একজন লেখকের মৃত্যু

একজন লেখকের মৃত্যু

ময় এখন প্রায় বিকেল চারটে। পশ্চিমাকাশে ঘন কালো মেঘের সমাবেশ। এই সময় টা কবি, সাহিত্যিক দের। কারণ আকাশে, বাতাশে লেখার রসদ প্রচুর। পশ্চিমের বারান্দা তে একটা চেয়ারে বসে ছিল অনিরুদ্ধ সরকার। টেবিলের উপর কাগজের রাশি।নাম করা রহস্য গল্পের লেখক। এই বৃষ্টি আসার আগের সময় টুকু ওনার বড়ই প্রিয়। গল্পের প্লট ভাবতে ভাবতে ই মালতী চা নিয়ে এল । সঙ্গে একটা ফ্লাক্স। ওতে ও চা রয়েছে। কারণ লিখতে লিখতে সন্ধ্যা গড়াবে। রাত হয়ে যাবে, তবু ও লেখা থামবে না। এর মধ্যে মেঘের গর্জন শুরু হয়ে গেল। সাথে প্রবল বৃষ্টি। চোখ বুঝে তা উপভোগ করেছিলেন অকৃতদার অনিরুদ্ধ। কিন্তু এত রসদও কোন নতুন প্লটের জন্ম দিচ্ছিল না। এক সময় পিছন থেকে মেয়েলি ডাকে তার ভাবনার ছন্দপতন হল। কে? — প্রবল বিস্ময়ে তিনি পিছন ফিরলেন। একজন বছর পঁচিশ – ছাব্বিশের মহিলা! উদভ্রান্ত চেহারা। অগোছাল চুল কপালের দুপাশ থেকে ঝুলছে। সিঁথির সিঁদুর লেপ্টে গেছে। দু চোখে যেন প্রতি হিংসার আগুন জ্বলছে! কে আপনি? এখানে কিভাবে এলেন? — বিস্ময়ে চেয়ার থেকে পড়ে যাবার মতন অবস্থা হল অনিরুদ্ধের।

— সেকি, আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি সোহিনী।
— কে সোহিনী? — চেয়ার খানা সোজা করে নিয়ে অনিরুদ্ধ জিজ্ঞাসা করল।
— আপনার এক গল্পের নায়িকা। যাকে আপনি বাঁচতে দেন নি । খুন করেছিলেন গলা টিপে।
— মানে? কি যা তা বলছেন? আমি খুন করেছি?

— হ্যাঁ, হ্যাঁ আপনি। আপনি ইচ্ছা করলে আমাকে বাঁচতে দিতে পারতেন। আমি তখন সাত মাসের প্রেগনেন্ট! একটু কষ্টও হল না আপনার?

— দেখুন আমি আপনাকে সত্যি চিনতে পারছি না। আমার সব গল্পই তো কাল্পনিক। তার সঙ্গে বাস্তবের মিল থাকতে পারে। কিন্তু…

— থামুন আপনি। আপনি একজন খুনী। অনিরুদ্ধ ক্রমশ ঘেমে উঠল। চোখে অবিশ্বাসের চাহনি।

— আচ্ছা কোন গল্প বলুন তো? আমার শতাধিক লেখার হাজারো চরিত্রের নাম আমার পক্ষে মনে রাখা সম্ভব না।–
মহিলার ভয়ঙ্কর দৃষ্টি সামলে কোনমতে কথাগুলো বলল ও।
— আপনার “সোনালী বৃত্ত” গল্প টা মনে আছে নিশ্চয়ই?
— সোহিনী একটা চেয়ার টেনে অনিরুদ্ধের মুখোমুখি বসল। অনিরুদ্ধ কিছুক্ষন ভেবে বলল, — হ্যাঁ মনে পড়েছে। কিন্তু সোহিনী গল্পের নায়িকা, কিন্তু কি করে বাস্তবে জীবন পায়?

— মনে রাখবেন অনিরুদ্ধ বাবু, সমাজের বিভিন্ন ঘটনা ই কিন্তু কাহিনী হয়ে লেখকের কাছে ধরা দেয়। আমি ও তাই। সোহিনী অনিরুদ্ধর নিরুত্তর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন চুপ করে রইল। ওর চোখ দুটো জলে ভেজা। তা আঁচল দিয়ে মুছে বলল, — আচ্ছা এবার বলুন তো আমাকে মারলেন কেন? কাহিনী তো অন্যরকম ও হতে পারত?

