তালাবদ্ধ ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে এক তরুণীকে। দরজার বাইরে পায়চারি করছে দুজন জোয়ান, তাগড়া যুবক। মেয়েটিকে বিকেলে আটকে রাখা হয়েছিল; সূর্য্য তখন নারিকেল গাছের পাতা ছুঁয়েছে। দূরের মসজিদের মিনার থেকে আসরের আজানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল। মেয়েটি বিনীত কণ্ঠে বলেছিল, ‘নামাজের সময় হয়েছে ভাইয়া, আমায় যেতে দিন’। রাতুল হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘বিপদে পড়লে সবাই ধার্মিক হয়ে যায়, হা হা হা’। সূর্য্য এখন ডুবি ডুবি করছে। একটু পরেই আলোকিত চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে যাবে। পাখিরা সব উড়ে যাবে নীড়ে। গৃহিণীরা প্রতিদিনের ন্যায় বাতি জ্বালাবেন। হৈ-হুল্লোড়ে মেতে থাকা মাঠ একটু সময়ের ব্যবধানে নীরব, নিস্তব্ধ হয়ে যাবে। রাস্তার দুপাশে সড়ক বাতিগুলো একে এক জ্বলে উঠবে। চায়ের দোকানে আড্ডা বসবে। অথচ, একটি মেয়ে আজ ঘরে ফিরবে না।
ছোট্ট একটি ঘর। চারদিকে ইটের দেয়াল। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটি কাঠের টেবিল পাতা। টেবিলের দুটো পায়া ঘুণপোকা সাবাড় করে দিয়েছে। অবশিষ্ট দুটো পায়া কুটকুট করে কাটছে। যেকোন সময় ভেঙে পড়বার সম্ভাবনা রয়েছে। টেবিলের উপর স্টিলের খালি গেলাস। গন্ধ বেরোচ্ছে, বিশ্রি গন্ধ। টেবিলের সামনে কাঠের চেয়ারে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে মেয়েটিকে। হাত বাঁধা, পা বাঁধা, মুখ অবধি শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। এতক্ষণ নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল সে। চোখের জলের সাথে নাকের জলটুকুও গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়া আর সম্ভব হচ্ছে না। বুকটা ভারী হয়ে আসছে। গলা শুকিয়ে গেছে। চোখ মেলে তাকাতে কষ্ট হচ্ছে। চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসছে ধীরে ধীরে।
রাতুল ফোন কানে লাগিয়ে বলল, ‘হ্যালো, আবিড়। আর কতটা সময় নিবি? সেই কখন থেকে বেঁধে রেখেছি। আসবি তো নাকি?’ ওপার থেকে কী বলছে শুনা যাচ্ছে না। নাবিল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাতুলের দিকে। রাতুলের মুখের ভঙ্গি দেখে আবিড় কী বলতে পারে, বুঝবার চেষ্টা করছে সে। রাতুল বলল, ‘আচ্ছা তাড়াতাড়ি আয়। আসার সময় জিনিসটা মনে করে আনবি। ভুলে যাস না আবার’। নাবিল চিন্তিত ভাবে বলল, ‘কী বলেছে ওঁ?’ ‘বলেছে আরো দু’ঘন্টা সময় চাই।’ ‘সে দু’ঘন্টা পরে আসুক। আমরা নাহয় দ্বিতীয় বার সেলিব্রেট করলাম। কী বলিস?’ রাতুল হো হো করে হেসে উঠল। দাঁতের ফাঁক দিয়ে পানের পাতলা লাল টকটকে পিক বেরিয়ে থুতনি বেয়ে মাটিতে পড়ল।
দরজা খোলে গেল। বাইরে ঘন অন্ধকার। মেয়েটি ক্লান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে দেখল। টর্চ হাতে দুজন লোক প্রবেশ করল ঘরে। দরজা আটকানো হলো। খোলে দেওয়া হলো মেয়েটির হাত-পায়ের বাঁধন। মুখের বাধন খোলা হলো না। মেয়েটি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করল। অথচ, শব্দ হলো না। কেউ শুনতে পেল না তার বিলাপ। কেউ না।
রাতুল শান্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। তার পিছু পিছু নাবিল। ঘরের মেঝেতে পড়ে রইল মেয়েটির অচেতন দেহ। গাল বেয়ে মাটিতে পড়ল এক ফোঁটা অশ্রু। বুকের ভেতর জমা হলো, নিজের প্রতি প্রবল ঘৃণা। ছিঃ, আজ মেয়ে বলে! গুট গুট শব্দ করে বাইক এসে থামল। দপ করে নিভে গেল আলো। রাতুল বলল, ‘জিনিস কই, আবিড়?’ আবিড় ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ধর, তোর জিনিস।’ ‘মাত্র এক বোতল! এতে কী হবে?’ ফোন বেজে উঠল। আবিড় ফোন হাতে নিয়ে বলল, ‘চুপ।’
রাতুল চুপ করে গেল। সে জানে আবিড়ের মায়ের ফোন। মা ফোন দিলেই সে সবাইকে চুপ করিয়ে দিয়ে একটু দূরে গিয়ে কথা বলে। আজও তাই করছে সে। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। কথা বলা শেষ করে আবিড় যখন ফিরে আসছিল, রাতুল বলল, ‘চানাচুর কই?’ আবিড় জবাব দিলো না। চুপচাপ ঘড়ি দেখল। তাকে বিচলিত দেখাচ্ছে। রাতুল বলল, ‘কী হয়েছে?’ আবিড় করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘মুন এখনো বাসায় ফিরেনি।’ ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা মেয়েটি চোখ খোলে তাকাল। সে স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে আবিড়ের গলা। দেয়ালে হাত রেখে ধরা গলায় বলল, ‘ভাইয়া!’
গল্পের বিষয়:
গল্প