মেন্টাল হসপিটালের এক চিলতে ঘরে বাইরের এক ফালি আলো এসে মুখে পড়তেই ঘুম ভাঙল অবিনাশের। গত সাত দিন থেকে এটাই ওর ঠিকানা। বেডের পাশে মেঝেতে একটা থালা তে দুটো শুকনো রুটি পড়ে আছে। কেউ হয়তো দিয়ে গেছে সকালে। এখন রোদের তেজ দেখে মনে হচ্ছে সকাল দশ টা বেজে গেছে। যদিও সঙ্গে কোন ঘড়ি নেই। অবশ্য পাগলের আবার সময় জ্ঞান! তবে ওর মনে হয় এক টা বাজতে বেশ দেরি আছে। কারণ একটা বাজলে তো করবীই আসবে।
বিছানা থেকে নেমে ভাঙা কাঁচের জানলা টার কাছে দাঁড়াল ও। কাঁচের ফলাটা বড়ই তীক্ষ্ণ। পরিষ্কার দেখা না গেলে ও শরীরের ক্ষত গুলো কিন্তু তাতে পরিষ্কার বোঝা যায়। ও তবু ফলাটার উপরের ধুলোর আস্তরণ টা একটু পরিষ্কার করে নিল। যাতে গত কালের ক্ষত গুলো একটু পরিষ্কার দেখা যায়। ওষুধ দিতে হবে। না হলে সেপটিক হয়ে যাবে। অবশ্য একই জায়গায় একই ক্ষত বার বার হলে তাতে তো আস্তে আস্তে পচন ধরবেই। কত আর ওষুধ দেওয়া যায়! ও দগ দগে জায়গা গুলো তে তুলোয় করে ওষুধ লাগিয়ে দরজার সামনে টাতে এল। দরজার বাইরে একটা গ্রীল গেট। তাতে তালা দেওয়া। যাতে ও বাইরে আসতে না পারে। কর্তৃপক্ষ ওর ঘরের দরজার উপর “বিপজ্জনক” কথা টা লিখে গেছে। তাই ওর ঘরে আর কেউ থাকে না। ও একাই থাকে। খাবার দেবার সময় গ্রীল আর দরজার নিচের ফাঁকাটা দিয়ে খাবার ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ওর সামনে কারোর আসা মানা।
অথচ ও তো সত্যিই পাগল না। ওকে যে বাড়ির লোক পাগল সাজিয়ে রেখে গেছে, তাও না। ক দিন আগেও ওর একটা বাড়ি ছিল। পরিবার ছিল। ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী কে নিয়ে ভরা সংসার ছিল। বেশ সম্পন্ন পরিবার ওরা। বাড়ি, গাড়ি, এমনি কি নিত্য নতুন নারীর কোন টার ই অভাব ছিল না দুশ্চরিত্র অবিনাশের। কিন্তু নিজের কৃতকর্মে হঠাৎ ই এই পরিণতি ওর। আর এর থেকে কোন ও দিন ই নিষ্কৃতি নেই ওর।
মারা যাবার পর দিন থেকেই নিয়মিত দুপুর একটা তে করবী আসে। গত কাল ও এসে ছিল। ওর হাতের তীক্ষ্ণ নখ ওকে ফালা ফালা করে দিয়েছে কাল। শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকেই গাদা গাদা মাংস খাবলা খাবলা তুলে নিয়েছে করবী। রক্তে ভেসে গেছে ওর গেঞ্জি, পাজামা। সব চেয়ে খারাপ অবস্হা পুরুষাঙ্গের। যত আক্রোশ যেন ওখানেই! ভাঙা কাঁচের সামনে ও নগ্ন হয় দাঁড়াল। ওকে এখন একটা পিশাচ মনে হয় নিজের ই।
অথচ ওকে যখন করবী আক্রমণ করে, কেউ কিন্তু করবী কে দেখতে পায় না। সবাই তখন ভাবে ও পাগল। না হলে নিজের শরীরে কেউ নিজে আঁচরায়, কামড়ায়? তাই পাগলা গারদে আসা টা অবশ্যম্ভাবী ছিল ওর কাছে। কিন্তু কাউকে ও বোঝাতে পারে না। করবী ওর উপর ভর করলে ওর শরীরের উপর আর ওর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ গুলো করবীর দ্বারা সঞ্চালিত হয়।
