নতুন ব্যাগে টাকাটা যত্ন করে রাখে স্বপ্না। দু’টো ভাগে। খুচরো হাতব্যাগে। বড় নোট আলাদা। ভেতরে একটা ছোট্ট চেন লাগানো খাপে। লুকনো। ব্যাগের ওই চেনের মধ্যেই চার মাসের টাকা একটু একটু করে জমিয়েছে স্বপ্না। যতটা পেরেছে।
এই বাড়িটা বেশ ভালো। মাসের এক তারিখেই টাকা মিটিয়ে দেয়। সাধারণত পনেরো দিন পর পর টাকা দেওয়ার কথা। ওরা প্রথমেই কথা বলে নিয়েছিল। একবারে দেবে। মাসের প্রথমে। ওই এক তারিখেই। বাড়ির দাদা বৌদি দুজনেই বেশ পষ্ট কথা বলেন। রাখঢাক নেই। যেমন কথা, তেমন কাজও। এখানে কাজ বলতে, দাদার বুড়ি মায়ের সেবা। যত্নআত্তি। ওই যেমন হয়। কফ-কাশি-বমি… গু-মুত পরিষ্কার। ওষুধপথ্যি দেওয়া তো আছেই। হিসেব করে। ঘণ্টা-মিনিট দেখে। একে বুড়ির কোমর ভাঙা। তার ওপর স্ট্রোক হয়েছে একবার। ডানদিকটা তেমন চলে না। বেডপ্যান দিতে হয়। কিন্তু বড় বুঝদার। ইশারা করত। কথা একটু জড়ানো। কান পেতে বুঝতে হয়। স্বপ্না সব বোঝে। বুড়ির চোখ দু’টো বড় মায়াময়। মাঝে মাঝে জলে ভরে আসে। কোঁকড়ানো নরম সাদা চুলের মধ্যে জল গড়িয়ে যায়। স্বপ্না নিজের আঁচলের খুঁট দিয়েই তো কতবার…
খাটটা ওরা বড় সুন্দর করে সাজিয়েছিল আজ। কত সাদা ফুল। রজনীগন্ধা আর পদ্ম চেনে স্বপ্না। আরও অনেক অন্যরকম ফুল। ও চেনে না। শেষযাত্রা বলে কথা। কিন্তু কেউ তেমন কাঁদল না। দাদা, বৌদি, আত্মীয়স্বজন। প্রতিবেশিরাও অল্প ক’জন। গম্ভীর, চুপচাপ, শান্ত। অনেক ধূপকাঠি, অনেক ফুল। সুন্দর গন্ধ চারপাশে। কাঁচের গাড়িতে উঠে বুড়িমা চলে গেল। মায়া কাটানো তো নয়, মায়া হয়তো তার আর ছিল না। মায়া কারওরই ছিল না। এই বয়সের মানুষের জন্য কীই বা পড়ে থাকে?
সবাই তো অবচেতনে দিন গোনে। বিট্টুও অত ছোট ছেলে। বুড়িমার একমাত্র নাতি। সে-ও কেমন গম্ভীর। একবার এসে দাঁড়াল। তারপর নিজের ঘরে চলে গেল। স্বপ্না ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে আসার সময় দেখল, বিট্টু টিভিতে কার্টুন দেখছে। বড়লোকেরা বোধহয় এমনই হয়। গলা শুকিয়ে কাঠ। পাশেই একটা লেবুজলওলা বসে। একা একাই খাবে? থাক। বাসস্টপে আজ অনেকক্ষণ বসতে হবে। উপায় নেই। শ্রীকান্ত কাল রাতেই জানিয়েছিল, আজ ওর দেরি হবে। যদিও আজ সকাল পর্যন্ত স্বপ্না জানত না বুড়িমা গত রাতেই চলে গেছেন। ও যখন ডিউটিতে এসেছে, তখন সব সাজানো চলছে। লোকজন জড়ো হয়েছে। অফিস-কাছারি ফেলে এসেছে সকলে, বারে বারে ঘড়ি দেখা। তাড়াতাড়ি শ্মশানে রওনা করে দিতে পারলে অফিসে চটপট হাজিরা দেওয়া যাবে। স্বপ্নাকে দেখে বৌদি এগিয়ে এল… ‘ভালই হয়েছে তুমি এসে পড়েছ। শেষ সময়টা মা তো তোমার কাছেই ছিল।’
— সকালে একটা ফোন করনি কেন বৌদি? স্বপ্না জানতে চায়।
— এমনিই। তোমার তো আর আজ থেকে ডিউটি রইল না। তোমার টাকাটা নিয়েই যাও। কাল থেকে আবার কখন বাড়িতে থাকি না থাকি…’
— কখন এতসব হল বৌদি? কাল রাতেও তো মাসিমাকে খাইয়ে দিয়ে গেলাম। তখন তো কিছু বুঝিনি গো!
