দুকামরায় বিন্যস্ত ঘরের একটি কামরা জুড়ে রয়েছে নানান রকম ক্যামিকেলের ছোট-বড় বিকার। এদিক ওদিক অবিন্যস্ত ভাবে রয়েছে হরেক রকমের প্রযুক্তিগত মেশিন। কিছুটা জায়গা দখল করেছে পুরোনো- নূতন আবিষ্কার সহ তার রকমারি সাজ সরঞ্জাম। আতঙ্ক স্যারের ছোট্ট দুনিয়া। ইতিমধ্যে কিছু আবিষ্কারে তাঁর নাম-ডাক বাড়লেও সেই অর্থে প্রভাব প্রতিপত্তি হয়নি। তাও তিনি আবিরাম ভাবে চালিয়ে চলেছেন, তাঁর জিনিয়াস মস্তিষ্ক প্রসূত নিত্য নূতন আবিষ্কার। রোজই চলে কিছু না কিছু নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট। আমি মাঝেসাঝে যাই, স্যারের নূতন এক্সপেরিমেন্ট চাক্ষুষ করতে। আমার বন্ধু, চিকু। আতঙ্ক স্যারের নিত্য সঙ্গী। দু’জনে সমবেত ভাবে চালিয়ে যায় তাদের ও তাঁদের নব নব পরিকল্পনা। আমার সে সবে বিন্দু মাত্র ভূমিকা না থাকলেও বেশ ইন্টারেস্টের কারণে স্যারের ডাকে চলে যাই যাদবপুরের এক চিলতে বাড়িতে।
আতঙ্ক স্যারের সাথে পরিচয়, সেই স্কুল জীবন থেকে। নবম শ্রেণিতে আমরা তখন। আমি বরাবরের ফাঁকিবাজ ছাত্রী ছিলাম। উল্টো দিকে চিকু ছিল অসম্ভব মেধাবী। ফাঁকিবাজি তে আমি গোল্ড মেডেল পেলে, চিকুর জন্য বরাদ্দ থাকত মেধার জন্য। আর বিজ্ঞান ! ওই সাবজেক্টে আমি অজ্ঞান। রস কষ বিহীন একটা সাবজেক্ট কোনো কালেই ভালো লাগত না আমার। আমি ছিলাম সাহিত্যের প্রতি দুর্বল। তবুও সেই নবম শ্রেণি থেকেই বিজ্ঞান – সাহিত্যের একটা মেলবন্ধন ঘটে গেছে। যে বন্ধন আজও সুদৃঢ়।
আতঙ্ক স্যারের স্নেহের জায়গাটা আমি আর চিকু দখল করে নিয়েছিলাম। ছোট্ট বড়ো যে কোনো এক্সপেরিমেন্ট সফল হলেই স্যার সমেত চিকু আমায় ডেকে পাঠাত। আমিও যেন অপেক্ষায় থাকতাম সেই ডাকের। স্কুল জীবনে বিজ্ঞান জিনিসটা ভালো না বসলেও, স্যারের আবিষ্কৃত আবিষ্কার গুলি দেখে প্রেমে পড়ে যাচ্ছি দিন দিন। তাই স্যারের ডাক পড়লেই সুদূর দমদম থেকে একছুটে চলে যেতাম স্যারের বাড়ি, যাদবপুর।
ঠিক বিকেল পাঁচটা। অস্থায়ী দোকানটা নিয়ে বসে, সত্য দা। নাগেরবাজার ওভার ব্রীজের শেষ বা শুরু যেখানে, সেখান থেকে এগিয়ে এসে রেমন্ড শপের পাশেই একটা জায়গা দখল করে বসে। এ জায়গা তার চিরস্থায়ী। ঘন্টা দুই কি তিন। অস্থায়ী দোকানের ঝাঁপ ফেলে একটা পরিতৃপ্তিকর হাসি নিয়ে শিস দিতে দিতে রোজ বাড়ি ফিরে যায়, সত্য দা। বিক্রি বাটা যেদিন মন্দ হয়, শিসের ধ্বনি পাল্টে যায়। বৃষ্টির দিন গুলোতে, বিক্রির গ্রাফটা নিম্নমুখী হয়ে যায়।
ম্যাক্সিমাম দিন গুলোয় দোকানে ইট পেটে রাখতে হয়। নাম্বার এর জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এরকমই একটা দিন। ভিড় উপচে পড়ছে সত্যদার দোকানে। আমি রাস্তার রেলিং এ হেলান দিয়ে অরিজিৎ সিং এর গান এ মগ্ন। আমার নাম্বারটা আসতে দেরীই আছে। মুঠোফোন টা বেজে উঠল ফোন ধরতেই চিকুর উত্তেজিত গলা, ‘স্যার একটা দারুন জিনিস বানিয়েছেন। তুই চলে আয়’। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দিল।
এদিকে সত্যদার ডাক পড়ল। আমার নাম্বার এসে গেছে। দোকানের সামনে যেতেই শালপাতার ঠৌঙা ধরিয়ে দিল। বাম হাতের চাপে মাঝখানে ভাঙার শব্দ হ’ল। ঝালঝাল আলু, মটর-ছোলা দিয়ে মাখা। মাঝখানে ভরে, টকটক জলে স্নান করিয়ে আমার পাতায় পড়া মাত্র, সময়ের জন্য অপেক্ষা না করে তিমি মাছের ন্যায় একটা প্রশস্ত হাঁ করে মুখের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে পরম তৃপ্তিতে চোখ বুঝলাম। আহ্লাদে আটখানা হয়ে সত্যদা কে উদ্দেশ্য করে বললাম, ওহ্। কি বানিয়েছো গো সত্য দা। পুরো চুমুর মতো। এই জন্যই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। গপাগপ কয়েকটা সাঁটিয়ে স্যার আর চিকুর জন্য কিছু পরিমাণ প্যাকেজিং করে যাদবপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
