আমার আর্মিতে জয়েনের দিনেই আমাকে কিছু কড়া ইন্সট্রাকশন দেয়া হয়। কটু কথাও শুনতে হয় আমার ফিটনেস নিয়ে। লম্বার দিক দিয়ে খারাপ না থাকলেও আমার স্বাস্থ্য আর্মিসুলভ ছিলো না। এমনিতেও বাড়িতে খাওয়াদাওয়াতে প্রচুর অনিয়ম করেছি। সেই অনিয়মের জন্য কোনো কথা শুনতে হয়নি। আজ শুনতে হচ্ছে। ইন্সট্রাকশনের কতগুলো পয়েন্ট এখানে তুলে ধরি, নিজের মোবাইল ফোন অফিসে জমা রাখতে হবে। তিন মাসের ট্রেনিংয়ে একবারও মোবাইল চাওয়া যাবে না।
অফিসারের প্রত্যেকটা কথা শুনতে হবে। অফিসার যদি বলে পাহাড়ে উঠে লাফ দিয়ে মরে যাও, পাহাড়ে উঠে লাফ দিয়ে মরে যেতে হবে। প্রশ্ন করা যাবে না। বাড়িতে ফোন করার জন্য বারবার রিকুয়েস্ট করা যাবে না ও খুব প্রয়োজন না হলে বাড়ি থেকে আসা ফোন ওকে দেয়া হবে না ট্রেনিং সেশনের সময়। এ জন্য কোনো কমপ্লেইন করা যাবে না। অসুস্থ হওয়া যাবে না। অজুহাত নামের হাত কেটে ফেলে দিতে হবে। আমার জন্য অন্যরকম একটা ইন্সট্রাকশন দেয়া হলো। সারাদিনে ২০০টা পুশ আপ দিয়ে অফিসারকে রিপোর্ট করতে হবে। এই দুইশো পুশ আপের জন্য আমাকে এক ঘন্টা সময় দেয়া হবে।
অনেক কথা বলা হলো, অথচ আমার পরিচয় দেয়া হয়নি। আমার নাম তারিফ, থাকি যাত্রাবাড়ি। দুই ভাইয়ের মধ্যে আমি ছোট। বড় ভাই অলরেডি আর্মিতে, আপাতত সোমালিয়াতে আছে। আর্মিতে কিভাবে আসলাম, সেই বিষয়ে তাই কথা বলার দরকার নেই। তবে এইখানে পাঠানোর জন্য নওরিনের আলাদা একটা তাগিদ ছিলো। নওরিন কে সেইটা নিয়েও পরে কথা বলি। কাজের কথায় ফেরত আসি। প্রথম দিনেই আমি কুপোকাত। ৩০টা পুশ আপ দিয়ে আমি আর নড়তে পারছিলাম না। নির্দেশ ছিলো ২০০ পুশ আপ শেষ করলেই দুপুরে খেতে পারবো। সেইদিন দুপুরে না খেয়ে ছিলাম। রাতে অবশ্য খাবার পাই। দিনে আবার সেই একই কাজ। পুশ আপ, ২০০টা। এবার ১০টা পুশ আপ দিতে গিয়ে মনে হলো হাত ভেঙে যাবে। আজ ইন্সট্রাকশন ছিলো এক ঘন্টার মধ্যে ২০০ পুশ আপ না দিতে পারলে পানিশমেন্ট আছে। পানিশমেন্টের জন্য রাজি হয়ে গেলাম। তবুও অন্তত দুপুরের খাবার দিক!
পানিশমেন্ট ছিলো এক পায়ে দাঁড়িয়ে খাবার খাওয়া। অনেক কষ্টের কথা বললাম, তাই না? আসেন আসল কষ্টের গল্প করি। নওরিনকে আমি চিনি তিন বছর ধরেই। ও থাকে ধানমন্ডি। ভার্সিটিতে থাকাকালীন ওর সাথে রিলেশন। প্রচন্ড পছন্দ করতাম ওকে। ভালোবাসতাম। আমাদের প্রেম-ভালোবাসা লুকানো ছিলো না। আমার আব্বা-আম্মা জানতো। ওর বাবা-মায়ের সাথে আমাকে ও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো। বাবা রিটায়ার্ড সরকারী কর্মকর্তা, ছেলে আর্মিতে, ছোট ছেলেও আর্মিতে যাবে, এগুলো শোনার পর নওরিনের বাবা-মা আমাকে তাদের ছেলের আসনে বসিয়ে দিলো। এগুলো কিভাবে কষ্টের গল্প হয়? জানেন, প্রচন্ড ঝালের আগে মুখে এক মুহুর্তের জন্য মিষ্টি মিষ্টি লাগে?