— শেষ রাতে হয়েছে। আমরাও জানি না। রাতের আয়া ঘুমিয়েছিল। ও ভোররাতে কেমন গোঙানি শুনে…
বৌদি সামলে নেন নিজেকে। আয়ার সঙ্গে এত কথা বলার কথা নয় তাঁর। উচ্চবিত্ত মানুষ নিজের চারপাশের গন্ডি ছেড়ে এত দ্রুত মাটির কাছে পৌঁছন না সচরাচর। তবুও এই বাড়িটা বড্ড ভালো ছিল। স্বপ্নার কাজের বাড়ির কপাল অবশ্য বরাবরই ভালো। এই আয়া-সেন্টারে নাম লেখানোর পর থেকে স্বপ্না ভালো বাড়িই পেয়েছে। ট্রেনে সবিতাদি বলেছিল, এক একটা বাড়ি খুব কুচুটে হয়। খাইষ্টা। খেতে দেওয়া তো দূরস্থান, সুস্থভাবে বসার জায়গাটুকুও দেয় না। সেই তুলনায় এই দু’বছরে স্বপ্না যে তিনটে বাড়িতে গেল, তিনটেই বড় ভালো। মানুষগুলো গোলমেলে নয়। যেহেতু আয়ার কাজ, বুড়ো মানুষের দেখভাল করতেই হত। স্বপ্না আয়া-সেন্টারে সেই রকমই বলে নিয়েছিল। কচি বাচ্চা ধরার অভিজ্ঞতা ওর নেই। বরং বুড়ো মানুষ সামলানো ওর পক্ষে সহজ।
বাপের মরণকালে একটানা একা হাতে সব করত স্বপ্না। মা পারত না। ভয় পেত। ছোট দু’টো বোনের তো আতুসিপনার শেষ নেই। কিছু এদিক-ওদিক বললেই নাকিসুরে কান্না। মা-ও ওদের দলে। ওরা লেখাপড়া করে। ওরা ইশকুলে যায়। ওরা কলেজে যাবে। ওরা আরও পড়বে। ওরা চাকরি করবে। ওদের পয়সায় সংসারের সুরাহা হবে। কলের মিস্তিরি শংকরের স্ট্রোক হয়ে শরীরের একটা দিক অসাড় হয়ে গেলে সংসার অচল হল। টালির চালে লতিয়ে ওঠা কুমড়োগাছের ফুলের মতো হলুদ হয়ে এল।
মায়ের টুকটাক সেলাই, দু’বাড়ি রান্নার কাজ করে জমানো সামান্য পয়সায় টান ধরল। স্বপ্নার পরের বোনটা টিউশনি করে। নিজে এবার এগারো ক্লাস। স্বপ্না দেখেছে ওর স্কুলের ব্যাগে লিপস্টিক। নেলপালিশ। অথচ ঘরে চাল নেই। ও বোনকে কিছু বলেনি। থাক। ছোট বোন। সাধ-আহ্লাদ থাকতেই পারে। নিজের পয়সাতেই তো কিনেছে। কিছু বললে যদি মুখঝামটা দেয়? স্বপ্না ঘরে বসে রান্না করে। সেদ্ধ, পোড়া, ভাজা। যে দিন যা জোটে। সব পোড়া বাসন ধুয়ে রাখে। সকলের সমস্ত ছাড়া কাপড় কেচে দেয় টাইমকলের মাপা জলে। স্বপ্না-জ্যোৎস্না-রত্না তিন কন্যার বাপ ফ্যালফ্যাল করে চায়। কী দেখে, কী ভাবে। টালির চালের ক্ষুদে ক্ষুদে ছিদ্র দিয়ে চুঁইয়ে আসা সূচের মতো সূর্যরশ্মি তার ভাবনার নাগাল পায় না।
ছোট বোন রত্না দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করে। সূর্য পৃথিবীর সমস্ত শক্তির উৎস। স্বপ্না শতচ্ছিন্ন গামছা দিয়ে বাপের পিঠের ঘায়ের পাশ থেকে মাছি তাড়ায়। ভাবে, সব শক্তি জড়ো করে একদিন ঐ টালির চাল ফুঁড়ে উড়ে যাবে মাঝ-আকাশে। একটা লাল ঘুড়ি ওখানে প্রায়ই ওড়ে। টানটান। একা। স্বপ্নার ছোট কালো মোবাইল ফোনটায় প্রায় কিচ্ছু দেখা যায় না। ঝাপসা। কতদিন হল একটা ফোন কিনবে ভাবছে। হাঁ-করা সংসারের ফাঁক পূরণ করতে করতে সাধ-আহ্লাদ সব কোথায় হারায়!
রোদে বসে বসে চোখ ঝলসে যায়। ব্যাগের আড়ালে মোবাইল রেখে একবার ঘড়ি দেখে স্বপ্না। বারোটা দশ। শ্রীকান্ত দু’টো নাগাদ আসবে বলেছে। একবার ফোন করবে ভাবে। থাক। সকালেই তো কথা হল। তখন স্বপ্না ট্রেনে। বারুইপুর স্টেশন থেকে লেডিস কম্পার্টমেন্টে উঠতেই ফোন। রোজকার অভ্যেস। একবার জিজ্ঞেস করে, ফোন করে শ্রীকান্তকে। রোজই। কেমন আছ। কখন বেরবে। কী খেলে আজ। মামুলি কথাবার্তার মধ্যে অধিকার আর প্রশ্রয় মিশে থাকে। শ্রীকান্ত ফোন করে রাতে। ঠিক ন’টা। স্বপ্না তখন কাজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্টেশনের পথে। সারাদিনের টুকটাক খোঁজ। উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা। ভালোবাসা নয়। যেন ভালোতেই বাস।
চটিটার দিকে একবার তাকায় স্বপ্না। জ্যোৎস্নার পুরনো চটি। তালি মেরে চলছে। জ্যোৎস্না যেদিন পালিয়ে গিয়ে জেরক্সের দোকানের প্রশান্তকে বিয়ে করল, এই চটিটা ছেড়ে রেখে গিয়েছিল চৌকির তলায়। প্রশান্তর দোকান ঠিক পাশের গলিতে। জ্যোৎস্না বই-খাতা কাগজপত্রের ছবি তুলতে যেত। সেখান থেকেই টান। কোনও কোনও স্রোত বড় স্বার্থপর। জ্যোৎস্না প্রশান্তকে বিয়ে করে মা-কে জোর ধাক্কা দিল একটা। এগারো ক্লাসের পরে তার পড়ার বইগুলো ছড়ানো রইল চৌকির তলায়। বইগুলো আর কারও কাজে লাগবে না। পাশ থেকে ওর ফেলে যাওয়া চটিজোড়া কেবল পায়ে গলিয়েছে স্বপ্না।
শঙ্কর বেঁচে থাকতেই স্বপ্না পথে নেমেছিল। উপায় ছিল না। ধুঁকে মরতে বসা বাপকে রোজ সেবাযত্ন করে তো ঘরে পয়সা আসে না। তার চেয়ে পরের বাপের সেবাযত্ন করলে পেটে দু’টো ভাত পড়ে। স্বপ্না আয়া সেন্টারে নাম লেখাল। ছোট বোন রত্না পড়ে। রোজ স্কুলে যায়। স্বপ্না বেশ বোঝে, তারও শিকল ছিঁড়ে উড়ে যাবার সময় হয়েছে। এক ঝড়জলের রাতে বাপকে শ্মশানে পুড়িয়ে আসার সময়ে লাল্টু, শিবু আর বাপনের সঙ্গে রত্নার হেসে হেসে ঢলে পড়া দেখে স্বপ্নার হিংসে হয়েছিল খুব। মনে হয়েছিল, ও নিজে কি তাহলে একা বাঁচার জন্যই বড় হয়েছে? রাতদিন সংসারের বোঝা টেনে, ফাইফরমাশ খেটে… আর কদ্দিন?
আনমনা স্বপ্না রাস্তা পেরতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে একদিন। গলির মধ্যে থেকে যে লোকটা জলের বোতল নিয়ে দৌড়ে এসেছিল, তার নাক চ্যাপটা, ঠোঁট দুটো পুরু, তেলতেলে ঘন কালো চুলের ফাঁকে অনেক রুপোলি রেখা। নীল জামার হাতার কাছটা ছেঁড়া। হাতে তখনও কাঠের গুঁড়ো। কিন্তু চোখে বড় মায়া। অচেনা সেই মানুষটির হাতের সবুজ প্লাস্টিকের বোতল থেকে জল খেতে খেতেই স্বপ্নার হঠাৎ মনে হয়েছিল, এই লোকটা ওকে ওই লাল ঘুড়িটার খোঁজ দিলেও দিতে পারে।
ধীরে ধীরে কাঠের দোকানের মিস্তিরি শ্রীকান্তর ঘামে মিশে থাকা তার্পিনের গন্ধ স্বপ্নার শরীর জুড়ে লেগে থাকে। অবশ্য অনেকদিন সময় লাগে। বারুইপুর থেকে বাঘাযতীনে টানা বারো ঘণ্টার ডিউটি। স্বপ্নার ছুটি নেই। আয়ার কাজে আবার ছুটি কীসের? বাপ-মা মরা শ্রীকান্ত, কাঠের দোকানে এক বিরাট পালংকে রোজ বাটালির কারুকাজ করে। তার নিপুণ হাতে লতাপাতায় অজান্তেই আঁকা হতে থাকে স্বপ্নার মুখ। তারও ছুটি নেই যে! এইভাবেই কোথা দিয়ে বছর ঘুরে যায়। ব্যাগের মধ্যে নোটগুলো একটু একটু করে জমাতে হয়। সংসার থেকে চুপিচুপি সরিয়ে আরেকটা আকাশের খোঁজ।
— কতক্ষণ এলে? আচমকা প্রশ্নে চমকে ওঠে স্বপ্না।
— তুমি এই এলে? আমি একদম খেয়াল করিনি। শ্রীকান্তর হাসিতে ক্লান্তি থাকে না। সবসময় নির্মল।
— দেরি হল একটু। কাজের দিনে হাফ ছুটি দিতে চায় না তো।
— মালিক বলল কিছু?
— নাঃ। আমি তো তেমন ছুটিছাটা নিই না। তুমি এলে, কাজের বাড়িতে কিছু জিগ্যেস করল না?
— না। বুড়িমাটা কাল রাতেই চলে গেছে। কাজ ফুরোল। টাকাও মিটিয়ে দিল।
— ভালোই হল একদিকে। কটা দিন বিশ্রাম করে নাও। গুছিয়ে নিতেও তো সময় লাগবে।
— তা ঠিক। ভালই হল। তুমি কি আজও এই জামাটাই পরবে?
— তুমিও তো এই শাড়িটাই…
— দেখি। চলো আগে একটু জল খাই। তারপর ফুটপাথের লেবু-জল বিক্রেতার দুটি কাঁচের গেলাস পাশাপাশি ভরে নেয় ঘোলাটে টক-নোনতা পানীয়। মুহূর্তে শুষে নেবে দু’টি প্রাণি। আকণ্ঠ পিপাসা তাদের।
— কাল ঘর ভাড়ার অ্যাডভান্স দিলাম গো। হাত খালি একেবারে।
— আমার কাছে টাকা আছে তো। চলো না।
ফুটপাথ থেকেই একটা জামা কেনা হয়। হলদে রঙের জামা। আর লাল শাড়ি। জরির পাড়ও আছে। প্লাস্টিকের নতুন শাঁখা-পলা স্বপ্নার শীর্ণ হাত দু’টোকে হঠাৎ ভরাট করে দেয় যেন। সিঁদুরের পাতাটি ব্যাগে রাখা থাক। আলতাও। ঘরে গিয়ে পরবে না হয়। নতুন ঘর এখান থেকে অনেক দূর। নতুন যে আস্তানাটির পাঁচিল বেয়ে আকাশের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকবে একটা লাল ঘুড়ি।