মায়াকে বাসার নিয়ে আসার পর ও কেমন জানি হতে শুরু করলো। যদিও ওর সাথেই এই বাসায় প্রথম এলাম। তবে মায়ার আচরণ বড়-ই আজব আমার কাছে লাগতে শুরু করলো। মায়া ওর বাবার ব্যাপারে আমার তেমন কিছুই বলেনি, এখানে আসার পর আমি অবাক বিষ্ময়ে বিষ্মিত হলাম। ঢাকার মতো শহরে তিন টা বিশাল বাড়ি। এখন যেখানে আছি এটা অনেক সুন্দর একটা বাড়ি।
আমরা বাসায় পৌঁছানার পর ওর বাবা-মায়ের পায়ে ধরে সালাম করে নিলাম। আসলে আমাকে পছন্দ হলেও জব নেই শুনে শশুরমশাই যে কিছুটা বিচলিত তা আর বলতে হয়নি। তার কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম আমাকে বলে দিয়েছে। এদিকে শাশুড়ি আম্মা বেশ খুশি আমাকে পেয়ে। তার এক মাত্র মেয়ের জামাই এখন তার ছেলেই হতে হবে। শাশুড়ি কি ভেবে যেন আমাকে বললেন ‘বাবা এখন থেকে আমাদের এখানেই থেকে যাওনা! তোমার বাবা মানে মায়ার আব্বুও সেটা চান। কারণ মায়ার স্বপ্ন পূরণের জন্য এখানে থাকা বাঞ্চনিয়” আমি কিছুটা সবিনয়ে মাথা নুইয়ে বললাম, “আপনি আর আব্বু যা ভালো মনে করেন। তাছাড়া আমারো অনেক ইচ্ছে মায়া তার স্বপ্ন পূরণ করবে। আমার ফ্যামিলি থেকেও সেটাই বলেছে” আত্নিয়রা এলেন খুঁচাও দিলেন। মামাশ্বশুর এর ছেলে মুস্তাফিজ এসেই বললো
“এ হে মেরা ভাইয়্যু এবার যে কাঁচানোট ছাড়তে হচ্ছে”
আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম “বাবারে শালাবাবু দেখি কথা শিখে গেছে! তা শালা টাকা দিয়ে কী হবে? প্রেমিকা আছে নাকি?” শুনে শালাবাবু আমার লজ্জা পেলো এমন সময় মায়া রুমে এসেই বললো “কী হচ্ছে এখানে?” আমি একটা হাসি দিয়ে বললাম “ওই দুলাভাই আর শালা মিলে গল্প করছিলাম”
“কি গল্প করছিলেন”
“ছিঃ ছিঃ এসব বলা যায় নাকি”
“উহ ঢং! ভাইয়া যাও পড়তে বসো”
“যাবার আগে শালাবাবু টাকার জন্য একবার তাকিয়ে ছিলো বুঝলাম তবে ব্যাপার টা এড়িয়ে মায়ার দিকে তাকিয়ে বললাম।
“ওরে আল্লাহ আমার বউরে দেকতি এত ফাইন লাকতেচে ক্যাঁ”
“ওই চুপ। এই ভাষায় আর কথা বলবেন না আম্মা শুনলে কি ভাব্বে”
তিন চার মাস কেটে গেলো ভুড়িভোজ আর আপ্যায়ন নিয়ে। ও হ্যাঁ আমার শশুর নিজেও ডক্টর সো টাকার অভাব নেই। এদিকে আমার জব কেন করতে হবে ভাবতেই পারিনা। তবুও শশুরের টাকাতে চলা কেমন দেখাই না? তাছাড়া আম্মা যদি শোনে এসব তখন? কি করা যায়? আমাকে যদি আমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করা হয় তবে আমি বলতে পারি, “বই লিখে টাকা আয় করতে পারবো” যদিও মায়াকে একবার বলেছিলাম তবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে,
– আচ্ছা জান একটা কথা বলি?
