অবশেষে

অবশেষে
অফিস থেকে বাসায় ফিরেই নিলয়ের মনে হলো কিছু একটা ঠিক নাই। অস্বাভাবিক নীরব পুরো বাসা। দুই মিনিটে পুরো ফ্ল্যাট চক্কর দিয়ে সে নিশ্চিত হলো,তার মাস খানেক আগে বিয়ে করে আনা অতি রূপবতী বউটি বাসায় নেই। নিলয়কেও ফোনে কিছু বলেনি বাহিরে যাওয়ার ব্যাপারে। অপারক হয়ে নিলয় ফোন করলো।
-কোথায় তুমি?
-এই তো ফিরছি, প্রায় চলে এসেছি
-কোথায় গিয়েছিলা?
-একটু কাজে
-আচ্ছা, আসো।
হিম শীতল গলায় কথা বলা শেষ করে ফোনটা বিছানার সামনে টেবিলে রেখে ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে নিলয়। মাথাটা টনটন করছে। এমনিতেই প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে বলে প্রচন্ড মানসিক চাপে থাকে নিলয়, তার উপর যদি বাসায় ফিরে দেখে বউ বাসায় নেই। তাহলে ছোটোখাটো একটা ঝড় মনে বয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। নিলয়ের লাইফে আসা প্রথম মেয়েটার নাম ছিলো মুন্নি। সেই ভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারের কথা। টানা দুই সেমিস্টার অনার্স মেরে ক্লাসের সবার সমীহ আদায় করে ফেলে ছিলো নিলয়, মুন্নি মেয়েটা অনেকটা গায়ে পড়েই বন্ধুত্ব করে। নিলয় মোটেও মেয়ে ঘেঁষা ছেলে ছিলো না। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। নিলয়ের লাইফের প্রথম এধরণের অভিজ্ঞতা। সে মন প্রাণ উজার করে দিয়ে ভালবেসে ছিলো। পরের সেমিস্টারেই রেজাল্টও ডাউন খেয়ে গেলো অতি অভিমানি ও ক্রমাগত তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে মানসিক অশান্তিতে রাখা মেয়েটার কারণে। অবশ্য মাস ছয়েকের মধ্যেই দেখা গেলো মেয়েটার গায়ে পড়ে প্রেমে পড়াটা ছিলো নিলয়ের ভাল রেজাল্টের কারণে পাওয়া খ্যাতির মোহ। প্রবাসি এক কাজিনকে বিয়ে করে পড়াশুনা গুল্লি মেরে মেয়েটা চলে গেলো অন্য কারও ঘরে গৃহিণী হতে। যাবার আগে নিলয়কে কিছু জানানোরই প্রয়োজন মনে করেনি।
নিলয় বেশ বড়সড় ধাক্কা খেলো। এঘটনায় মেয়েদের ব্যাপারে তার মনের ধারণাটা চিরদিনের জন্য চেঞ্জ হয়ে গেলো। মেয়ে মাত্রই টাকার লোভী, মেয়েরা ভালবাসে না, শুধু অভিনয় করে যায়, মেয়ে মাত্রই প্রতারক, পরকিয়ায় আসক্ত- এইটাইপের কথাবার্তা ফেসবুকে দেখলেই শেয়ার দেওয়া শুরু করলো। নানা পোস্টে সুযোগ পেলেই মেয়েদের এক হাত দেখে নিত। কোথাও কোন মেয়ে ধর্ষণ বা নির্যাতনের শিকার হয়েছে, এরকম পোস্ট দেখলে সে বিচিত্র তৃপ্তি পেত, সেসব পোস্টে “উচিৎ শিক্ষা হয়েছে, এগুলাই ডিজার্ভ করে” এধরণের কমেন্ট করে কত যে গালি খেয়েছে সে, তার হিসাব নাই। থোড়াই কেয়ার করে সে। আর টাকা থাকলেই যেহেতু মেয়ের অভাব হয় না। তাই সে আবার পড়াশুনা ভাল মত করে টাকা কামানোর ধান্দা শুরু করলো। বড় একটা আইটি ফার্মে বেশ বড় একটা পদে এক সময় নিজেকে পৌঁছাতে পারলো সে, খাটনিও প্রচুর, বেতনও প্রচুর, দুইয়ে দুইয়ে চার। অবশেষে পরিবারের সাহায্যেই মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির অতিরূপবতী এক মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে এসেছে, মাঝে আর কোন মেয়েকে ধারে কাছেই আসতে দেয়নি, অনলাইন-অফলাইনে কেবল মেয়েদের ঘৃণাই করে গেছে শুধু।