করবীর মৃত্যুর পর যে কদিন ও বাড়িতে ছিল, তখন ও প্রতি দিন দুপুর এক টার সময় করবী আসত। এখানে আসার পর ও আসে। এক গভীর প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধ স্পৃহা নিয়ে ও আসে। চোখে থাকে পাশবিক উল্লাস। আর তার পর ফালা ফালা করে দিতে থাকে ওকে। ও কোন প্রতিরোধ ই গড়ে তুলতে পারে না। যখন ও বাড়ি তে থাকত, তখন অবশ্য ছেলে বা বৌ ওকে বাঁচাত। ওর হাত, পা দড়ি দিয়ে বেঁধে দিত। তার পরেও অবশ্য এক পাশবিক শক্তির সাহায্যে ও দড়ির বাঁধন মুক্ত করত। তার পর নিজের শরীরের উপর ই চালাত এই ভয়ঙ্কর অত্যাচার। আসলে ও কিছু করত না। সব করবীই করাত ওকে দিয়ে। বাড়ির লোক বুঝতেই পারল না, করবীর মৃত্যুর পরদিন থেকেই কেন এই আচরণ অবিনাশের!
এখানে এক ডাক্তার বাবু দিনে এক বার করে এক টার অনেক আগেই আসেন। সঙ্গে দু জন গার্ডকে নিয়ে। ওরা ওকে চেপে ধরে থাকে। তবেই ডাক্তার দেখার সাহস পায়। ওর ঘা তে মলম লাগায়। ওর নখ কাটার ব্যবস্থা করে দেয়। তার পর একটা দড়ি দিয়ে বাঁধার ব্যবস্থা করে যায় যাবার আগে। ওরা ও বুঝতে পারে না, কিভাবে ও বাঁধন মুক্ত হয়ে যায়! নখ না থাকলেও প্রতিদিন ওর শরীর কিভাবে ফালা ফালা হয়ে যায়! ও অনেক বার বলার চেষ্টা করে ছিল, যে ও পাগল না। কেউ একজন ওর শরীরে ভর করে। তার পরই ও হিংস্র হয়ে যায়। কিন্তু কেউ শেষ পর্যন্ত ওর কথা বিশ্বাস করল না। এমন কি ডাক্তারও না। অথচ কাউকে করবীর নাম করে ও বলতেও পারে না। পাছে পুলিশ ওকে গ্রেপ্তার করে। এখন অবশ্য মনে হয়, জেল খানা আর পাগলা গারদের মধ্যে সেরকম কোন ফারাক নেই। তবে এই শাস্তি টা হয়তো ওর প্রাপ্য ই ছিল। করবীকে যে কষ্ট টা ও দিয়েছিল, তুলনা করলে এই শাস্তি টা যথেষ্ট উপযুক্ত মনে হয় ওর।
করবী ওর শালী। প্রচণ্ড শিক্ষিতা, মার্জিত আর রুচি শীলা। বছর খানেক আগে সবে ওর বিয়ে হয়েছিল। তার পর কয়েক মাসের মধ্যেই হঠাৎ এক দিন এক মর্মান্তিক বাইক দুর্ঘটনা তে স্বামী, স্ত্রী হাসপাতালে ভর্তি হয়। স্বামী কে বাঁচানো সম্ভব হয় নি। কিন্তু করবী কোমা তে থেকেও বেঁচে যায়। অবশ্য সে বাঁচা মরে যাবার থেকে ও ভয়ঙ্কর। মেরুদণ্ডে আর শরীরের নিচের অংশে গুরুতর চোট পাওয়া তে পুরো নার্ভাস সিস্টেম অকেজো হয়ে যায় ওর। চির দিনের মত অসার হয়ে যায় সারা শরীর। চলে যায় বাক শক্তি। চলে যায় হাত, পা নাড়ানোর সামান্য ক্ষমতাও। হসপিটাল থেকে অবশেষে জ্যান্ত লাশ হয়ে ফিরে অবিনাশের বাড়িতে হয় ওর শেষ ঠিকানা।
