বিয়ের প্রথম রাতেই স্বামীকে বলেছিলাম, আমাকে কিছুদিন সময় দেন। এই এক বাক্যই যেন ঔষধের মতন কাজ করেছিল। কোলবালিশ কোলে দিয়ে অন্যপাশ ফিরে শুতে শুতে লোকটা বলেছিল,
___” তুমি শুয়ে পড়ো আমি ঘুমালাম “। অনেকেরই হয়তো অবিশ্বাস হবে, যে এটা কি সম্ভব এমন হয় নাকি কখনও! হ্যাঁ এমনটাই হয়েছি। পরেরদিন খুব সকালে আমাকে আলতো করে ছুঁয়ে যখন ডাকলো ধরফড়িয়ে উঠে বসলাম। চোখ কচলাতে কচলাতে তাকিয়ে দেখি,সামনে মামুন মানে আমার বর দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় টুপি মুখে এক রাশ স্নিগ্ধতার আবেশ। হাসিমাখা মুখ নিয়ে বলল,
___ ” কলি কিছু কথা ছিল বলবো? ” এলোমেলো হয়ে থাকা শাড়ির আঁচল টেনে নিয়ে আস্তে করে সরে বসে তাকে বসার জায়গা দিলাম। মুখ নিচু করে পাশে বসে বলল,
___ ” যাক বসতে দেওয়ার পারমিশন যখন দিয়েছ, তার মানে কথাগুলো বলার পারমিশনও পেলাম নাকি?” সদ্য ঘুম থেকে উঠা ফোলা মুখ চোখ নিয়ে তার সামনে বসে হাঁ করে কথাগুলো শুনছিলাম। আসলে ঘুম থেকে উঠে যে কি রিএক্ট করবো সেটাই বুঝতেছিলাম না। একদিকে নতুন বিছানার কারণে ঘুমটাও ভালো হয় নি। মাথার বাঁ পাশ ব্যাথায় দপদপ করতে সাথে চোখ জ্বালা ফ্রি। তারপর মানুষটার কথায় মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম। বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে মামুন বলা শুরু করলো,
___ ” দেখো কলি তুমি আমার বিয়ে করা বউ। আমার তোমার মধ্যে কেমন সম্পর্ক সেটা আমরা জানি কিন্তু তোমার কাছে অনুরোধ প্লীজ বাইরের মানুষদের তেমন কিছু বুঝতে দিও না। মানসম্মানের ব্যাপার, আর হ্যাঁ স্বামী হওয়ার মেইন শর্তই হলো ভালো বন্ধু হওয়া। আমি আমার বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলাম বাকিটা তোমার ব্যাপার। এখন উঠে গোসল করে মায়ের কাছে যাও। “
___ ” গোসল করবো কেন?” অনেকটা বেকুবের মতন প্রশ্ন করে বসলাম। পরোক্ষনেইযেন চুপ হয়ে বিছানা ছেড়ে
উঠে চললাম গোসল করতে। ঘরের দরজা খুলতেই শিশির ভেজা এক বিশাল উঠান। উঠান ঘেরা চারখানা ঘর। দক্ষিন পশ্চিম কোণায় দুটো বাথরুম আর তার পাশে টিনের বেড়া দেওয়া কল। মনে হয় ওখানেই গোসল করতে হবে। সারাজীবন শহরের চার দেওয়ালে ঘেরা বাথরুমে গোসল করা এই আমি যেন হঠাৎই বদলে গেলাম। মনটা যেন খুব খুশি হয়ে উঠলো হঠাৎ করেই। আবার ঘরে ঢুকে বিছানায় টাওয়াল রেখে গামছা খুঁজে বের করলাম। গাড় নীল একটা তাঁতের শাড়ি বের করলাম যার লাল পাড়। এসব নিয়ে চললাম গোসল করতে। উঠানে পাড়া দিতেই যেন মনে অন্যরকম এক প্রফুল্লতা চলে এলো। পাখিদের কিচিরমিচির, খোপে আটকানো মোরগের চওড়া গলার ককক আর সূর্যের আলতো কিরন সব মিলে মিশে বর্ণনাতীত সৌন্দর্য। দুপা এগোতেই বড় জায়ের সাথে দেখা। এই সাত সকালেও যেন পান খেয়ে ঠোঁটটাকে টুকটুকে করে রেখেছে। অনেকের চেহারা দেখলেই মন ভালো হয়ে যায় বড় ভাবি ঠিক তেমনই একজন। আমাকে এভাবে দেখেই যেন হাসিতে গড়িয়ে পড়লো উনি,
___ ” যাউক তাইলে এতদিনে আমার দেওরের সুমতি হইলো তাইলে…যাও নয়া বউ নাইয়া আসো। আম্মায় কোরান পড়ন শেষ কইরাই নাস্তা চাইবো। তাড়াতাড়ি যাও বইন”।কিছু না বলেই মাথা ঝাকিয়ে দ্রুত চললাম গোসল করতে। আমারশশুরবাড়ি অনেকটা মেয়েহীন। শাশুড়ির চার ছেলে। আমার বরই সবার ছোট। বড় ভাসুর একাই থাকে গ্রামে, অন্য দুই ভাসুর স্বপরিবারে প্রবাসী। আমার সাহেবও ঢাকায় স্থায়ী চাকরি সূত্রে। এখানে শুধু বড় ভাই ভাবী আর আমার শাশুড়ী এই তিনজনই থাকে। শশুর ছিল এক বাপের এক ছেলে। শাশুড়ীরও সেইম অবস্থা এজন্য নাকি আত্মীয় স্বজন নেই বললেই চলে। এসব কিছুই বিয়ের আগে আমার ফুপু রসিয়ে রসিয়ে আব্বার কাছে বলেছিল। ঝই ঝামেলা হীন পরিবারের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে।
