কিছুদিন আগে জানতে পারলাম, আমার বাবা নাকি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। বিষয়টা শুনলাম করিম চাচার কাছে। যেদিন এ কথাটা জানতে পারলাম, সেদিন থেকে বাবার প্রতি অসম্ভব ঘৃণা কাজ করছে। সকলের কাছে গর্ব করতাম যে বাবাকে নিয়ে, সে বাবা আজকে আমায় সকলের সামনে ছোট করে দিল। এখন বাসা থেকে বের হতে গেলে লজ্জা লাগে, পাছে কেউ জিজ্ঞেস করে, তোর বাবার নাকি বিয়ে করেছে? তা তোর সৎ মাকে কি তোদের বাড়ি নিয়ে আসবে নাকি রে? ব্যাপারটা একদমই ভালো করে নাই তোর বাবা। দেখতে তো অনেক সাধাসিধে লোক বলে মনে হয়। তা এমন কাজ যে করবে, সেটা কি কারো ধারণা ছিল??? লোকলজ্জা আমার কাছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার। গরীব হতে পারি, কিন্তু একজন ভালো মানুষ হিসেবে সমাজ থেকে পাওয়া সম্মানটুকু খোওয়াতে পারিনা। আর আমার বাবা কিনা সেই কাজটিই করে বসলেন।
লজ্জায় মাকে এ কথা জিজ্ঞেস করার সাহস নেই যে মা বাবার বিয়ের ব্যাপারে জানেন কিনা। বাবার টাকায় কেনা খাবার খেতে আমার যেন কেমন দম বন্ধ লাগছে। মাকে ছেড়ে এখান থেকে কোথাও যাওয়ার সাহসও নেই আমার। ভয় হয়, যদি বাবা তার দ্বিতীয় বউকে বাসায় এনে মাকে অত্যাচার করে। যদিও আজ পর্যন্ত বাবাকে কখনো কারো সাথে উচু গলায় কথা বলতেও দেখিনি, অত্যাচার তো দূরের কথা। কিন্তু এখন তো তা করতে পারে। যে লোক মাকে ছেড়ে আরেকটা বিয়ে করতে পারে, সে সবই পারে। সন্ধ্যায় বাবা ছোট ভাইকে দিয়ে আমায় ডেকে পাঠালেন। বুঝতে পারছিলাম না, যাবো কি না। অবশেষে মা এসে বললেন, ‘তোমার বাবা ডাকছে তোমায়।
গিয়ে দেখো কেন ডাকছেন তিনি।’ মায়ের চোখে মুখে তাকিয়ে দেখলাম, কেমন যেন শান্ত শান্ত একটা ভাব। যেন এ পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ তিনি। মায়ের কথা শুনে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। এখনও কত সম্মান বাবার প্রতি তার। মা হয়তো বাবার বিয়ে প্রসঙ্গে এখনও কিছু জানেন না। মার চোখের দিকে আর তাকানোর সাহস আমার নেই। তাই তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে পরি। বাবার রুমে গিয়ে দাঁড়াতেই বাবা বললেন, আমার কাছে এসে বসো শোভন। ঘৃণায় আমার দম ফেটে যাচ্ছিল, বললাম, যা বলবার বলুন আপনি। এখানে দাঁড়িয়েই সব শুনছি। বাবা বললেন, নিশ্চয় রাগ করে আছো। ব্যাপার না। কিন্তু যে কথাগুলো তোমায় না বললেই নয়, আজকে সে কথাগুলোই তোমায় বলবো, সময় একটু বেশি লাগবে। বুঝতে পারলাম বাবা তার দ্বিতীয় বিয়ে সম্পর্কে কথা বলবেন।
তাই বাবার সামনে রাখা চেয়ারটায় বসে পড়লাম। বাবা শান্ত গলায় বললেন, এই কথাগুলো শোনার অধিকার তোমাদের অনেক আগেই হয়েছিল। কিন্তু তোমাদের উপর সমাজের কোন খারাপ প্রভাব পড়ুক সেটা আমরা চাই নি। তাই তোমাদের কিছু বলা হয়নি। এখন তোমার বয়স উনিশ হয়েছে। ভালো মন্দ বিচার করার বয়স হয়েছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, সময়টা এখন এ কথাগুলো বলার অনুকূলে। আমি বললাম, এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা না বলে, আসল কথাটায় বলে ফেলুন না। বাবা মৃদু হাসলেন, বললেন, শোভন, তুমি যাকে আমার দ্বিতীয় বউ ভাবছো, সে কিন্তু আমার দ্বিতীয় বউ না। শুনে ভড়কে গেলাম আমি, তারমানে কি বাবা আরো বিয়ে করেছেন! বাবা আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারলেন। তিনি বললেন, সে আমার প্রথম স্ত্রী। এ কথা যেন আমার মাথার উপর দিয়ে গেলো। আমি বললাম, প্রথম স্ত্রী মানে!
