এই মেয়ে এত বড় হইছো এখনও ভাতের মাড় গালতে পারো না ? সব ভাত ফালায় দিছো!এইটাও কী বিশ্বাস করার মত ? নাকি ভং ধরছো? জানলেই করতে হইব, তাই ভাবতাছো? বেশি শিক্ষিত মেয়েতো, তাই বেশি বুদ্ধি খাটাইতাছো। বুঝি, সবই বুঝি। তোমার মত অত শিক্ষিত না হইলেও আমরাও সংসার কইরা খাই।এইসবে কিন্তু কাজ হইব না। এই বাসার কাজকাম কিন্তু তোমারই করতে হইব।
আমার মায়েরে দিয়া কিন্তু কিচ্ছু করাইতে পারবা না। এইসব ভংছং ছাইড়া ভাত গুলিরে উঠাও।দেখছনি কারবারডা! কি এক আকামা মেয়েরে ধইরা আনছে।” চিৎকার করে কথাগুলো বলতে লাগলেন আমার বড় ননাস। আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না। আমি পুরোপুরি স্তব্দ হয়ে গেছি একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনায় । তারপরও খুব সাহস নিয়ে বললাম আপা আজকে একটু শিখিয়ে দেন তবেই পারব! “হুমম আমিতো রান্না শিখানের চাকরি নিছি, শিখাইতে গিয়া আজকের রান্নাডা আমিই করি! তাই না!” বলে আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইলেন তিনি।
একটু আগে দুই পট চাল ধুঁয়ে ভাত বসিয়েছিলাম।সকালের নাস্তাটা আজ আমিই রেডি করব বলে ঠিক করেছিলাম। সবুজ এখনও বিছানায়। আজ ওর ছুটি। ওকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে নিজেই নিজের ক্ষমতার কাছে সারপ্রাইজ হয়ে গেলাম। আমাদের বাসায় রাইস কুকারে প্রায় সময় ভাত, খিচুরি রেঁধেছি। কিন্তু এই বাসায় এসে পরলাম বিপদে, সকালে বড় আপা মানে সবুজের বড় বোনকে রাইস কুকারের কথা বলতেই ওনি চেঁচিয়ে উঠলেন। জানালেন তারা মাড় সহ ভাত খেতে পারেন না।মাড় গেলে ঝরঝরা ভাত খান তারা।আমার আশায় গুড়ে বালি পরল তখনই।তারপরও চেষ্টা করছিলাম মনপ্রান দিয়ে কিন্তু হিতেবিপরীতই হল।মাড় গালতে গিয়ে ভাতই অনেকটা পরে গেল।কিছু মাড় হাতেও পরল। গরমটা সহ্য করতে না পেরে চিৎকার করতেই আপা কিচেনে এসে এইসব বলা শুরু করলেন।আপার কথাতে আমার শাশুড়ী ছুটে আসলেন ততক্ষণে কিচেনে।
“ও আল্লাহ বৌ এইডা কী করছো? ভাততো সব পরছে।সর সর দেহি কী করছ?” বলে শাশুড়ী এগিয়ে আসতে চাইলেন কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারলেন না। আপা মাঝ পথে থামিয়ে দিলেন। “কী দেখবা তুমি? খবরদার মা তুমি কিন্তু এইবয়সে রান্দার কাজে আইবা না। এইসব হইল শিক্ষিত মানুষের চালাকি! এরা এমন সব ভংছং কইরা শাশুড়ীরে ঘরের কাজের মানুষ বানায়। সাবধান তুমি এইসব ছলচাতুরীর মধ্যে পরবা না।” মাকে কথাগুলো বলছিলেন আর আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলেন ।তার চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে খুব ছোট বলে মনে হচ্ছিল।তার চোখগুলো যেন বলছে আমার সব ফাঁকিবাজি সে ধরে ফেলেছেন। আমি কেন জানি আর তার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না।নিজের চোখ নত করে দাঁড়িয়ে রইলাম আর ভাবতে লাগলাম এখন কী করব!