– আপনাকে না এসব জান বাবু ডাকতে বারণ করছি।
– ওপ্স মুখ ফোসকে বের হয়ে গেছে।
আচ্ছা শোনো, তুমি তো আমাকে অনেক ভালোবাসো আর আম্মুও আমাকে অনেক ভালোবাসে এজন্য আমি চাচ্ছিলাম এমন একটা জব করতে যাতে বাইরে যেতে নাহয়। মানে ঘরে বসে কাজ করার মতো কোনো প্ল্যান আর কি। আমি কিন্তু একটা ব্যাপার ভেবেও রেখেছি জানো? মায়া ভ্রুকুটি করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো – কি শুনি?? “মনে করো আমি বই লিখতে পারি। উপন্যাস এই মনে করো গল্প + কবিতা তারপর তা প্রকাশ পেলো আর সবায় কিনলো জনপ্রিয়তা বাড়লো আমিও টাকার মালিক হলাম আর বেকারত্ব ঘুচলো সাথে তুমিও আমাকে সারাক্ষণ কাছে পেলে। ভালো ভাবছিনা বলো?
– নাহ একদম না। আপনাকে এইসব লেখক টেখক হতে হবেনা। আপনি বিসিএস টা দেবেন।
– আমাকে দিয়ে এসব কখনওই হবেনা। তার থেকে ভালো তোমার বডিগার্ড হই। আমার শশুরের কত টাকা বলো?
– একদম না। আগামীকাল থেকে আপনি জবের জন্য ট্রাই করবেন। আর হ্যাঁ আমিও পড়ালেখা নিয়ে বিজি। এতো সময় নেই কথা বলার।
– মাঝেমাঝে প্রেম তো করতেই পারো।
– কেন প্রেম করতে হবে কেন? আজ থেকে আমরা আলাদাভাবে ঘুমাবো।
– একদম না। আমি পারবো না তোমাকে ছাড়া ঘুমাতে।
– কেন বিয়ের আগে কে থাকতো আপনার সাথে??
– মায়া থাকতো।
– আমি থাকতাম মানে?
– হুম আমার কোলবালিশ এর নাম মায়া।
– তো কোলবালিশ নিয়েই থাকতেন আমার কাছে কি?
– কী আবার ভালোবাসি আমার বউ কে।
– উঁহু, যান ফ্রেশ হয়ে আসেন আজকে বাইরে যাবো আপনাকে নিয়ে।
এদিকে মায়া আমাকে যতোই সময় দিক না কেন। মা কিন্তু মায়াকে এখনো মেনেই নেইনি। আমি মায়ের সাথে কথা বলি। মা একবারো মায়ার কথা জিগ্যেস করেনা। আবার বাবা কথা বলে মায়ার সাথে। বাবার ওষুধ খাওয়া বা কিছু লাগবে কি’না মায়া জিগ্যেস করে। ছোটোবোন লতা মায়ার সাথে প্রায় কথা বলে। মায়া যে দেখতে সুন্দরি নয় শ্যামবর্ণের এটা ওর বাবা-মাকে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই। তারা যেন এটা মানেইনা। আমার ভালো লাগে এই ব্যাপার টা। বিয়ের দুইবছরে পরের কথা। মায়ার তখনো শেষ সেমিস্টারের ফাইনাল পরিক্ষা, বেশ প্রস্তুতি নিচ্ছে তাছাড়া তার জন্য যাবতীয় নোটস কালেকশন আমিই করেছিলাম। তার বান্ধবির বাসায় যাওয়া! কলেজে যেয়ে কাগজপত্র জমা দেওয়া আমার ভালোই লাগতো বউ এর জন্য কাজ করতে। যদিও ওর বান্ধবিরা আমাকে নিয়ে কানাঘুষো করতো। তাতে আমার হাসিই পেতো।
পরিক্ষা চলাকালীন মায়াকে বেশি রাত পর্যন্ত পড়তে বারণ করতাম। আবার দুজন সকালে উঠে নামায পড়ে ওকে পড়তে বসতে বলতাম। আর মায়া লক্ষ্মী মেয়ের মতো পড়তো। মাঝেমাঝে মায়ার চুলে তেল দিয়ে দিতাম বা চুল আছড়ে দিতাম মায়া শুধু মিটমিট করে হাসতো আর বলতো “এতোটা ভালো না বাসলেও পারতেন কিন্তু” আমি কেবলি বলি “আহ চুপচাপ পড়ো নাহলে কিন্তু আব্বুর স্বপ্ন পূরণ করতে পারবেনা। আর আমিও ডাক্তারের জামাই হতে পারবো না” মায়া কেবল হাসে আর পড়ে। কখনো বা এমন হয় আমি মায়াকে গোসল করিয়ে দেই। আমি খাইয়ে দেই। মায়া কেবল আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার কপালে একটু চুমু দিয়ে বলে “ভালোবাসি”। বিশ্বাস করেন পাঠক তখনো আমার মনেই হয়নি মায়া কালো। বা আমার আজও মনে হয়না মায়া কালো।