নাগেরবাজার থেকে শ্যামবাজার এসে সেখান থেকে যাদবপুর গামী একটি বাসে চড়ে সোজা আতঙ্ক স্যারের বাড়ি। যখন পৌঁছলাম, তখন ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যা সাতটার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। চিকুর হাতে প্যাকেটা দিয়ে স্যার কে শুধোলাম, নূতন কি বানিয়েছেন স্যার? আমাকে একটা মেশিনের কাছে নিয়ে গেলেন স্যার। লাল-নীল আলো জ্বলছে- নিবছে। আগেই বলেছি আমি সাহিত্যের ছাত্রী। স্যারের আবিষ্কার ততক্ষণ বোধগম্য হয় না যতক্ষণ না তিনি বুঝিয়ে বলেন। স্যার কথা শুরু করার পূর্বেই চিকু একটা প্লেটে খাবার গুলো নিয়ে হাজির।
তার থেকে স্যার একটা একটা করে মুখে টপাটপ পুরে সশব্দে শেষ করার পথে। আমি আর চিকু হাঁ করে তাকিয়ে আছি। চিকু যে খায়নি, স্যারের সে হুঁশ নেই। এ হ’ল সত্যদার হাতের যাদু। একসময় স্যার থামলেন। প্লেটে তখন দু’টি মাত্র অবশিষ্ট। তাই দিয়ে চিকু কোনোরকমে মুখভর্তি জল শুকনো করল। খাওয়া শেষে স্যার শুরু করলেন,
-‘এটা একটা টাইম মেশিন। বলতে পারিস টাইম ট্রাভেলার্স। তুই তোর ইচ্ছে মতো যে কোনো সময়ে পৌঁছে যেতে পারবি এটার সাহায্য নিয়ে’। আমি স্যার কে শুধোলাম, এরকম হয় নাকি? আমি চাইলেই সেই সময়ে কি করে পৌঁছে যেতে পারি? স্যার আবার ও……
-‘ ওরে বোকা, তার জন্য তোকে সেই পিরিয়ডের সময় টা এই মেশিনে সেট করতে হবে। ঠিক পৌঁছে যাবি। আমি আর চিকু তো ঘুরে এলাম’। বড়ো বড়ো চোখ করে, আমি নির্লিপ্ত ভাবে বললাম আমাকে ছাড়াই কোথায় ঘুরে এলেন? আমার করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে স্যারের বোধ করি একটু দুঃখ হল। আমাকে নিয়ে যাওয়ার প্রমিস করে বললেন,
-‘ নিউটনের সাথে দেখা করে এলাম’। আমি আবারও প্রশ্নকারী, নিউটন! কি দেখে এলেন? আমার প্রশ্নের উত্তরে আতঙ্ক স্যার,
-‘দেখলাম একটা আপেল গাছের নীচে হেলান দিয়ে বসে কি সব লেখালিখি করছেন। আমি আর চিকু কিছু শুধোবার আগেই টাইম মেশিন এমন বিট্রে করল ফিরে আসতে হ’ল’। মনে মনে বেশ খুশিই হলাম। বাড়ি ফেরার পথে, আতঙ্ক স্যারের থেকে প্রমিস টা পাক্কা করে নিলাম। আমার পচ্ছন্দসই একটা জায়গা নিয়ে যাওয়ার। ততদিনে টাইম মেশিনকে আরও পাকাপোক্ত করা যাবে।
অনেকগুলো মাস কেটে গেছে। আতঙ্ক স্যার আর চিকু ব্যস্ত ছিল মেশিনের যান্ত্রিক গলযোগ নিবারণ কার্যে। ব্যস্ততার দরুন অনেক দিন স্যারের সাথে যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি। ছুটির দিন। বাড়িতে শুয়ে -বসে, বই পড়ে সময় কাটাচ্ছি। বিকেলের দিকে স্যারের কাছে যাবার জন্য, ফোনে স্যার কে জানালাম। কদাপি আপত্তি করেন না স্যার। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। শুধু একটি আদেশ ছাড়া। স্যারের আদেশ পালনে আমি আর চিকু সদা তৎপর।
সেদিন স্যারের বাড়ি থেকে ফিরে আসা ইস্তক ভাবতে বসেছিলাম। কোথায় টাইম ট্রাভল করা যায়। অনেক কিছুই মাথায় আসছে। আবার নিজেই সেসব বাদ দিচ্ছি একের পর এক। একসময় ভাবতে ভাবতে নিজের উপর বিরক্ত হয়ে চিন্তাদের ছুটি দিয়েছি। চিন্তিত মনকে রিফ্রেশ করার জন্য টেলিভিশন এর চ্যানেল গুলো এদিক ওদিক করছি। স্টার গোল্ড চ্যানেলে গিয়ে রোমোটকে বিশ্রাম দিলাম। রঙিন পর্দায় তখন আমার প্রিয় অভিনেতার মুখ। সিনেমা দেখার সাথে সাথে আমার প্ল্যানও রেডি হয়ে গেল। এখানেই যাব আমি। বিকেলে স্যারের বাড়ি যাবার আগে, সত্যদার দোকানে একবার হানা দিলাম। আমাকে দেখেই সত্যদা একগাল হেসে……..