এইগুলো সেই এক মুহুর্তের মিষ্টি।
নওরিনের বাসায় আব্বা-আম্মা দুইজনই যায়। আমাদের ব্যাপারে কথা হয়। সিদ্ধান্ত হয় আমি আর্মিতে জয়েন করবো। তার এক বছর পর আমাদের বিয়ে হবে। আংটি বদল হয়ে গেলো ওই দিনই। এর এক সপ্তাহ পর আমি এখানে, ২০০টা করে পুশ আপ দিচ্ছি আর মরে যাচ্ছি। এখানে আসার আগে আমাকে নওরিন বলেছিলো, ওখানে পৌছেই একটা ফোন করে ওকে যেন জানাই। ওকে ফোন করতে পারিনি। বাসায় জাস্ট জানানো হয়েছে যে আমি এখানে পৌছেছি, ব্যস। দেখতে দেখতে সপ্তাহ পার হয়ে গেলো। কোনো পানিশমেন্টেই আমার ডেভেলপ করানো সম্ভব হচ্ছিলো না। আমাকে অফিসার হুট করে একদিন একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন।
‘প্রেমটেম করো নাকি?’
‘না স্যার।’
‘মিথ্যা বললে ১০০ পুশ আপ আরো করাবো। আবার বলছি, প্রেমটেম করো?’
‘না স্যার। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।’
‘ওর নাম কি নওরিন?’
আমি পুশ আপ বন্ধ করে অফিসারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তারপর আমাকে ইন্সট্রাকশন দিলেন। প্রতিদিন ২০০ পুশ আপ দিলে ২০০ সেকেন্ড করে নওরিনের সাথে কথা বলতে পারবো। ৩ মিনিট ২০ সেকেন্ড। দুইদিন পর কথা বললে ৬ মিনিট ৪০ সেকেন্ড। ২০০ পুশ আপ এর কম পুশ আপ দিলে এক সেকেন্ডও কাউন্ট হবে না। ২০০ পুশ আপ এর বেশি পুশ আপ দিলে সেটা কাউন্ট হবে। আমি ‘ওকে স্যার!’ বলে একটা চিৎকার দিলাম ও পুশ আপ দিতে শুরু করলাম। সেদিন অনেক কষ্টে ৭৯টা পুশ আপ দেই আমি। আমার সর্বকালের রেকর্ড।
এক মাস ধরে আমি এই সেশনে আছি। অন্যান্য ট্রেনিংগুলোও করছি। তবে আগের চেয়ে পুশ আপ একটু সহজ হয়ে গেছে। প্রতিদিন অবশ্য ২০০ পুশ আপ দেয়ার আগেই আমার স্ট্যামিনা একদম শেষ হয়ে যায়। অফিসারের ঘড়িতে এখনও এক মিনিট যোগ হয়নি। দুই মাস পর সেই শুভক্ষণ আসলো। জীবনে প্রথমবার ২০০টা পুশ আপ দিলাম। প্রচন্ড খুশিতে তালে বেতালে অফিসারকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার ৩ মিনিট ২০ সেকেন্ড অফিসারের ঘড়িতে অ্যাড হয়ে গেলো। সেইদিন রাতে অফিসার আমার সামনে দাঁড়িয়ে স্টপওয়াচে সময় দেখছে আর আমি নওরিনের সাথে কথা বলছি দূরে দাঁড়িয়ে। ওকে বললাম, অল্প সময়ে কথা শেষ করতে হবে। ও বললো, ঠিক আছে। অল্প অল্প করে কথা বলবো। আমরা এভাবে কথা বললাম,
‘কেমন আছো?’
‘ভালো। তুমি?’
‘ভালো। সবাই ভালো আছে?’
‘এখানে ওখানে সবাই ভালো আছে।’
‘রাতে কি খেলে?’
‘শুটকি আলু, ডাল, ভর্তা আর ভাত, তুমি?’
‘রুটি, ডাল, লাবড়া।’
‘কবে আসবে?’
‘জানিনা। গল্প শুনবে?’
‘হু বলো।’
‘এক ছিলো রাজা আর এক ছিলো রাণী। রানী খেতো শুটকি আর রাজা খেতো লাবড়া। একদিন রাণীর গলায় শুটকির দলা আটকে গেলো আর রাণীর কন্ঠ হয়ে গেলো শুটকির মত শুকনো। ’
‘তারপর?’