সেজন্যই আব্বা অনেকটা লাফিয়ে পড়েছিল আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য। গুটিকয়েক আত্মীয় যারা এসেছিল তারা কালকে রাতেই চলে গিয়েছে। এখন এ বাড়ি দেখে মনেই হচ্ছে না যে একটা বিয়ে সাদি নামক কিছু হয়েছে। সকালের নাস্তা শেষ করে ঘরে আসতেই দেখি, মামুন মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করতেছে। গোসল শেষ করে আর চুল মোছার সুযোগটাও পাই নি, তাই আয়নার সামনে যে চুল গুলো গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে সামনের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম, আচ্ছা এই মানুষটার কি দোষ। বিয়ের প্রথম দিনই কেন তাকে শাস্তি দিচ্ছি আমি? কিন্তু নিজের সাথে হওয়া ঘটনা গুলো যেন আষ্ঠেপৃষ্ঠে আটকিয়ে ধরেছে আমাকে। খুব ইচ্ছা করছিল ছিঁড়ে দিতে এই বেড়াজাল কিন্তু নিয়তি বলেও খুব কঠোর একটা জিনিস আছে আমার জীবনে৷ বিয়ের কয়েকদিন পরই আমি আর মামুন চলে আসি ঢাকাতে। শুরু হয় টোনাটুনির জীবন।
প্রতিদিন মামুন অফিসে যাওয়ার পরে কাজের বুয়া সব কাজ গুছিয়ে দিয়ে যায়, আমি রান্নাবান্না করে কখনও বা বই পড়ি কখনও বা গাছে পানি দেই। সন্ধ্যায় মামুন ফিরলে কেমন জানি হাঁফ কেটে যায়। মানুষটা সত্যিই আমাকে ভালো বন্ধু বানিয়ে নিয়েছে।অফিসে যাওয়ার পথ থেকে শুরু করে অফিস থেকে আসার পথের সব কিছু পই পই করে বলতে থাকে। রাতে দুজনের মাঝে একটা বিশাল দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কোলবালিশটা। খুব ইচ্ছা করে সেই দেওয়াল ভেঙ্গে ওপারে মানুষটার মাঝে মিশে যাই। কিন্তু ওই যে নিয়তি। কিন্তু একদিনের ঘটনায় কেমন জানি এলোমেলো করে দিয়ে গেলো সব। যা লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম সেটাই মামুনের সামনে চলে এলো। সেদিন মাঝ রাতে মামুন ভেঙ্গেছিল কোলবালিশের দেওয়াল। হাজার হোক পুরুষ মানুষতো, পাশে সদ্য বিয়ে করা বউ। কতদিনই বা নিজেকে সংযত রাখতে পারে। সেদিন তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিলাম সজোরে। চিৎকার করে বলেছিলাম,
___ ” সব পুরুষই চরিত্রহীন, লম্পট।” মামুন কিছুই বলে নি, শুধু অবাক হয়ে চেয়ে দেখেছিল আমার দিকে। মধ্য রাতেই বেরিয়ে গিয়েছিল গায়ের শার্টটা হাতে নিয়ে। যাওয়ার আগে শুধু ফিরে তাকিয়ে বলেছিল,
____” কলি ক্ষমা করে দিও। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারি নাই।” কিছু না বলে বালিশের উপরে আছড়ে পড়ে হু
হু করে কাঁদতে লাগলাম। পরেরদিন দুপুরে যখন উনি বাসায় ফিরলেন দুজন হাঁ হয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি। মামুনকে দেখে মনে হচ্ছে যেন টর্নেডো গিয়েছে ওর উপর দিয়ে। আর আমি রাত থেকে দুপুর পর্যন্ত কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানিই যেন শেষ করে ফেলেছি। মামুনকে দেখেই যেন আছড়ে পড়লাম ওর বুকের মাঝে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
____ ” আমাকে রেখে তুমি কই গেছিলা, আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। আমি যে খুব ভয় পাই।”
____ ” এই পাগলি কি হইছে তোমার৷ আমি কোথাও যাবো না তোমাকে ছেড়ে!” এই বলেই মামুন আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললাম,