-‘কি ব্যপার তিথি দিদিমণি। এতোদিন আসোনি যে বড়ো’।
মনে মনে ভাবলাম। ফ্রিতে দিলে রোজ আসতাম। সেই কথা মনের মধ্যেই চেপে রেখে প্রতিহাসি দিয়ে ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে দিলাম। সাথে চটপটা চাটনি দিয়ে চটপট কয়েকটি বেঁধে দিতে বললাম। দোকানে ভীড় না থাকার দরুন বাঁধা ছাঁদা করতে বেশী দেরী হল না। আজ একটু বেশী সময় হাতে নিয়েই যেতে হবে। তাই বড়ো কাঁচের বাক্সটাকে ইগনোর করলাম। আমাকে ডাকলেও আমি আজ সাড়া দেবো ই না। যতই মুখ থেকে জল পড়ে রাস্তা ভিজে যাক। তাও না। যতই তারা অনুরাগ করুক আমার ওপর, পরে মানিয়ে নেওয়ার প্ল্যান করে সত্যদার দোকান ত্যাগ করলাম। সময় মতো চারচাকার বাহনগুলি ঝটপট জুটে যাওয়ায় স্যারের বাড়ি পৌঁছতে বেশী সময় নিলাম না। ধূলোর মেকআপ করা পাদুকা জোড়া বাইরে খুলছি। ভেতর থেকে স্যার….
-‘তিথি এলি বুঝি’!
-‘এনেছিসতো’?
ঘরের ভেতরে ঢুকে স্যারের মুখের সামনে তুলে ধরলাম প্যাকেট টা। আগের মতোই চিকু কিচেনের জন্য বরাদ্দ জায়গা থেকে ভরা প্লেটটা স্যার কে এগিয়ে দিল। তবে এবার আর ভুল হয়নি চিকুর। আগের থেকে নিজের জন্য আর আমার জন্য গোটা কয়েক সরিয়ে রাখল। এখন স্যার কে কোনোভাবেই বিরক্ত করা যাবে না। তাই দু’জনে এক কোনে দাঁড়িয়ে আছি। তার আগে অবশ্য সাঁটিয়েছি আমরাও। স্যারের খাওয়া শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষায় আছি আমি আর চিকু। একটার পর একটা চাটনি মাখিয়ে মাখামাখি করা রাউন্ড বল গুলো স্যার পরম তৃপ্তিতে গলধঃকরন করছেন। ওভারের শেষ বলটা ছোঁড়া হতেই, আমি বলে উঠলাম স্যার। আমার কাছে একটা লাল্লনটাপ প্ল্যান আছে। স্যার কিছু বলার আগেই কথাটা পাল্টে দিলাম। ওকথা স্যারের কর্ণগোচর হওয়া মানে, আমার কানের নীচে পাঁচটি আঙুলের ছাপ জ্বলজ্বল করত। আমি কথা ভাঁজার আগেই, স্যার ধরলেন…..
-‘কতদিন পর জিভের স্বাদ খানিক পরিবর্তন হল’।
-‘এরকম মাঝে মাঝে’
স্যার মাঝপথে কথা থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আবারও বললেন,
-‘ তিথি। তোর টাইম যান তৈরী। বল কোথায় যেতে চাস’।
টেলিভিশনে যেদিন থেকে ‘যোধা আকবর’ দেখেছিলেম সেদিন থেকেই দৃদৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। এখানেই যাব। আমার হাজারো প্রশ্ন নিয়ে। সেই মতো স্যার কে জানালাম আমার মনের সুপ্ত ইচ্ছে। আইনস্টাইন এর মতো খোঁচা খোঁচা সাদা-কালো চুল গুলোয় আঙুল চালিয়ে কি একটু ভেবে বললেন,
-‘ এখানেই যাবার অভিমত হল কেন তোর’?
মিহি সুরে উত্তর দিলাম, না মানে ইয়ে আকবর রূপী হৃত্বিক রোশনকে দেখার পর থেকে মনটা ওই দিকেই পড়ে আছে স্যার। আমার কথায়, আতঙ্ক স্যারের ঠোঁটেও এক চিলতে হাসি ফুটল। প্রথমটা ভেবেছিলাম, স্যার বুঝি বকা দেবেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে স্যার আমাকে ভুল প্রমাণিত করে সহমত জানাতেই, একবার মনে মনে ‘এক পল কা জিনা’ গানটায় নেচে উঠলাম। মনে তখন গিটার বাজছে। আরও কিছু দিনের সময় চেয়ে নিয়ে স্যার আমাকে বিদায় জানালেন।
মনে একরাশ উত্তেজনা নিয়ে স্যারের বাড়ি থেকে ফিরছি। আমরা পাড়ি দেবো সেই ১৫০০ শতকের দিকে। টাইম ট্রাভেলার এ করে একঝটকায় পৌঁছে যাব মোঘলদের দরবারে। উফফ! কি সাংঘাতিক ব্যপার ঘটতে চলেছে। যা এতদিন ইতিহাসের পাতার পর পাতা জুড়ে পড়েছি! সেই জায়গা চাক্ষুষ করতে যাচ্ছি। কিছু দিনের অপেক্ষা। কদ্দিন যাবৎ অঝোর কেঁদে চলেছে আকাশ। ন্যাপকিনও সেই জল মুছতে পারছে না। বাড়িতে বসে বিরক্ত হচ্ছিলাম। সাথে মনটাও বিষন্ন ছিল। খারাপ আবহাওয়ার জন্য আমাদের যাত্রা স্থগিত হয়ে যায়। রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনের অপেক্ষায় বসে আছি। গালে হাত। কবি সুকান্তের মতো পোজ।
মুড ভালো করার একটাই দাওয়াই। সত্যদার হাতের তৈরী রাউন্ড রাউন্ড বল। বৃষ্টির মধ্যেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য সত্যদার দোকান। এই বৃষ্টির মধ্যেও সত্যদা কে দেখে মন-প্রাণ সব জুড়িয়ে গেল। সত্যদা ও আমাকে দেখে বিগলিত হল বৈকি। দোকানে মাছি তাড়ানোর থেকে একটা দুটো খদ্দের এলে যে কোনো দোকনদারের মুখের হাসি একটু চওড়া হয়ে যায়।
সত্যদা কে অনুরোধ করলাম। আলু মাখা, টক দই; লাল চাটনি; ঝুরি ভাজা দিয়ে গোল গোল ছোট্ট বলগুলো ভরে দিতে। একটি প্লেটে সাজিয়ে আমার মুখের সামনে এগিয়ে দিল, সত্যদা। আমার মনে তখন আর একটি গান বাজছে,‘আমারও পরাণ যাহা চায়। তুমি তাই। তুমি তাই গো’। মনে মনে অবিশ্যি রবি ঠাকুরের থেকে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছি।
বেশ করে সাঁটিয়ে উদরপূর্ণ করে, প্রশান্তমনা হয়ে; বিজ্ঞদের মতো সত্যদা কে কমপ্লিমেন্ট দিচ্ছি। এমনসময় মুঠোফোনে ঝংকার ধ্বনি বেজে উঠল।
ওপ্রান্তে চিকুর গলা। স্যারের তলব আগামীকাল।
পরদিন সকালে কাকতালীয়ভাবে আকাশের ঘনঘটা কেটে গিয়ে সূর্যি মামার হাসিমাখা মুখ দেখা গেল। দীর্ঘশ্বাস পড়ল একটা। আশার আলো ফুটল মনে। অপচয় করার মতো সময় হাতে নেই। সকালেই বেরিয়ে পড়লাম, আতঙ্ক স্যারের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
স্যারের বাড়ি পৌঁছে দেখলাম। টাইম মেশিনের কাছে বসে স্যার কি সব করছেন। কাছে এগিয়ে গেলাম। স্যার একবার মুখটা তুলে আবারও নামিয়ে নিয়ে জানিয়ে দিলেন,
-‘আজই আমরা টাইম ট্রাভেল করব’।
স্যারের কথা মতো আমি আর চিকু রেডি। আমার আর চিকুর কোমরে একটা বেল্ট দিয়ে বেঁধে দিলেন। নিজেও কোমরে বেল্ট বাঁধলেন। মেশিনের উপর চড়ে বসলাম তিনজনে। স্যার একবার ডানহাতের বুড়ো আঙ্গুল টা উঁচিয়ে আমাদের দিকে দেখালেন। আমরা মাথা নেড়ে সায় দিতেই, স্যার একটা সুইচ টিপে দিলেন।
তীব্রতার সাথে এগিয়ে চলেছি আমরা।মিনিট কয়েকের অভিযানের পর একটা শুকনো খটখটে জায়গায় আমরা অবতরণ করলাম। চারিদিকে শুধু বড়ো বড়ো স্তম্ভ। তিনজোড়া পা একটু একটু করে এগিয়ে চলেছে। রাস্তায় সেই অর্থে জনপ্রাণী নজরে পড়ছে না। একটু এগিয়ে যেতেই একটা ঘোড়ায় টানা এক্কাগাড়ি চোখে পড়ল। গাড়ির মালিক সামনে এগিয়ে আসতেই, আতঙ্ক স্যার জিজ্ঞাসা করলেন আকবরের মহলের ঠিকানা। লোকটা দায়িত্ব করে টাঙ্গায় চড়িয়ে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে দিলেন।
আকাশচুম্বী প্রস্তরখণ্ড দেখে, চক্ষু ছানাবড়া হবার জোগাড়। যা সব ইতিহাসের পাতায় পড়েছি, আজ তার নৈসর্গিক সৌন্দর্য চাক্ষুষ করছি। চারিদিকে নাম না জানা হরেক রকমফুলের বাগান। গাছগাছালিতে ভর্তি পুরো রাজ্য।
আমাদের তিনজন কে ঘোরাঘুরি করতে দেখে একজন ষন্ডা মার্কা লোক আমাদের কাছে এগিয়ে এল। বাজখাঁই গলায় প্রশ্ন করল,
-‘কৌন হো তুম লোগ’?
