ক্যালেন্ডারের দিকে চোখ পড়তেই মনে মনে আবার হিসেবটা করে নেয় চন্দ্রানী। আজ থেকে ঠিক দেড় মাস আগে নিয়মিত শারীরিক ঋতু পরিবর্তনের হঠাৎ বেনিয়ম হওয়ায় খুব স্বাভাবিক উৎকন্ঠা এবং একরাশ বুক ধুকপুকুনি নিয়ে ড. চ্যাটার্জির কাছে ছুটে গিয়েছিল সৌরজ কে নিয়ে। ড চ্যাটার্জি বহুদিনের পরিচিত। ব্যস্ত এবং বেশ নাম করা স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ। ওরা যেতেই প্রেসক্রিপশন প্যাড থেকে মুখ না তুলেই অভ্যস্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন, “শেষ কবে হয়েছিল?” সলজ্জ চন্দ্রানী উত্তর দিয়েছিল “২ মাস”। অভ্যস্ত হাতে পাশে রাখা প্রেগনেন্সি টেস্ট এর একটা স্ট্রিপ চন্দ্রানীর হাতে দিয়ে বললেন- “যাও টেস্টটা করে এসো। নিজেই তো বাড়িতে করে নিতে পারতে।”
বাথরুমে ঢুকে এক পলক স্ট্রিপটার দিকে তাকিয়ে, চন্দ্রাণী নিজের মনেই বলে ওঠে “কী অদ্ভূত না!” তার শরীরে ভ্রুণের উপস্থিতির সাক্ষী দেবে একটা প্লাস্টিকের স্ট্রিপের দাগ। মিনিট দশেক পরে চন্দ্রানী যখন বাইরে এলো তখন সৌরজের জিজ্ঞাসু চোখ তার দিকে তাকিয়ে। একটু হেসে সে বলল “পজিটিভ।”
সেই দিন থেকেই চন্দ্রানী একটা অদ্ভূত ঘোরের মধ্যে আছে। প্রায় রোজই ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে মনে মনে হিসেব করতে থাকে, কবে? কবে? কবে? তারপর নিজের শিশুসুলভ অস্থিরতায় নিজেই লজ্জা পায়। তার আর সৌরজের বৈবাহিক জীবন সাত বছরের। বিয়ের পরপরই সন্তানের ইচ্ছা মনে এলেও সে চিন্তাকে প্রশ্রয় দিতে পারেনি দু’জনের একজনও। চন্দ্রানীর পিএইচডি চলছে আর সৌরজ নেহাতই খুব সাধারন ওষুধ বেচুবাবু। কতই বা আয়? সেই সময়ের কথা ভাবলে বিয়ে করাটাই খুব সাহসি পদক্ষেপ বলে মনে হয় চন্দ্রানীর। আজ সময় পাল্টেছে। চন্দ্রানী এখন কলকাতার একটা নামকরা কলেজে লেকচারার আর সৌরজ সরকারি চাকুরে। দু’জনের সাজানো সচ্ছ্বল সংসার। তাই এখন তৃতীয় মানুষটির আবির্ভাবের জন্য অধীর আগ্রহে তৈরি তারা।
আজ অফিস ফেরত রিপোর্টগুলো নিয়ে আসার কথা সৌরজের।সব সন্তানসম্ভবা মেয়েদের ক্ষেত্রেই যে সমস্ত টেস্টগুলো করা আবশ্যিক সেগুলো করতে দিয়েছিলেন ড চ্যাটার্জি। আজ করব কাল করব করে হপ্তা দু’এক এমনি কাটিয়ে দিয়েছিল চন্দ্রানী। অবিরাম আত্মীয়স্বজনের ফোন, কাজের মাসি থেকে মাসতুতো দাদার পিসতুতো বোনের খুড়শাশুড়ি, সবার বিবিধ প্রকার জ্ঞানের চাপে কী ভাবে যেন মাথা থেকে বেরিয়েই গেছিল টেস্টের কথাটা। হঠাৎ পৌনে তিন মাসের মাথায় সৌরজই মনে করিয়ে দেয় তাকে,
–কি গো টেস্টগুলো করাবে না? আর এক মুহূর্ত দেরী করেনি চন্দ্রানী। সেদিন বিকেলটা বড় সুন্দর ছিল। কনে দেখা আলোয় ওদের বারান্দাটা ভেসে যাচ্ছিল। খুব ভালো লাগছিল চন্দ্রানীর। ভাবনার চটকা খানখান করে হঠাৎ কলিং বেল বেজেছিল। দরজা খুলে চন্দ্রানী বলেছিল, “রিপোর্টগুলো এনেছ মনে করে?”
পরের দিন সকালে বাকি সব কাজ ফেলে রেখে তারা ছুটল ড চ্যাটার্জির চেম্বারে। ট্যাক্সিতে যেতে যেতে দু’চোখ বন্ধ করে আগের দিনের গোধূলির কনে দেখা আলোর কথা মনে পড়তেই কোথা থেকে যেন লবনাক্ত জলের অবিশ্রান্ত ধারা তার চিন্তাকে ঝাপসা করে দিতে লাগলো বারবার। মনে পড়তে লাগলো একটাই দৃশ্য, মুখ কালো করে দাঁড়ানো সৌরজ, তার দিকে না তাকিয়ে বলেছিল একটাই কথা – “পজিটিভ”। মানেটা প্রথমে বুঝতে পারেনি সে। মুখে একরাশ ঘৃণা আর চোখভরা অবিশ্বাস নিয়ে সৌরজ ছুঁড়ে দিয়েছিল রিপোর্টটা তার দিকে।
-“তুমি এইচআইভি পজিটিভ। ছিঃ চন্দ্রা”
আর কিছু ভাবতে পারেনি চন্দ্রানী। বিশ্বাস-অবিশ্বাস এর দ্বন্দ্বে সে নিজেকে ছুঁড়ে দিয়েছিল বিছানায়। এও কি সম্ভব? সে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ! এত বড় লজ্জা, অপমান! কার কাছে যাবে সে? তার গর্ভে যে সন্তান আছে তার কী হবে? নিজের জীবন একমুহূর্তের জন্য শেষ করে দেবার কথা ভাবলেও পরমুহূর্তেই মনে পড়ে সেই প্রাণ স্পন্দনের কথা, যে তার শরীরের মধ্যে একটু একটু করে বেড়ে চলেছে। আজ এত আনন্দের বাড়িটা যেন মরুভূমি।
বিদ্যুতের মত চন্দ্রানীর মাথায় খেলে গিয়েছিল একটা অশ্লীল প্রশ্ন। আগের চাকরি করার সময় কতদিন, কত রাত তো সৌরজ টুরে গেছে, বাইরে থেকেছে, তখনই কি কোথাও? কোনও দিন? ঘেন্নায় শিরশিরিয়ে ওঠে সে। এই লোকটাকে ভালোবেসে এসেছে সে? এই লোকটার সন্তান না না এই সন্তান তার চাই না। যেখানে বিশ্বাস নেই, ভালোবাসা নেই, কার শরীরের মারণ জীবাণু বয়ে চলেছে সে? চোখ খুলতেই চন্দ্রানী টের পেল যে চেম্বার এসে গেছে। ড চ্যাটার্জি নিজেকে যতটা সম্ভব সংযত রেখেই সৌরজকেও টেস্টটা করাতে বলেন।
–দেখো এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু কী আর করবে বল? তোমরা বরং ড সরকারের কাছে একবার যাও। বুঝতে পারছি প্রথম সন্তান। কিন্তু রিস্কটা তো রয়েই যায়।আর ভালো কথা, এই চিকিৎসা তো ঠিক আমি করি না, আর বুঝলে মানে আমি বেশ কিছুদিনের জন্য একটু বাইরে যাচ্ছি। আর বোলো না, কনফারেন্স। সৌরজ তুমি তো বোঝোই (ফোনটা তুলে) পরের জন?”
পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছিল দু’জনেরই। খুব ভালোভাবেই টের পাচ্ছিল যে ডাক্তারবাবু কায়দা করে তাদের থেকে মুক্তি পেতে চাইছেন। অসহায়, বিভ্রান্ত দুজনে বাইরে এসে দাড়ায়। দুজনের অজস্র ঘৃণা, অভিমান, প্রশ্ন পরস্পরের প্রতি থাকা সত্ত্বেও দু’জনে এগিয়ে চলে অনিশ্চিত নিকষ কালো ভবিষ্যতের দিকে।
এক মুহূর্তের মধ্যে দু’জনের স্বাভাবিক সম্পর্ক ভরে ওঠে সন্দেহের মাকড়সার জালে। বারবার চন্দ্রানী কে কুরে কুরে খায় যে কথাটা, সেটা হল আমি কেন? বাড়ির লোকজন আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সবার কাছে কী মুখ দেখাবে তারা। এতবড় অসহায়তার মুহূর্তে দু’জনে বুঝতেই পারে না তাদের কী করা উচিত। চন্দ্রানীর গর্ভে একটু একটু করে বেড়ে উঠছে যে, তার তো কোনও দোষ নেই! তাকে কোন অভিশপ্ত পৃথিবীর আলো দেখাবে তারা? ভাবতেই শিউরে ওঠে চন্দ্রানী। বারান্দায় মুখ কালো করে দাড়িয়ে থাকা সৌরজকে অসহ্য লাগে তার। এত বড় বেইমান। এক ছুটে গিয়ে বাঘিনীর মত ঝাঁপিয়ে পড়ে সে সৌরজের ওপর। “কেন তুমি আমাকে এ ভাবে ঠকালে? কেন? আমাদের প্রথম সন্তান… তুমি পারলে? আমি আর এক মুহূর্তও ” সজোরে ধাক্কা দিয়ে সৌরজকে ফেলে সে ঢুকে যায় চানঘরে। সৌরজ একই ভাবে কঠিন হয়ে দাড়িয়ে থাকে। সেই রাত্রেই ওরা ঠিক করে এইভাবে অবিশ্বাস নিয়ে এক ছাদের তলায় থাকা সম্ভব নয়। আলাদা হয়ে যাবে। তবে অবশ্যই একটা হেস্তনেস্ত হবার পর। কার কাছে যাবে চন্দ্রানী, ভেবেও কুলকিনারা পায়না। চন্দ্রানী নিজের জামাকাপড় গোছাতে গোছাতে বলে ওঠে,
– এই সন্তান আমি চাই না। কালই কোনও প্রাইভেট নার্সিং হোমে গিয়ে কথা শেষ করতে দেয় না সৌরজ। একটানে ছুঁড়ে ফেলে দেয় তার গোছানো বাক্স।
– ইয়ার্কি পেয়েছ? বাচ্চা কি তোমার একার নাকি? যা ইচ্ছে তাই করবে ভাবছ? আমি এখনও বেঁচে আছি।”
নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চন্দ্রানী বলে, ” লজ্জা করে না তোমার? ছিঃ।” সৌরজ সমস্ত রাগ অপমান-বোধহীন হয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে চন্দ্রানীর দিকে। বলে “তুমি সত্যিই আমায় বিশ্বাস কর না?”
সে রাতে ওরা কেউ ঘুমোয়নি। কে জানত ওই একদিনেই আরও কত জীবন ছারখার করে দেওয়া সত্য তাদের জন্য অপেক্ষা করে ছিল। এক সত্য দু’জনকে ঠেলে দিয়েছিল জীবনের দু’প্রান্তে। আর সেই রাতেই জামাকাপড় গোছানোর সময় ফাইলটা আচমকা চোখে পড়ে যায় চন্দ্রানীর। ভেসে যাওয়া চোখ দিয়ে ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারেনি সে! হঠাৎ কী যেন মনে পড়ায় তার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যায় বরফের স্রোত। এই ফাইলটাই তো? দু’বছর আগের ঘটনা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতে এক অদ্ভূত সত্যের সামনে এসে দাঁড়ায় সে। দু’বছর আগে পেটে তীব্র ব্যথা হওয়ায় হসপিটালে ভর্তি হয়েছিল চন্দ্রানী। ডাক্তার আর দেরি করেননি। সঙ্গে সঙ্গে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন “acute cholecystitis” বলে।
অপারেশন চলাকালীন রক্ত দিতে হয় চন্দ্রানীকে। দু’বোতল। তবে কি? অনিচ্ছাসত্ত্বেও যে আশঙ্কা তার মনে দানা বাঁধতে আরম্ভ করে, সেটাকে উড়িয়ে দিতে পারে না। আজ তার সঙ্গে হয়ত সৌরজও এই মারণ রোগের জীবাণু নিজের শরীরে বয়ে নিয়ে চলেছে। একটু একটু করে তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা এই লক্ষ লক্ষ জীবাণু ধ্বংস করে দিচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। বিহ্বল চন্দ্রানী আর টাল সামলাতে পারে না। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মেঝেতে।
আরও সাতটা বছর কেটে গেছে। আজ সৌরজ-চন্দ্রানী দুজনেই এই মারণ বীজাণুর বাহক। অনেক ডাক্তারের চৌকাঠে ঠোক্কর খাবার পর অবশেষে কি অদ্ভূত উপায়ে এই সরকারী হসপিটালে ঠাঁই জোটে তাদের। অনেক চিন্তা ভাবনা করে দু’জনে মনস্থির করে যে, জেনেশুনে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেবে না আগামী প্রজন্মকে। দু’জনেই আজ নিয়মিত ওষুধ খেয়ে সুস্থ জীবনে ফিরে এসেছে।
তবে আজ ওরা আর দু’জন নয়। এ মাসের ওষুধ গুণে নিয়ে ওরা যখন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এল, তখন ওদের জন্যে অপেক্ষা করছিল ফুটফুটে একরত্তি মেয়ে তিথি। তিথি অবশ্য এখনও জানে না যে তার জন্মদাত্রী মা এই মারণ রোগের শিকার হয়েই মারা গিয়েছিল। আর বাবা মারা গিয়েছিল অসুখ ধরা পড়ার অনেক আগেই। সে এক লাফে চন্দ্রানীর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুখ গুঁজে দেয় নতুন মায়ের বুকে। এক মুহূর্তের জন্য চন্দ্রানীর বুকের রক্ত চলকে ওঠে! তা হলই বা সে রক্ত মারণ বিষে ভরা।