচ্ছে। মুছে ফেলার তাগেদা নেই কোনো। আমি গুটি পায়ে এগিয়ে চলছি বাড়ির উদ্দেশ্যে। আজ রাতে হলুদ শাড়িতে আমার ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। সব ভালোবাসা পূর্ণতার নয়, কিছু ভালোবাসা অপূর্ণতারও।
গল্পের বিষয়:
গল্প