তুমি আসবে বলে তাই

তুমি আসবে বলে তাই

শহর কলকাতার হকাররা হল গিয়ে একটা আলাদা ‘‌ট্রাইব’‌। না, যেমন ডাক্তার, বা উকিল, অথবা পুলিশ, তেমন পেশা–পরিচয় দিয়ে আলাদা করার কথা বলছি না। বরং তুলনা করা যায় এস্কিমোদের সঙ্গে। একটা ট্রাইব। বরফের মধ্যে, বরফেরই ঘরবাড়ি বানিয়ে তার মধ্যে থাকে, জায়গার দখল নিয়ে সিন্ধুঘোটকদের সঙ্গে মারামারি করে, বর্শা দিয়ে গিঁথে মাছ মেরে, তার পর সেটা তরিবৎ করে খায়, তেমনই। অথবা যেমন মাসাইরা। আফ্রিকায় নানা কিসিমের উপজাতি থাকে, কিন্তু মাসাইদের মতো কেউ নয়।

ভাবা যায়, মাসাই ছোকরা বিবাহযোগ্য হলে এককালে তাকে মাটিতে দাঁড়িয়ে, স্রেফ একখানি বর্শা দিয়ে সিংহ শিকার করে প্রমাণ দিতে হতো, যে সে একজন নারীকে সামলানোর মতো লায়েক হয়েছে! মানে এছাড়া খামোকা এক বেচারা সিংহকে মেরে ফেলার তো আর কোনও কারণ হয় না। মাসাই যুবককে রক্ত মেখে, ঘেমে, আসলে ওটাই বোঝাতে হতো যে সংসারের যে কোনও সিংহ–সম বাধা বিপত্তির সামনা করতে সে তৈরি। কে জানে, শিকার নিষিদ্ধ হওয়ার পর হয়ত টানা ছত্রিশ ঘণ্টা পাব–জি খেলে, বা লাগাতার এক হপ্তা বাংলা সিরিয়াল দেখে মাসাইদের সেই একই দক্ষতা এবং কষ্টসহিষ্ণুতার প্রমাণ দিতে হয়।

অবশ্য না না, মাসাইরা কী করে বাংলা সিরিয়াল দেখবে!‌ যে যাকগে, কথা হচ্ছিল কলকাতার হকারদের নিয়ে। তারা যে অত্যন্ত নিবিড় অধ্যবসায় এবং কঠোর অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে শেষ পর্যন্ত একজন হকার হয়ে ওঠে, এ ব্যাপারে আমার অন্তত কোনও সন্দেহ নেই। সেই অনুশীলনের সঙ্গে যে কোনও মিলিটারি অ্যাকাডেমির তুলনা চলতে পারে। কেউ কখনও দেখেছে কোনও হকারকে লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে চলে যেতে?‌ বরং বুক চিতিয়ে তারা ভয়ঙ্কর সব বিপদের মোকাবিলা করে। কেমন বিপদ?‌ উদাহরণ দিই।

আমাদের এক আত্মীয়া, তিনি সম্পর্কে আমার ঠাকুমার বোন হতেন, থাকতেন রাঁচিতে, বছরে দু’‌বার বাজার করতে আসতেন কলকাতায়। তাঁর স্বামী এক কালে রাঁচির পুলিশ সুপার ছিলেন। সেই সুবাদে পুলিশদের দিয়ে ফাইফরমাশ খাটানো ছিল তাঁর নিত্যকর্ম। স্বামী পুলিশের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরও বহু বছর অবধি তিনি একটি অভ্যেস বহাল রেখেছিলেন। হাওড়া স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে কুলির মাথায় লটবহর তুলে বাইরে এসে, স্রেফ তুড়ি বাজিয়ে কাছের ট্রাফিক পুলিশটিকে ডাকতেন। তার পর তুমুল এক কর্তৃত্ব নিয়ে বলতেন, ‘‌এক ট্যাক্সি বুলা দো।’‌ তাঁর হাবভাব দেখে কোনও পুলিশের কোনওদিন ফিরে বলার হিম্মত হয়নি, কেন?‌ কে আপনি?‌

তা ইনি কলকাতায় এসে এক বিকেলে হেলতে দুলতে অবতীর্ণ হতেন হাতিবাগানের ফুটপাথে। দূর থেকে তাঁকে দেখতে পেলেই হকারদের মধ্যে সাড়া পড়ে যেত। কোন কোন দোকানে তিনি দাঁড়াতে পারেন, সেটা আন্দাজ করে নিয়ে অল্পবয়সি, অনভিজ্ঞ হকাররা দ্রুত পিছনে চলে যেত। ফ্রন্টলাইনে এসে পোজিশন নিতেন পোড় খাওয়া, দরাদরি করায় পোক্ত ওয়র–ভেটারেনরা। শুরুটা সবসময়ই খুব ভাল হতো। মাসিমা কেমন আছেন?‌ এবার অনেক দিন পর এলেন। বাড়ির সবাই ভাল আছে তো?‌ নাতি–নাতনিদের এবার সঙ্গে এনেছেন নাকি?‌ এখানে হকারদেরও রণকৌশল আলাদা। তারা স্থানীয় রাজনীতি, জাতীয় অর্থনীতি, এমনকি তেমন হলে আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির প্রসঙ্গ তুলে বোঝানোর চেষ্টা করবে, কেন আরও একশোটা টাকা ভালবেসে চেয়ে নেওয়া তাদের দরকার। কিন্তু তাতেও ভবি ভোলে না। ‘‌সরি’‌ বলে পছন্দের জিনিস নামিয়ে রেখে আন্টি হাঁটা দেন। পিছন থেকে ভেসে আসে হকারের আর্তচিৎকার— ম্যাডাম, ম্যাডাম, আর অন্তত পঞ্চাশটা টাকা কনসিডার করুন!‌

এসব প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময়ের পর শুরু হতো আসল লড়াইয়ের প্রস্তুতি। ওটা কত দাম?‌ এর আর কোনও রঙ আছে?‌ আরএকটু ভাল কিছু আছে?‌ দেখাও দেখি। এটার কত দাম?‌ নামাও, রাখো এখানে। ধারাবাহিক একটা প্রক্রিয়া। বিভিন্ন দোকান থেকে বিবিধ প্রয়োজনের নানা জিনিস এসে স্তূপাকার হতো সামনে। তার পর উনি নিজের দাম বলতে শুরু করতেন।

— আচ্ছা, ওটা যেন কত বললে?‌ তিরিশ টাকা?

— না মাসিমা, কী যেন বলেন। ২০০ টাকায় বেচছি। আপনার জন্যে ১৮০।

— আচ্ছা বেশ, ৪৫ টাকা। আচ্ছা, এটা কত বলেছিলে?‌

— আজ্ঞে আপনার যা দাম। ১৬০ টাকা।

— ঠিক আছে। এটা তা হলে কুড়ি টাকা।

এই অবিশ্বাস্য কথোপকথন চলত পরের দশ–পনেরো মিনিট ধরে। যে ধরনের কথা সঙ্ঘবদ্ধ হকারযূথের সামনে মুখ ফসকে বললেও চূড়ান্ত অপমানিত হওয়ার ঘোর সম্ভাবনা। কিন্তু ইনি তুড়ি মেরে পুলিশ ডাকা লোক। অন্তত হাজার তিনেক টাকার মাল কিনে ফেলার চেষ্টা শুরু করতেন সাত–আটশো টাকার মধ্যে। দরাদরি করতে করতে গলদঘর্ম হয়ে যেত হকাররা। শেষ পর্যন্ত ওই সাত–আটশো বেড়ে হতো হয়ত ১৩৫০ টাকা। তাও ওই শেষ পঞ্চাশ টাকা ওঁর হাতেপায়ে ধরে চেয়ে নিতে হতো। তার পর সব মালপত্র বেঁধেছেঁদে উনি হকারদের দিয়েই একটা রিকশ ডাকাতেন। যাওয়ার আগে অবধারিত বলতেন, ‘‌কয়েকটা জিনিস নিতে ভুল হয়ে গেল। কাল আবার আসব।’‌

হকাররা নিজেদের মাথার চুল খামচে ধরে বলত, ‘‌আচ্ছা মাসিমা।’‌ তাদের হতাশার আসল কারণ, শুধু যে কয়েকটা জিনিস নিতে ভুল হয়ে গেল, তা তো নয়। যে জিনিসগুলো ভুল করে নেওয়া হয়ে গেছে, সেগুলো আবার ফেরত আসবে। যেগুলো এখানে পছন্দ করে নিয়ে গেলেন, কিন্তু বাড়ি গিয়ে ততটা পছন্দ হবে না, সেগুলো বদলানো হবে। পরবর্তী কয়েকটা দিন এসব নিয়ে দাঁত–নখ বের করে লড়ে যাবেন রাঁচির মাসিমা আর তাঁর কলকাতার বোনপোরা।

হাতিবাগান থেকে গড়িয়াহাট। ডার্টি নর্থ থেকে প্রি%

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত