বিয়ের সাত বছর পর যখন আজ আমার স্ত্রী অহনা গর্ভবতী, তখন প্রতিটা মুহূর্তে অহনাকে কটুবাক্য বলা আমার মা আজ ভীষণ খুশি! এতোটাই খুশি যে উনার সামর্থ্য হলে অহনাকে পৃথিবীর সর্ব সোনা দিয়ে স্নান করিয়ে দিতেন। বিয়ের তিনেক বছরেও যখন অহনা মা হতে পারছিলনা, মা তার বেঁচে থাকাটা কষ্টের করে দিয়েছিলেন। প্রতিটি দিন, প্রতিটা মুহূর্তে, মা অহনাকে তার মা হতে না পারার ব্যর্থতার জন্য কটুকথা বলতেন। বাবাতো অহনার প্রতি এতোটাই অতিষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন যে তার হাতের খাবার পর্যন্ত খেতে চাইতেন না। অহনা প্রতিটা অপমান, তুচ্ছতাচ্ছিল্য আমার মুখের দিকে চেয়ে সহ্য করে যেতো। কখনো মা-বাবার এমন আপত্তিকর কথাবার্তার জন্য প্রতিবাদ করত না। মা কয়েক বার আমাকে বলেছেন “ভালোবেসে এমন একটা বন্ধ্যা মেয়েকেই বিয়ে করলি যে সংসারে সুখ দিতে পারছেনা। একটা সন্তানের মা হতে পারছেনা। বাবাও অনেক ধরনের কথাবার্তা বলতেন আমাকে। নেহাও অনেক অপমানিত হতো এসব নিয়ে। কিন্তু দুজনের কেউই প্রতিবাদ করতাম না।
অহনা প্রতিটা রাত জেগে থাকতো। একা একা কান্না করতো। সারাদিন নিজেকে শক্ত রাখতো। মায়ের গালাগালি, বাবার তাচ্ছিল্যতা সহ্য করতো মুখ বুঁজে। কিন্তু মনের ভেতর সৃষ্ট ক্ষতের ব্যথা নিঃশব্দ রাতে অহনা সহ্য করতে পারতোনা। আমি ঘুমের দেশে চলে গেলে সে নির্ঘুম থেকে কাঁদত। তার অনেক নির্ঘুম রাতের সাক্ষী হয়েছি আমি। অনেক সময় আমার বুকে মুখ লুকিয়ে বলতো – “আমাকে এতো ভালো কেনো বাসো হৃদয়? আমি তোমার মা বাবার ইচ্ছে পূরণ করতে পারছিনা। আমার কারণে তুমিও তো শতশত বার অপমানিত হয়েছো। কেনো ছেড়ে দিচ্ছোনা আমাকে”? আমি প্রতুত্তরে বলতাম -” ভালোবাসি তাই”। আজো অহনা রাত জেগে ক্রন্দন করছে। “কাঁদছো কেন অহনা”? আমার প্রশ্নের জবাবে সে বলল, ” এটা সুখের কান্না হৃদয়। তোমাকে আমার দুঃসময়ে পাশে পাওয়ার কান্না।”
দুঃখের শেষ কিন্তু এখনো হয়নি। সকাল হতে না হতেই মা আমাকে ডাকলেন। বাবাও ছিলেন সেখানে। মা উনার মনের প্রশ্ন জুড়ে দিলেন। “বাবা হৃদয় বউমার ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে এটা কি জানা যাবে”? মায়ের এই মুর্খের মতো প্রশ্ন শুনে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। আমিও পাল্টা প্রশ্ন করে বসলাম ” কেনো মা? এটা কেন জানতে চাও”? মা আমার হাতটা ধরে আহ্লাদী কণ্ঠে বললেন, “আমার না নাতি চাই। তোর বাবারো একি কথা হৃদয়”। ” কেনো মা? আমার যদি মেয়ে অর্থাৎ তোমার যদি নাতনি হয় তাহলে কোনো সমস্যা”? মা চোখ দুটো বড় বড় করে বললেন, “খবরদার হৃদয়! ভুলেও এমন অশুভ কথা মুখে আনবিনা”! মায়ের কথা শুনে আমি ভীষণ অবাক হলাম। বিশ্বাস করতে পারছিনা যে আমি এই মায়ের ছেলে যার চিন্তাভাবনা এতো তুচ্ছ। ” কথাটা কিভাবে অশুভ হতে পারে মা!? মেয়ে জন্ম দেয়া কি অশুভ কাজ!? “তাহলে? বংশের নাম উজ্জ্বল করে ছেলেরা। বংশকে এগিয়ে নিয়ে যায় ছেলেরা।” “তাহলে তো মা তোমার জীবিত থাকার অধিকার নেই। তুমিও তো মেয়ে বা নারী”।