পরিক্ষার আগের রাতে মায়ের সাথে কথা বলতে চাইছিলো বাট আম্মা বলেনি। আমার শশুর-শাশুড়ি কিন্তু এসব কিছুই জানেনা। আর মায়াও বলেনি। কারণ মায়া অনেক ভালো একটা মেয়ে। সেইদিন মায়া কথায় কথায় বলছিলো “জানো আম্মু আমার শাশুড়ি কী দারুণ রান্না করতে পারে। তুমি একবার খেলেই প্রেমে পড়ে যাবে” এই কথা শুনে শাশুড়ি আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘মেঘ বাবা, তোমার মা অনেক ভালো রান্না করে নাকি?’ আমি হেসে বললাম ‘জ্বি আম্মু আপনার মতোই’ শশুরমশাই আমার বাবার সাথে বেশ ভালো একটা সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। দুজন মিলে নানান গল্প করেন। ভালোই লাগে আমার। এবার বাড়ি গেলে ছোটোবোন কে একটা স্মার্ট ফোন কিনে দেবো ভেবেছি যেন বাবাকে দেখতে পারি। খুব সুন্দর চলছিলো আমাদের সংসার। যদিও এটাকে আমার আর মায়ার সংসার বলেনা। বলে শশুরের সংসারে আমরা মেহমান। তবে মায়ার জব হলেই আমরা বাসা নিচ্ছি আর আমিও জবের জন্য ট্রাই করছি অপেক্ষা। এই যুগে বই লিখে পেটে ভাত জুটবেনা জানি, কিছু একটা করা লাগবে।
যেদিন মায়ার রেজাল্ট হবে আমার তো সেই রকম চিন্তা হচ্ছিলো। মায়া নিজের রুমে একা একা শুয়ে আছে! আর এদিকে আমি আর বাবা বসে বসে ভাবছি। ঠিক দুপুরবেলা মায়ার রেজাল্ট হাতে পেয়েছিলাম। আমিতো চিল্লিয়ে উঠি আমার খুশি দেখে কে। আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। যেন আমিই ডাক্তার হয়েছি এমন খুশি আমার। খুবই দারুণ রেজাল্ট করে মায়া। সেইদিন প্রথম বাবা-মায়ের সামনে মায়াকে জড়িয়ে ধরি! লজ্জার মাথাও খেয়ে বসি। শশুর ব্যাপার টা বুঝতে পেরে সামলে নিলেন। শাশুড়ি শুধু মায়াকে বললেন “এমন ছেলে পেলি কোথায় তুই পুরাই পাগল” এদিকে বউকে জড়িয়ে ধরি একবার। চুমু খাই একবার। বাবাকে কল করি। কত যে আনন্দ আমার। প্রিয় পাঠক তখনো কিন্তু আমার মনেই হয়নি মায়া কালো বা শ্যামবর্ণের। ভালোবাসা কালো টালো মানেনা বুঝলেন। জীবনে বহু মেয়েকে দেখেছি! ধুর ভালোই লাগেনা। আমার বউ হচ্ছে দুনিয়ার শেরা সুন্দরি। আমার বউয়ের মিষ্টি তেলাওয়াত শুনলে আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য। কথা শুনলে ইচ্ছা করে শুনেই যাই। জ্বি মায়া আমার বউ।
তারপর ওর বাবার পরামর্শ নিয়ে শুরু হয় মায়ার নতুন জীবন। নতুন ভাবে শুরু হয় আমার স্বপ্ন পূরণের অঙ্গিকার। আর ঠিক এক বছরের ইন্টার্র্নি তারপর মায়াকে পেছনে ফিরে তাকাতে হবেনা। এদিকে মায়াকে নিয়ে দুইটা ঈদ কাটিয়েছি ঢাকাতে। মায়া গ্রামে যেতে চেয়েছিলো তবে আমিই নেইনি। শুধু ওই একটা অজুহাত। এবার আর কোনো অজুহাত নেই। আমিও রাজি হলাম মায়াকে নিয়ে যাবো। শশুরের প্রাইভেট কার থাকতে আমার আর ঝামেলা কি? দুদিন ভর নানানকিছু কেনাকাটা করলাম। একটা ব্যাপার মায়া আগের থেকে কিছুটা সুন্দরি লাগছে। আসলে আমার কাছে নাকি সত্যিই হয়েছে আমি জানিনা। কারণ ও আমার কাছে সবসময় সুন্দরি ছিলো। চারবছরের প্রেম চাট্টিখানি কথা না। যখন আমরা গ্রামের উদ্দেশ্যে বের হলাম। শশুর আমাকে জড়িয়ে কেঁদেই দিলেন।