ভাঙাচোরা হিন্দিতে আতঙ্ক স্যার উত্তর দিলেন,
-‘হামলোগ কোলকাতা থেকে আয়া হ্যায়’।
অবাক চোখে লোকটা আবারও প্রশ্ন করল,
-‘ ইয়ে কৌনসি জাগা হ্যায়’?
আবার আতঙ্ক স্যার,
-‘এটা একটা জাগা হ্যায়। যো পশ্চিমবঙ্গমে পড়তা হ্যায়’।
প্রচন্ড রেগে গিয়ে ষন্ডামার্ক লোকটা,
-‘মজাক করতা হ্যায়’?
-‘চলো জাঁহাপনা কে দরবার মে’।
বলেই টানতে টানতে আমাদের নিয়ে চলল।
দরবারে প্রবেশ করতেই আমাদের চোখ আরও ধাঁধিয়ে গেল। রাজদরবার জুড়ে বসে আছেন কত মানুষ। মধ্যমণি একজন। যাঁর শরীর সিংহাসনে শোভা পাচ্ছে। চোখে মুখে দিপ্তী ঠিকরে পড়ছে। তাঁদের বেশ ভূষার সাথে আমাদের বেশভূষার আকাশ পাতাল ফারাক।সিংহাসন ত্যাগ করে সেই মূর্তি এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। যত সামনে এগিয়ে আসছে, আমার বুকের ধুকপুক আওয়াজ টা তীব্রতর হচ্ছে। এগিয়ে আসছে আমার স্বপ্নের নায়ক।
এগিয়ে আসতেই আমার মাথা ঘুরে গেল। এ তো হৃত্বিক রোশন নয়। তবে কে? ভাবতে ভাবতে প্রশ্ন করেই ফেললাম, কৌন হো আপ? আমার প্রশ্নে পুরো রাজদরবারে হৈচৈ পড়ে গেল। ষন্ডামার্কা লোকটা উচ্চস্বরে বলল,
-‘ আজ্ঞা হুজুর’।
-‘ইসকা শির ধড় সে আলাগ……’
প্রচন্ড পৌরুষের অধিকারী সেই মূর্তি হাত তুলতেই পুরো রাজদরবার পিন ড্রপ সাইলেন্ট। আমাকে তাক করে বললেন,
-‘ ম্যায় হুঁ……..’
এইরকম একটা গম্ভীর অবস্থা ও আমাকে চুপ করে রাখাতে অক্ষম। বলেই ফেললাম, ম্যাঁয় হুঁ না হামনে দেখি হ্যায়। বহত বার।
দূর্দন্ডপ্রতাপের মূর্তি কোনোরকম রাগ প্রকাশ না করে বলে উঠল,
-‘ ম্যায় হুঁ ইঁহা কা বাদশাহ……’
বাদশাহ এক হি হ্যায়। ও হ্যায় হামারা শাহরুখ খান। আমার কথায় সেই ষন্ডা মার্কা লোকটা আমাকে এই মারতে যায়। সিংহাসন থেকে নামা লোকটার হাত তুলে বাধা দেওয়ার কারণে থেমে যায়। এরপর কিছুটা শাহরুখ এর ইস্টাইলে দু’টো হাত দু’দিকে বিস্তৃত করে, লোকটা বলে ওঠে…..