— বিশ্বাস কর সোহিনী গল্প টা আমার আর সঠিক মনে নেই। ওটা আমার লেখক জীবনের শুরুর লেখা। হয়তো গল্পের প্রয়োজনেই তোমাকে মারতে হয়েছিল। অনিরুদ্ধর কথায় সোহিনী নিশ্চুপ হয়ে রইল। ইতিমধ্যে বৃষ্টি থেমেছে। একটা কোলাহল দূর থেকে শুনতে পাচ্ছে অনিরুদ্ধ। কিছুক্ষনের মধ্যেই তা ওর বাড়ির নিচে এস থামল। এক সঙ্গে হাজারো মানুষের আর্তনাদ! তারা উপর দিকে তাকিয়ে কি যেন বলতে চাইছে।

— ওরা কারা সোহিনী? — চেয়ার থেকে উঠে দেখতে গিয়ে মাথাটা টলে গেল অনিরুদ্ধর। গা টা খুব পাক দিচ্ছে।
— হা হা হা — সোহিনী যেন হেসে গড়িয়ে পড়ল। মুখের বিবর্ণতা মুহূর্তে উধাও।

বুকে একটা জ্বালা অনুভব করল অনিরুদ্ধ। বুকে হাত চেপে চোয়াল শক্ত করে বলল, — তুমি হাসছ কেন? নিচে ওরা কারা?

— ওরাও আমার মতন অভাগা আর অভাগী, যাদের আপনি গল্পের প্রয়োজনে হত্যা করেছেন নির্বিচারে। আজ সবাই তাই প্রতিশোধ নিতে এসেছে।

–প্রতিশোধ? কিন্তু কেন? মুখ থেকে কিছু টা রক্ত উঠে এল অনিরুদ্ধর।

— হত্যার শাস্তি হত্যা। আজ আপনার দিন শেষ মিস্টার অনিরুদ্ধ সরকার। সবার পক্ষ থেকে তাই আমি আপনাকে হত্যা করতে এসেছি। — সোহিনীর চোখে মুখে এক নারকীয় উল্লাস। শরীর টা দুমরে মুচরে গেল অনিরুদ্ধের ভিতর থেকে । সারা শরীর এখন জ্বলছে।

— হা হা হা — সোহিনী হঠাৎ হাসি থামাল। তারপর অনিরুদ্ধর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, — যে চা টা কিছুক্ষন আগে খেয়েছেন, তাতে আমি নিজের হাতে বিষ মিশিয়েছি । আপনি আমাকে মালতী ভেবেছেন। আজ আপনার খেলা শেষ মিঃ অনিরুদ্ধ। শেষ কথা গুলো হয়তো আর শুনতে পেল না অনিরুদ্ধ। তার আগেই চোখ দুটো স্থির হয়ে গেল। দু চোখে যেন এখনও অপার বিস্ময়। এই অবধি লেখার পর অমরেশ ব্যানার্জীর মনে হল গল্প টা মন্দ হবে না। বড় গল্প তো কেউ পড়তে চায় না। তাই যত ছোট লেখা যায়, তত ই পাঠক বাড়ে। যদিও তার পাঠক সংখ্যা অগণিত। বাস্তবে তখন সত্যিই মেঘ করেছে। এখন ই বৃষ্টি শুরু হবে। পশ্চিম দিকের বারান্দা তে বসে ফ্লাক্সের থেকে চা ঢালল কাপে। কিছুক্ষন আগে ভৃত্য মন্টু চা বানিয়ে দিয়েগেছে। মনে একটা ভারি তৃপ্তি। বহুকাল আগে কোন এক বাঙালি লেখকের কল্পনার চরিত্র জেগে উঠে তার সঙ্গে প্রেম করেছিল। তার নাম মনে পড়ল না অমরেশের। কপি করা সে কোন দিন পছন্দ করে না। তার লেখা স্বতন্ত্র। ভাবনার মাঝেই পিছনে পায়ের শব্দ পেয়ে চমকে গেলেন। ঘুরে বসলেন তিনি। একজন মাঝ বয়স্ক ভদ্রলোক তার সামনে।

— কে আপনি? কিভাবে এলেন এখানে? — বিস্ময়ের ঘোরে চায়ের কাপ থেকে কিছুটা চা ছলকে পড়ল লেখার উপর।
আগন্তুক হাসল। — সে কি, আমাকে চিনতে পারলেন না? আমি অনিরুদ্ধ সরকার। কে অনিরুদ্ধ? আমি তো আপনাকে চিনি না। — অমরেশ লেখাটা ভিজে যাওয়ার প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হল।

— বা রে, কিছুক্ষন আগেই আমাকে নিয়ে গল্প লিখলেন। আর এর মধ্যে সব ভুলে গেলেন?
— কি বাজে কথা বলেছেন? আমার লেখা চরিত্র জ্যান্ত হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে? ইয়ার্কি পেয়েছেন? সত্যি করে বলুন কে আপনি?
— চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল অমরেশের।
— ইয়ার্কি তো আপনি মারছেন। যদি অনিরুদ্ধ সরকারের লেখনী জ্যান্ত হতে পারে, তবে আপনার টা কেন হবে না?
— আশ্চর্য! আপনি আমার গল্প টা পুরো টাই জানেন দেখছি। আপনি কি মন পড়তে পারেন?
— না পারি না। আর তার দরকার ও নেই। কারণ আমি আপনার সৃষ্টি। লেখক যখন পড়বে, তখন তো আমি তাদের কাছে জীবন্ত হয়েই থাকব, তাই না? যাক, অদরকারী কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাই না।