“বাবা তোমার মতো ছেলের সাথে আমার বিয়েকে দেখে আমি খুব-ই খুশি। তোমরা খুব সুখে থেকো বাবা” শশুরবাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে বের হলাম গ্রামের উদ্দেশ্যে। একটা ব্যাপার বুঝিনা আম্মার সাথে মায়ার তেমন কোনো সুসম্পর্ক বা মধুর স্মৃতি নেই। তবুও আম্মার জন্য মায়ার সচেতনতার অন্ত নেই। আম্মা ঠিক আছেন তো? খেয়েছেন তো? ব্যথা এখন কেমন? ওষুধ নিচ্ছেন তো? বেশি কাজ যেন না করে। বিকালে যেন সামান্য হাটাহাটি করে নানান কিছু লতাকে বলে দেয়। আর লতাও বাধ্য মেয়ের মতো সবকিছুই শোনে। বাসায় যখন আমরা পৌঁছাব তখনো কী আম্মা মায়াকে অপছন্দ করবে? নাকি জড়িয়ে ধরবে, আম্মা জড়িয়ে নিলেই মায়ার আর কোনো খোভ থাকবেনা। যদিও মায়া এসব নিয়ে আমাকে কোনো কথা বলেনি আজও। মায়া মেয়েটা কেমন যেন চাপা স্বভাবের। এখন আমার কাঁধে লক্ষ্মী মেয়ের মতো মাথা গুঁজে শুয়ে আছে। আর আমি ওর হাতটা ধরে চোখ বুঝে আছি।
ভালোবাসা যেন এমনি। কাছের মানুষ বা প্রিয় মানুষের সাথে থাকতে পারা জীবনের বড় এক অর্জন। আর এক সাথে থাকার ফলে যে সুখ অনুভব হয় তা অতুলনীয়। আমারো তেমনি অনুভব হচ্ছে। আমাদের টোটাল সম্পর্ক ছয় বছরে! আমার কিন্তু মায়াকে ছাড়া অন্য মেয়েকে নিয়ে থাকার কথা ছয় সেকেন্ডের জন্যও মনে হয়নি। কারণ সম্পর্ক যখন মজবুত হচ্ছে তখুনি আমি বউ বলে ডাকতাম। আর ওর বাবার ব্যাপারে তেমন কিছুই বলতে চায়নি। আর আমিও জোর করিনি। তবে আমার শশুরমশাই বেশ উঁচু আর সাদারঙের আমার শাশুড়ি দেখতে সুন্দরি। কিন্তু আমার বউ কেন এমন হলো? এই প্রশ্ন করলে নিশ্চিত শাশুড়ি রেগে যাবেন তাই আর করিনি। যখন গ্রামের বাড়ি পৌছালাম তখন রাত ১০:০০ বাসায় এসেই আব্বু-আম্মু কে পেয়ে অনেক খুশি হলাম। আর এবার আম্মাকেও দেখলাম তেমন অভিমান নেই। মায়া যখন আম্মাকে জড়িয়ে ধরলেন আম্মা আর ছাড়ালেন না। মেয়ে ডক্টর হয়েছে কেন অখুশি হবে। অন্ততপক্ষে সবার কাছে গল্প তো করতে পারবে। আর লতা তো প্রচণ্ড খুশি।
“দাদা কতদিন পর এলি। তুই মোটা হয়ে গেছিস। ভাবী অনেক যত্ন করে তোর তাই না। আমার জন্য কী এনেছিস আগে বের কর”
“কিছুই আনিনি তোর জন্য একটা আধাপাগল ছেলে খুঁজে বের করবো তারপর তোকে বিয়ে দেবো হাহাহাহ”
“আমাকে না তুই আরেকটা বিয়ে কর যা”
কথাটার সাথে মায়া তালমিলিয়ে বললো।
“আচ্ছা মেঘ ভাইয়া তাহলে আরেকটা বিয়ে করেন আমি আর আপু বিয়ে খাবো”
“তুমিও আমাকে ভাইয়া বলতেছো”
‘এ’মা আপনি তো পাবলিক ভাইয়া’
‘ধ্যাত’