-‘ম্যায় হুঁ জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবর’।
অনেক বাগ্বিতন্ডা, তর্ক-বিতর্কের পর আমাকে বিশ্বাস করানো গেল। ইনিই সেই সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক। আকবর। সাহিত্যের ছাত্রী বলে, পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ; প্রমাণ ছাড়া কি করে মেনে নিই! এই লোকটাই সেই আকবর। যাঁর কারণে ইতিহাসে আমি কম নাম্বার পেয়েছিলাম। উনি কবে কী করে গেছেন! কোথায় যুদ্ধ করেছেন! আমি কেন সে দায় নেব মনে রাখার? এসব করার সময় আমাকে জিজ্ঞেস করে করেছিলেন? তাই আমিও সুযোগের সদ্ব্যবহার না করে পারলাম না। যতই হোক আতঙ্ক স্যারের ছাত্রী তো। বাজিয়ে দেখে নিলাম, আদৌ জিনিসটি সঠিক কিনা। যদি চীনের মতো ঠকিয়ে দেয়।
স্বয়ং আকবর আমাদের তিনজনের আপ্যয়ন এর দায়িত্বে থাকলেন। চারিদিকে চকমকি পাথরের কারুকার্য করা বিশাল বিশাল স্তম্ভ। দেওয়াল জুড়ে অবস্থান করছে নানান রকমের অয়েল পেন্টিং। একের পর এক সেগুলির সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন, স্বয়ং বাদশাহ। একপ্রকার আপ্লুত আমরা। গোটা রাজপ্রাসাদ ঘুরে দেখে আমরা একটু ক্লান্তি বোধ করছিলাম। একটু বিশ্রাম দরকারি বুঝে আকবরের কাছে আর্জি জানালাম।
একটি বিশালাকার ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনটি বিশালাকৃতির পালঙ্ক। সারা ঘর জুড়ে চিত্রকলার উপস্থিতি আকবরের শিল্পী সত্বার পরিচয় বহন করছে। আমি, আতঙ্ক স্যার, চিকু বসে বসে গল্প করছি। এমন সময় জনা পাঁচেক দাসী পাঁচটি বড়ো বড়ো থালা নিয়ে আমাদের কক্ষে প্রবেশ করলেন। নানান রকম মোঘলাই খাবারের সাথে হরেকরকম ফল। থালার যা সাইজ! দু’টি থালা রেখে বাকি গুলি ফেরত পাঠালাম আমরা। পরম তৃপ্তিতে খেয়ে প্রশস্ত পালঙ্ক গুলিতে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিলাম সবাই।
ঘুম ভাঙতেই, প্রবেশকারী বাদশাহ কে দেখে তিনজনেই উঠে বসি। তাঁর পিছু পিছু অনেক নারী-পুরুষ শরীরের প্রবেশ। তিনজন এর ওর দিক চাওয়া চাই করছি। পরম মমতার সাথে বাদশাহ বলে উঠলেন,
-‘এঁরা আমার পরিবার’।
আকবরের মুখে বাংলা শুনে প্রথমটা ঘাবড়ে যাই তিনজনেই। উনিই জানালেন, ভারতে থাকতে থাকতে একটু বাংলা জেনেছেন বৈকি। সব তো আর ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকে না। এবার আমি আর চিকু ইশারায় চোখাচোখি করলাম। মনে মনে পরস্পরে আশ্বস্ত হলাম, আতঙ্ক স্যারের ভাঙাচোরা হিন্দি আর শুনতে হবে না ভেবে।
একে একে সবার সাথে পরিচয় পর্ব সারা চলছে। বেশী কেউ না। মাত্র জনা চৌদ্দ পত্নী আর জনা আষ্টেক সন্তান। চৌদ্দ জন পত্নীর বারো জন পরিচয় পর্ব সেরেই অন্দর মহলে বিদায় নিলেন। ভালো ভাব জমল জোধাবাই এবং রুকাইয়া সুলতানা বেগমের সাথে। একসময় তিনিও বিদায় নিলেন।
আটজন সন্তান, হাসান, হুসাইন; জাহাঙ্গীর; মুরাদ; দানিয়েল; আরাম -বানু-বেগম; শাকার-উন-নিসা-বেগম এবং শেহজাদী খানুমের মধ্যে শুধুমাত্র ছোট্ট জাহাঙ্গীরের সাথে আমাদের জমল ভালো। একসময় জাঁহাপনা আকবরের রাজদরবারে ডাক এলে তিনিও প্রস্থান করলেন। এখন আমরা পাঁচজন মিলে গল্প করছি। গল্পের মাঝেই একটি আর্জি করে বসলাম, জোধাবাই এর কাছে। রাতের খাবারের পাতে যদি একটু বিরিয়ানী পড়ে! এককথায় রাজী হয়ে তিনি আমাদের আর্জি রাখার প্রতিশ্রুতি দিলেন।
মোঘল দরবারে খানাপিনা- আয়েশ করার পর বেশ ফুরফুরে লাগছে। পরিবর্ত হিসাবে আমরা যদি কিছু না করি সেটা মনুষ্য ধর্মের চরম অকৃতজ্ঞতার পরিচয় বহন করবে। সেটি হতে দিতে পারিনা আমরা কেউ ই। ফুল পরিবেষ্টিত বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আতঙ্ক স্যার কে বলে উঠলাম, স্যার সত্য দাকে আনা যায় না কোনো ভাবেই? আমার প্রশ্নের উত্তরে স্যার, কিছুটা উত্তেজিত হয়েই বললেন….
-‘যায় না মানে’?
-‘আলবাৎ যায়’।
পরদিন জাঁহাপনা আকবরের থেকে চিকু আর আতঙ্ক স্যার বিদায় নেবার জন্য আদেশ প্রার্থনা করল। আমি এখানে থাকব সেটা আলাপ আলোচনার পর ঠিক হয়েছিল। সত্যদার ঠিকানা সমতে সমস্ত রকম বিবরণ, আতঙ্ক স্যার কে দিয়ে রেখেছিলাম। ওদের ফেরত আসার কথা শুনে জাঁহাপনা, সেনাপতি মান সিংহ কে সবরকম ব্যবস্থা করার জন্য আজ্ঞা দেন। তা নিষ্প্রয়োজন জেনে, বাদশাহ কারন জানতে চাইলে…আতঙ্ক স্যার রাজদরবারে সবার সমক্ষে তাঁর আবিষ্কার টি তুলে ধরে বিস্তারিত বর্ণনা করেন। এসব শুনে, সবার চক্ষু ছানাবড়া।
আতঙ্ক স্যারের সাথে চিকুর বিদায় নেওয়ার পর নিজেকে একটুও একলা মনে হয়নি এখানে। রাজদরবারে, আকবরের নবরত্ন সভার সবার সাথে পরিচয় পর্ব সেরে ফেলেছি ইতিমধ্যে। বেশ কিছুদিন ধরে নিজেকে সম্রাজ্ঞী মনে হচ্ছে যেন। নবরত্ন সভায়, রাজা টোডরমল, তানসেন; বীরবল; আবুল ফজল; কবি ফৈজি; আব্দুল রহিম খান; ফকির আজিওদ্দিন; সেনাপতি মানসিংহ এবং মোল্লা দো পিঁয়াজা প্রমুখের সাথে আমার জন্যও একটি আসন সংরক্ষিত হয়েছে। একসময় ইতিহাস যেভাবে আমাকে চোখের জলে, নাকের জলে করিয়েছে আজ তার মিষ্টি প্রতিশোধ তুলছি মনে হচ্ছে। আহা। কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।
আতঙ্ক স্যার-চিকুর আসার আগেই কতকগুলি মনোরম কাজ সেরে নিয়েছি। বীরবলের থেকে একটি গল্প শুনেছি। সেনাপতি মানসিংহের সাথে ঘোড় সওয়ার করেছি। তানসেন এর থেকে হেঁড়ে গলায় কিভাবে বাথরুম সিঙ্গার হওয়া যায় সে বিদ্যা রপ্ত করেছি। কবি ফৈজির থেকে বেশ কিছু আরবি ভাষায় কবিতা শুনেছি। যার বিন্দু মাত্র বোধগম্য হয়নি আমার মোটা মাথায়। ওদিকে জোধাবাই এর প্রিয় পাত্রী হওয়ার কারণে রোজ রাতে খাবার পাতে বিরিয়ানীর ব্যবস্থা করে ফেলেছি। যা আমিনিয়া বা আর্সেনালের থেকে শতাধিক সুস্বাদু।
বেড়ে কাটছে দিনগুলি। কিন্তু সেই দিনগুলি আর সোনার খাঁচায় রইল না বেশীদিন। আতঙ্ক স্যার, চিকু; সত্যদা এসে পৌঁছেছে। সর্বকালের মহান সম্রাট আকবরের মোঘল রাজদরবারে। আতঙ্ক স্যার কে দেখে একটু মনখারাপ হলেও, সত্যদা কে দেখে মুখের হাসি চওড়া হয়ে গেল। সত্যদার হাতে ধরা কাঁচের বাক্স দেখে, দিল পুরা গার্ডেন গার্ডেন হো গয়া। একটি জায়গায় সত্যদা তার বাক্স টা নামিয়ে রাখল। সাথের জিনিস পত্র গুলোও। সত্যদা কে দেখে অন্দরমহল থেকে সবাই ছুটে এলেন। সত্যদার সাথে সবার পরিচয় করিয়ে দিলাম। সবার নজর কাঁচের বাক্স টার দিকে। কি যেন একটা অদ্ভূত জিনিস। দাররক্ষী উচ্চস্বরে জানান দিল,
-‘জাঁহাপনা আকবর পধার রহে হ্যায়’। শুনেই সবাই সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছেন সম্রাট। যেখানে আমরা সবাই দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানে এসে স্থিত হলেন। আতঙ্ক স্যার কে তাক করে,
-‘এসব কি এনেছেন’?
-‘সাথে কে’?
-‘এই আপনার গুরুত্ব পূর্ণ কাজ’! আতঙ্ক স্যার কাঁপা গলায় বললেন,
-‘আজ্ঞে হুজুর। এটা সামান্য ভেট আমাদের তরফ থেকে আপনাদের জন্য’।
-‘কিসের ভেট’? বাদশাহের প্রশ্নে এবার আতঙ্ক স্যার, মনে যতটা সাহস আনা যায় এনে বললেন,
-‘আজ্ঞে আপনাদের আন্তরিকতার’।
-‘আপনাদের আতিথেয়তার’।
আমি আর চিকু স্যারের পাশে এগিয়ে গেলাম। স্যার কে সাপোর্ট করে আমরা দু’জন একই কথা বললাম। ওদিকে সত্যদা ফ্যালফ্যাল করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। সবার বেশভূষা দেখে যৎপরোনায় অবাক। কোথায় এসে পড়েছে বুঝে উঠতে পারছে না। এমন সময় বাদশাহ আকবর আবারও বলে উঠলেন,
-‘ ভেট পেশ কিয়া যায়ে’।