বিয়ের পর গত একমাস সে তার বউ এর জীবন যত ভাবে পারা যায় অতিষ্ঠ করে ফেলেছে। মেয়েটা এমনিতেই আগে বোরকা-হিজাব পরতো নিজের ইচ্ছাতেই, নিলয় তাকে আরও কড়াকড়ি ড্রেসকোড দিয়েছে। চোখও ঢেকে রাখতে হবে, হাতে হাত মোজা পরতে হবে। মেয়েটা আপত্তি করেনি, মেনে নিয়েছে। প্রচন্ড রূপবতী মেয়ে বলে নিলয় তাকে নিয়ে প্রচন্ড ইনসিকিউরিটিতে ভুগে! চাকরির কারণে তারা দুইজন আলাদা বাসা নিয়ে থাকে। সারাদিন খালি বাসা। মাথায় কত ভয়ানক আশংকা যে খেলা করে। সে খুব চেষ্টা করছে তার কিংবা মেয়েটার বাসা থেকে কোন মুরুব্বিকে এনে বাসায় রাখতে। কিন্তু কেই বা রাজি হবে নিজের সংসার ফেলে আরেকজনের বউকে পাহারা দিতে? নিলয়ের শুধু টেনশন বাড়ে। হুটহাট অফিস থেকে বাসায় চলে আসে সুযোগ পেয়ে। বউ এর ফেসবুক পাসওয়ার্ড নিয়ে বসে আছে, নিজেরটা অবশ্য বৌকে দেওয়ার কথা মাথাতেও আসেনি।
তবে এখন পর্যন্ত তার বউটা তার কোন কথায় আপত্তি করেনি। এত সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করা নিয়ে তার অনেক বন্ধুই তাকে সাবধান করে ছিলো, কিন্তু মেয়েটার মধ্যে সুন্দরী মেয়েদের মধ্যে যে সহজাত অহংকারী ভাব থাকে সেটাও দেখা যাচ্ছে না। চুপচাপ, ঠান্ডা স্বভাবের একটা মেয়ে। বাসায় ঢুকে নিলয়ের ঠান্ডা দৃষ্টি উপেক্ষা করেই বোরকা খুলতে খুলতে মেয়েটা বেডরুমে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর এসে নিলয়ের সামনে একগ্লাস ঠান্ডা পানি আর একবাটি সেমাই রেখে গেলো, বুঝা যাচ্ছে ফ্রিজে ছিলো। নিলয় কিছু না বলে সেমাইটা হাপুসহুপুস করে খেয়ে নিয়ে এক ঢোকে গ্লাস খালি করে একটা বিশাল একটা ঢেঁকুর তুললো। নাহ, মেয়েটার রান্নার হাত অসাধারণ, নিলয়ের মাথাটা বিগড়ানো না থাকলে সে হয়তো বুঝতো কতটা লাকি সে!
-এই অসময়ে কোথায় গিয়েছিলে?
-বিকাশ করতে। আম্মা ফোন দিয়ে বললেন ইমার্জেন্সি কিছু টাকা লাগবে, সামনের মোড়ে গিয়েছিলাম।
নিলয় মুখ বিকৃত করে বাজে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়, সে জানে বিকাশের টাকাগুলো মেয়েটার নিজের ইনকামের টাকা। এটা নিয়ে কিছু বলা যাবে না। পাশের বাসায় দুইটা ছোট ছোট মেয়ে দিনে একবার করে এসে ঘন্টা দুয়েক পড়াশুনা করে যায়। তার বিনিময়ে সামান্য কিছু যা দেয় তাই মেয়েটা বিকাশে রাখে। নানা কাজে লাগে।
-বাহিরে যাচ্ছো, ফোন করে বলোনি কেন?
-পাঁচ মিনিটের ব্যাপার, ভেবেছি তুমি ফেরার আগেই চলে আসব।
-ওহ তাই? তা এরকম আমি আসার আগেই কতবার বাহিরে থেকে ঘুরে আসো?
নিলয়ের কন্ঠে বিশ্রী নোংরা ইঙ্গিত। সুনয়না, যার হাতে এইমাত্র তৃপ্তি করে খাওয়া সেমাইয়ের খালি বাটি, থমকে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ আগে বাহিরে তীব্র গরমের মধ্যে কালো বোরকা পরে যাওয়ায় ঘেমে ভিজে যাওয়া সেলোয়ার এখনও শুকায়নি, ঘরে ফিরেই কাজ শুরু করায় এখনও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, সে এক হাতে বাটি ধরে আরেক হাতে কপালের ঘাম মুছে খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো..