করবীর প্রতি বরাবর ই তীব্র লোভ ছিল দুশ্চরিত্র অবিনাশের। ওকে ছোঁয়া আর ভোগ করার অদম্য বাসনা থাকলেও নিজের সম্মান আর পরিবারের কথা ভেবে ওকে ওর ভাবনা স্থগিত রাখতে হয়। কিন্তু সুযোগ যে শেষ পর্যন্ত বাড়ি বয়ে চলে আসবে, তা কোনও দিন কল্পনা করে নি অবিনাশ। তাই সেদিন যখন বাড়ি শুদ্ধ সবাই নিকো পার্ক গেল। ও মাথা যন্ত্রণার নাম করে পড়ে থাকল। তারপর ধীরে ধীরে নিজের কাম চরিতার্থ করার জন্য এগিয়ে গেল। ও জানে করবীর কোন প্রকার প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই। তাই অবিনাশ খুব নিশ্চিন্তে ওর সারা শরীর টাকে নিয়ে খেলা করল। করবী শুধু পলক হীন অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে লোলুপ অবিনাশ কে দেখছিল। হাতে সময় নিয়ে পুরো কাম ক্রীড়া শেষ করে অবিনাশ এক সময় উঠে দাঁড়াল। নিপুণ হাতে ঠিক করে দিল করবীর অবিন্যস্ত পোশাক। কোথায় ও কোন চিহ্ন রাখল না ও। দেওয়াল ঘড়ি টা এক বার দেখল ও। বেলা একটা বাজে। শরীরে আর মনে এক অদ্ভুত তৃপ্তি। এত সহজে যদি যৌনতা মেটানো যায়, তবে পয়সা খরচ করে বাইরে যাবার কি দরকার? হঠাৎ করবীর চোখের দিকে চোখ পড়তেই দেখল করবী কাঁদছে। ও মনে মনে হাসল এবার।
— নে, যত খুশি কাঁদ। কারোর বাপের সাধ্য নেই, কিছু বোঝে। যদি না হঠাৎ প্রেগনেন্ট হয়ে পড়ে করবী। তার পর যখন মনে পড়ল যে করবীর জরায়ু ও মারাত্মক জখম ছিল। তখন নিশ্চিন্ত হয়ে বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরায় ও। ও খেয়াল করে নি, কখন যেন করবীর নির্বাক দৃষ্টি তে জল শুকিয়ে প্রতিশোধের ঝিলিক দেখা গেছে।
এর কিছু সময় পরই বাড়ির লোক ফিরে আসে। আর সবাই কে অবাক করে পরদিন ই করবী মারা যায়। ডাক্তারের কথায় এটা ওর মতন পেশেন্টের কাছে খুব ই সাধারণ প্রত্যাশিত ঘটনা। কোথাও কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
খুব নিশ্চিত হয় অবিনাশ। অবিনাশের অবশ্য খুব আফসোস হয় করবী মরে যাওয়া তে। ও যদি আর কদিন বাঁচত, তবে ভাবনার মাঝে ডাক্তার আর তার সহকর্মী রা এল। সারা শরীর চেক করল। ওষুধ পত্র গুলো ও ঠিক ঠাক ও দিয়েছে কিনা দেখে, তারপর ওকে বেঁধে চলে গেল। কারণ একটা বাজতে আর দেরি নেই। এর মধ্যে ডাক্তার রাও জেনে গেছে ওর কেস হিস্ট্রি। একজন গার্ড বাইরে অপেক্ষা করল। ওর ক্ষেপামো হলে ওকে আটকাবার জন্য। ও শুনল, ডাক্তার বের হবার সময় যেন বিরক্ত হয়ে কাউকে বলছে, — এরকম উদ্ভট রোগী আমি জীবনে দেখি নি। প্রতিদিন ঠিক দুপুর একটা তে ওর ক্ষেপামো জেগে ওঠে। তখন গায়ে যেন অসুর ভর করে!