___ ” কিছু বলার ছিল আপনাকে….”
___ ” তুমিটাই তো সুন্দর ছিল আবার আপনি হলো কেন। তোমার যা ইচ্ছা হয় নির্দ্বিধায় বলো কলি। আমি কিন্তু বিয়ের পরেরদিনই তোমার বন্ধু হতে চেয়েছিলাম৷ আর বন্ধুর কাছে সব কিছু শেয়ার করা যায়। “
মামুন খুব শান্ত স্বরে কথাটা বলতেই যেন আমার গলার কাছেকান্নার ঢেউ আঁছড়ে পড়লো। হড়হড়িয়ে বলতে লাগলাম আমার সেই বিভীষিকাময় নিয়তিটাকে, ” তখন আমি খুব ছোট মনে হয় আট কিংবা নয় বছর হবে, বাবা মা চাকরি করতো সেই সুবাদে বাসায় একাই থাকতাম। একজন খালা ছিল বাসা তার কাছেই আমার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটতো। আম্মু একজনকে বাবা বলে ডাকতো, আসলে আমার নানা ছিল না তো। তাই অফিসের একজনকেই কিভাবে জানি বাবা ডাকতো। একদিন আম্মুর সাথে উনি এসেছিলেন আমাদের বাসায়, এসেই আমাকে নানা নানা করতে করতে কোলে বসিয়েছিলেন। কিন্তু কেন জানি না আমার খুব খারাপ লাগছিল। উনি আমাকে কোলে বসিয়ে আদরে আদরে জোরে জোরে হাতে চাপ দিচ্ছিল৷
কেন জানি না জড়িয়ে ধরাটা খুব অস্বস্তিকর লাগছিল। শেষমেষ যখন উনার হাত থেকে মুক্তি পেলাম এক দৌড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম রুম থেকে। এর পর যখনই উনি আমাদের বাসায় আসতেন আমি এক প্রকার লুকিয়েই থাকতাম। আম্মু খুব রেগে যেতো কিন্তু আমি আম্মুকে বুঝাতেই পারতাম না কেন আমি এমন করতেছি। কিন্তু ভাগ্যের কি লিখন একদিন আম্মুর সেই বাবা আমাদের বাসায় আসলেন ঠিক দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবে হবে সেই সময়ে। উনাকে দেখেই খালা তাড়াতাড়ি চলল রান্নাঘরে নাস্তা আনতে। আমি পড়ার টেবিলে পড়ছিলাম পিছনে ছায়া দেখতেই আমি ঘুরে তাকিয়ে যেন একদম জমে গিয়েছিলাম। উনি ঠিক কুৎসিত এক পশুর মতন হাসছিলেন। সোজা এসেই আমার জামার ভিতর দিয়ে হাত দিয়ে আমার বুক স্পর্শ করলেন। ব্যাথায় কুঁকড়ে যেয়ে আমি উনার হাত ধরে টানাটানি করতে লাগলাম নিজেকে বাঁচানোর জন্য।
চিৎকার করতেই যাবো তখন ঠোঁটের উপরে টের পেলাম জঘন্য সেই স্পর্শ। কতটুকু যে ভয়ংকর ছিল সেই সময়টা আমি আজও বলে বোঝাতে পারবো না। আমার সারাটা শরীর হাত দিয়ে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছিল সেদিন। আমার শুধু মনে হচ্ছিল, ইসস মরে যেতে পারতাম তাহলে হয়তো এই গ্লানি থেকে রেহাই পেতাম। কখন যে উনি চলে গিয়েছিল আমার খেয়াল নেই। আম্মুকে এই ঘটনা বলতেই সজোরে এক চড় খেয়েছিলাম। গলায় ফাঁস দিয়ে মরার ভাবনা এসেছিল একবার কিন্তু কেন জানি না সাহসে কুলায় নি ওই বয়সে। জানো মামুন সেই থেকে আমি খুব ভয় পাই। এউ পুরুষ সমাজের প্রতিটি মানুষকে আমি খুব ভয় পাই। “এ পর্যন্ত বলার পরে আর কোন কিছুই বলতে পারি নি। শুধু মামুনকে ধরে কেঁদেক চলেছিলাম। হঠাৎ টের পেলাম গালের উপরে এক ফোঁটা পানির ছোঁয়া। চোখে চোখ রাখতেই, মামুন ধরা গলায় বলল,
___ ” তোমার কাছে প্রতিজ্ঞা করলাম আমি, আমাদের মেয়েকে এই নোংরা সমাজের ছোঁয়া কখনও লাগতে দেবো না।” পুনশ্চঃ এখন আমাদের দুই রাজকুমারি আছে। তাদের কাছে তাদের বাবা যেন ঠিক সুপার ম্যানের মতন। সেদিন নাকি কারা বড় মেয়েকে দেখে শিশ বাজিয়েছিল, মেয়ের বাবা সোজা জেলে ভরে রেখে এসেছে।
গল্পের বিষয়:
গল্প