‘রাজা ভাবলো, রাণীর মত অবস্থা তো তারও হওয়া উচিত। রাজা রাণীকে অনেক ভালোবাসতো।’ ‘মোটেই বাসতো না।
রাজা ছিলো কঞ্জুস। উচিত হইসে লাবড়া খাওয়ায়ে রাজাকে।’ ‘না না, রাজা রাণীকে অনেক ভালোবাসতো। তাই রাজা ভাবলো সেও রাণীর মত গলায় লাবড়ার দলা আটকে নিজের গলা লাবড়ার মত স্বাদহীন করে ফেলবে। কিন্তু লাবড়া এত পিছলা, যত বড় দলাই বানায় গলায় আটকায় না। পিছলে পেটে চলে যায়।’ ‘কি বলছো তুমি এগুলো? অন্য কিছু বলো। উল্টাপাল্টা গল্প বলে খালি।’ ‘কি বলবো বুঝতে পারছি না। মাথা কাজ করছে না।।’ ‘কিছু বলতে হবে না। একবার আমি বলবো, ভালোবাসি। একবার তুমি বলবে, ভালোবাসি। পারবে না?’
‘হু পারবো!’ আমরা টানা ৩৮ সেকেন্ড একে অপরকে ভালোবাসি বলে গেলাম। তারপর ফোন রেখে দিলাম। আমার সময় শেষ।পরের দিন আবার ২০০ পুশ আপ কমপ্লিট। তার পরের দিন। তার পরের দিন। আমরা তিন মিনিট, চার মিনিট আর কয়েক সেকেন্ডের জন্য অপ্রয়োজনীয় কথা বলতাম। কয়েক সেকেন্ড একে অপরকে ভালোবাসি বলতাম। কিন্তু কয়েক মিনিট কথা বলে আমাদের পুষতো না। আমি একটানা এক সপ্তাহ পুশ আপ দিলাম। অতিরিক্ত পুশ আপও দিতে থাকলাম। আমার ঘড়িতে জমলো ২৩ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড। অনেক সময়। তারপরের দিন বাসা থেকে ফোন আসলো। ইন্সট্রাকশন বলে, প্রচন্ড ইমার্জেন্সি না হলে বাড়ি থেকে ফোন আমি রিসিভ করতে পারবো না। কিন্তু আমাকে সেদিন বলা হলো…তারিফ, ইটস এন ইমার্জেন্সি।
আমার বুক ধুকপুক করতে লাগলো। আমার ভাই থাকে সোমালিয়াতে। যুদ্ধাবস্থাতে সেখানে কত লোক মারা যাচ্ছে। আমি ভাবলাম ভাইকে নিয়ে খুব খারাপ কিছু শুনতে যাচ্ছি। ফোন রিসিভ করে জানতে পারলাম, ভাই ভালো আছে। নওরিন একসিডেন্ট করেছে, অবস্থা খারাপ। ভাই আমার তিনদিনের ছুটির ব্যবস্থা করেছেন। আমাকে আসতে হবে। হাসপাতালে যাওয়ার আগেই নওরিন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের জন্য মারা যায়। রেইপ এন্ড মার্ডার কেস। দিনে দুপুরে, তাও বাসের ভিতর। নওরিনের কথা মতে, সব যাত্রীকে যাত্রাবাড়ি নামিয়ে দেয়া হয়। ওকে বলা হয় শেষে নামতে, সবাই নামলে আরামে নামতে পারবে সে। সবাই নেমে যাওয়ার পরপরই বাস একটানে জায়গা ত্যাগ করে। নওরিন বাস থেকে নামতে পারেনি।
তিনদিনের ছুটি কাটাতে ইচ্ছে হলো না। দুইদিনের মাথায় ক্যাম্পে ফেরত আসলাম। অফিসার জানতে চাইলেন, কেমন আছে নওরিন। আমি কিছু বলতে পারলাম না। রাতে হুট করে অফিসারের তাবুতে গিয়ে বললাম ঘড়িটা দিতে। আমার নামে ২৩ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড মজুদ আছে। অফিসার এই প্রথমবার আমার হাতে ঘড়িটা দিয়ে দিলেন, আমার সাথে আসলেন না। আমি নির্বিকারভাবে বের হয়ে আসলাম। জায়গাটা খোলামেলা, উপত্যকার মত উঁচুনিচু। আমি ঘড়িটা চালু করি আর নওরিনকে ফোন দেই। ওপাশ থেকে জানায়, ফোন বন্ধ আছে। আমি ওই ফোন বন্ধের বার্তা শুনতে থাকি আর মূর্তির মত চোখ বড় বড় করে চোখের পানি ফেলি। আমার ২৩ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড যেন শেষ হওয়ার নয়।
গল্পের বিষয়:
গল্প