অ্যাসট্রেতে আধখাওয়া সিগারেটের টুকরোখানা ফেলে সন্দীপ অঙ্কের খাতাগুলো নিয়ে বসল। হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষার একগাদা খাতা দড়ি দিয়ে বেঁধে টেবিলের ওপর রাখা। ক্লাসের লাস্টবয় সৈকতের খাতাটাই সে সবার আগে বার করেছে। খাতাটা খুলতেই দেখল,একটা একশো টাকার নোট খাতার ভেতর স্টেপল করে দিয়েছে। দেখেই তার সর্বাঙ্গ যেন জ্বলে উঠল। এমনিতেই ক্লাসে ভীষণ চ্যাংড়ামো করে। তার ওপর আজকের এই ধৃষ্টতা দেখে সে গার্গীকে ডেকে বলল—“শুনছো,এদিকে এসে দেখে যাও।” গার্গী আয়নায় বসে চুল আঁচড়াচ্ছিল। মুখটা ঘুরিয়ে বলল—“কি হলো আবার?” সন্দীপ খাতাখানা দেখিয়ে বলল—“দ্যাখো,ঘুষ দিচ্ছে! যাতে এবারের মতো পাশ করিয়ে দিই।” গার্গী ফিক করে হেসে বলল—“ওটা রেখে দাও। দু প্যাকেট সিগারেট হয়ে যাবে।”
—“সেকি গো! তুমি হাসছো!”
—“হাসব না তো কি করব শুনি? তোমার ওই সব ছেলেগুলো কাণ্ডকারখানা দেখলেই আমার হাসি পায়।”
সে গার্গীর কথাগুলো শুনতে শুনতে আবার খাতা দেখতে শুরু করল। গার্গী সারাদিন কাজকর্ম নিয়ে ফ্ল্যাটেই থাকে। রোজ সন্ধ্যের দিক করে টিভি চালিয়ে বাংলা সিরিয়াল না দেখলে তার চলে না। সন্ধ্যেবেলা সন্দীপ স্কুল থেকে ফিরে এসে অন্যঘরে বসে অঙ্কের বই নিয়ে প্রাকটিস করে। ইলেভেনের নতুন সিলেবাসে এখন আবার ম্যাট্রিক্স ঢুকিয়ে দিয়েছে। নতুন নতুন অঙ্ক সমাধান করতে বেশ ভালোই লাগে সন্দীপের। কিন্তু এই খাতা দেখার ঝামেলাটা এলেই ওর চোখে মুখে বিরক্তি ফুটে ওঠে। গার্গী চিরুনিটা রেখে সন্দীপের দিকে চেয়ে বলে—“এই আমায় কেমন দেখাচ্ছে।” সে সৈকতের খাতার দিকে চোখ রেখেই বলে—“ব্লাডিফুল!”
—“কি বললে!” সঙ্গে সঙ্গে চোখ তুলে গার্গীকে এক ঝলক দেখে নিয়ে বলে—“বিউটিফুল!” গার্গী ওর কাছে এসে তর্জনী দিয়ে ওর কপাল থেকে নাক পর্যন্ত আঙুলটা নিয়ে গিয়ে বলে—“পরে খাতা দেখবে।” তারপর ওর জামার কলারটা নিজের দিকে টেনে বলে—“মাস্টরমশাই অনেক বই পড়েছ,এবার আমায় পড়বে এসো।”
সন্দীপ হেসে বলে—“কি হচ্ছে কি গার্গী ছাড়ো। অনেক খাতা বাকি!”
গার্গী বলে—“ধুস্ তোমার মধ্যে একফোঁটা রস-কষ নেই।” সন্দীপ সৈকতের স্টেপল করা ওই একশো টাকাটা ওর হাতে দিয়ে বলে—“এই নাও, এটা দিয়ে লিপস্টিক কিনে নেবে।”
—“থ্যাঙ্ক ইউ।” বলে টাকাটা ব্রেসিয়ারে ভেতরে ঢুকিয়ে গার্গী রান্নাঘরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর দু কাপ গরম চা নিয়ে এসে ঘরে ঢুকে বলে—“র’ চা বানিয়েছি কিন্তু। দুধ চা খেলে তোমার আমার অম্বল হবে।” সন্দীপ বলে—“টেবিলে রাখো।”
—“খাতাগুলো দেখতে কটা বাজবে শুনি?”
—“রাত্তির তো হবেই। এতগুলো খাতা।”
—“সব এক সাথে দেখবে নাকি! অল্প করে করে রোজ দ্যাখো,কমপ্লিট হয়ে যাবে গো।”
—“তুমি শুয়ে পড়ো।” গার্গী একটু গোমড়া মুখে বলে—“হ্যাঁ,আমার তো সখ আহ্লাদ বলে কিছু নেই।” সন্দীপ বিরক্ত হয়ে বলে—“কি চাইছো টা কি!”
—“থাক,তুমি তোমার খাতা,বই নিয়ে থাকো। আমি শুয়ে পড়ছি।”
এই বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে গার্গী। সন্দীপ বোঝে আর তার খাতা দেখা যাবে না। সে খাতাগুলোকে গুছিয়ে রেখে গার্গীর পাশে এসে শোয়। তারপর কাঁধের কাছে হাত দিয়ে নিজের দিকে টানতে যায়। গার্গী এক ঝটকায় নিজেকে সরিয়ে নেয়। সন্দীপ বোঝে এভাবে হবে না। সে ওর কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে—“একটা জিনিস এনেছি। দেবো না।” গার্গীর তাতেও কোনো সাড়া শব্দ নেই। বাধ্য হয়ে বেড সুইচটা অফ করে হাতের ওপর মাথা রেখে শুয়ে থাকে সন্দীপ। এভাবে মিনিট কুড়ি কেটে যাবার পর হঠাৎ গার্গী তার মাথাটা সন্দীপ বুকের মধ্যে রাখে। সন্দীপ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে—“খুব রাগ!” সে বাচ্ছাদের মতো করে বলে—“তুমি আমায় আগের মতো আর ভালোবাসো না।”সে গার্গীর মাথাটা বালিশে রেখে ওর দিকে চেয়ে বলে—“খুলব?”
—“কি?”
—“ওইটা?”
—“কোনটা”
—“ওইটা গো?”
—“কোনটা গো?” সন্দীপ ইয়ার্কি মেরে বলে—“টিভি।”
—“এখন টিভি খুলবে! এক নম্বরের শয়তান লোক।”
সন্দীপ হো হো করে হেসে ফেলে। গার্গী বলে—“স্কুলের বিচ্ছুগুলোর হাওয়া তোমার গায়ে লেগে গেছে।” পুজোর আগে স্কুলের হাফ ইয়ার্লির খাতা দেখানো হবে। সেদিনের রাতের আনন্দের পর সকালে খাতা দেখার সময় সৈকতকে পাশ নম্বর দিয়ে পাশ করিয়ে দিয়েছে সন্দীপ। এক এক করে প্রত্যেকটা খাতা দিতে শুরু করল সে। প্রথমেই ফার্স্ট বয় অনিন্দ্যকে খাতাটা দিয়ে বলল—“এবার কিন্তু একশোয় একশো হল না! ছোট্ট একটা ভুল,দ্যাখ—বাইনমিয়াল থিয়োরিমের অঙ্কটায় স্টেপ জাম্প করেছিস। জয়েন্টে তো ঘ্যাঁচ করে পুরোটা কেটে দিতো।” তারপর যথাক্রমে সেকেন্ড বয়,থার্ড বয় সক্কলকে খাতাগুলো দিয়ে দিল। বাকি রইল সৈকতের খাতাটা। ওর খাতাখানা হাতে নিতেই চমকে উঠল সন্দীপ।
দেখল কেউ যেন ওর দেওয়া 30 নম্বরটা কেটে পাশে 10 লিখে দিয়েছে। সন্দীপ ভালো করে দেখলো, হাতের লেখাটা চিনতে ভুল হলো না তার। সঙ্গে সঙ্গে সৈকতকে বলল—“এক মিনিট দাঁড়া আমি আসছি।” এই বলে ক্লাসের বাইরে বেরিয়ে গার্গীকে কল করল সে। গার্গী ফোনটা রিসিভ করতেই সে বলল—“এটা কি করেছ?” গার্গী ফোনের ওপাড় থেকে বলল—“ঠিকই করেছি। আমি জানতাম সেদিনের ভালোবাসার চোটে তুমি সৈকতকে পাশ করিয়ে দেবে। তোমায় আমি চিনি সন্দীপ। সৈকত এমন কোনো মহান কাজ করেনি,যে ওকে পাশ করিয়ে দিতে হবে। ওর খাতাটা ভালো করে চেক করে ওর প্রাপ্য নম্বরটুকুই দিয়েছি।”
—“সে কি গো!”
—“পক্ষপাতিত্ব করো না সন্দীপ। দেখো অঙ্কগুলো ঠিকঠাকই চেক করেছি। জানোই তো ম্যাথ নিয়ে এম এস সি করেছি,অতটা ভুল দেখব না। আর হ্যাঁ,খাতার ভাঁজে ওর ওই একশো টাকার নোটটা স্টেপল করা আছে,দেখে নিও।”