নিষাদের হাতে একটি চিঠি। চিঠি একটু আগেই এসেছে। চিঠি তার বাবা পাঠিয়েছেন। বাবার বাসা ছাড়ার আজ দু’মাস পূর্ন হয়েছে । মঙ্গলবারে বাসা থেকে বেরিয়ে ছিল মঙ্গলবারেই বাসা থেকে এই প্রথম ডাক আসলো। সে চিঠি পড়তে চাচ্ছে কি চাচ্ছে না সেটা বুঝতে পারছে না । দু’টানার মধ্যে পড়েছে। একবার মনে হচ্ছে ওইসব মানুষ মানেই বিরক্তি। তাদের চিঠি নেহাত বিরক্তিকরই হবে। না খুলাই ভালো। আবার কৌতূহলী মন সেই কথা শুনছে না। মস্তিষ্কে এখন এই চিঠির আয়ত্তে। চিঠি টেবিলে পড়ে আছে। সে এক দৃষ্টিতে চিঠির দিকে তাকিয়ে আছে। সে কি খুলবে?
‘মা এদিকে একটু আসো?’
‘কাজ করছি। যন্ত্রণা করিস না তো । ‘
‘দরকার ছিল।’
‘এখানে আসতে কি লজ্জা করে?’
নিষাদ তার ঘর থেকে রান্নাঘরে গেল। ফাতিমা রান্না করছেন। নিষাদ উসখুস করছে। তার দৃষ্টি অস্থির। কিছু বলতে চাইছে। কোথায় থেকে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। হাত চুলকাতে চুলকাতে বলল, ‘পরের মাস থেকে আমি আর খরচ আনতে পারবো না।’ ফাহিমা লাউ কাটাছিলেন। ছেলের এমন কথায় অবাক হলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন,’কেন?চাকরি চলেগেছে?’
‘না।’
‘তাহলে?’
‘আমি আনতে পারবো না মানে পারবো না। এতো কথা ভালো লাগে না।’
‘ভালো লাগে না বললেই হলো?’
‘জানি না।’
‘জানি না মানে? তুই জনবি না তো কে জানবে?’
‘দেখ জলজ্যান্ত একটা মানুষ ঘরে থাকতে আমি সংসার চালাতে পারব না।’
‘এভাবে বলছিস কেন?তোর বাবার এইটুকু টাকায় কী করে চলবে?’
‘আমার বয়সি সবাই বাপের টাকায় চলে। তারা তাদের মতো করে জীবন উপভোগ করছে।আর আমি রোজগার করে খাচ্ছি। ‘
‘সবার জীবন কি একরকম হয়? তুই রোজগার করছিস এখনে খারাপ কি?’
‘ ভালো খারাপ বুঝার দরকার নেই। আমি আর কোন টাকা দিতে পারব না। ‘
‘তোর কি হয়েছে?’
‘আমার কিছু হয়নি। টাকার কথা বললে কিছু হবে।’
নিষাদ আর একমুহূর্ত নষ্ট না করে রান্নাঘর ত্যাগ করলো।ফাহিমা পলক হীন চোখে ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন। এটা কি ভ্রম? তিনি কিছু বুঝতে পারছেন না। নিষাদের গন্তব্যে কাজিরটুলা। সেখানে বন্ধুদের নিয়ে জম্পেশ আড্ডা হয় । সে এই আড্ডায় নতুন যুক্ত হয়েছে। গাঁজা ও ডাল নিয়ে আনন্দেই দিন কাটে। শুক্রবার সারাটাদিন সেখানে সময় কাটে। কোন কোন দিন রাতে থেকেও যায়। পুরো রাত সবাই আদিমানব হয়ে পৃথিবী উপভোগ করে। সদর দরজা পার হবার সময় তিন্নি ডাকল, ‘এই ভাইয়া এই।’
নিষাদ রোবটের মতো থামলো। গম্ভীর হয়ে বলল,’বল।’ ‘আমাকে কিছু টাকা দে তো।’ ‘টাকা ফাকা আমি দিতে পারব না। বাবার কাছ থেকে নিস।’ তিন্নি কাছে এসে তাড়াহুড়োয় দু’হাত দিয়ে মানিব্যাগ খুঁজছে। এই দৃশ্য কয়েকদিন পর পর দেখা যায়। তিন্নি ডেকে বলবে টাকা দে। নিষাদ ইচ্ছে করেই বলে টাকা নাই। শুরু হয় হাতাহাতি। একসময় তিন্নি ক্লান্ত হয়ে বলে ‘দে না।’ আজ তার ব্যতিক্রম হলো। তিন্নি খুঁজতে খুঁজতে বলল,’আরে দে তো। হাতে সময় কম।’ নিষাদ তিন্নির গালে চড় বসায়। তিন্নি বা গালে হাত রেখে বিস্ময় চোখে দাঁড়িয়ে আছে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাবধানেই চোখে পানি জমতে শুরু করেছে।হঠাৎ করেই বিশাল পরিমাণ পানির আগমন। তার চোখে নোনা পানির জোয়ার এসেছে। নিষাদ বলল, ‘ একবার বললে কথা কানে যায় না?
