আমি সুরঞ্জন। একটা অদ্ভুত সমস্যায় পড়েছি জানেন! কার সঙ্গে আলোচনা করব বুঝতে পারছি না। বাড়িতে আমি একা। না মানে ঠিক একা নই, সঙ্গে কয়েকটা বদ্রী পাখি আর দুটো বেড়াল আছে। অ্যাকোরিয়ামও আছে একটা। পাথর ভরা। জল নেই।
এসব মৌলির শখের জিনিস। মৌলি আমার স্ত্রী। মৌলি থাকলে মাছগুলোও থাকত। সবথেকে বড় কথা আমার সমস্যাটা ওর সঙ্গে শেয়ার করতে পারতাম। কিন্তু মাস ছ’য়েক হল মৌলি চলে গেছে। এ রকম কিছু একটা হবে আমি বুঝতে পেরেছিলাম। আমি দেখেছিলাম তো শালিকের বাসায় ডিম ফুটে বাচ্চা হয়েছে, ছাদ থেকে ঝুঁকে সেই ছবি তুলছে মৌলি। হঠাৎ আলগা শ্যাওলায় পিছলে গেল একটা পা। ছাদের চাবিটা লুকিয়েই রাখতাম তারপর থেকে। একদিন কী করে যেন সেটা খুঁজে পেয়েছিল। পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন ওকে ছাদ থেকে পড়ে যেতে দেখেছিল। না হলে সবাই ভাবত সুইসাইড করেছে। হয়ত আমিও তাই।
খুব বাচ্চা চাইত। আমার জন্য হচ্ছিল না। মানে এমনি সব ঠিকই ছিল কিন্তু…! কী বলব বলুন তো! এ ভাবে সবাইকে বলার মতো বিষয় এটা! আর লজ্জা করেই বা কী হবে। প্রথম যেদিন টেস্ট করাতে গেছিলাম, বিলিং কাউন্টারে একজন সুন্দরী মহিলা আপাদমস্তক দেখে জানতে চাইল – “মিনিমাম চার-পাঁচ দিন গ্যাপ আছে তো?” পাশ থেকে মৌলি সম্মতিসূচক একটা শব্দ উচ্চারণ করেছিল। তারপর একজন নার্স এসে হাতে কাঁচের অ্যাসট্রের মতো গোল একটা পাত্র দিয়ে বলল – পুরোটা ধরার চেষ্টা করবেন এটার মধ্যে, বাইরে যেন না পড়ে।” পুরোটাই তার হাতে নিজে হাতে তুলে দিয়েছিলাম। রিপোর্ট কার্ডে স্পার্ম কাউন্ট অস্বাভাবিক কম এসেছিল। তখন থেকেই সিগারেট, টুকটাক শুকনো নেশা একদম বন্ধ। ওষুধ খেয়ে অবস্থার উন্নতি ঘটলেও সেটা মৌলির মা হবার পক্ষে যথেষ্ট ছিল না।
একদম শেষ রাতে আমার সঙ্গে মৌলির কথা হলো। ও কিন্তু বলল সুইসাইড করেনি। বিকেল ফুরিয়ে আসছিল। সিঁড়িটা অন্ধকার। গা ছমছমে। নামলেই কেউ একটা আড়াল থেকে জড়িয়ে ধরে জোর করে আদর করার চেষ্টা করবে বলে ওর মনে হচ্ছিল। তাই ছাদ থেকে লাফিয়ে নামতে গেছিল। এটা বানানো কিনা জানি না। তবে জানেন আমার বাড়িতে এসে কেউ রাত কাটাতে পারে না। এটা সত্যি।
কালই স্বপ্নে আমি ছাদের গামলায় একটা মরা কাক ভাসতে দেখেছি। সকালে উঠে দেখি বাড়ির সামনে রাস্তায় একটা মরা কাক। এ রকম কেন হয় বলুন তো? আজকাল রাস্তায় ভিড়ের মধ্যে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। পা জড়িয়ে যায়। দিক্ভ্রান্ত লাগে। চেনা চেনা লাগে মানুষের মুখ। কোথাও দেখেছি বলে মনে হয়। আচ্ছা এগুলো কি অসুখ? মনের অসুখ বলে কিছু হয়? তাহলে তো সবারই মনের অসুখ আছে। কেউ বলে, কেউ লুকায়, আবার কেউ জানেই না। আমিও তো জানি না। কিন্তু আমার ওসব রাখঢাক নেই। পুরনো বন্ধুরা কেউ আর যোগাযোগ রাখে না। কারণ কী জানেন? ওই যে আমি মুখের ওপর বলে দিই। ওরা ধরা পড়ে যায়। বিশ্বাস করুন আমার কারোর সাথে কোনো শত্রুতা নেই! ইস্ ওরা যদি এটা বুঝত!
আমার সমস্যার কথাটা বলতে গিয়ে খেয়াল করলাম, একটা নয় আমার অনেক সমস্যা। যেমন, আসল কথাটা না বলে আমি ফালতু ভূমিকা ক’রি। যেমন আমার মধ্যে সবসময় একটা অপরাধবোধ কাজ করে যে মৌলির মৃত্যুটার জন্য আমিই দায়ী। কিন্তু এটা থেকে আমি বেরোতে চাই। সিরিয়াসলি। বিশ্বাস করুন, অন্তত জীবনে একবার একটা দারুন প্রেম করার ইচ্ছে আছে।
আচ্ছা এই যে আমি স্বপ্নে যা দেখি বা ভাবি সেটা সত্যি হয়ে যায়, এটা কি অসুখ? কী করে বুঝব কোনটা অসুখ? সুখ শব্দটাই যে খুব জটিল। ক্ষণস্থায়ী। শ্রাবণের বৃষ্টির মতন। খামখেয়ালি। খামখেয়ালি মানুষদের বোধহয় দু’তিনটে মন। আমার ক’টা জানতে চাই। যে মনটায় সুখ বেশি সেখান থেকে একটু একটু নিয়ে অন্য মনগুলোয় রেখে দেবো। না না, শুধু শুধু একটা কঠিন কাজের দায়িত্ব নিচ্ছি। সমান ভাগে ভাগ করা-টরা আমার আসে না। একটু এদিক ওদিক না করলে নিজেকে যন্ত্র মনে হয়।
আমার ভয় করে একদিন আমি যন্ত্র হয়ে যাবো। আমি নড়লে চড়লেই যান্ত্রিক শব্দ হবে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে খারাপ হয়ে গেলে রাস্তায় পড়ে থাকব। জ্যাম হবে। আমার চারপাশে গাড়ি মানুষ ট্রাফিক পুলিশ আর অ্যাম্বুলেন্স। না না, আমার জন্য নয় ওই অ্যাম্বুলেন্সটা। আমিও প্রথমে তাই ভাবব, তারপর ইউ টার্ন করে লালবাতিটাকে হারিয়ে যেতে দেখব। আমার জন্য আসবে একটা জং ধরা ক্রেন। আঁকশিতে ক’রে আমায় নিয়ে যাবে তাতে আমার আপত্তি নেই। আমার ভয় ঝুলতে ঝুলতে যাওয়াতে। আমি এমনিতেই ভিড় উপচে পড়া বাস বা ট্রেনে উঠি না। উঁচু বারান্দা থেকে কাগজের কুচির মতন ভাসতে ভাসতে বা কানে সুড়সুড়ি দেবার বাতিল পালকের মতন হেলতে দুলতে নিচে নামার অ্যাডভেঞ্চারও আমার আসে না।
আজ দিন তিনেক হল ঘড়িটায় রাত দুপুর সব মিলেমিশে খানখান। পেন্ডুলামটা হারিয়ে গেছে রাত তিনটেতে। স্বপ্ন মনে থাকে না আজকাল। কিছু শব্দ মনে থাকে। ভাঙার শব্দ। জোড়া লাগার শব্দ। এমনকি খসে পড়ারও। তখন জানলার বাইরে শিউলির গাছটা জানলায় লেগে থাকা স্ট্রিট লাইটের আলোগুলো মুছে দেয় না আর, ভোরের আলো মেজে দিয়ে গেছে কখন। শুনতে পাইনি।
গত একবছর কোনো মেয়ের দিকে তাকিয়ে তার সঙ্গে মিশতে ইচ্ছে করেনি। বারান্দায় কয়েকটা মচমচে লাল নেলপালিশ মাখা নখ পড়ে আছে। কাল রাতে যে মেয়েটা ছিল, তার। মোবাইলে কোনও ফোন আসে না। নিজেই বিভিন্ন সময় নিজের ফোনে ফোন করি। মোবাইলে মিসড্ কল বিনা সুদে বাড়ছে। সাত দিনে একশো। মনের অসুখ তো অনেকটা বন্ধ বাড়ির অন্ধকারের মতন। কেন এলো মেয়েটা? বলল আমি নাকি পড়িয়েছি। আর্টস গ্রুপ। ভুল বলছে, আমি কোনওদিন কাউকে পড়াইনি। কিন্তু মেয়েটা কি করে জানল কথা বলার সময় চশমার ফাঁক দিয়ে দেখাটা আমার মুদ্রাদোষ?
সব রঙিন মানুষই যে ছবি আঁকতে পারবে এমন কোনও কথা নেই। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জলরঙে আঁকা ছবিটা যে বৃষ্টির জন্মদিনে আঁকা হবে এমনটা নয়। তেমনি যার আলগা হাতখোঁপা আদরের গন্ধ জমিয়ে রাখত তাকে বদলে যেতে দেখেছি ছোট চুলে। মৌলি সিঁদুর পড়ত না। পাড়ার প্যান্ডেলে সিঁদুর খেলত দশমীতে। ভাসানেও গেছিল কয়েকবার, দায়ে পড়ে। তখন ও নতুন এপাড়ায়। আমি যতদূর জানি, কুড়ি বছরের পুরনো পাড়াতেও নতুন ছিল ও। মিশত না খুব একটা। মিশতে চাইত না, নাকি মিশতে পারত না, জানতে চাইনি কখনও। জিজ্ঞেস করলে হয়ত একটা নতুন গল্প পাওয়া যাবে। ও আচ্ছা। সেটা তো আর হবে না। মৌলি নেই।
যখনই ও থাকে না, ওর একটা ইম্পর্টেন্ট ক্যুরিয়ার আসে বাড়িতে। অথবা ইউনিভার্সিটির সুন্দরী ছাত্রীরা দলবেঁধে আসে আড্ডা মারবে বলে। এখনও কেউ আসেনি এবার। অবশ্য কাউন্ট ডাউন এখনও শুরু হয়নি। মাত্র কিছু দিন হল মৌলি নেই। এখনও কেউ জানে না ও নেই, সুতরাং কবে ফিরবে সেটাও জানার কথা নয়। মৌলির এই আচমকা না থাকাটা, সবার মধ্যে থেকে হঠাৎ ভ্যানিশ হয়ে যাওয়াটা, নতুন নয়। আগেও ঘটেছে, আমি এটা নিয়ে চিন্তিত নই, আমার ধারণা কেউই নয়। না, একটু ভুল বললাম। মানে এখনও তো এটা একটা মুখরোচক টপিক হয়ে ওঠেনি আড্ডার।
সিনেমার গল্পে এসব ক্ষেত্রে প্রটাগনিস্ট একটা দারুণ ক্যামেরা নিয়ে কোনও নিঝুম পাহাড়ের আঁকে বাঁকে খাঁজে নিরুদ্দেশ খুঁজে বেড়ান। পাহাড়ি নদীর পাথর ছুঁয়ে দেখে খালি পা। তারপর টিপিকাল কিছু মুহুর্ত। ফায়ারপ্লেস। হুইস্কি। কটেজের রাতজাগা বারান্দা। অদ্ভুত যান্ত্রিক কোনও কেয়ারটেকার। যার ঘোলাটে চোখে লালশিরার মানচিত্র। এইসব। মৌলিও কি এরকম কোথাও যায়? ধরা যাক যায়। তারপর আর ফিরতে ইচ্ছে করে না ওর। তবু প্রতিবার মনটা উপড়ে নিয়ে পাহাড়ি ঘূর্ণির বাঁকে মিশে যায়। হয়তো একদিন আর শেকড়ের মতো উপড়ে ফেলতে পারবে না। মনটা ধস নামা পাথর হয়ে যাবে।
মৌলি যদি সত্যিই না ফেরে তাহলে মানুষের কাছে আমাকেই জবাবদিহি করতে হবে। সেটা শুধু আমি ওর হাজব্যান্ড বলে নয়। প্রথমত, ব্যাপারটা অস্বাভাবিক এবং দ্বিতীয়ত, না ফেরার সাইকিটা আরও বেশি অদ্ভুত। লোকের মনে হবে বানানো। তাই তাসের মতো একটু সাজিয়ে নিতে হবে।
যাই হোক, মৌলি যে নেই এটা আমার খারাপ লাগছে না। একা থাকতে আমার ভালো লাগে। ইনফ্যাক্ট এই নির্জনতাটা নিয়েই তো ওর সাথে আমার একটা ইন্টেলেকচুয়াল ঠোকাঠুকি। অ্যাকোরিয়ামের ভেতর দুটো মাছের মধ্যেও হয় দেখবেন! নিঃশব্দে। শুধু জল তোলপাড় হবার আলোড়নে বুঝতে পারি ওরা আর একসঙ্গে থাকতে চাইছে না। দমবন্ধ হয়ে আসছে। মৌলির মাছ নিয়ে বেশ পড়াশোনা আছে। আমার নেই। তবে দেখেছি, ওরা অনুভূতিগুলোকে রাবার ব্যান্ডের মতো টেনে বড় করে না। থামতে জানে। আসলে সময় কম তো জীবনে। মানে যারা অনেকদিন বাঁচে তারা ঠিক এটা বুঝবে না।
এই যে নেপালি ছেলেটা বাঁশি বাজাচ্ছে, ল্যাম্পপোস্টে লাঠির শব্দ করছে, ও একমাস হলো এসেছে। বৌ নিয়ে। দেশ থেকে। আমার খুব মনে হয়, এমন যদি হতো ও আর ওর বৌ একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে রাতে বেরোয়! শিবুর বন্ধ চায়ের দোকানের সামনের বেদিটায় শরীর ছুঁইয়ে বসে! বুকে মাথা রাখে বা অন্ধকার গলির পাঁচিলে হেলান দিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ভরে চুমু খায়! আমি সত্যিই চাই ওরা শব্দ করে হাসুক, প্রাণভরে দু’জন দু’জনকে দেখুক। আমার নিজের অবশ্য এত প্রেম আসে না। একটা ভালো বর হবার কোনো গুণই নেই আমার। তবে বিশ্বাস করুন আমি কোনওদিনই চাইনি মৌলি একেবারে চলে যাক আমায় ছেড়ে।
যাবে জানতাম। কিন্তু এইভাবে … না মানে … আমাদের একসঙ্গে এগারো বছর কাটিয়ে দেওয়া, প্রেগন্যান্সি বা মিসক্যারেজের স্বপ্ন, স্পার্ম কাউন্ট কম আসা মেডিক্যাল রিপোর্ট, সবটাই কিন্তু অ্যাক্সিডেন্ট। মৌলির মৃত্যুটার মতন। ধাক্কাটা আমি অত জোরে কিন্তু দিতে চাইনি। বিছানার মাথার কাছে তেকোণা কাচের টেবিলটা ও-ই কিনে এনেছিল শখ করে। ওসব বড় হোটেলে থাকে। বাড়িটা তো বাড়িইইই। তার ইন্টেরিওর ডেকোরেশনটা তো হোটেলের মতো হতে পারে না।
যাক্গে, যেটা বলছিলাম, এমনভাবে পড়ল, কাচটা ভেঙে গলায় আড়াআড়ি ঢুকে গেল। ইম্পোর্টেড কাঁচ। আমার খারাপ লাগছে মৌলিকে মারা যাবার আগে দেখতে হলো ওর প্রিয় কাচের জিনিসটা ঝনঝন ক’রে ভেঙে গেল!
ভাবছেন ধরা পড়ে গেলাম? নিজের কথার জালে জড়িয়ে গেলাম? যাঁরা মনে মনে আমায় সন্দেহ করছিলেন, তাঁরা আনন্দ পেলেন হয়তো। থাকুন না মিথ্যে আনন্দে, আমার কোনও আপত্তি নেই। আসলে আমিও দারুণ একটা দোলাচলতার মধ্যে ছিলাম। মৌলিকে ধাক্কাটা মারার পর থেকে। প্রথমত, ধাক্কা মারাটা অন্যায় হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, ধাক্কা মারার পর ও কাচের টেবিলটার উপর আছড়ে পড়ল না। কিন্তু কয়েকদিন আগেই আমি মুহুর্তটা দেখেছিলাম। আমার পুষে রাখা বিষণ্ণতার অন্ধকার থেকে আমারই একটা হাত ধাক্কা মারছে মৌলিকে আর ও ছিটকে পড়ছে। ছোট ছোট ত্রিভুজের মত টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে কাচ। এত রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মৌলির শরীরটা কিছুতেই হালকা হচ্ছে না। ক্রমশ একটা নিরেট পাথরের মত ভারি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে সেটা ঘটলই না। মানে আমি যা দেখলাম সেটা মিলল না। এরমও হয় দু’একবার।
মৌলি আর নেই। কিন্তু ও পাশের ঘরে। মেঝেতে শুয়ে আছে। মেঝেটা খুব ঠান্ডা জানেন! কাল খুব বৃষ্টি হয়েছিল। আচ্ছা আজও কি হবে? রোজই যদি বৃষ্টি হয়, এইভাবে আকাশ ছাপিয়ে, তাহলে কি সব নদী হয়ে যেতে পারে! সম্পর্কের ভেতর নদী। বিক্ষোভে নদী। মিছিলে নদী। অভিমান কান্না অট্টহাসিতে নদী! আর আকাশের কোল ঘেঁষা মেঘের সংসারে ঢুকে পড়া সেই সব বহুতলগুলো? কী জানি, মনে হয় সেদিনই দাবানল লাগবে কংক্রিটের জঙ্গলে। আগুন জল উদ্ভ্রান্ত মানুষের দিক্শূন্য আর্তনাদ। একটা মৃত্যু উপত্যকার প্রসব বেদনার মতো। সেখানে আকাশ বলে কিছু নেই। একটা অসম্ভব বড় চিমনির ধোঁয়াটে মুখ। এইভাবেই একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে পৃথিবী। মাঝে মাঝে মনে হয়।
আমার অবশ্য অনেক কিছুই মনে হয়। অহেতুক কিনা বুঝি না। মানে আমি যতক্ষণ এই সুরঞ্জন লোকটা হয়ে থাকি, ততক্ষণ আমার মনের মধ্যে হাজার হাজার দোলনার দুলুনি। শুধু দুলুনি বললে বড্ড ঘুমপাড়ানি শোনায়। ঘুম কই সুরঞ্জনের চোখে? আসলে একটা অবিরাম ট্রাপিজের খেলা। ভাবনাগুলোর দোলনা বদল। ভারসাম্য দখল। একটু আগেই যেমন মনে হল মৌলি পাশের ঘরে শুয়ে। মেঝেতে। না না, অসম্ভব। নরম বিছানা ছাড়া শুতেই পারত না মৌলি। মেঝেতে তো গেঁথে রাখা আছে ঝিনুক! অনেকদিন সমুদ্রে যাইনি মনে হল। অনেকদিন ঢেউ ভাঙা ফেনায় হারিয়ে ফেলিনি পায়ের পাতা। সমুদ্র আনতে পারিনি চার দেয়ালে। একফালি বালিয়াড়ি এনেছিলাম শুধু। জোয়ারে ভেসে আসা ঝিনুক, ডাবের খোলা, হাওয়াই স্লিপার এইসব। হাঁটছিলাম। পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে। যদিও চোখে ছিল ভাঁটা। যেখানে যাওয়া মানা জোয়ারে। অদ্ভুত এক দূরে চলে যাবার অনুভূতি। মানুষ কি সমুদ্রের কাছেই দূরে চলে যাওয়া শেখে!
সেদিন রবীন্দ্র সদন থেকে হাঁটতে হাঁটতে বিড়লা প্ল্যানেটারিয়ামের কাছে এসে কিছুতেই ঠিক করতে পারছিলাম না কোনদিকে যাবো। একবার মনে হচ্ছিল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দিকে, একবার ইচ্ছে করছিল পার্কস্ট্রিট। সেদিন সুরঞ্জন ছিল না আমার শরীরে। আর পাঁচটা ভবঘুরে মানুষের মতই উদ্দেশ্যহীন, ঠিকানাহীন লাগছিল নিজেকে। আকাশ মেঘলা। শোকসভার মতো আরোপিত স্তব্ধতা। সময়টা বিকেল বিকেল। তবু আলো জ্বলে গেছে শহরে। কিছুতেই রাস্তাটা পার হতে পারছিলাম না। খুব বেপরোয়া লাগছিল গাড়িগুলো। হঠাৎ তীব্র হর্ন। একটা বিচ্ছিরি চাকা ঘষার শব্দ। কিছু শোরগোল। এর বেশি কিছু টের পাইনি। শুধু অনুমান করছিলাম একটা অ্যাক্সিডেন্ট। ঘটেও গেল।
এই সুরঞ্জন লোকটাকে আজকাল আমার ভয় করছে। না, সে যা দেখে তা ঘটে যায় বলে নয় কিন্তু। হঠাৎ সে একটা কবিতাও লিখে ফেলেছে। কি লিখেছে শুনবেন? লিখেছে –
রক্তরা পড়ে থাক রাস্তায়
ধুয়ে ফেলার তৎপরতা চাই না
রক্তরা জমাট বাঁধছে
পিঁপড়ের মতো দলে দলে ঘিরে দাঁড়াবেন না
ওই জলগুলো রাস্তায় ঢালবেন না
দয়া করে অন্য কোথাও দিন জলের লাইনে
লোহিত কণিকা কতটা মিশল পিচে
হিমোগ্লোবিন কম ছিল কিনা
এসব আপনাদের জন্য নয়
আপনারা ঠেলাঠেলি করে বাসে উঠুন
দড়ির আগুনের মতো ঝুলে থাকুন
জেব্রা ক্রসিং ছুটে গলে যান ডিভাইডারের ফাঁক
ওকে একা ছেড়ে দিন
বৃষ্টি আসবে ভিজতে দিন
ও ভিজতে চেয়েছিল
ভেজা শহরের শরীরে নিশান ছিল
একটা ভাঙা আয়নার প্রতিফলন
ছাতাটা হারায়নি
আকাশে মেঘেরা রাস্তা পারাপার করছিল।