” আরে হাত ছাড়, বৌ–” শাশুড়ী মা কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে আপা আবার বললেন “কী বৌ বৌ করতাছো তুমি বেক্কল কোহেনকার। সাদা চামড়া দেইখা ওই ছ্যামড়া সব ভুইলা গেছে, এখন ওরে কও এই সাদা চামড়া ধুইয়া ধুইয়া পানি খাইতে, শিক্ষিত মাইয়া, শিক্ষিত ফ্যামেলি, এহন কও এই শিক্ষিত ধুইয়া ধুইয়া পানি খাইতে। আমারে কোন কথাই কইতে দেয় নাই।এহন দেখ কেমন মজা! না খাইয়া থাক সবগুলি মিল্লা।” কথা গুলি সবুজকে শুনিয়ে শুনিয়ে আরও জোরে জোরে বলতে লাগলেন তিনি। তখন নিজেকে আরও ছোট বলে মনে হতে লাগল।
“বৌ তুমি ভাতও রানতে পারো না? এইডা কোন কতা হইল? তোমার মায় ভাতটাও রানতে শিগায় নাই?” শাশুড়ী মা এইটুকু বলেই থেমে গেলেন। কিন্তু তার কথার সুর ধরে আপা বলতে শুরু করলেন “মাস্টারনী মা দুনিয়ার পোলাপানরে পড়ালেখা শিখায় আর নিজের ঘরে নিজের মাইয়ারে ভাতটা পর্যন্ত শিখাইতে পারে নাই। তাজ্জব কথা।”
মাকে নিয়ে এমন খোঁচাটা একেবারে আমার বুকে গিয়ে লাঁগল। আমার দুচোখ বেয়ে নদী বইতে শুরু করল। তাকে সমুচিত জবাব দেওয়াটা ঠিক হবে কী না ভাবতেই দেখি সবুজ এসে দাঁড়াল কিচেনে। “সকাল বেলা কী শুরু করছ বড়পা? ছুটির দিন একটু শান্তিতে ঘুমাতেও পারছি না তোমার বকবকানিতে। সমস্যা কী তোমার?” একটু বিরক্ত হয়েই কথাগুলো বলল সবুজ। “তর বৌ যে ভাত রাঁধতে জানেনা তা কী জানস”?বলে একটা দুষ্ট হাসি দিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালেন আপা। “রাঁধতে জানেনা। শিখে নিবে।ভেরি সিম্পল।আমিওতো কত কিছু জানিনা।তুমি কি জন্মের পরপরই সব শিখে ফেলছো নাকি ধীরে ধীরে শিখছ? তুমি একটু শিখিয়ে দাও ব্যস ঝামেলা শেষ। এত ক্যাচালের কী আছে?” সবুজ ওর স্বভাবসুলভ ভাবে বলল।
“হুম আমিতো তর শাশুড়ীর মত মাস্টারনি হইছি, এহন তর বৌরে রান্না শিখামু। মনে হয় স্কুল খুইল্লা বইছি। তুই তর বৌরে রান্না শিখা।শিক্ষিত বৌ সাদা চামড়া আর কী লাগে? আর কী কিছুর দরকার আছে তর। তুইতো পাগল —” তার কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সবুজ একটা চিৎকার দিয়ে উঠল “ও মাই গড! মুমু তোমার হাতেতো ফোস্কা পরে গেছে। ওরে আল্লাহ! কী ভয়ংকর অবস্থা। এই মেয়ে তুমি এখানে দাঁড়িয়ে ভ্যাভ্যা করে কাঁদছ কেন? ইডিয়ট একটা। জলদি আসো”। বলে সবুজ আমাকে টেনে কিচেন থেকে বের করে নিয়ে ডাইনিংএ বসাল। আমার শাশুড়ী মা ফ্রিজ থেকে বরফ বের করতে করতে বললেন ” হাতেযে মাড় পরছে তাতো বৌ একবারও কয়নাই, বুঝুম কেমনে? আর এই বুইড়া ধামরিতো ক্যাচক্যাচ করতে করতেই শেষ, বৌয়েরযে হাত পুড়ছে তা দেখব কেমনে।” সবুজ আমার হাতে ভাল করে বরফ ডলে ডলে জ্বলা কমানোর চেষ্টা করতে লাগল।এর পর বার্নল ক্রীম এনে হাতের মধ্যে মেখে দিতে দিতে বলল বুঝছো বড়পা, আমার মাস্টার শাশুড়ী তার মেয়েরে ভাতের মাড় গালতে শিখায় নাই ঠিক আছে, কিন্তু আদব কায়দাটা পাকাপোক্তভাবে শিখাইছে। তা না হইলে আজকে দেখতাম কত ধানে কত চাল হয়।
আমার ননাস হয়ত কিছু একটা বলতেন কিন্তু আমার শাশুড়ি তাকে টেনে তার রুমে নিয়ে গেলেন। সবুজ খুব করে চেষ্টা করতে লাগল হাতের জ্বলা কমানোর। কিন্তু আমি সবুজকে একবারও বলতে পারলাম না সবুজ আমার হাতের জ্বলার চেয়ে মনটা বেশী জ্বলছে, ওই জ্বলাটা তুমি কীভাবে কমাবে? মনে মনে বললাম রান্না আমি ঠিকই একদিন শিখে নিব কিন্তু আজকের এই দুঃখ জীবনে কোনদিন ভুলব না। আমার বড় ননাসের বাসা আমার শশুর বাড়ি থেকে চল্লিশ টাকা রিক্সা ভাড়া।ননাসের বড় মেয়ের স্কুলটা আমার শশুর বাড়ির কাছেই তাই তিনি প্রতিদিন মেয়েকে নিয়ে স্কুলে এসে সকাল বেলাটা এই বাসায় থাকেন পরে স্কুল ছুটি হলে মেয়েকে নিয়ে বাসায় যান।
আমার শাশুড়ী মানুষ হিসেবে খারাপ না।সবুজ বার বার আমাকে বোঝাতে লাগল। ওর কথায় জানলাম আমার শাশুড়ীর মনটা অনেক নরম।খুব মিশুক, গল্প করা পছন্দ করেন।সবুজের কথাগুলে শুনতে শুনতে নিজের মায়ের কথা মনে পঠে গেল। মা বিয়ের আহে বলেছিলেন “মুমু আমি যেমন তর কাছে সেরা মা, ঠিক তেমনি সবুজের মা সবুজের কাছে সেরা মা।তাই তরা দুজন এক সাথে সুখি হতে চাইলে কখনও সবুজের মায়ের অসম্মান করবি না। আর ভুলেও সবুজের কাছে ওর মায়ের কোন দোষ বলবি না। তাতে তুই নিজেই সবুজের মন থেকে অনেক দুরে চলে যাবি।” দেখলাম মা সত্যিটাই বলেছিলেন আমাকে।
বিয়ের পর পর বাসা ভরা মেহমান ছিল রান্নাবান্না করার জন্যও একজন মহলা ছিল এতদিন। আমার ছোট ননাস খুব শান্ত, ওনি এই কয়দিন রান্নাঘর দেখাশোনা করেছেন একাই । ওনি চলে যাওয়ার পর এখন স্বভাবতই আমার উপর ন্যস্ত এই মহৎ কাজটি। বাবার বাড়িতে মা সকাল বেলা রান্না করে বাটি বাটি করে তরকারি বেড়ে ফ্রিজে রেখে দিয়ে স্কুলে চলে যেতেন। টিচার হিসেবে তার বেশ কদর। মা অংকের টিচার সন্ধ্যায় তিনজন ছাত্র পড়ান। সেই ছোটকাল থেকেই দেখে আসছি এই একই নিয়ম৷ মা বলতেন এদের বেতন নাকি মা আমাদের তিন ভাইবোনের নামে ডিপোজিট করেন। আমরাও মাকে তাই কখনও কেন বিষয় নিয়ে কোন বিরক্ত করতাম না।
খাবারদাবার নিয়ে আমাদের তেমন কোন ঝামেলা ছিল না। মা যা রান্না করে সামনে দিতেন তাই খেয়ে নিতাম।মা শুধু আমাদের পড়াশোনার দিকে ফোকাস দিতে বলতেন। আর আমরাও মায়ের আদর্শ সন্তান হিসেবে তাই ফলো করতাম।মা বলতেন শুধু পড়াশোনাটাই টাইম মত শিখে নেওয়াটা ভাল এছাড়া আর সব কাজ মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে নিজে নিজেই শিখে নেয়।মায়ের এই কথাটা এখন আমার খুব মনে পড়ছে, রান্নাটা এখন আমার প্রয়োজন তাই যেভাবেই হউক শিখে নিব, শুধু শিখে নিব না ভালোমতই শিখে নিব বলে মনস্থির করলাম। প্রথম প্রথম ইউটিউব দেখে রান্না করতে শুরু করলাম।খেতে বসে আমার শাশুড়ী বলেন বৌ এই তরকারিটাতে মরিচ একটু বেশি দিও, ওই তরকারিটাতে হলুদ একটু কম দিও। একদিন শুটকি ভুনাতে আমি জিরাগুঁড়া দিলাম আর তা দেখে বড় আপা হাসতে হাসতে খুন,যেন তার পেট ফেটে যায়। মাকে বলতে শুরু করলেন “মা এই মেয়ের বান্না খেয়ে তোমার শরীর ঠিক থাকলেই হয়!”
বুঝলাম কিছু একটা সমস্যা থেকেই যাচ্ছে, তাই ইউটিউব বাদ দিলাম। পরে একদিন বুদ্ধি করে শাশুড়ী মাকে গল্প করার কথা বলে রান্নার সময় কিচেনে নিয়ে চেয়ার দিয়ে বসিয়ে দিলাম। গল্পের ছলে ছলে মাকে জিজ্ঞেস করে করে তরকারিতে কোনটায় কতটুকু হলুদ মরিচ ধনিয়া দিতে হবে৷ কোনটায় জিরা গুড়া দিব কোনটায় দিতে হবে না।এসব কিছু হাতে কলমে শিখে নিতে শুরু করলাম।একূিন দুইদিন করে এভাবে চলল বেশ কিছুদিন। এই কয়দিন সবুজকে দিশে ভিন্ন ভিন্ন বাজার করিয়েছি। যাতে ভিন্ন ভিন্ন রান্নাটা ধরতে পারি। আসলে রান্না একটা আর্ট। একেক অঞ্চল ভিত্তিক একেকে রকম।আমার কাছে বেশ মজাই লাগল রান্না শিখতে গিয়ে। এখন আমি অনেক কিছু রান্না করতে পারি।মাখে মাঝে নতুন নতুন ডিস টৃরাই করি। খেতে বসে সবুজ নাম্বার দিত প্রতিদিন, কখনও ৬০ কখনও ৭০,৮০, ৯০।এমন করে একদিন ১০০ দেওয়া শুরু করল।
আমার তখন আনন্দই আনন্দ। আমার শাশুড়ী মা গল্পের ছলে এই নাম্বারের কথা বড় আপার সামনে বলে ফেলল আর তখনই তিনি তার স্বভাব মত শুরু করলেন তোমার সবুজ কি আর তোমার আছে? ওতো এখন বৌয়ের গোলাম হইছে। দেখনা সারাক্ষণ শুধু মুমু, মুমু করে। বৌয়ের কাজকাম করে। আগে কোনদিন টেবিল পরিস্কার করছে? কোনদিন ছাদ থেইকা শুকনা কাপড় আনছে? বোতল ভইরা ভইরা ফ্রিজে রাখছে? এহন দেহ কেমনে বৌ ওরে দিয়া কাজ করায়।বোন দুইটারেতো একেবারে ভুলছে।” কথাগুলো আমি সব শুনলাম কিন্তু কিছু বললাম না। কেনজানি তাকে আমার এখন আর ভালো লাগে না। তার সাথে কোন কথাও বলতে ইচ্ছে করে না। এক কথায় তাকে আমি একটু এরিয়ে চলি।
কিন্তু সমস্যা হল তার কথাতে মায়ের মনে কিছুটা আছড় হল। মা এর পর সারাদিন একটু থম থম হয়ে রইলেন। রাতে সবুজকে খুব করে বকা দিলেন বোনদের খোঁজ খবর না নেওয়ার জন্য। সবুজ ওর মায়ের মনটা খারাপ টের পেয়ে বলে বসল।”ও কে, মা তুমি দুই আপাকেই ডাক।সামনের শুক্রবার আমার শাশুড়ী মাকেও বলছি আমাদের বাসায় আসার জন্য। ওনি মেয়েকে কোথায় বিয়ে দিলেন তাতো একবারও এসে দেখলেন না। তাই বলেছি এসে যেন দেখে যান, আর তার মেয়েযে বেশ ভাল রাধুনি হয়ে উঠেছে তাও একটু দেখিয়ে দিব সেই সুযোগে।” বলে হাসতে লাগল।
আমার মা আসবেন আমার বাসায় আমার সেযে কী আনন্দ তা বলে বোঝাতে পারব না।কী রাঁধব কী করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।তারপরও মায়ের পছন্দ অনুযায়ী রান্নাবান্না শেষ করলাম তাড়াতাড়ি। বড় আপার শাশুড়ী কম মসলার তরকারি খান তাই তার জন্য আলাদা করে রান্না করলাম।একদিন মাটন কাচ্চি করেছিলাম, সবুজের কীযে ভাল লেগেছিল তা ও নিজেই জানে। আজ সব বাচ্চাদের জন্য সেই কাচ্চিও রাঁধতে হল ওর কথায়।
মায়ের সাথে বসে একটুি গল্প করতে পারলাম না। বাসা ভরা এত মানুষ, মাকে একটু বুকে জড়িয়েও ধরতে পারলাম না। ছোট আপা থাকাতে রক্ষা, না হলে একা একা সব কুলিয়ে উঠতে পারতাম না। সবুজও টুকটাক হেল্প করছে কাজকর্মে। মা তার বেয়াইনদের নিয়েই গল্পে জমে গেলেন। পরে তারা সবাই একসাথে টেবিলে বসলেন খেতে।সবুজ মাকে কাচ্চিটা এগিয়ে দিয়ে বলল “আম্মা এইটা একটু খান, দেখবেন মুমু কী রান্না শিখছে, একেবারে ফার্স্ট ক্লাস”। সবুজের কথাতে আমার খুব আনন্দ হতে লাগল। দেখলাম আমার মায়ের চোখমুখও খুশিতে চকচক করছে। মেয়ের শশুর বাড়িতে এসে মেয়ের এত প্রশংসা শুনতে কোন মায়ের না ভালো লাগে।
সবুজের কথায় মা হাসতে হাসতে বললেন “মুমু যখন যে কাজটা করে তা পারফেক্ট করেই করে, আমার সত্যি সত্যিই আজকে খুব ভালো লাগছে আমার মেয়ে আমার জন্য আমার পছন্দের এত এত আইটেম রান্না করেছে আমাকে খাওয়ানোর জন্য ।আমি খাব কী আমারতো দেখেই পেট ভরে গেছে।সবুজ বাবা এটা যে কী এক আনন্দ তা তোমাকে বোঝাতে পারব না।” পাশেই বসে ছিলেন বড় আপা।হটাৎ করেই বলে উঠলেন।”খুশি হন আর যাই হন খালাম্মা, মেয়েরে রান্নাবান্না না শিখাইয়া বিয়ে দেওয়াটা কিন্তু আপনার ঠিক হয় নাই। আপনার মেয়েরে কী তার শাশুড়ী রান্না কইরা খাওয়াইব? ওরে আল্লাহ এই মেয়েতো বিয়ের পর দেখলাম কিছুই রাঁধতে পারত না। একেবারে আকাইম্মা ছিল।”
তার কথাটা শুনার পর পর আমার মায়ের মুখটা মলিন হয়ে গেল। আমার ভিতরটায় একটা ঝড় শুরু হল। সবুজ একটু জোরে বলে উঠল আপা– ওকে আমার মা থামিয়ে দিলেন।ইশারায় বললেন চুপ থাকতে।সবুজও চুপ হয়ে গেল। আসলে আমার টিচার মায়ের মধ্যে এমন কিছু আছে যা সবাইকে বাধ্য করে তুলে।আর নয়ত সবুজ না জানি কি শুরু করে দিত।ওকে যতটুকু চিনি কিছু উলোটপালোট বলে ফেলতো ঠিকই যদিও সামনে বড় আপার শাশুড়ী বসে আছেন। আমার বুকটা তখন কাঁপছে ভয়ে, না জানি মা আমাকে এই নিয়ে কী বলেন? শুনলাম মা বলতে শুরু করেছেন “ঠিক বলেছ মা, মেয়েকে আমি রান্নাবান্না না শিখিয়েই বিয়ে দিয়েছি। আর এটা আমি নিজ ইচ্ছেতেই করেছি।মেয়ে হল পরের আমানত।বিয়ে দিব আর তখনই হয়ে যাবে অন্যের ঘরের সম্পদ।তাকে আমি আমার ধাঁচে গড়ে কী লাভ? সে যেই ঘরে যাবে সেখানকার ধাঁচটাইতো তাকে শিখতে হবে, শুধু শুধু কেন আমি পণ্ডশ্রম করব। এই যে দেখ আজ আমার মেয়েটা ঠিক তোমার মায়ের হাতের রান্নার মত করে রাঁধতে শিখেছে।সবুজ প্রতিদিন শান্তি নিয়ে খাচ্ছে, বিয়াইনও সেদিন আমাকে বললেন মুমু নাকি তার শাশুড়ীর মত রাঁধতে পারে।
ভাবতে পারো কত ভালো একটা কথা এইটা, একটা মেয়ের মায়ের জন্য। আর আমি মেয়ের মা।নিজের জীবন দিয়ে অনেক কিছু শিখেছি, মেয়ের জীবন কখন কার কোথায় কেমন হয়ে যায় তার কি কোন ঠিক ঠিকানা থাকেরে মা? চেষ্টা করেছি বাবার বাড়িতে যেন মেয়েটা একটু আরাম আয়েশ করে কাটাতে পারে। সেইতো বিয়ের পর ঘর সংসার, চাকরি বাকরি, রান্নাবান্না বাচ্চা পালা।একটার পর একটা বোঝা না চাইতেও যেন চাপতেই থাকে ঘাড়ে। তাই বিয়ের আগের জীবনটায় শুধু আদর দিয়ে ভরিয়ে রাখতে চেয়েছি, চেয়েছি কোনরকম চাপ ছাড়াই ওর হাসিখুশি জীবনটা ভোগ করুক। যদি আর কখনও এমনটা না পায় তবুও যেন এখনকার কাটানো সময়গুলো মনে করে দুখের সময়টা পার করতে পারে।” কথাগুলো বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেলেন মা আমার। আমি না চাইতেও কেন জানি কেঁদে ফেললাম।ইচ্ছে হচ্ছিল মাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বলি, মা আমি তোমাকে অনেক ভালেবাসি, তুমি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা।কিন্তু বলতে পারলাম না।
“বিয়াইন একদম ঠিক কথাগুলি কইছেন, এক্কেবারে মনে ধরছে আপনের কথাগুলি। আসলে জ্ঞানী মানুষ হইলে যা হয়। আমার বৌ তার মায়ের কাছ থেইকাই রানদা শিক্ষা গেছে।আমরাতো হের রান্দা খাইতেই পারি না। বাড়ির সবার গেস্টিক আলসার হওনের অবস্থা। তরকারির মধ্যে দুইন্নার মসলা দিয়া থুয়।তেলে এক্কেবারে চুপচুইপ্পা। ধুরো!ধরো! ওগুলি না খাওন যায় না ফালান যায়।এত্ত কইরা কই কমায় কমায় দাও, হেয়তো কমায় দিতেই পারেনা। কেমনে পারব? ওমনেইযে শিক্ষা লইছে।” একদমে কথাগুলো বললেন বড় আপার শাশুড়ী। “আম্মা শুনেন আপনার হইল অভ্যাস খারাপ, মানুষ পাইলেই শুধু আমার বদনাম করেন। এহন পাইছেন আমার ভাইয়ের শাশুড়ীরে অমনিই শুরু করছেন আমার বদনাম।আপনগো ওই ঔষধ ঔষধ তরকারি আমার পেটে যায় না। আমি যা রানদুম তাই খাইলে খান না খাইলে অন্য কারউ কাছে যান।