‘তাই বলে মারবি?’
‘ আর এমন ঘষাঘষি করবি না । এসব করতে হলে মাঠে নাম। তখন আমার কাছে আসতে হবে না।’ তিন্নি নড়াচড়া হীন দাঁড়িয়ে আছে। যেন সে একটি গাছ। ছোট্ট একটি গাছ। যার বড় বড় ডালপালা নেই। অসংখ্য পাতা নেই।বাতাসে গাছের পাতা নড়ে। তার চুল নড়ছে। এতক্ষণে চোখের পানি বাঁধ ভেঙ্গেছে। অশ্রুসিক্ত চোখ চেয়ে আছে নিষাদের পথে। গত দু’মাস ধরে নিষাদ সংসারের খরচ আনছে না। ফাতিমার কাছে জমানো কিছু টাকা ছিল। সেগুলো দিয়ে চাল সহ অন্যান্য খরচ চালিয়েছেন। এখন হাত খালি। এ মাসের চালের কথা স্বামীকে বলতে হবে। নাছির উদ্দিন বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন।
এখন চাকরি নেই। টিউশনি করে অল্প কিছু পান তা দিয়ে কোনরকম চলে। ফাহিমা ঘরে ঢুকে নাছির উদ্দিনের পাশে বসলেন। চালের কথা কিভাবে শুরু করবেন বুঝতে পারছেন না। নাছির উদ্দিন আর নিষাদের টাকায় কোনরকমে সংসার চলে। নিষাদ সবসময় রেগে রেগে কথা বলে । ভালো কথা বললেও কঠিন জবাব দেয়। তার সাথে ভালো দু’টো কথা বলা যায় না। খরচাপাতির কথা কিভাবে বলবেন। ফাহিমা নাছির উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ঘরে চাল নেই।’ নাছির উদ্দিন বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলেন। ফাহিমার কথায় বিরক্ত চোখে তার দিকে তাকালেন। চোখ জোড়া বইয়ের উপর রেখে বললেন, বই পড়ার সময় ডাকবে না এই কথা কতবার বলতে হবে? মানা করা কিছুতে মানুষের কৌতূহল বেশি থাকে। এই জিনিসটা ফাহিমার ভিতর বেশির থেকে বেশি পরিমাণে আছে।নাছির উদ্দিনের বই পড়ার সময় রাজ্যের কথা মনে হয়। তার মনে হয় কথা গুলো এখন না বললে না হয়। এরকম কেন হয়? তার হাদিস তিনি খুঁজে পান না। ফাহিমা বললেন, ‘এমাসের চাল কবে আনবে?’
‘আমাকে বলছো কেন?’
‘নিসাদের কাছে টাকা নেই।’
‘টাকা নেই বললেই হলো নাকি? ডাকো তাকে।’
ফাহিমা সাথে সাথে বলে উঠলেন,’তোমার কিছু বলতে হবে না। যা বলার আমি বলেছি। এমাসের টাকা খরচ করে ফেলেছে। ‘ নাছির উদ্দিন ফাহিমার কথার উত্তর দিলেন না। তিনি উঁচু গলায় ডাকলেন, ‘নিষাদ? নিষাদ?’ ‘আরে করছো টা কী ? বললাম তো ফাহিমাকে কথা বলতে না দিয়ে বললেন,যাও ছেলেকে আসতে বলো। ফাহিমা অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিষাদের ঘরে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। সামনে তাকিয়ে দেখেন নিষাদ দরজার কাছে চলে এসেছে। ফাহিমা চোখ দিয়ে ইশারা করছেন নিষাদকে চলে যাবার জন্য । নিষাদ আদেশ অগ্রাহ্য করে বলল, ‘আমাকে ডেকেছ।’ নাছির উদ্দিন গম্ভীর হয়ে বললেন, কেন ডাকতে পারি না?’ নিষাদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। নাছির উদ্দিন বললেন,’তোমার মা যা বলল তা কি সত্যি?’
‘হ্যাঁ।’
‘যাও চাল নিয়ে এসো?’
‘টাকা দাও।’
‘টাকার কথা আমাকে বলছো কেন?’
‘তো কাকে বলব?’
‘তোমার কাছে টাকা নেই?’
‘না।’
‘বেতন দিয়েছে?’
‘কিছু বলার থাকলে বলো। এসব জেরা ফেরা ভালো লাগছে না।’
‘আমি জেরা করছি ?’
‘অবশ্যই।’
‘তোমার কাছে দায়িত্ব বলতে কিছু নেই?’