— অনিরুদ্ধ একটা চেয়ার টেনে বসল মুখোমুখি।
—যত সব ফালতু কথা। এখন বলুন, কি জন্য এসেছেন? আমার হাতে ও সময় কম।
— আপনাকে শেষ করতে? অনিরুদ্ধর চোয়াল শক্ত হল। কথাটা শুনে চেয়ার থেকে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল অমরেশ।

— কি? আমার ডায়লগ আমাকে শোনাচ্ছেন! আচ্ছা যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেই, যে আপনি সত্যি সত্যি আমার গল্পের চরিত্র। তাহলেও কি কারণে আমাকে মারতে এসেছেন?
— একই কারণে। যে কারণে আমাকে মরতে হয়েছিল। — অনিরুদ্ধর কথা তে হঠাৎ অমরেশ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল।
— আপনার অনেক ভাট বকা এতক্ষণ সহ্য করছি। এবার মজা বুঝবেন। কোন ভণিতা না করেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অনিরুদ্ধর মুখে ঘুষি ছুড়ল ও। কিন্তু কাকে মারল ও? ঘুষি টা তো অনিরুদ্ধর মুখ ভেদ করে চলে গেল! এ যেন একটা ধোঁয়ার মূর্তি!

— নিজের চোখ কেই বিশ্বাস করতে পারল না ও। এ কি করে সম্ভব!
— কি ভাবছেন? আমার মুখে ঘুষি লাগল না কেন? কি করে লাগবে? মৃত মানুষের কি কোন সলিড শরীর থাকে? হা হা হা অনিরুদ্ধর হাসি টা ওর কাছে অসহ্য লাগল অমরেশের। বাইরে একটা কোলাহল যেন ক্রমশ এগিয়ে আসছে। ওরা কারা? — নিজের মনেই প্রশ্ন জাগল ওর।

— ওরা সবাই আপনার তৈরি চরিত্র। –ওর মনের কথা জেনে বলল অনিরুদ্ধ। তারপর নিচের দিকে তাকিয়ে বলল– তবে আজ ওরা সবাই মৃত। আপনি ওদের আপনার খেয়াল খুশি মতন যখন, তখন মেরেছেন। আজ সবাই প্রতিশোধ নিতে এসেছে। আমি ওদের প্রতিনিধি। — কথা বলতে বলতে অনিরুদ্ধর অবয়ব টা আবার যেন চেয়ারে বসে পড়ল।

— কিন্তু আমি তো সব গল্পের প্রয়োজনে করেছি। ইচ্ছা করে….
— থামুন আপনি। — অমরেশ সাফাই গাইতে যেতে অনিরুদ্ধ থামিয়ে দিল।
—ইচ্ছা করলেই গল্পের মোড় ঘোরানো যেত। — অনিরুদ্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এর মধ্যে ই বৃষ্টি শুরু হল প্রবল ভাবে। বাষ্প কণা তে চারদিকে ধোঁয়াসা হয়ে গেল। মাথা টা বন বন করে ঘুরতে লাগল অমরেশের। বুকে তীব্র জ্বালা অনুভব করল ও। মাটিতে বসে পড়ল ও।

— হা হা হা, কি বুঝছেন অমরেশ বাবু? বিষের ক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। তাই না?
— বিষ! বিষ কোথা থেকে আসবে? — অমরেশ অনেক কষ্টে কথা টা বলল।
— কেন, আপনি জানেন না? এ হল সেই বিষ যা সোহিনী আমাকে আপনার নির্দেশে খাইয়েছিল। আমি এক কাপ খেয়েছি চা এর সঙ্গে। আর ফ্লাস্ক এর টা নিয়ে এসেছি আপনার জন্য। মৃত্যু যন্ত্রণা প্রবল ভাবে উপলব্ধি করল অমরেশ। কোন মতে বলল, — কিন্তু চা টা তো মন্টু দিয়েছিল!

— মন্টু না আমিই দিয়েলগেছি। আপনি কল্পনার জগতে ছিলেন বলে ধরতে পারেন নি। হা হা হা হাসতে লাগল অনিরুদ্ধ। চোখে সফল হবার পরিতৃপ্তি। অমরেশ একবার ওঠার চেষ্টা করল। পারল না। মুখ থেকে একগাদা রক্ত গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। কয়েক বার কেঁপে শরীর টা স্থির হয়ে গেল। দু চোখে তখনও অপার বিস্ময়। লেখার পাতা গুলো সব এলো মেলো হয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। কলম টা ও গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। আর কোন দিন কোন অহেতুক মৃত্যুর গল্প রচিত হবে না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত