মিনিবাসটা পিকনিক গার্ডেনের সামনে থামতেই রতন বাবু বাস থেকে নেমে পড়লেন। সন্ধ্যা নামেনি এখনো। পশ্চিমের দিগন্তরেখার উপর বসে সূর্য ঝিমুচ্ছে। খানিক বাদেই ঘুমাতে যাবে। হাতঘড়িটা একবার দেখে নিলেন রতন বাবু। ইস্! পাঁচ মিনিট লেট! কী বেয়াক্কলে কাজটাই না করলেন! আজ তার ফেসবুক ফ্রেন্ডের সাথে প্রথম দেখা হবে। আর তাতেই কিনা লেট করলেন! ইংরেজীতে একটা কথা আছে — ‘ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ দ্য লাস্ট ইম্প্রেশন’। প্রথম চান্স আর দ্বিতীয় বার আসে না। তাই মনে মনে নিজেকেই গালমন্দ করতে লাগলেন।
অনেক জোরাজুরি করে রতন বাবুর কলিগ বিজয় তাঁর একটা ফেসবুক একাউন্ট বানিয়ে দিয়েছিল। প্রোফাইলে নাম দিলেন ‘রনি দাস’। রতন নামটা কেমন সেকেলে, তাই! আর প্রোফাইল ফটো দিলেন ‘অমিতাভ বচ্চনের’। বচ্চন সাহেব তাঁর ‘ফেভারিট এক্টর’ যাকে বলে! একাউন্ট খোলার দুদিন পরেই একটি ‘ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’ এলো। প্রোফাইলে ‘শ্রীদেবী’-র ফটো। নাম ‘লেখা’। তাও আবার দুবার, ‘লেখা লেখা’! কোন টাইটেল নেই। শ্রীদেবী তাঁর প্রিয় নায়িকা। তাই প্রোফাইল ফটো দেখেই রতন বাবু ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে নিলেন। তারপর চলতে লাগলো মেসেঞ্জারে কথা বলা। আজ তাদের প্রথম দেখা হবে।
রতন বাবু হন্তদন্ত হয়ে পার্কের ভিতর ঢুকে পড়লেন। তবে তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ অত্যন্ত সন্তর্পনে ফেলছেন। পরিচিত কেউ দেখে ফেললেই হল— সব খেল খতম! অমল বলে দিয়েছে, চেনা কেউ দেখলে মহিলাটিকে দূর সম্পর্কের বোন বানিয়ে নিতে। এসব ব্যাপারে অমল একেবারে ‘খিলাড়ি’। তাঁর সমবয়সী হয়েও অমল এখনো যুবতী মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করে। এইতো কিছুদিন আগেই ফেসবুক ফ্রেন্ড একটি মেয়ের সাথে দেখা করে এলো। রতন বাবুরও যে নারীসঙ্গের ইচ্ছা জাগত না, তা নয়! তবে লোকলজ্জার ভয়ে এমন উগ্ৰ মনোবাসনা চেপে রাখতেন। এই পার্কে রতন বাবু এর আগেও এসেছিলেন, ছেলের প্রেমলীলা ফাঁস করতে। সমস্ত পার্কের আনাচে-কানাচে খোঁজ করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন সেবার। তবে পার্কটা ঘোরা হয়েছিল। বেশ মনোরম লেগেছিল। তাই এখানেই ডেকেছেন লেখাকে।
চলতে চলতে একবার স্ত্রী শ্রীলেখার কথা মনে পড়তেই পা দুটো টলমল করতে লাগলো। শ্রীলেখাও যৌবনকালে অতীব সুন্দরী ছিল। তার ছিপছিপে গড়ন, টানা টানা চোখ, কাজল কালো একরাশ চুল দেখে তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এখন শ্রীলেখার যৌবন ফুরিয়েছে। শরীরে মেদ জমেছে, চামড়ায় ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে, চুলেও পাক ধরেছে। অথচ রতন বাবুর যৌবন যেন এখনো খানিক অবশিষ্ট আছে। কতইবা বয়স তার! সবেমাত্র আড়াই কাল চলছে। তবুও একটা দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় পরলেন। তিনি কোন অপরাধ করছেন না তো! তক্ষুনি অমলের অমৃত বাণী মনে পড়তেই মনোবল ফিরে পেলেন। এই দেখা করার বিষয়ে প্রথমদিকে রতন বাবু পিছপা হচ্ছিলেন। অমলই তাকে অভয় দিয়ে বলল— ভয় কী হে! তুমি তো আর চুরি করতে যাচ্ছ না। মনে কর ঘরের ডাল-ভাত একঘেয়ে লাগছে, তাই হোটেলে যাচ্ছ বিরিয়ানির স্বাদ নিতে।
কিন্তু তিনি বিরিয়ানিও খেতে চান না। শুধু গন্ধটুকু নিয়েই ফিরে আসবেন ভেবেছেন। দূর থেকেই দেখলেন পার্কের কোণের একটি বেঞ্চে পিছন ফিরে বসে আছে লেখা। রতন বাবুর প্রিয় লাল রঙের শাড়ি পড়েছে। চুলের খোঁপায় বেলি ফুলের গোছা। রতন বাবুই বলেছিলেন। তিনিও লেখার প্রিয় নীল রঙের শার্ট ও ব্ল্যাক প্যান্ট পড়েছেন। লেখা মোবাইল নাম্বার দিতে চায়নি। তাই চেনার সুবিধার্থে এই পথ অবলম্বন করতে হয়েছে। রতন বাবুর হাতে একটি হলুদ রঙের গোলাপ ও চকলেটের প্যাকেট। অমল বলছিল মেয়েরা নাকি চকলেট ও লাল গোলাপ খুব পছন্দ করে। তাই আসার সময় কিনে নিয়েছিলেন। তবে প্রথম দেখাতেই লাল গোলাপটা বাড়াবাড়ি হয়ে যেত! লেখার উদ্দেশ্যটাও ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারেন নি এতদিনে। হয়তো বন্ধু হতে চায়। বিবাহিত কিনা তাও জানা নেই। জানতেও চাননি। পাল্টা প্রশ্ন করলে কী জবাব দেবেন সেই ভয়ে।
লেখার কাছে পৌঁছে পিছন থেকে রতন বাবু একটু ইতস্তত বোধ করে লাজুক স্বরে ডাকলেন— লেখা! প্রথম ডাকে লেখার সাড়া না পেয়ে দ্বিতীয়বার ডাকতে যাবেন এমন সময় লেখা পিছন ফিরতেই নামের আগে ‘শ্রী’ যোগ করে ফেললেন— শ্রীলেখা!… তোতলাতে লাগলেন— তু.. তু.. তুমি! শ্রীলেখাও ভোজবাজি দেখার মত বিস্ময়-বিস্ফারিত চোখে জিজ্ঞাসা করল— তুমি ই রনি! গোধূলি বেলার লালাভ ছটার আলিঙ্গনে দুজনের মুখই রাঙা হয়ে উঠলো।