শহরের কোনও এক বিত্তশালী নাগরিক অন্ধ হয়ে যেতে শুরু করলে দেশ-বিদেশের চিকিৎসকেরা জানালেন, তাঁর সুস্থতার জন্য প্রয়োজন বাঘের চোখ প্রতিস্থাপন করা।
খবরটা আমি দেখেছিলাম পত্রিকায়। অনলাইনেও লোকে হাসছিল প্রচুর। গুজব ভেবে আমি এড়িয়ে গিয়েছিলাম। তবে আমার মনে পড়েছিল সারামাগোর ‘ব্লাইন্ডনেস’ উপন্যাসটির কথা, যেখানে সবাই অন্ধ হয়ে যেতে শুরু করেছিল। উপন্যাসটা পড়ে নিজেকে মানসিকভাবে দুর্বল মনে হচ্ছিল। ট্রমাটিক। সকালে চোখ খুলে প্রায়ই অন্ধকার দেখতাম। প্রায়শ মধ্য দুপুরে সব ঝাপসা হয়ে যেত। আর মনে হত এই বুঝি অন্ধত্ব আমাকে খেয়ে ফেলবে। শেষমেষ এক বন্ধুর সহায়তায় গিয়েছিলাম তার পরিচিত এক মনোচিকিৎসকের কাছে। উপকার পেয়েছিলাম। কারণ, ওই সাময়িক ক্ষণে ক্ষণে ফিরে আসা অন্ধত্বের অনুভূতি থেকে আমি মুক্ত হয়েছিলাম। বাঘের চোখ দরকার, এই খবরে অবশ্য আমার মনে ভয়টা ফিরে এসেছিল।
আমার সেই বন্ধুর সঙ্গে আবার যোগাযোগ করলাম, যাকে আমি ডাকতাম মিস্ট বলে। ওর আসল নাম ছিল কুয়াশা। নামটা ওর পছন্দ ছিল না। কুয়াশা মানে ধোঁয়াটে। কিন্তু কেন কুয়াশা নাম হল এমনটা আমিও ছোটবেলায় অনেক ভাবতাম। আশার আগে একটা কু লাগিয়ে দিলেই হল? আমি ওকে তাই মিস্ট বলে ডাকতাম। মিস্টের সঙ্গে আমার দেখা হত কম, ফোনেই বেশি কথা বলতাম। ও আবার আমাকে আরিমাতানো বলে ডাকতে চাইত না কখনওই। এক এক সময় নিজের মতো করে এক একনামে ডাকত। আজ যখন ফোন করলাম, মিস্ট বলল, “কি রে অরি কী খবর?” অরি বললেই আমার থিয়েরি অঁরির কথা মনে পড়ে। আমার প্রিয় ফুটবলার। মেসির আগে তো আমি অঁরিকেই ভালোবেসেছিলাম। আমি বললাম, “আমার আবার সেই ডাক্তারকে দরকার।” মিস্ট বলল, “আবার অন্ধত্ব?”
— দেখিসনি, একটা লোকের বাঘের চোখ লাগবে?
— দেখেছি। ওই ডাক্তারটা বাঘের চোখ খুঁজতে সুন্দরবন যাচ্ছে। সঙ্গে আমিও যাচ্ছি। তুই যাবি?
আমি অবাক হয়ে বললাম, “তুই এটা বিশ্বাস করছিস?”
— করছি।
আমি খেপে গিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম। মিস্ট ওই চিকিৎসকের সঙ্গে কেন বাঘের চোখ খুঁজতে যাবে? ভাবার সঙ্গে সঙ্গে টের পেলাম, ক্রমশ ঝাপসা হতে হতে আমার সামনে সবকিছু কালো হয়ে উঠছে। আমি ফের সেই অন্ধত্বের মুখোমুখি। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, আমার ড্রয়িংরুমের বুক শেলফের কাছে, সেখানেই মেঝেতে বসে পড়লাম। ব্যাপারটা কমপক্ষে এক থেকে দু’মিনিট থাকবে, এই সময়টা আমাকে বসে থাকতে হবে স্থির। এই এক দু’মিনিট কাটানোর জন্য আমি সাধারণত গুনতে শুরু করি। আজকেও তাই করছিলাম। গুনতে গুনতে এক ঘণ্টা পার হল, দু’ঘণ্টা পার হল, তিন ঘণ্টা পার হল। কিন্তু আমার দৃষ্টি আর ফিরে এল না।
বাড়িতে এখনো নকশি ফেরেনি। নকশি আমার এই রোগটা সম্পর্কে জানে না। বিয়ের আগেই রোগটা থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম দেখে প্রাক্তন প্রেমিকাদের কথা বললেও নকশিকে রোগের কথাটা বলা হয়নি। অবশ্য লুকিয়ে রাখার জন্য নয়, প্রয়োজন মনে না করাতেই আমি ওকে বলিনি। আমার ভীষণ ভয় করতে শুরু করল। ভয় পেলে যা হয়, তাই হচ্ছিল। হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল। ঘাম হতে লাগল। মনে হচ্ছিল বন্ধ হয়ে আসবে নিঃশ্বাস। কিন্তু সেই মুহূর্তেই ফোন এল। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না কে করেছে। তবু ধরলাম। ওপারে নকশির গলা।
— এই শুনেছ?