ডাক্তারের কথায় অবিনাশ মনে মনে হাসল। আসল সত্য টা যদি ডাক্তার জানত। তবে সে ডাক্তারির বদলে ওঝা বা গুনিন নিয়ে আসত। ডাক্তার রা চলে যেতেই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে করবী এল। ও এলে সর্ব প্রথম ওর হাত গুলো জেগে ওঠে। আজকে ও উঠল। মুহূর্তে বাঁধন গুলো পট পট করে খুলে গেল। ও দেখল আঙুলের নখ গুলো ক্রমশ সূচালো হয়ে গেছে! প্রথমে ওর ডান হাতের কব্জি টা খামচে ধরল। তারপর ছাড়াতে না ছাড়াতে দুটো গালে পর পর নখ গুলো চালিয়ে দিল। মুহূর্তের মধ্যে রক্তাক্ত করে দিল ওর মুখ। তার পর চেপে বসল ওর গলায়। ওর যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে!
— ছাড় আমাকে করবী, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে! — তুমি ছেড়েছিলে সেদিন আমাকে? যে আজ আমি তোমাকে ছাড়ব? — কর্কশ কণ্ঠে করবী বলল।
ততক্ষণে দরজা খুলে গার্ড দৌড়ে এসেছে। কিন্তু কোন প্রতিরোধ গড়ে তোলার আগেই অবিনাশের লাথি (আসলে করবীর) আছড়ে পড়ল গার্ডের বুকে। সে ছিটকে দরজার বাইরে পড়ল। সে দিকে তাকিয়ে করবী গর্জন করে উঠল।
— আজ আর কেউ তোমাকে বাঁচাবে না অবিনাশ বাবু। তুমি হয়তো ভুলে গেছ, যে আজ আমার শ্রাদ্ধ। হয়তো আর কিছুক্ষন পর আমার অস্তিত্ব চিরদিনের মত শুধু ফটোকেন্দ্রিক হয়ে থাকবে। তাই যা করার আজ ই করতে হবে। এর পর আমার হাতে আর সময় থাকবে না। দুটো হাতের আঙুল সাঁড়াশির মতন ওর গলা তে চেপে বসছিল অবিনাশের। ওর সমস্ত শক্তি দিয়েও তার বাঁধন আলগা করতে পারল না ও। তবু ও ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, — আমাকে ছেড়ে দাও করবী। এই কদিন তো আমি অনেক কষ্ট পেয়েছি। আর কেন?
একটা অট্টহাস্য করে করবী ওকে ধাক্কা মেরে মেঝেতে ছুড়ে ফেলল। একটা কর্কশ, অপার্থিব হাসি ওর গলা দিয়ে বেড়িয়ে এসে বলল, — সে দিন আমাকে দেখে তোমার এত টুকু দয়া হয়েছিল, যে আজ আমার হবে? হিংস্র পশুর মতন আমার যন্ত্রণাক্লিষ্ট শরীরের উপর তোমার লালসা মিটিয়েছ! আজ তোমার দিন শেষ অবিনাশ। কথা টা বলেই অবিনাশ উঠে দাঁড়াল। তারপর জানালার কাছে গিয়ে ভাঙা কাঁচ টা ফ্রেম থেকে বার করে নিজের পুরুষাঙ্গ টা কেটে উপরে ফেলল। তারপর মেঝেতে পড়ে যন্ত্রণা তে ছটফট করতে লাগল। পরক্ষণেই রক্তাক্ত শরীর নিয়ে ফের উঠে দাঁড়াল। তারপর কাঁচের ধারালো ফলাটা দিয়ে নিজের গলার নলি টা বিচ্ছিন্ন করে দিল। তারপর অসহ্য যন্ত্রণা তে টিকটিকির কাটা লেজের মতন ছটফট করতে করতে এক সময় স্থির হয়ে গেল। আর উঠল না।