মা আমার গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে বললেন ” মায়ের সামনে তর্ক করতে তোর লজ্জা হয়না”? বাবা সোজাসাপটা বলে দিলেন, “আমরা যাচাই করেই ছাড়বো বউমার গর্ভে ছেলে না মেয়ে। আর মেয়ে থাকে তাহলে আমরা গর্ভপাত করাতে বাধ্য হবো”। আমার অবাক হওয়ার কোনো অন্ত নেই। শিক্ষিত সমাজে এমন অশিক্ষিত কথাবার্তা আমাকে খুবই বিচলিত করছে। আমি বাবাকে বললাম, ” বাহ বাবা বাহ! কি সুন্দর করে বলে দিলেন যদি মেয়ে হয় তাহলে গর্ভপাত করিয়ে নিবেন। আপনি কি মনে করেন আমি তা করতে দেব”? “হৃদয় অনেক বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। তুই যদি গর্ভ পরীক্ষা না করাস তাহলে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যা”! বাবার উক্ত কথায় আমার চোখের জলকে আর ধরে রাখতে পারলাম না।
” ঠিক আছে বাবা চলে যাবো এই ঘর ছেড়ে। কিন্তু আপনাদের দুজনকে কিছু বলতে চাই। আজ আপনি এই পৃথিবীতে আছেন কারণ আপনার জননীও একজন নারী। যদি আপনার জননীকে গর্ভেই হত্যা করা হতো তাহলে আপনিও এই পৃথিবীর মুখ দেখতে পারতেন না। আর মা আপনি একজন নারী হয়ে এমন তুচ্ছ কথাগুলো বলতে পারলেন কিভাবে? আমার নিজেকে ঘৃণা হচ্ছে যে আপনাদের ছেলে ভেবে। মনে রাখবেন বাবা বংশ বাড়াতে নারী-পুরুষ সমান অবদান পালন করে। আর শুধু ছেলেরাই না মেয়েরাও বংশের নাম উজ্জ্বল করে এর বাস্তব অনেক উদাহরণ আছে।”
আমি আর কোনো কথাই বললাম না। সোজা রুমে এসে অহনাকে বললাম “অহনা তোমার যা যা কাপড় আছে সবকিছু গোছানো শুরু করো। আমরা আর এ বাড়িতে থাকবোনা।” অহনা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। “এভাবে তাকিয়ে আছো কেন কাপড় গোছাও!”
“কিন্তু কেন?” “মা বাবা চান তোমার গর্ভ পরীক্ষা করিয়ে ছেলে না মেয়ে হবে তা দেখতে। আমরা আর এই ঘরে থাকবো না!” আমি কাপড় চোপড় গোছাচ্ছিলাম তখনই বাবা-মা রুমে এসে বললেন, “বাবা হৃদয় আমাদেরকে মাফ করে দে বাবা! সত্যিই আমরা অনেক বড় ভুল করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমরা এখন উচিৎ শিক্ষা পেয়ে গেছি বাবা। তুই ঘর ছেড়ে যাস নে বাবা, যাসনে!” আমি অহনার কানে কানে বললাম, “অহনা ট্রিক টা কাজে লেগেছে।” অহনা আমার দিকে অবাক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে আর আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসছি।……
গল্পের বিষয়:
গল্প