— কী?
— সবাই দলে দলে বাঘের চোখ খুঁজতে যাচ্ছে। বাঘের চোখ খুঁজে দিতে পারলে নাকি একটা দ্বীপ তার নামে লিখে দেওয়া হবে। দ্বীপটা নাকি খুব সুন্দর। এসব কাণ্ড দেখে আমার খুব বিরক্ত লাগছে।
— তুমি কোথায়?
— কী হয়েছে তোমার?
আমার কাঁপা কাঁপা গলা শুনেই নকশি সম্ভবত বুঝে ফেলেছিল আমি ভালো নেই। নকশিকে বললাম, “আমিও কিছু দেখতে পারছি না।”
— আরে, ওই বাঘের চোখ নিয়ে খবর বেশি দেখেছ বোধহয়। আমি আসছি কিছুক্ষণ পর। অফিসেও যাওনি না? থাক আর দরকার নেই। ফোনটা রাখলেই তুমি আবার দেখতে পাবে।
সত্যি সত্যি ফোনটা রাখার সঙ্গে সঙ্গে আমার দৃষ্টি ফিরে এল। নকশি ঠিকই বলেছিল। মানসিক চাপ। মিস্টের কথায় চলে গিয়েছিল আলো, নকশির কথায় চলে গেল অন্ধকার। ধীরে ধীরে হৃৎপিণ্ডের গতি স্বাভাবিক হয়ে এল। নিঃশ্বাস মিনিটে ১৬ বারে গিয়ে আটকালে বুঝতে পারলাম, মনের ভয়টা সত্যি কমেছে। দ্রুত উঠে নিজের ঘরে চলে এলাম। বাঘের চোখ সংক্রান্ত যত খবর আছে সব দেখতে শুরু করলাম।
এক এলাহি কাণ্ড! লোকে দলে দলে বাঘের চোখ খুঁজতে যাচ্ছে সুন্দরবনে। চিড়িয়াখানার বাঘগুলো নাকি আগাম টের পেয়ে বিড়াল হয়ে লুকিয়ে আছে কোথাও। এখন তাই বোঝা যাচ্ছে না কে বিড়াল আর কে বাঘ। ফ্রিজ থেকে খাবার গরম করে খেতে বসলাম। নকশির খবর নেই এখনও। এতক্ষণ কেন লাগছে? চিন্তা হচ্ছিল খুব। নকশি যেটা বলছিল সেটাই ঠিক। লোকে দ্বীপের লোভেই এসব কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে। দ্বীপে যাওয়ার এত লোভ মানুষের? আমি আশ্চর্য হচ্ছিলাম। পুরো বিষয়টা চরম হাস্যকর মনে হচ্ছিল। সুন্দরবনের বাঘ যে বিড়াল হয়ে যাবে না, সে বিষয়ে কি তারা নিশ্চিত?
টিভি চালিয়ে তাই দেখলাম, সমস্ত ঢাকা শহর খালি হয়ে যাচ্ছে। ফেরিঘাটে বাসের ভিড়, মানুষের ভিড়, পা ফেলার জায়গা নাই। সকালে নাকি একটা ফেরি অনেকগুলো গাড়ি নিয়ে মাঝনদীতে ডুবে গেছে। সেখানে কতজন মারা গিয়েছে তার হিসেব এখনও পাওয়া যায়নি। নকশি কি আর আসবে না? ফোন করে বন্ধ পেলাম। এটা নতুন নয়, প্রায়ই ওর ফোন বন্ধ হয়ে যায়। কখনও ইচ্ছে করেই বন্ধ করে, কখনও বা চার্জ শেষ হয়ে যায়। আমিই বরং বের হই। ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছে না। অফিসে না গেলেও আশেপাশে ঘুরে আসা যায়। রাস্তা ফাঁকা। বন্ধের দিন ছাড়া এমন ফাঁকা রাস্তা আর কখনও দেখিনি। ফাঁকা রাস্তায় দেখলাম একজন প্রায় উড়ে উড়ে আসছে। কাছে এলে বুঝতে পারলাম, নকশি। আমাকে দেখেই বলল, “ভালো হল তোমাকে এখানে পেয়ে গেলাম। জলদি যা টাকা আছে সেটা নিয়ে এসো আর ব্যাগে দু’জনের জামাকাপড় ঢুকিয়ে নিও তোমার পছন্দমতো।”
— কেন?
— আমরাও যাব সুন্দরবন। আমরা কেন বসে থাকব?
আমি নকশিকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, বাঘ বিষয়ক আমাদের কোনও ধারণা নেই বললেই চলে। খামোকা নিজেদের জীবনটা খোওয়াব কেন? নকশি আমার দিকে মনে হলো বাঘের চোখে তাকাল। যদিও বাঘের চোখ কেমন এ ব্যাপারে আমার স্পষ্ট ধারণা নেই। তা সত্ত্বেও মনে হল। ও আমাকে পাত্তা না দিয়ে বাড়িতে ঢুকে গেল। দ্রুত বেরিয়েও এল। আমি ততক্ষণ বাইরেই দাঁড়িয়েছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না কী বলব, কী করব। এর ভেতরে আবার মিস্টকে ফোন করেছিলাম, ও ধরেনি। কেটে দিয়েছে। সম্ভবত ও রওনা দিয়ে দিয়েছে। নকশি এসে আমাকে বলল, “তুমি কি যাবে নাকি যাবে না?”
— যাব না। খানিক আগেই তুমি ফোনে বিষয়টা এমন ভাবে বললে যেন তোমার কিছু যায় আসে না। আমাকে বাড়িতে থাকতে বললে। দু’মিনিটের ভেতর কী হল?
— দু’মিনিট না, দু’ঘণ্টা। কী হল সেটা তোমাকে ব্যাখ্যা করতে রাজি না আমি। শেষবারের মতো জানতে চাইছি, তুমি যাবে না যাবে না? হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম, “যাব।” নকশিকে এই বিপদে একা ছেড়ে দেওয়া যায় না।
রাস্তার মোড় পর্যন্ত আসতেই আমাদের চোখে পড়ল শত শত বিড়াল রাজপথে ছোটাছুটি করছে, যেন ভীষণ ভয় পেয়েছে। আমাদের দেখে বিড়ালগুলো থমকে দাঁড়াল। আমরা দাঁড়িয়েছিলাম ঠিক জনহীন চৌরাস্তার মাথায়। দু’পাশ থেকেই ওরা আসছিল। আমাদের দেখে থমকে গেল। ওরা দেখতে কিন্তু ঠিক আসল বিড়ালের মতো নয়। আকারে একটু বড়। শরীরের চাইতেও চোখগুলো কেমন স্পষ্ট। নাকি মন আমাকে ভুল দেখাচ্ছে? নকশির দিকে তাকালাম। আমাদের চোখাচোখি হল। মুহূর্ত আগের নকশির চেহারার সেই একাগ্রতা, সেই জেদ একটু ম্রিয়মাণ দেখাল। সেখানে এখন ফুটে আছে প্রশ্ন ও দ্বিধা। বিড়ালগুলো আমাদের দেখে একটুর জন্য থেমেছিল। তারপর আমাদেরকে কাটিয়ে ফের ছুটতে শুরু করল। একটা সময় তাদের ছুটে যাওয়া শেষ হল। মনে মনে বললাম, সুন্দরবন তাহলে এখন বাঘশূন্য।
— চলো এবার তাহলে যাওয়া যাক। নকশিকে বললাম।
— আর গিয়ে কী হবে? কোথাও কিছু পাওয়া যাবে না। লোকটার সত্যিকারের বাঘের চোখ লাগবে, বিড়ালের নয়। নকশির কণ্ঠে ঝরে পড়ল হতাশা।