সত্যদার কাছে আমরা তিনজন এগিয়ে গেলাম। ফিসফিসিয়ে বললাম, তুমি ইতিহাসের যুগে এসে পড়েছো সত্য দা। এমন একটা ইতিহাস রচনা করে দাও যাতে মোঘলরা তোমার রচিত ইতিহাস ভুলতে না পারে। কি বুঝল সত্যদাই জানে। সব সাজসরঞ্জাম নিয়ে প্রথমে একপ্লেট দই ফুচকা আকবরের সম্মুখে পেশ করা হল। কিভাবে খাবেন বুঝে উঠতে না পেরে আমি আর চিকু সামনে গিয়ে ইশারায় দেখিয়ে দিলাম। একটা মুখে পুরতেই দু’চোখ বন্ধ করে চিবিয়ে চলেছেন। গপাগপ করে পরের গুলোও শেষ করে আদেশ দিলেন,
-‘সবকে লিয়ে পেশ কিয়া যায়ে’
এর মাঝে আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন এই অপূর্ব লোভনীয় খাবারের নাম। সবার হাতে আমি আর চিকু শালপাতার ঠোঙা ধরিয়ে দিয়েছি। সত্যদা একের পর এক ফুচকার মধ্যে আলু মাখা ভরে তেঁতুল জলে চুবিয়ে সবার পাতায় দিয়ে চলেছে নিরলসভাবে। জোধাবাই এর কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, সুস্বাদু না? মুখ ভর্তি ফুচকা নিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
এরপর একে একে নবরত্নের কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম গোলাকাকৃতি বলের স্বাদ সম্পর্কে। কেউ কোনো উত্তর না দিয়ে খেতেই ব্যস্ত। মাথা নাড়া ছাড়া কোনো উত্তর নেই। একসময় বীরবল আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন। তথ্য সমেত আমি তাঁকে জানালাম, এটিকে বলে পানিপুরি বা গোলগপ্পে। এর প্রেমে যে একবার পড়েছে দই ফুচকা, টক জল ফুচকা, চুড়মুড়, লাল চাটনি দিয়ে ফুচকা। সবাই তৃপ্তি ভরে খেয়ে সত্যদার ইয়া বড়ো কাঁচের বাক্স নিমিষে খালি করে দিল। আরও আব্দার হয়েছিল খাবার। কিন্তু টাইম ট্রাভেলের সময় ফুরিয়ে আসায় আমাদের ফিরতে হয়েছিল। সত্যদার সুস্বাদু ফুচকার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার হয়েছিল, মোঘলদের রাজসভায়। পরিবর্তে মিলেছিল প্রচুরপরিমাণ উপঢৌকন। আমরা ফিরে আসার সময়, আকবর-জোধাবাই এর চোখের কোনে চিকচিক করে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল ফুচকা প্রেম তাঁদের ছিন্ন হল। তাঁদের সবার নজর, সত্যদার কাঁচের বাক্সটার দিকে।
ওঁদের করুণ মুখ দেখে প্রথমে আমার একটু খারাপ লাগলেও পরে মনে মনে ভেবেছিলাম। তোমাদের ইতিহাস মনে রাখার সময় আমারও ঠিক এরকমই করুণ অবস্থা হয়েছিল। একদিন তোমারা ইতিহাস রচনা করেছিলে। আজ আমার যে ফুচকার ইতিহাস টা রচিত করে গেলাম। সে তোমরা কস্মিন কালেও ভুলতে পারবে না! একে বলে মধুর প্রতিশোধ।মোঘলদের থেকে পাওয়া উপঢৌকন থেকে কিছু অংশ সত্যদা কে দেওয়া হয়েছিল। সেই দিয়ে সত্যদা একটা স্থায়ী দোকান কিনেছে। দোকানের নাম রেখেছে ‘ আকবরের দরবার ‘। পরে সত্যদাকে সব বিস্তারিত বলায়, সবটা বুঝতে না পারলেও কিছুটা বুঝেছিল।
প্রাপ্ত উপঢৌকনের কিছু পরিমাণ দিয়ে, আতঙ্ক স্যার একটা থ্রি বি এইচ কে ফ্ল্যাটবাড়ি সমেত একটি ল্যাবরেটরি বানিয়েছেন। বাকিটা গচ্ছিত আছে পরবর্তী এক্সপ্ররিমেন্টের জন্য। ফিরে আসা ইস্তক আমি আর চিকু সেই স্বপ্নের রাজ্য থেকে নিজেদের বের করতে পারিনি। দু’জনে তখনো বুঁদ সেই ঐতিহাসিক কাহিনীর মধ্যে। দু’জনে এটা ভেবে আরও উৎফুল্লিত। যে ইতিহাস আমাদের একটা সময়ে নাকানি চোবানি খাইয়েছে, সেখানে আমরা ফুচকার ইতিহাস রচনা করে এসেছি। অবশ্যই আতঙ্ক স্যারের আবিষ্কৃত ‘টাইম মেশিন’ এ ট্রাভেল করে। আর দ্বিতীয়, সত্যদার হাতের তৈরী ফুচকার জাদু দিয়ে। দু’জনের কাছেই আমরা কৃতজ্ঞ। দু’জনে মিলে চিন্তায় বুঁদ হয়ে আছি। মুঠোফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে আতঙ্ক স্যারের নামটা ভেসে উঠছে। লাউড স্পিকারে দিলাম।
-‘ আর একবার টাইম ট্রাভেল করবি নাকি’?
-‘জোধা-আকবর তো দেখে এলি’।
-‘যাবি নাকি শাহজাহান -মুমতাজ কে দেখতে’? বলাই বাহুল্য আমি আর চিকু উত্তেজিত। আবার একটা ঐতিহাসিক ভ্রমণের হাতছানি।