” রেগে একেবারে গজগজ করতে করতে বড় আপা কথাগুলো বললেন তার শাশুড়ী কে। “দেখলেন কেমন বেদ্দপ বৌ, কেমনে কথা কয়, বিয়াইন দেখছেননি, আপনার মাইয়ার কামডা, কী করল”। বলে বড় আপার শাশুড়ীও রেগে গেলেন। আমার শাশুড়ীকে দেখলাম তার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। তিনি উঠে এসে বড় আপার শাশুড়ী আর আমার মায়ের হাত দুইটা ধরে কেঁদে ফেললেন “আপনারা আমার উপর রাগ রাইখেন না। আমার মাইয়ার ব্যবহারে আমি সত্যি সত্যিই খুব লজ্জা পাইছি।আমি আপনাগো কাছে মাফ চাই। আমি আর কী কমু।” বড় আপা কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন তখন ছোট আপাই বড় আপাকে টেনে মায়ের রুমে নিয়ে গেলেন। আস্তে আস্তে পরিবেশ নরমাল হল। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আবার সবাই মিলে গল্পগুজব করতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন। আমি সব কিছু গুছিয়ে একটু মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠলাম কিন্তু আমার শাশুড়ী আর বড় আপার শাশুড়ীর জন্য সামনে যেতে পারছিলামনা।
রুমের ভিতর গিয়ে কী কথা হয়েছিল দুইবোনের তা জানি না। তবে বের হওয়ার পর দেখলাম বড় আপা বেশ চুপচাপ। মায়ের চলে যাওয়ার সময় হল।সবুজ যাবে মাকে বাসায় পৌঁছে দিতে। আমি বাসার জন্য কিছু খাবার প্যাক করে দিলাম। সবুজই জোর করে প্যাক করাল ও সাথে করে নিয়ে যাবে বলে। যাবার সময় মা বড় আপার মেয়েটাকে ডেকে কাছে নিয়ে আদর করলেন ওর পড়াশোনার খোজ খবর নিলেন পরে বললেন। “তোমার মা কী তোমাকে এখন থেকেই রান্না শিখাচ্ছেন নাকি? ভুলেও এখন ওগুলোর দিকে মনোযোগ দিও না৷ এখন সম্পূর্ণ ফোকাস দাও পড়ালেখায়। রান্নাবান্না হল হাতের খেলা। ওটা সময়মত এমনিতেই শিখে নিবে মুমু মামীর মত।” বলে আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলেন। আমার মনটা মুহুর্তের মধ্যে আলোকিত হয়ে উঠল। মনে হল ঘন মেঘ কাটিয়ে ঝলমলে সূর্যের উদয় হল মায়ের ওই হাসিতে।
সবুজ আমার মায়ের সাথে যোগ দিয়ে বলল মুমুকে দিয়ে একটা রান্নার স্কুল খুলিয়ে দিব।যে কেউ এসে যখন খুশি রান্না শিখে যাবে। আপনজনের জন্য কেন ফি নেওয়া হবেনা।” ওর কথাতে অন্য সবাই হেসে ফেলল। যাবার সময় মা আমার হাতটা ধরে, আস্তে করে বললেন। “মন খারাপ করতে নেই। সবার জীবনই এমন। এমনটাই স্বাভাবিক। এটাই সংসার। সবকিছু মানিয়ে নেওয়ায় জীবন। ভালো থাকিস।” মা চলে গেলেন কিন্তু আমার মনও মননে মায়ের আদর্শ আর শিক্ষা রেখে গেলেন। কেমন জানি একটা আনন্দ রয়ে গেল মনের ভিতর তা আমি কোনদিন কাউকে বোঝাতে পারব না।আজ আমার মনে যুদ্ধ জয়ের স্বাদ পেলাম। কেন পেলাম ? তা জানিনা। কিন্তু পেলাম।আহা! কি এক শান্তি।
গল্পের বিষয়:
গল্প