রাতের বেলা সবাই মিলে নানান গল্প করলাম। কার জন্য কি এনেছি সব লতা আর মায়া বের করে দিলো। তাদের দুজনের হাসিমুখ দেখে আমার যেন কলিজা জুড়িয়ে গেলো। লতা মায়াকে বলেওছিলো “ভাবী তুমি কিন্তু আগের থেকে অনেক বেশি সুন্দরি আর কিউট হয়ে গেছো’ আমি হেসে বললাম। ‘হ্যাঁ নতুন নতুন প্রেমে পড়েছে এজন্য’ মায়া এবার কিছুটা ভ্রু কুঁচকে বললো “আহারে”
গ্রামে বের হইনা কতকাল। সেই বাল্যকালের বন্ধু। দূরন্তপনা। যাদের দেখেছি পিচ্চি এখন তারা কত বড় হয়ে গেছে। বেশ আনন্দ হলো। আমার যে এখনো জব হয়নি আর হয়েছিলো আমিই করিনি মায়ার ডক্টর বানাবো এজন্য। এই ব্যাপার টা কেও জানেনা। আমি হাসিমুখে বলি ‘এই করি।ছোটোখাটো কিছু’ সপ্তাহ খানেক পরের কথা, এক রাতে বাবা আমাকে ডেকে বললেন “আসলে তোমার সাথে এসব নিয়ে কথা হয়নি আগে তবে আজ বলা জরুরী। লতার জন্য একটা সুপাত্রের সন্ধান পেয়েছি। আমি চাই একবার তুমি তার সাথে কথা বলো, যদি পছন্দ হয় বিয়ের দিকে আগাবো” ‘আচ্ছা বেশ তো, তা ছেলে কি করে? আপনি চেনেন তাকে?’
‘ছেলে প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করে। বেশ ধার্মিক ও সুদর্শন যুবক। তার বাবা বাজারে ওষুধের দোকান করেছেন আমার বন্ধু মানুষ’ ‘বাবা আপনি যেহেতু ভেবেছেন সেহেতু আমি কথা বলে দেখি তারপর নাহয় বিয়ের জন্য পাকা কথা বলবেন’ রাতে মায়াকে ব্যাপার টা বললাম। লতার পড়ালেখা শেষ! এখন সামনে বিসিএস দেবে আর এদিকে বাবা চাচ্ছেন বিয়ের কথা। মায়া সব শুনে বললো “বাবা আর আপনি যা ভালো মনে করেন। তবে লতার অনুমতি আর ওর পছন্দ আছে নাকি এবং ছেলের চরিত্র কেমন এসব জানা খুব জরুরী। এবং আজ লতার বিয়ে! ওই ছেলের সাথেই। ছেলে দেখতে সুন্দর তাছাড়া শিক্ষকতার পেশা বেশ ভালো তাতে আর কেও অমত করেনি। বিয়েটা সুন্দর ভাবে শেষ হবার পর লতা শশুরবাড়ি চলে যায়। লতা এযুগের আধুনিক মেয়ে সো তাকে বুঝিয়ে বলার কিছুই নেই। তবুও ভাবী হিসাবে মায়া তা পালন করেছে।
তারপর আমরা শহরেও চলে আসি এক মাস গ্রামে থেকে। মায়াও শুরু করে তার নতুন জীবন। আর আমিও সিরিয়াস এবার জব পেতেই হবে। বয়স হচ্ছে জব পেতে হবে। সংসার বানাতে হবে। বাবা ডাক শুনতে হবে। কত কি স্বপ্ন। আল্লাহর কাছে প্রাণভর চাইতাম একটা জবের জন্য। ঠিক দুমাস বাদে একটা অফিসে জব টা পেয়েও গেলাম। সকালবেলা মায়াকে হসপিটলে রেখে আমি যেতাম অফিসে আর ফেরার পথে দুজন মিলে চলে আসতাম। কি দারুণ স্বপ্নের মতো চললো আমাদের দিনগুলো। বছর দেড়েক পরের কথা। আম্মা একবার বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লো। তখন বাবাকে বলে ঢাকাতে নিয়ে এলাম। এবং মায়ার বাসাতে রেখেই আম্মার ট্রিটমেন্ট করা হলো। আম্মা ব্যথার রুগী তার সারা শরীরে ব্যথা টনটন করে যা বাবাকে যন্ত্রণা দেয় বুঝি। যখন আম্মা সুস্থ হলেন আর মায়ার সেবাও গ্রহণ করলেন তখন বুঝেছিলাম আম্মা মন থেকে মায়াকে গ্রহণ করলেন। আর এর মাঝে আম্মা তার একটা দাবীও জানিয়েছেন। মায়া আমার বুকে মাথা রেখে আস্তে আস্তে বলছিলো “আম্মু আজকে কি বলেছে জানেন?”
“কি?”
“আম্মু আর আব্বুর খুব সখ নাতিনাতনির সাথে খেলা করবেন আর এদিকে আমার আম্মুও এটাই চান তাদের মেয়ের বাচ্চা হোক”
“দেখো মায়া! বাচ্চা নেওয়াটা খুব সহজ তবে তুমি কি পারবে হসপিটল আর বাচ্চা এক সাথে সামলাতে? আমি অফিসে থাকবো সারাদিন, তাছাড়া বাচ্চা নিলে তোমাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হবে। অনেক পেইন হবে নিতে পারবা”
“হুম পারবো”
‘আগে ভাবো তারপর সিদ্ধান্ত নাও’
‘আমার বাবু লাগবেই। আম্মু মুখ ফুটে যখন বলেছেন তখন’
‘আচ্ছা বুঝলাম ঘুমাও’
‘না ঘুমাবো না এখন আপনি তিন মাস পর মায়ার মাঝে যে লক্ষণ গুলো ধরা পড়ে তাতে শশুরমশাই হেসেই বললেন,
‘মায়াকে এখন থেকে পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে ভারী কাজ গুলো কম করতে বলবে। প্রথম থেকেই যত্নশীল হতে হবে’
‘কিন্তু বাবা আমার অফিস??’
‘কি দরকার বলো তো। আমার এতো সম্পত্তি তার কি হবে? কে খাবে এসব?’
‘বাবা তাই বলে বেকার থাকবো?’
‘কই বেকার! আমার মেয়েকে পেয়েছ তার দায়িত্ব নিয়েছো বিনিময়ে বাবা হচ্ছো এটা কম কিসে?’
ছয় মাস যখন তখন কিন্তু মায়ার অবস্থা বেশ খারাপ। দেহ ভারী হতে লাগলো। যদিও মাতৃকালীন ছুটি আগেই নিছিলো। তারপর আমিও অফিস থেকে ছুটি নেই। ব্যস্ততা আমার এখন মায়াকে নিয়ে। এই খেতে হবে। সময়মত গোসল করবে। রাত জাগা যাবেনা, নামাজ পড়তে হবে কোরআন পড়তে হবে। আর আমার লক্ষ্মী বউ থাকতে হবে। মায়া হেসে বলে, ‘আপনি সেই আগের মতোই আছেন। কোনো চেঞ্জড নেই। আপনার তো ইচ্ছে মেয়ে হবে! যদি মেয়েই হয় তবে মেয়ের সাথে এসব প্রেমিক ভাব দেখালে মেয়ে কি ভাব্বে’
‘ওরে কচি বউ রে, মেঘের মেয়ে সো সেও বাপের মতোই হবে। আর হ্যাঁ আমার মেয়ে হোক তখম দেখবা মেয়েকে আমি কত সব বানিয়ে রাখি। আমার মেয়ে হবে মস্তবড় লেখিকা। সে হবে আবৃত্তিকার। সে হবে ধার্মিক তবে লিখবে। একজন আদর্শ মেয়ের বাবা আমি’
‘উরে বাবা! আমি যেন কেওনা’
‘স্যরি কে তুমি?’
‘ওই যে’
‘কি ওই যে’
“আপনার দুষ্টু মেয়ের লক্ষ্মী আম্মু”
“ওই ওই! আমার মেয়েকে একদম এসব বলবেনা”
যেদিন ডেলিভারি হতে অটি তে নিয়ে গেলো। মায়া আমার হাত ধরে ছিলো। আর আমিও জড়িয়ে ধরে সাহস দিলাম তারপর আমিই কান্না করে দিলাম। মায়াকে এতো বেশি ভালোবাসি যে ওর কিছু হলে আমি সহ্য করতে পারবো না। মায়া কে ছাড়া আমি যে অশহায়। ওর একটু ব্যথা লাগলে ওর থেকে বেশি কষ্ট হয় আমার। তাহলে আমার মায়া কতটা ত্যাগ স্বীকার করছে মা হবার জন্য? প্রিয় পাঠক, মায়া বাঁচবে কি মরবে আমি জানিনা। শুধু জানি মায়া আমার জন্য নিজের জীবন বাজি রেখেছে। সেই মেয়েটার গায়ের রং কোনো ব্যাপার না। সে কালো না সাদা এটাও ব্যাপার না। এখানে ত্যাগ টাই বড়। একটা মেয়ের সবথেকে বড় ত্যাগ মা হওয়া। আর একজন পুরুষের অর্জন বাবা হওয়া। আমি কী পারবো বাবা হতে?
হতাশা নানান চিন্তা যখন আমাকে পাগল করে দিচ্ছিলো তখনী নার্স হাসিমুখ নিয়ে বললেন “এই যে মহারাজা, রাণী এবং রাজকন্যা দুজনি ভালো আছে। এখন যান মিষ্টি নিয়ে আসুন! আর হ্যাঁ এমন রাজা আমি কোনোদিন দেখিনি”
কথাটা শুনে উপস্থিত সবায় হেসেই দিলো। আমি দৌড়ে গেলাম মায়ার কাছে। যেয়েই কপালে একটা চুমু দিয়ে আমার মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছি যখন মেয়েকে আমার কোলে দিলো এবং মেয়ে ভ্যাঁ করে কেঁদে দিলো। ওটা ছিলো আমার তৃতীয় আনন্দ। চোখে আনন্দ অশ্রু খেলা করছে। মায়া কেবল আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর বাবা মাও এলেন গ্রাম থেকে। বেশ খুশি সবায়।
মায়াকে বাড়ি নিয়ে এলাম, মেয়েও এখন হাত পা নাচিয়ে খেলা করে। আমি অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। মেয়ের নাম রেখেছি “সিন্থিয়া তাবাচ্ছুম পরী” মায়া আমি আর মেয়ে শুয়ে থাকি। মেয়ে ঘুমালে মায়া আমার বুকে মাথা রাখে তারপর রাজ্যের গল্প করে। মেয়ে নাকি তার মতো ডক্টর হবে। গরিব মানুষ কে সেবা দেবে। মেয়ে নাকি খুব শান্ত হবে। একদম বাবার মতো নয়। এই নিয়ে মায়ার সাথে আমার ঝগড়াও লাগে। তারপর দুজনি হেসে খুন।
এখনো এত বছর পরেও আমি একটা কথাই বলি ‘পাগলী একটা’ এতো বছর পরেও মায়াকে এক সেকেন্ডের জন্য বিরক্ত লাগেনি আমার। মায়াকে কালো মনে হয়নি। ভালোবাসা যেখানে বড় গায়ের রং সেখানে তুচ্ছ। মা আর শাশুড়ি যখন পরীর সাথে খেলা করে আমার তখন খুশিতে নাঁচতে ইচ্ছা করে। এদিকে পরীর ফুফি তো ঢাকাতে আসার জন্য নাছরবান্দা। লতা এলেও অনেক খুশি হবে। এ যেন স্বর্গের দিন। এ যেন প্রিয়তমা প্রিয়জনকে বুকে আগলে রেখে ভালোবাসি বলার দিন। ভালোবাসা যেখানে এতো রঙিন গায়ের রং সেখানে নগণ্য।
আজ মা খুশি। বোন খুশি। আজ বাবা খুশি আমি খুশি। মায়ের সেই দুশ্চরিত্র মেয়েকে বিয়ে করলে কি এই সুখ পেতাম? মা পেলেও আমি পেতাম না। কারণ তো জানেনই। আর মায়াকে পাবার জন্যই আমার জন্ম। কি সুন্দর নির্মল সরল জীবন আমাদের। ভালোবাসি পরীকে আর পরীর আম্মু মায়াকে!
গল্পের বিষয়:
গল্প