অয়ন অফিসে বেরনোর জন্য বাইক বের করবে, মা এসে বলল, “তোর বাবার জন্য একটা বাঁদর-টুপি আনিস মনে করে। কবে থেকে তো বলছি!”
সত্যিই কথাটা আজ দু’তিন দিন হল সুমিত্রা বলছেন অয়ন ,মধুশ্রী দুজনকেই। কিন্তু দু’জনেই ভুলে যাচ্ছে। অয়ন তাই আজকে একটু লজ্জাই পায়। বাইকটা বের করতে করতে ও বলে, “মোবাইলে রিমাইন্ডার দিয়ে রাখছি। আজ ভুলব না। প্রমিস!”
মধুশ্রী বাইরে দাঁড়িয়ে জুতোর স্ট্র্যাপ লাগাচ্ছিল এক পা তুলে, কসরৎ করে। অয়ন ওকে বাইকে করে অটোস্ট্যান্ডে ছেড়ে দেয়। অটোয় গেলে ও স্কুলের গেটেই নামতে পারে। দ্বিতীয় পাটি জুতোর স্ট্র্যাপ লাগাতে লাগাতে ও হেসে ফেলে বলল, “কাল ভ্যালেন্টাইনস ডে! আর হাবিকে তুমি গিফট করবে মাঙ্কি ক্যাপ!”
এইসব হাবি গোছের শব্দের অর্থ বুঝতে আগে সুমিত্রা খাবি খেতেন। এ ব্যাপারে ওঁর দৌড় ছিল হাবিজাবি পর্যন্ত! কিন্তু পুত্রবধূ তাঁর এ যুগের মেয়ে। সবসময় এই ভাষাতেই কথা বলে! শাশুড়ির সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশাতেও বেশ দড়! তাই সুমিত্রা পাল্টা দেন, “না রে! সে তো আমি নতুন ইসবগুলের প্যাকেট আনিয়েই রেখেছি!”
অয়ন বাইকে স্টার্ট দেবার পর মা’কে বুড়ো আঙুল তুলে দেখায়। এখন এর মানে সুমিত্রা জানেন। “মা, দারুণ দিলে!” কিন্তু জবাবে তিনি পাল্টা বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ-প্রদর্শনে যান না। কপাট ভেজিয়ে দুগ্গা দুগ্গা বলেন। অয়নের বাইকের গর্জন ছাপিয়ে শুনতে পান বীরেনের কাশির ঘড়ঘড়ানি! সুমিত্রার কাছে এখন নানা ধরনের শব্দ সংসারের নানা চরিত্র হয়ে আসে। এখন আর বীরেনের কাশির টানা ঘড়ঘড় আওয়াজ কানে ততটা অসহ্য লাগে না! বরং রান্নাঘর বা চানঘর থেকে কানে আসা এই শব্দটাই ওঁর কাছে বীরেনকে জাগিয়ে রাখে।
সত্যি, এ বারের ঠান্ডাটা যেন যেতেই চাচ্ছে না! ঠান্ডার নতুন নতুন খবরে ছেলে-বৌমা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। নিত্যি প্ল্যান ভাঁজছে, কোথায় যাওয়া যায় অন্তত দুটো দিনের জন্য! কোথায় গিয়ে মুঠোয় বরফ নিয়ে লুফোলুফি খেলা যায়! আর ওদের এই লাফালাফির সঙ্গে সঙ্গেই সুমিত্রার বুকের মধ্যে একটা বল লাফাতে থাকে! মানুষটা কী কষ্টটাই না পায় ঠান্ডায়! একটার ওপর আর একটা গরম জামা চড়িয়েও যেন সে দুর্বিপাক ঠেকানো যায় না! কাশতে কাশতে এমন অবস্থা হয় যেন প্রাণবায়ুটা মুখের মধ্যে এসে পাক খেতে থাকে! যে কোনও সময় বেরিয়ে পড়তে পারে! সুমিত্রা যেন সেই অবিশ্বাস্য ক্ষণটির অপেক্ষাতেই থম মেরে থাকেন। তারপর একময় দমক স্তিমিত হয়ে আসে নিজেই। নিজের স্থানুবৎ অবস্থা থেকে ঝাড়া দিয়ে উঠে সুমিত্রা একটা জলের গ্লাস এগিয়ে দেন বীরেনকে। কিন্তু শরীরে যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট আছে, তাই দিয়ে বীরেন জলের গ্লাসে একটা ঠেলা মারেন। জল অবশ্য তাতে একফোঁটাও মেঝেতে পড়ে না! সুমিত্রার একটা আগাম অনুমান ছিলই এরকম প্রতিক্রিয়ার, তাই সামলে নেন।
বীরেনের যেন যত রাগ সুমিত্রার ওপর! কেন যে এত রাগ! কীসের যে এত রাগ! রাগ কি সুমিত্রার থাকতে নেই! কতবচ্ছর এই একই জিনিস চলছে! সুমিত্রা মানুষ নন? ওঁর বয়স হয়নি? টেবিলের ওপর রাখা গরমজলের পাত্রটা তুলে সুমিত্রা পা বাড়ান বাইরের দিকে।
অয়ন অফিসে গিয়ে সহকর্মী তারকদাকে অনুযোগ করে, এত সুন্দর ঠান্ডা পড়ছে, কিন্তু কোনও প্রোগ্রাম হচ্ছে না! তারক সেন রসিক, সমঝদার লোক। বুঝতে ভুল করেন না কোন প্রোগ্রামের কথা অয়ন বলছে! জবাব দেন, “টাকা ছাড়ো! কত প্রোগ্রাম চাও, হবে!” অয়ন ট্রাউজার্সের পেছন পকেটে হাত দিয়ে দীর্ঘ-লালিত তৃষ্ণা নিবারণের আয়োজনে মাতে। তারক সেনের ফ্ল্যাটে বসে আসর। চারজনের। সবাই অফিসের। সময় একটু গড়ালে বস হয়ে ওঠে চারজনেরই কমন চাঁদমারি! ওই আবর্ত চেতনার মধ্যেও অয়ন আবিষ্কার করে, বাছাই এবং লক্ষ্যভেদী শব্দচয়নে ও কতটা পারদর্শী! শুধু তাই নয়, মোটরবাইকের হ্যান্ডেলে ওর সন্ধের যাপন প্রভাব ফেলছে না দেখে ও নিজেই নিজেকে তারিফ করে!
তারিফ অবশ্য মধুশ্রীর কাছে জোটে না! যে ক্ষিপ্রতায় অয়ন ওয়শরুমে ঢোকে, স্নান সেরে ধুয়ে ফেলতে চায় সন্ধেটাকে, তাতে মধুশ্রীর মুখে মেঘ জমে! এই নিয়ে একটা কথা বলতেও ওর আত্মসম্মানে লাগে। ইচ্ছে করে রিমাকে একটা ফোন করতে! আজ স্কুলে এই ভ্যালেন্টাইনস ডে নিয়ে নিজেদের মধ্যে একপ্রস্ত হাসাহাসি হচ্ছিল। হাল্কা চালে মধুশ্রী বলেছিল “ওসবের আর বয়স নেই। মনেই থাকে না দিনটা!” রিমা বলে উঠল, “তোদের তো রোজই ভ্যালেন্টাইনস ডে! তাই মনে থাকে না! আমারটা দেখ গিয়ে কাকে নিয়ে সেলিব্রেট করা শুরু করেছে ওখানে!” প্রোষিতভর্তৃকা রিমার আক্ষেপের অনুযোগে যথেষ্ট বাড়াবাড়ি আছে মধুশ্রী জানে। তবু ওর এখন একটা ফোন করে রিমাকে বলতে ইচ্ছে করে, “দূরত্ব কখন যে কীভাবে তৈরী হয়, তার কতটুকু তুই জানিস!”
অয়ন আজ রাতে খাবার টেবিলে যাবে না, মধুশ্রী জানে। ও অয়নের প্লেটটা ওদের ঘরে নিয়ে আসে। ছোট করে বলে, “খেয়ে নাও।” অয়ন অসহায় অপরাধীর মতো মধুশ্রীর দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি খাবে না?”
“না খাওয়ার কী হয়েছে?” কথাটা বলেই মধুশ্রী বোঝে জবাবটায় যথেষ্ট ঝাঁঝ রয়ে গেল। অয়ন খালি গায়ে, পাজামা পরে খাটে বসে পা দোলায়। কিছু বলে না। মধুশ্রী ঘর থেকে বেরোবার আগে বলে যায়, “গায়ে একটা কিছু দাও। অতো বাড়াবাড়ি কোরও না!” সুমিত্রা মধুশ্রীকে বলেন, “তোর বাবার খাবারটা দিয়ে আসি। তুই শুরু কর।” এবারও মধুশ্রী সংক্ষিপ্ত জবাব দেয়, “তুমি এসো না। তাড়া কিসের!” সুমিত্রা শুধোন, “তিনি এনেছেন বাঁদর-টুপি?”
“আমি এনেছি।”
“তুই এত চুপচাপ কেন রে? ওঠ। ঘরে যা। আমি এদিকটা সেরে নেব।”
সুমিত্রা মধুশ্রীর পিঠে হাত রাখলে সেটা উঠে পড়ার ঠেলা, না ভরসার হাত, মধুশ্রী বুঝতে চায়। ও ওঠে না। সুমিত্রাও হাত সরান না। হঠাৎ সুমিত্রা একটা ফিচেল হাসি হেসে বলেন, “একটু শাস্তি দে না আজ!”
বাঁদর-টুপিটা নিয়ে বীরেনকে পরিয়ে সুমিত্রা টেনে টুনে দেখেন সবদিক ঢাকা পড়ল কিনা। জানান, মধু এনেছে। বীরেন ফ্যালফ্যাল করে তাকান। হয়তো বুঝতেই পারেন না, মধুটা কে! সুমিত্রা সে প্রশ্ন পড়ে জবাব দেন, “তোমার বৌমা!” বীরেন ঠোঁটটুকু ফাঁক করে। তাকে হাসি বলেই ধরে নেন সুমিত্রা। বীরেন এবার ওঁর হাতদুটো ছড়িয়ে দেন সুমিত্রার সামনে।
সুমিত্রা ছুঁয়ে দেখেন যুগ-যুগান্তের শীতলতা এসে জমা হয়েছে সে করযুগলে! সুমিত্রা খুব জোরে নিজের হাত ঘষতে থাকে ওই দুই হাতে। শাঁখা-পলার বেড় দেওয়া, গৃহকর্মপীড়িত একজোড়া হাতের তালু ক্রমশ উষ্ণতা চারিয়ে দিতে থাকে ওই শীর্ণ, শীতল হাতদুটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে! কত স্মৃতি, কত ওঠাপড়ার ইতিহাস সঞ্চারিত হয়ে যায় এ হাত থেকে ও হাতে! ধীরে ধীরে বীরেনের চোখের পাতা মুদে আসে। এবার সুমিত্রাও একটু শরীরটাকে এলাতে পারবেন। চারধারের মশারি গুঁজে দিতে দিতেই শুনতে পান আর একঘর থেকে আসা চাপা কথা-চালাচালি, হাসির শব্দ! সুমিত্রা ঠিক করেন, কাল হাত অবসর হলে একবার নেট ঘেঁটে দেখে নেবেন, ভ্যালেন্টাইনস না কী বলে এরা সব, ব্যাপারটা আসলে কী!