-কি বললে?
নিলয় এই শান্ত গলার পিছনে যে ভয়ানক কাল বৈশাখী ঝড় লুকিয়ে ছিলো, টের পেলো না। সে আবারও দাঁত মুখ বাঁকিয়ে বললো..
-তোমরা মেয়েরা যে কি চিজ তা আমার হাড়ে হাড়ে জানা আছে। তার উপর চেহারা সুরুত একটু ভাল হলে তো কথাই নেই। সুনয়না এক পা এগিয়ে এলো। নিলয়ের চোখে চোখ রেখে বললো..
-কোন মেয়ের চেহারা সুন্দর হলেই মেয়েটা দুশ্চরিত্রা হয়? নিলয় টিটকারির সুরে বলে..
-যে ফল যত গন্ধ ছড়ায়, সেটা পঁচে তত তাড়াতাড়ি। সুনয়না হাতের বাটিটা ভয়ানক গতিতে মাটিতে আছড়ে ফেললো। নিলয় হকচকিয়ে গেলো একদম, এত বিকট শব্দ হয়েছে যে মনে হয় পাশের ফ্ল্যাটের মানুষেরাই শুনতে পাবে। সর্বদা শান্ত, সুবোধ সুনয়নার এরকম রূপ এর আগে দেখেনি নিলয়, মেয়েটার ফর্সা গাল টুকটুকে লাল হয়ে গেছে, নাকের পাটা ফুলে গেছে। মেয়েটা তীক্ষ্ম কন্ঠে বললো..
-আমার চরম শত্রুও যে আমাকে কখনও আমার ক্যারেকটার নিয়ে কিছু বলার সাহস করে না, কে তুমি আমার দিকে আঙ্গুল তুলো? কে দিয়েছে তোমাকে এই অধিকার? মেয়েটা নিলয়ের দিকে এক পা এগিয়ে যায়, আবারও চিৎকার করে বলে..
-কে?
এই প্রথমবারের মত নিলয় অসহায় অনুভব করে। সে কিছু বলতে পারে না। সুনয়না কিছুক্ষণ চোখ মুখ দিয়ে আগুনের হল্কা বের করে ঝড়ের গতিতে বেডরুমে ফিরে যায়। উদ্ভ্রান্তের মত একটা বড় লাগেজ টেনে নিয়ে তাতে এলোপাথাড়ি ভাবে কাপড়চোপড় ছুঁড়ে ফেলতে ফেলতে থাকে। নিলয় পেছনে এসে দাঁড়ায়। খুব আশ্চর্য গলায় জিজ্ঞেস করে..
-কি হচ্ছে? কই যাও তুমি? সুনয়না নিলয়ের দিকে না তাকিয়েই বলতে থাকে, একটা মাস! একটা মাস আমি তোমার অত্যাচার চুপচাপ সহ্য করেছি। সারাজীবন স্বপ্ন দেখেছিলাম এখানে ওখানে ভালবাসা না বিলিয়ে একবারে কারও জন্য অপেক্ষা করলে কপালে ভাল একটা মানুষ জুটবে যে আমাকে বুঝবে, আমাকে সম্মান করবে। আর কপালে কি জুটলো? একটা লুজার, বলদ! নিলয়ের চোয়াল ঝুলে পড়ে। এসব কি ভাষা! এ কোন সুনয়না দেখছে সে! মেয়েটা হঠাৎ কাপড় গোছানো বাদ দিয়ে নিলয়ের সামনে এসে টিটকারির সুরে জিজ্ঞেস করে..
-“লাইফে তো একবারই ছ্যাক খেয়েছিলা, না? তাতেই এই অবস্থা? একটা মেয়েকে দিয়েই পুরো নারী জাতিকেই চিনে ফেললে? এভাবে তাকানোর কিছু নেই, খোঁজ খবর আমরাও নিয়েছি!”
নিলয় মাছের মত খাবি খায় কিছুক্ষণ। কিছু বলতে পারে না।
কখনও জানতে চেয়েছো, আমার জীবনটা কেমন ছিলো? গত কুড়িটা বছর আমার কিসের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি? তোমার চোখে আমি শুধুই একটা গন্ধ ছুটানো পাকা ফল যাকে ঢেকে ঢুকে রাখতে হয়, শুধুই একটা দেখানোর শো-পিচ যেটা তুমি অনেক দাম দিয়ে দোকান থেকে কিনেছো। যেটা নিয়ে তুমি শুধু ভয়ে ভয়ে থাকো পঁচে যাবে কি না, অন্য কেউ চুরি করে নিয়ে যাবে কি না! কিন্তু আমি তো ফল বা শো পিচ না, নিলয়। আমি একটা মানুষ, আমি নিজে যদি পঁচে যেতে চাই তুমি কি দিয়ে আমাকে আটকাবা? ফেসবুকে কমেন্টে অখাদ্য কুখাদ্য লজিক দিয়ে ঝড় তুলে ফেলা নিলয় এখন মুখ ফুটে কোন শব্দ বের করতে পারে না। আমার সুন্দর চেহারাটা তোমার জন্য একটা ট্রফি হলেও আমার জন্য এইটা সারা জীবন অভিশাপ ছিলো, জানো? সেই ছোট বেলা থেকে। কাজিন, দূর সম্পর্কের ভাই, চাচা, মামা কত জন যে কাছে ঘেঁষত, বাজে টাচ করত। কিছু বুঝতাম, কিছু বুঝতাম না, কুঁকড়ে থাকতাম নিজের মধ্যে। কলেজে উঠার আগেই জীবন নরক যন্ত্রণার বানিয়ে ফেললো এলাকার ছেলে পেলেরা। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় হাজারটা উপায়ে টিজ, রাতের বেলা জানলায় ঢিল ছুড়া, প্রেম পত্র থেকে শুরু করে উঠায় নিয়ে যাওয়ার, এসিড মারার হুমকি।
এই অশান্তিময় জীবনের যন্ত্রণা তুমি বুঝবা? স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি। কোথাও কোন শান্তি নেই। চেহারা সুন্দর লাগে তাদের কাছে, তার মানে আমি যেন কোন দলিলে সই করে রেখেছি তাদের যাবতীয় যন্ত্রনা আমাকে হাসিমুখে সইতে হবে। একেকজনের কি হেডম, এই দলের নেতা, সেই দলের বড় ভাই। কারও কলিজা হয়নি নিলয় সামনে এসে পুরুষের মত মুখ ফুটে ভালবাসার কথা বলবে। তারা শুধু আমাকে ভোগই করতে চেয়েছে, যখন পারেনি, পেছন থেকে ক্ষতি করতে চেয়েছে। কত অসহ্য দিন রাত ঘরে বন্দি হয়ে থাকা, দুঃস্বপ্ন দেখে রাত জাগা। “তুমি এসবের কি বুঝবা নিলয়? তুমি তো তাদেরই একজন!” শেষ বাক্যটা নিলয়ের বুকের ভেতর গিয়ে ধ্যাঁচ করে লাগে। মেয়েটা তাকে এই দৃষ্টিতে দেখে? বখাটে কাপুরুষদের একজন?
মেয়েটা চোখ মুছে কন্ঠস্বর বদলে ফেলে। আসলে আর কথা বলে লাভ নেই। ভেবেছিলাম তুমি এতদিনে বুঝে যাবা আমি মেয়েটা কেমন তাই তোমার যাবতীয় উদ্ভট আবদারে কখনও না করিনি। কিন্তু একমাসে তুমি প্রমাণ করে দিয়েছো বড় ডিগ্রী আর ভাল চাকরি থাকলেই হয় না। আর আজকের কথাগুলা প্রমাণ করে দিয়েছে, কিছু মানুষের ভিতরটা একদম পঁচে যায়, আমি যতই লয়াল থাকি না কেন, তুমি সন্দেহই করে যাবা আজীবন। আজ যদি তোমার কোন বন্ধু তোমায় খুঁজতে, তুমি না থাকা অবস্থায় বাসায় আসে, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তুমি আমার দিকেই তোমার নোংরা আঙ্গুল তুলবা।
অভাব অনটনের সাথে সংসার করা যায় নিলয়, শারীরিক ভাবে অসুস্থ একটা মানুষের সাথেও সংসার করা যায়। কিন্তু এক মন ভর্তি সন্দেহ নিয়ে ঘুরা মানুষের সাথে সংসার করা যায় না। তুমি আমাকে ভালবাসো না, আমার মন পড়ার চেষ্টাও করো না। আমাকে মানুষ হিসাবেই দেখো না। তোমার মত স্টুপিডিটির সাথে গত একমাস বহু কষ্টে ছিলাম। বাকি জীবনটুকু কাটাতে পারবো বলে মনে হয় না। আমি বিদায় হচ্ছি। তুমি বরং গন্ধটন্ধ ছড়ায় না এরকম কোন ফল খুঁজে নিও। গোটা দেশ বেচতে পারা, নিলয় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মেয়েটা ঘুরে চলে যাচ্ছিলো, নিলয় পেছন থেকে হাত ধরলো। সুনয়নার শরীরে যেন বিদ্যুৎ শিহরণ খেলে গেলো। এতদিন তারা এক ছাদের নিচে আছে কিন্তু এই প্রথম সুনয়নার শরীরে এরকম অনুভূতি হলো। সে ধীরে ধীরে আবার ঘুরে নিলয়ের দিকে তাকালো, ছেলেটার চোখে পানি। কি অদ্ভূতই না দেখাচ্ছে তাকে। নিলয়ের এরকম চেহারা আগে কখনও দেখেনি সুনয়না। নিলয় ভাঙ্গা গলায় বললো..
-আমিও ভালবেসে ছিলাম। অনেক ভালবেসে ছিলাম। আমি সারা জীবনে আর কাউকে ভালবাসিনি। ঐ মেয়েটাকে ভালবেসে ছিলাম, জানো? আমার বুকের ভিতর সারাদিন তার জন্য ধুকপুক করত, একদম প্রথম যখন মেয়েটা ভালবাসি বলেছিলো, কি প্রচন্ড সুখী মনে হয়েছিলো নিজেকে। নিজের পড়াশুনা, ভালমন্দ বাদ দিয়ে তাকে ভাল রাখতে চাইতাম, তার মন জয় করতে চাইতাম, তার দেওয়া কষ্টে আমি কত রাত হুহু করে কেঁদে চোখ ভিজাতাম।
আমার সেই কাঁন্না কেউ দেখেনি। এত ভালবাসতাম যারে, যাকে হারানোর ভয়ে বুকের মধ্যে রক্ত হঠাৎ হঠাৎ ছলকে উঠত, সেই মেয়েটা আমাকে কিছু না বলে একদিন অন্য একটা ছেলের সাথে চলে গেলো, কিছু বলেনি আমাকে, কিছুই না, অনেক কষ্ট, অনেক। কাউকে বলতে পারিনি, বুঝাতে পারেনি, সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করত, কেউ বুঝেনি প্রতিটা রাতে মেয়েটার জন্য আমার বুকের ভিতরটা কিরকম ছিঁড়েখুঁড়ে যেত। আমিও ভালবাসতে চাই সুনয়না, কিন্তু আমার খুব ভয় লাগে খুব ভয়। নিলয় চোখের পানিতে নাক মুখ মাখামাখি হয়ে গেছে, সুনয়না তাকে টেনে বুকের মধ্যে নিয়ে নেয়। ছেলেটা অবুঝের মত হাউমাউ করে কাঁদছে, গত ছয় বছর ঘৃণা দিয়ে চেপে রাখা কষ্টের বন্যাগুলো আজ চোখের পানিতে মুক্তি পেয়েছে। বিছানায় শুয়ে ছোট বাচ্চার মত কাঁন্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠা নিলয়কে বুকে লুকিয়ে রেখে সুনয়না মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ফিস ফিস করে বলে..
-আবার ভালবাসবা তুমি। এই বোকা ছেলে। এই! কাঁন্না থামাও। আমি ঐ মেয়েটা না, আমি তোমার বিয়ে করা বউ, আমি কোথাও যাচ্ছি না, কোন ভয় নেই তোমার। আমাকে ভালবাসো। যত ইচ্ছা উজাড় করে ভালবাসো। আমি তোমাকে আরও ডাবল ভালবাসা দিবো। তোমার ভালবাসার কিছু অংশ তো নষ্ট হয়েছে, আমারটা দেখো, একদম ফ্রেশ। কাউকে দেইনি। একদম তাজা ফল, তোমার জন্য। নিলয় মুখ তুলে তাকায়। নাকের পানি চোখের পানিতে সুনয়নার জামা মাখামাখি করে ফেলেছে, তার মধ্যে কাঁন্না মাখানো মুখটা দেখতে খুবই বিচিত্র লাগছে। ওড়না দিয়ে মুখটা মুছতে মুছতে সুনয়না ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে..
-মফিজ মিয়া, প্রেম করবেন আমার সাথে? চোখ ভর্তি পানি নিয়েই নিলয় হেসে ফেলে, সুনয়না টের পায় তাদের ঘরের ভিতর এই রাত দুপুরে হঠাৎ এক মুঠো রোদ ঢুকে গেছে। ভালবাসার অদৃশ্য রোদ।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত