এমনিতে সব ঠিকই আছে, দু’দশক পর দেখা হচ্ছে। কলকাতায় শীত কেটে গিয়ে চাঁদিফাটা চত্তিরমাস ফেটে পড়বার আগে এক ছটাক যে বসন্ত আসে মানসিক, সেই সীমিত সময়ের সেলেই, বিয়ে করে বহুকালের জন্যে প্রবাসী হয়ে যাওয়া বহু পুরাতন বান্ধবীর সঙ্গে। এইখানে মনে রাখতে হবে, প্রেমিকাকে আমি প্রেমিকাই বলি, সুতরাং এখানে বান্ধবী বলছি যখন, তার মানে কোনও টকগন্ধ এর সঙ্গে নেই। বরং মহানগরের যে কোনও মলের একটি কোণ যেমন কফির সুবাসে যোজনগন্ধা হয়ে থাকে চিরন্তন, প্রথম বার পা রাখলেও যেমন তার ঠিকানা চিনে নিতে অসুবিধা হয় না এতটুকুন,
তো সেইখানে পৌঁছে, সব ক’টা টেবিলের সমস্ত মহিলাকে খুঁটিয়ে জরিপ করে, (এখানে কে যে কী ভাষায় কথা বলছে, কে যে কার দিকে হাত নাড়ছে, পুরোটাই মায়া) আমার দিকেই নাড়ছে মনে করে, আসলে মধ্য বয়সের অবচেতনে একটা আশা তো থাকেই, সেই রিফ্লেক্সে আমিও পাল্টা দাঁত কেলিয়ে বহু বার মুরগি হয়েছি অতীতে! এবার তাই আত্মসম্ভ্রমে খানিক সাবধানী হয়ে, অতি সন্তর্পণে চাক্ষুষ সবটা পরিক্রমা করে শেষে গিয়ে বুঝলুম, সে এখনও আসেনি। কথা হচ্ছে, এই কফি কর্নারগুলোয় বিস্কুটের নাম কুকি, আর তার দাম আমার এক প্যাকেট সিগারেটের সমান। তাছাড়া খালিপিলি বসে থাকাও ভদ্র জায়গায় ভালো দেখায় না, কিছু না কিছু নিতেই হয়। সুতরাং সে না-আসা অবধি ঘুরে-ঘুরে অন্যান্য দোকানপাট দেখাই স্বাস্থ্যকর। এই মনে করতে-করতেই ফোন বাজল। যে হাত নেড়েছিল, সে আমায় দেখেই হাত নেড়েছিল, অতীত অভিজ্ঞতায় হীনমন্যতা জন্মেছে মনে গভীরে, তাই বিশ্বাস করতে পারিনি, ও-ই সে-ই।
আরে, নতুন এক ফ্যাকড়া হয়েছে আজকাল, কী সমস্ত ফিল্টার বেরিয়েছে, মা গো! ব্রণ ফুসকুড়ি ছুলি মেচেতার দাগফাগ মুছে তো দিচ্ছেই সব, বসন্তবিক্ষত গাল মেজে মাখম করে দিচ্ছে! সালা জম্মে-না-ওঠা ভুরু অবধি এঁকে দিচ্ছে মোটা করে! সরলরেখা ঠোঁট ফুলিয়ে পাউট করে দিচ্ছে, থালার মত মুখ পাক্কা পানপাতা। এদ্দিন বাদে ফেসবুকে ফের যোগাযোগ হওয়ার পর, আমি তো ছবিটবি দেখে মনে করেছিলুম, সেই একই রকম দেখতে আছে বুঝি। কিছুই পাল্টায়নি বিশ বচ্ছরে। বিজ্ঞানও সাজিয়ে নিয়েছিলুম নিজের মতো করে। বিদেশ মানে তো স্বর্গ, মানুষের সেখানে বয়স বাড়ে না, হাল্কা দুয়েকটা চুল পাকে খালি, তাও ভেতরে ভেতরে। মানুষ চাঙ্গা থাকে। ওয়াকে যায়, জিম করে টানটান, খালি ফ্রুটস খায় আর নন-অয়েলি ফুড। শরীর একেবারে ইস্ত্রি-করা। চিরবসন্ত লাল হয়ে থাকে গালে।
এ বান্ধবী আমার প্রথম যুগের সহকর্মী ছিল। কফি খেতে খেতে, নতুন করে আবার সে সব কথা হল। সেই অফিসের কারুর সঙ্গে আর যোগাযোগ আছে কিনা, কত মজা হতো অফিসে তখন, অমুকে কী বদমাশ ছিল, তমুকে কী ভালো, কার প্রতি কার কিছু একটা ছিল কি ছিল না। এ সব কথা, গত প্রায় বচ্ছরখানেক ধরে চ্যাটে বহু বার হয়েছে। তবু আবার হল। তার ওখানকার বাড়ি বর বাচ্চা, আমার এখানকার জীবন, সবই হয়েছে। এখন আসলে, পাশের বাড়ির লোকের সঙ্গে যত না কথা হয়, স্মার্টফোনের কল্যাণে পৃথিবীর অন্য প্রান্তের মানুষের সঙ্গে টাচে থাকা হয় বেশি। সারাক্ষণ চ্যাট চলতে থাকে।
এখানে কখন কতটুকু বৃষ্টি হচ্ছে, ওখানে কবে রোদ উঠছে, বরফগলা জলে বাঙালি মেয়ের এখনও এত বচ্ছর পরেও কেমন গা ঘিনঘিন করতে থাকে, আমার আজ সাইনাস, কাল তার কোল্ড, আমার বেরবার সময়ে গুড ডে উইশ, তার ঘুমোবার সময়ে কলকাতার মধ্যগগনে দাঁড়িয়েও আমার গুড নাইট বলা! বিশ্বাস করুন, চেষ্টা করলে ঠিকই অভ্যেস হয়ে যায়, স্বাভাবিক হয়ে যায় অচিরেই। এই গোলাকার গ্রহের বিভিন্ন কোণের বডিক্লক সমান্তরালে চলতে থাকে সক্কলকার শরীরে। একসঙ্গে প্রতিবেশীর মতো বইতে থাকে অনেকগুলো জীবন পাশাপাশি, কোনও অসুবিধা হয় না।
আসলে, অসুবিধা নয়, অস্বস্তি বলে একটা কথা আছে মানুষের জীবনে। আর সেটা অসুবিধের চেয়ে অনেক বেশি অস্বস্তিকর। সেটা চ্যাট থেকে ফোনে বাড়ে। ফোন থেকে মুখোমুখিতে সহস্রগুণ আরও। প্রেমিকাতেও তাই, বিশ বচ্ছর বাদে বান্ধবীতেও তাই। চিরকালই। তার মধ্যে, এখন তো আমরা লিবারাল হয়েছি, পলিটিকালি কারেক্ট হয়েছি, ম্যাচিওরড মধ্য বয়সে পৌঁছেছি। সুতরাং সব বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলাই তো স্বাভাবিক! যে কোনও সমস্যাই শেয়ার করা যায় এখন। পরস্পরকে সাজেশন দেওয়া না-হোক, সাপোর্ট তো করা যায়ই, সিরিয়াসলি। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলা বুড়ো বয়সের বন্ধুত্ব। মলে, উঁচু সিলিং থেকে নেমে আসছে সারি সারি আলো। নিচু স্বরে হলেও, মিউজিক বেজে চলেছে টানা। প্রথমে অত কানে আসছিল না। এখন ধীরে ধীরে অসহ্য হয়ে উঠছে। চারপাশে লোকে লোক। গম্ভীর মুখে যাতায়াত করছে।
মিউজিয়াম দেখতে এসছে যেন। আবার পরিচিত কারুর সঙ্গে দেখা হলেই আদিখ্যেতায় জড়িয়ে ধরছে। সরি, হাগ করছে! গালে গাল ঠেকিয়ে চুমু খাচ্ছে হাওয়ায়। আদেখলের মতো তিনতলা বার্গার, জলহস্তীর কামড়ে তার চিজ গড়িয়ে নামছে কষ বেয়ে। পাশের টেবিলে তরুণ দু’টি বাঙালি, তার মধ্যে একজন শাড়ি-পরা, অন্যজন খাদির জ্যাকেট, দুরন্ত ইংরিজিতে প্রেমালাপ করে যাচ্ছে। আমরা দুজনে হাসি-হাসি মুখ করে বসে আছি সেই কখন দিয়ে, কে আগে উঠবার কথা বলব, কী করে বলব! দু’জনেই তো বলে এসেছি আজ পুরো বিকেল সন্ধ্যে ফ্রি আছি দু’জনেই। একটা ফোনও আসছে না কারুর। আড্ডা মারতে বসে হোয়াটসঅ্যাপ চেক করা যে খুবই অশোভন! কী করে যে লোকে করে! এই এক বচ্ছরের আদানপ্রদানে সে বিষয়ে প্রচণ্ড বিরক্তি প্রকাশ করে সহমত হয়েছি দু’জনেই। এখন এই অকারণ স্মিতহাস্য বিনিময়, আর এই বিষয়বস্তুহীন চুপ সময় কাটানো, এইগুলোই বিপজ্জনক।
এইখান থেকেই জটিলতা শুরু হয়। হঠাৎ মাথার মধ্যে ফ্ল্যাশব্ল্যাকে চলতে শুরু করে সিরিয়াস কোনও কথোপকথনের টুকরো। ও দেশে জীবন আসলে কেমন। ওই একটু উইকেন্ডের লপচপানি ছাড়া বাকি পাঁচটা দিন ঠিক কেমন করে কাটে। বাঙালি কেমন আরও বেশি করে পেছনে লাগে, ছোট করে পরস্পরকে, বৈভবের দেখনদারি ছাড়া আসলে যে ভাবভালোবাসা কিছুই বিশেষ নেই, কেউই যে আসলে কলকাতাকে মিস করে না, মৌরিগ্রাম বা ময়নাগুড়ির জন্যে মনকেমন করে না কারুরই,
যে যার মতো দিব্যি থাকে, ওর মেয়ের ইউনিভার্সিটি হাজার মাইল দূরে, তারপরে ওর ইচ্ছে আফ্রিকাতে গিয়ে কাজ করবার, বর বরের সময়মতো ঘুমোয়, ঘুমোবার আগে অবধি ল্যাপটপে ব্যস্ত থাকে, সকালে গার্ডেনে ব্যস্ত থাকে, ছুটির দিনে ডগিকে স্নান করায়, গাড়ি ধোয়, আসলে কনজুগ্যাল লাইফ বলে কিছু থাকে না রে শুরুর ওই দুয়েক বছরের পর… আর, আমিও তার উত্তরে কত সিরিয়াসলি বুঝিয়েছি, নিজেকে এভাবে শেষ করিস না, বসে বসে ডিপ্রেশনে মরছিস কেন, নিজেকে শুকিয়ে মারা পাপ, ওখানে কাউকে ভাল্লাগলে, এবার একটা প্রেম কর, প্রেম কর…