‘দেখ এতো কিছু বলতে পারবো না। আমাকে এসব জ্ঞানের কথাও বলবে না।’
ফাহিমা বললেন,’কথা কিভাবে বলতে হয় জানিস না?’ ‘আমাকে কথা শিখাতে এসো না। নিজের কোন অস্তিত্বই নেই আবার বাচ্চা পয়দা করেছ।ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোন পরিকল্পনা নেই আবার কথা শিখাতে আসছে।’ ‘আমাদের অস্তিত্ব নেই?’ ‘তোমাদের কী আছে বলো? টাকা সম্পত্তি কিছু আছে? থাক ভাড়াটে বাসায় আর বড় বড় কথা। তোমাদের নিজেরই ঠিক নেই আবার দু’টো বাচ্চা পয়দা করছ। এদের লালনপালনের চিন্তা মাথায় আসে নি? ফাহিমা হা হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখের সামনে কীসব হচ্ছে তা ধরতে পারছেন না। নাছির উদ্দিন বলেন, ‘আমার সামনে থেকে দূর হও।’ ‘যাচ্ছি। তবে আর কখনো আসতেও বলবে না। নাছির উদ্দিনে সাধারণ ভাবেই বসে আছেন। তাকে দেখে বুঝা যাচ্ছে কিছুই হয় নি। সব স্বাভাবিক। কিছু কিছু জিনিস হাতের নাগালের বাইরে চলে গেলে তাকে আর ধরা যায় না। তখন শুধু দেখে যেতে হয়। নাছির উদ্দিনের এখন দেখার অধ্যায় চালু হয়েছে। ফাহিমকে বললেন, ‘তিন্নি কোথায়?’
নিষাদ তার বাবার চিঠি পড়ছে। প্রিয় নিষাদ চিঠির শুরুতে অপ্রিয় ব্যক্তি কেও প্রিয় লিখতে হয়। এই কথাটি তুমি স্কুলে থাকাকালীন সময় প্রায়ই বলতে। আজ তোমার বেলায় প্রিয় লিখতে গিয়ে কোথাও জানি একটা বাধা কাজ করছিল। তুমি কেমন আছো? নিশ্চই ভালো। ভালো থাকার কথা।আপদ বলতে এখন কিছু তোমার জীবনে নেই।তোমাকে কিছু আপদ দিতে এসেছি। তোমার কাছে অনুরোধ এই আপদ গ্রহণ করে আমাকে দায় মুক্ত করবে। সেদিন তুমি বলেছিলে আমি নিঃস্ব আমার কিছু নেই। কেন তোমার জন্মদাতা পিতা হলাম। বিষয়টা তোমার মতো কেউ এভাবে ভেঙে বলেনি । বললে তোমাকে পৃথিবীতে আসতে হতো না। ভুল যখন দেরিতে হলেও বুঝেছি তখন একটা সমাধান করা জরুরি। আমার কাছে জমাকৃত চার লাখ টাকা আছে। তোমার বোনের বিয়ের জন্য জমিয়েছি। তুমি বলেছিলে আমার কিছুই নেই । আমি সবসময় ভাবতাম আমার ছেলেমেয়ে আছে। আমার কাছে অমূল্য সম্পদ আছে। তুমি আমাকে ভুল প্রমাণ করেছ।
সেদিন তুমি চলে যাবার পর তোমার মা বলেছিল, তোমার কী আছে কী নেই এসব নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। আমাদের কাছে তুমি আছো। তুমিই সবকিছু।’ (আমাদের বলতে ফাহিমা ও তার মেয়েকে বুঝানো হয়েছে। তুমি শঙ্কিত বোধ করো না) তোমার মায়ের এই কথায় স্মরণ হয় যে আমার কাছে আমি আছি। সম্পত্তি হিসেবে আমি ব্যথিত আর কিছু নেই। তাই এই পুরুনো আসবাপত্রের একটা ব্যবস্থা করলাম। খামটি খুললে ব্যাংক একাউন্ট সম্পর্কে সব তথ্য পাবে। একাউন্টে টাকা আছে। তোমার মায়ের জন বৃদ্ধাশ্রমে কথা বলা আছে । তাকে নিয়ে জামেলা হবে না। শুধু তিন্নির জন্য কিছু করতে হবে। একটা ভালো ছেলে দেখে তোমার ইচ্ছেমতো বিয়ে দিয়ে দিও। সম্পত্তি হিসেবে এই ব্যাংক একাউন্ট ব্যতিত আর কিছু দিতে পারলাম না দুঃখিত।
ইথি
তোমার বাবা ( এই লাইনটি কেটে নিচে লিখা)
নাছির উদ্দিন
পুনশ্চ: আপনাকে তুমি বলার জন্য দুঃখিত। ফাহিমাকে তোমার মা বলার জন্যও দুঃখিত। বিয়ে না দিলেও দয়াকরে আমার মেয়ে বাজারে নামার জন্য বলবেন না। তার মামার কাছে পাঠিয়ে দিবেন। এই অধমের আপন মানুষের আশপাশ থেকে যথা সম্ভব দূরে থাকবেন।
গল্পের বিষয়:
গল্প