আমি রেশমা। আঁতুড় ঘরে আমার রেশমের মতো কোমল মুখ দেখে দাদী বলেছিলেন, “এইটা তো একটা রেশমের গুঁলটি। অরে তোমরা রেশমা বইল্যা ডাইকো” সেই দিন থেকে আমি রেশমা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কোমলতার সাথে কিছু লাবন্যও যোগ হয় মুখশ্রীতে। আম্মা বলতেন, “তুই আমার সাত রাজার ধন এক মানিক, তোরে যে কোথায় রাখি”। সেই এক মানিকের পরিবারে সুখ আর স্বস্তির বদলে ছিলো অভাবের ঘেরাটোপ। সেই টোপ ডিঙোতে নয় বছর বয়সে আমার ঠাঁই হলো বারোশো স্কয়ারফিটের এক অভিজাত ফ্ল্যাটে। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ুয়া আমার বইগুলো ছিঁড়ে হলো ঝাল মুড়ির ঠোঙা।
অথচ কী ভীষন ভালো লাগতো আমার ইচ্ছে কবিতার সেই ছেলেটিকে। যে শুধু খেয়া ঘাটের মাঝি হতে চেয়েছিলো। আমিও তারমতো হতে চেয়েছিলাম কিছু। বিত্তবান নয়। হতে চেয়েছিলাম সচ্ছল। যাতে সপ্তাহন্তে এক বেলা সস্তা মাছ জোটে পাতে। অথবা ব্রয়লার মুরগীর এক টুকরো রান। বাদ বাকি ক’টা দিন নাহয় ডাল ভাতই সই। ওনারাও আমাকে দুবেলা নিয়ম করে চিকন চালের ভাত খেতে দিতেন। কিন্তু যদি আমি বেখেয়ালে ইম্পোর্টেড দামী কাপ ভাঙতাম কিংবা চীনা সিরামিকের ডিনার প্লেট। তাহলে তার সাথে অত্যুৎসাহী আয়োজনে উত্তম মধ্যমও চলতো সমান তালে। আমি তাদের বোঝাতে পারিনি যে, আমার হাত জোড়া ঘুড়ি ওড়াতে অভ্যস্ত। বাসন মাজতে নয়। আম্মা একদিন দেখতে এসে বললেন, “তোর হাতে কি ওইটা? ছ্যাঁকার দাগ? এরা বুঝি খুব মারে?” আমি উত্তর দেইনি।
বিচারের সংকটে প্রতিবাদের ভাষাও মূক হয়ে যায় এক সময়। আম্মার আঁচল ধরে ফের বস্তিতে ফিরলাম। বাড়ন্ত আমার শরীর তখন ফ্রক ছেড়ে কামিজে লজ্জা ঢাকতে তৎপর। অসাবধানতায় ওড়না সরে গেলে আম্মা চিৎকার করতেন, “বুকের ওড়না ঠিক কর রেশমা।” আমি আপাদমস্তকে শ্লীলতার চাদর জড়িয়ে রাখতাম। ততদিনে অবশ্য পুরুষের লোভী চোখের আঁচে ভস্ম হতে শিখে গিয়েছি । কিন্তু ক্ষুধা কি আর চরিত্র বোঝে? সম্মান ভুলুন্ঠিত হলেও পাকস্থালীর খাবার চাই। অল্প বেতনে কাজের ব্যাবস্থা হলো এক গার্মেন্টসে। ভোরের আলো চোখ মেলবার আগেই আমার চোখের পাতায় মুখ ধোঁয়ার জল পড়তো। হন্তদন্ত হয়ে এক হাতে খাবারের ডিব্বা নিয়ে যখন বাস ধরতাম। সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে থেকেও ফুল টাকা ভাড়া বাড়িয়ে দিতাম। তখনও শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় অযাচিত পুরুষের হাতগুলো ঘৃণ্যতম চিহ্ন রেখে যেতো। আত্নসম্মান বাঁচাতে মুখে কুলুপ এঁটে ভাবতাম।
একদিন সম্মানের জীবন ঠিক দুয়ারে এসে দাঁড়াবে। কিন্তু কোথায়? দরিদ্র্যের জীবন সংগ্রামকে যেখানে কেউ মুল্য দিতেই নারাজ। সম্মান চাওয়া সেখানে হাস্যকর। তবুও দুর্দমনীয় ইচ্ছেশক্তি নিয়ে দুবেলা অন্নের সংস্থানে আমি সয়ে গেছি সব। কিন্তু একদিন দুর্বিনীত ঘুর্নিঝড়ের তান্ডবে জিইয়ে রাখা শেষ সম্বলটুকুও হারাতে হলো। সন্ধ্যের পর বাড়ি ফিরছি। কাজ শেষ করতে সেদিন কিছুটা দেরী হয়ে গিয়েছিলো। বাসে উঠতেই লোভী কিছু চোখকে সজাগ দেখলেও মনে সাহস সঞ্চয় করে ভেবেছি। আরো তো অনেকেই আছে সাথে। ভয় কিসের? ক্রমশ ফাঁকা হতে শুরু করলো বাস। সবার গন্তব্যে বাস থামলো শুধু আমার আর গন্তব্যে ফেরা হলোনা।
আমার বাড়ির পথ থেকে ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে তীব্র গতিতে বাস ছুটিয়ে নিয়ে চললো অচেনা রাস্তায়। শংকা আর উদ্বেগে অবশ হয়ে আসা হাত পা সমেত আমি তুমুল চিৎকারে শুধু একটি কথাই বার বার বলেছি, “আমাকে ছেড়ে দ্যান ভাই, বাড়ি যাইতে দ্যান” তারা শোনেনি। ক্রুরহাসি হেসে উল্লাসে ফেটে পড়েছিলো। ক্ষুধার্ত পশুর মতো খাবলে খুবলে উপভোগ করেছিলো সুস্বাদু নারী মাংস। পরনের ওড়না ছিড়ে ঠেসে গূঁজে দিয়েছিলো মুখে। আর হুংকারে বলেছিলো,” “বেশি শব্দ করবি, জানে মাইরা ফালামু।” সকালে যখন ওড়নায় শরীর মাথা আবৃত করে বের হচ্ছিলাম। আম্মা দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে বলেছিলো, ” আমার মাইয়াটারে বেবাগ বদ নজর থেইক্যা বাঁচায় রাইখো আল্লাহ”। প্রচন্ড ব্যাথায় গোঙাতে গোঙাতে আমি তখন স্রষ্টাকে সহস্রবার ডেকেছি আর বলেছি, কী অপরাধ আমার? কী অপরাধে এই অসহনীয় শাস্তি?
চার হাত পা শক্ত করে আবিষ্ট করে রেখেছে একেকজন। নড়ার শক্তি হারিয়ে জীবন্মৃত লাশের মত পড়ে ছিলাম। অথচ, আমার এখনো সমুদ্র দেখা বাকি। ঘন জংগলে জোনাকের ঝাঁক দেখা বাকি। সবুজ পাহাড়ে ভোরের সুর্যোদয় দেখা বাকি। কার্যসিদ্ধি করে ওরা তখন মনের আঁশ মিটিয়ে হাসছে। একজন স্ববলে আমার টুটি চেপে ধরলো। পেশিবহুল হাতের চাপে কন্ঠের হাড় ছিঁড়ে যাচ্ছে আমার। বাঁচার শেষ আকুতিটুকু করলাম। শুনলোনা। আজ আর আম্মার হাতের ডাল চচ্চড়ি খাওয়া হলো না। বাসে ওঠার আগে ফোনে বলেছিলাম বেড়ে রাখা ভাত ঠান্ডা হওয়ার আগেই দরজায় টোকা পড়বে আমার। নিশ্চই আম্মা এতক্ষনে ভাত বেড়ে বসে আছেন। আব্বা দুশ্চিন্তায় রাস্তার মোড়ে আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। ফুসফুস নিঃসৃত শেষ অক্সিজেন টুকু মিশে গেলো ওদের বিকৃত আনন্দ উদযাপনে। এদেরই কেউ হয়তো বাড়ি ফিরে তার বাচ্চা মেয়েটিকে এই হাতেই আদর করবে। কেউ হয়তো এই হাতেই বয়স্ক মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করবে।
বউকে নির্লিপ্ত গলায় বলবে, ” তরকারীতে আইজ লবন কম হইছে”। তাদের কেউই জানবেনা এই হাতগুলো কিছুক্ষন আগেই কী পাশবিক যন্ত্রনায় জজর্জরিত করে খুন করেছে আমাকে। আমার শরীরটাকে ওরা দুর্গন্ধময় বর্জ্যের মতো ছূঁড়ে ফেলে দিয়েছে অন্ধকার ব্রীজের নিচে। কাল ভোরে হয়তো কেউ খোঁজ পাবে আমার। খবরে খবরে সয়লাব হবে পত্রিকার পাতা। একদিনেই পত্রিকার বিক্রি বেড়ে হবে চারগুণ। সেই সাথে, “জাস্টিস ফর রেশমা” নামক উত্তেজক স্ট্যাটাসে ভাসবে কথিত সোশ্যাল মিডিয়ার নীল সাদা রঙের ভার্চুয়াল পৃথিবী। তখন আর কেউ আমায় রেশমা বলে ডাকবেনা। আমার পরিচয় তখন শুধুমাত্র একজন ধর্ষিতা। ধর্ষিতাদের কোনো নাম হয় না। তেমনি ধর্ষকদেরও সাজা হয় না। আর তার কিছুদিন পর, সবাই স্বভাবজাত ভাবেই সবকিছু ভুলে যাবে।
ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে অজস্র ধর্ষকে ছেয়ে যাবে গোটা দেশ। বিচারহীনতার এই দেশে এমন ঘটনায় বিব্রত হবে না আর কেউ। নারীরা একের পর এক ছেলে সন্তান প্রসব করবেন। জরায়ুর অন্ধকার থেকে বের হয় সময়ের পরিক্রমায় মানুষ না হয়ে ক্ষমতাবান বলশালী পুরুষ হয়ে উঠবে একেক জন । তারপর একসময় সেই জরায়ুতে তারা প্রবেশ করাবে লোহার শিক কিংবা লাঠি। শুধু আমার আম্মার আর্তনাদ থামবে না। বিচারের দাবিতে বুক চাপড়ে কেঁদে কেঁদে সে শুধু বলবে, আমার একটা মাইয়া ছিলো ” রেশমা”, রেশমের মতন কোমল তার মুখ।
গল্পের বিষয়:
গল্প