বাবা বললেন, হ্যা। ওর নাম উর্মি। খুব ভালো মেয়ে। আমি যখন চাকরির জন্য ঢাকা আসি তখন ওর সাথে আমার পরিচয়। কলিগ ছিলাম আমরা দুজন। একসাথে চলাফেরা করতাম, সব কাজ একসাথে করতাম। দুজন দুজনকে পছন্দ করে বিয়েও করি। সংসার সব দিক দিয়ে ঠিক ছিল, কিন্তু আমাদের কোন সন্তান ছিলো না। এজন্য আমার কোন আফসোস বা অতৃপ্তি ছিলো না। প্রথমে তোমার দাদু আমাকে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে উর্মিও এ বিষয়টা নিয়ে অনেক সিরিয়াস হয়ে পরে৷ সে বলে, দুজন দুজনকে ভালোবাসলাম, সংসার করলাম সাত বছর, ঠিক আছে, কিন্তু সন্তান ছাড়া তো আর চলে না। তুমি দ্বিতীয় বিয়ে করো। আমি রেগে যেতাম, বলতাম, পৃথিবীর সবাইকে সৃষ্টিকর্তা সবদিক দিয়ে সুখী করেন না৷ একটা অসুখ তার থাকবেই। তোমার আমার জন্য সন্তানের অসুখ। কিন্তু আমার জন্য তুমি ছাড়া আর কিছু চাই না। তারা আমার কথায় কান দিতো না।
একদিন তোমার দাদু খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমাকে আর উর্মীকে গ্রামের বাড়িতে ডেকে পাঠান, বাড়িতে এসে দেখলাম, তোমার দাদু মৃত্যসজ্জায় শুয়ে আছেন। উনি আমাকে কাছে ডাকলেন, বললেন, মৃত্যুর আগে নাতী নাতনীর মুখ দেখতে পারলাম না৷ কিন্তু আমি চাই, আমার একটা নাতী নাতনী থাকুক৷ মরার পরও কবরে যে আলো জ্বেলে দিয়ে আসবে৷ তুই আমার এই কথাটা রাখ, বাপ-মা মরা এই মেয়েটাকে তুই বিয়ে করে উদ্ধার কর। মেয়েটারও একটা গতি হলো, সাথে তোরও ছেলে-পুলে হলো। উর্মির সাথে কথা হয়েছে আমার, সে বড় ভালো মেয়ে৷ এ বিয়েতে তার কোন আপত্তি নেই। আমি উর্মির দিকে তাকালাম। পানিভরা চোখে মুখে হাসি এনে সেও মাথা নেড়ে সায় দিল। একজন মৃত্যপথযাত্রীর কথা উপেক্ষা করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা কাউকেই দেননি। সেদিনই তোমার দাদু মারা গেল৷ এক সপ্তাহ পর তোমার মায়ের সাথে আমার বিয়ে হলো।
বিয়ের প্রথম প্রথম তোমার মাকে নিয়ে আর উর্মিকে নিয়ে ঢাকার বাসায় থাকতাম। উর্মি কখনো তোমার মাকে সতীন হিসেবে দেখেনি। নিজের আপন বোনের মতো ভালবাসা দিয়ে তাকে ভরে রাখতো৷ যেদিন তুমি জন্মগ্রহণ করলে, সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল উর্মি। সারাদিন তোমার আর তোমার মায়ের যত্ন নিতো। কিন্তু তোমার বয়স যখন ৫ মাস, তখন উর্মি বলে যে সে আমাদের সাথে থাকবেনা। প্রথমে আমি ভয় পেয়ে গেলাম, কিন্তু পরে সে বুঝালো, শোভন বড় হয়ে যখন বুঝবে তার দুই মা, তখন তার মনের অবস্থা কেমন হবে, তার প্রতি তোমার অনুভূতির কথা চিন্তা করে সে দূরে থেকেই তোমাদের ভালেবাসা শ্রেয় মনে করলো।
যেন সমাজ তোমার উপর আঙ্গুল তুলে কথা বলতে না পারে। তারপর থেকে তোমার মায়ের সাথেই বেশি থাকা হয়। কেননা এটা উর্মির আবদার ছিল। মাসে একবার গিয়ে উর্মিকে দেখে আসি। আর প্রতি মাসে তোমাদের জন্য যেসব খাবার, কাপড় চোপড় নিয়ে আসতাম, সবকিছু উর্মি নিজ হাতে কিনে দিতো। সৃষ্টিকর্তা তাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন শুধু অন্যকে সুখী রাখার জন্য। নিজের সুখ সে বুঝতো না। যদিও তার ঋণ কোনদিন শোধ করার মতো না, তবুও যদি তোমার মনে হয় যে, তোমার সৎমা, একজন ভালো মানুষ। তাহলে তুমি তাকে গিয়ে মাঝে মাঝে দেখে আসতে পারো। অনেক খুশি হবে সে।
বাবার কথা শুনে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল৷ এখন নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে। বাবা তো তার ভালোবাসা, তার জীবনকে সেক্রিফাইজ করেছেন আমাদের দুই সন্তানের সুখের জন্য। আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম, বললাম, বাবা, প্লীজ আমাকে মাফ করে দাও। আমি তোমাকে ভীষণ ভুল বুঝেছি। বাবা আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, বোকা ছেলে। তোমার রাগ হওয়া তো স্বাভাবিক ছিল৷ যেহেতু তুমি কিছু জানতে না। কিন্তু আমি আর তোমার মা ভয়ে ছিলাম, ব্যাপারটা তুমি কিভাবে নিবে। যাক এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হতে পারলাম।
সেদিন রাতে আমার ভালো ঘুম হয়নি৷ আমাদেরকে পৃথিবীতে আনার জন্য যে মহিলা নিজের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিলেন, তাকে দেখার জন্য মন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। না দেখেই তাকে আমি ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি। তাই সকাল হতে না হতেই বাবার রুমে গিয়ে বললাম, বাবা, আমি উর্মি আন্টিকে দেখতে চাই। বাবা মা দুজনই খুব খুশি হলেন। বাবা, মা, ছোট ভাই, আমি চারজনই রওয়ানা দিলাম পৃথিবীতে বিদ্যমান এক জীবন্ত ফেরেশতাকে দেখার জন্য৷ যাকে মা বলে ডাকলেও যেন তার যথার্থ মর্যাদাটুকু দেওয়া হবে না।
গল্পের বিষয়:
গল্প