একটা দমকা বাতাশে ঘুম ভেঙে গেল। ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। এখন রাত প্রায় বারোটা। অন্তত নার্সিংহোমের ইলেকট্রনিক দেওয়াল ঘড়ি টা তাই বলছে। পর্যাপ্ত আলোও রয়েছে ঘরে। এটা একটা নন এসি কেবিন। পাশাপাশি দুটো বেড রয়েছে। এই পাশে আমি। আর ঐ পাশে রহিম চাচা। রহিম চাচা গত কাল ভর্তি হয়েছে।
ফ্যান দুটো দিব্যি দুলতে দুলতে ঘুরে চলেছে। বাইরের বারান্দা দিয়ে ও বেশ জোরে হাওয়া বইছে। পর্দা টা উড়তে উড়তে বেড অবধি চলে আসছে। বাথরুমের দরজার দিকে তাকাতে হৃত স্পন্দন দ্রুত তর হল। কোন এক অদৃশ্য হাত যেন হ্যান্ডেল টা ঘোরাচ্ছে! দরজা টা একটু ফাঁকা হয়ে বন্ধ হতেই ভিতরে জল পড়ার শব্দ! কে ভিতরে? আমার সমস্ত ভয় পেটের ভিতর থেকে এক লপ্তে উঠে এল চিৎকার হয়ে। কোন জবাব পেলাম না। মিনিট খানেক পর দরজার হাতল টা আবার ঘুরল। একটা বুটের আওয়াজ! ভয়ে আমার তখন সারা শরীর কাঁপছে। নিস্তব্ধ ঘরে তখন বুটের আওয়াজের বাইরে শুধু মাত্র আর একটা আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সেটা আমার হৃত স্পন্দনের।
মেঝে তে তাকিয়ে দেখলাম এক জোড়া ভিজে পায়ের ছাপ বাথরুম থেকে ঘরের ভিতর ঢুকল! তারপর ঠিক আমার আর পাশের বেডের রহিম চাচার মাঝখানে রাখা ডেস্কের সামনে গিয়ে সোফায় গিয়ে বসল। চোখের সামনে কিছুটা গদি বসে গেল দেখলাম! একটা পেন ডাইরির পাতা তে কিছু লিখে চলেছে। পেন টা তো ডাক্তার ব্যানার্জির! যিনি গত কাল দুপুরে আমার চিকিৎসা করছিলেন। তবে কি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখলাম, রহিম চাচা ও আমার মতন অবাক হয়ে দেখছে। গত কাল রহিম চাচার শরীর বেশ খারাপ ছিল। গলা ব্যথা, গায়ে ধূম জ্বর ছিল। সেই সঙ্গে প্রচণ্ড শ্বাস কষ্ট। অক্সিজেন চলেছে অনেক বেলা পর্যন্ত। এখন বেশ ভাল আছে। অক্সিজেন মাস্ক খোলা হয়েছে। আমার দিকে চোখ পড়তেই ইশারা তে জিজ্ঞাসা করল, এগুলো কি হচ্ছে? ভূত নাতো? আমি আর কি জবাব দেব? নিজেই তো ভয়ে কাঁপছি। অবাক হবার আর ও বাকি ছিল। ডেস্কের উপর দুটো ফাইল ছিল। একটা আমার আর একটা রহিম চাচার। নিজে নিজেই আমার ফাইল টা খুলে গেল। একটার পর একটা পাতা কেউ যেন উল্টাচ্ছে, মন দিয়ে পড়ছে। তার পর রহিম চাচার ফাইলের পাতা ও পর পর উল্টাতে লাগল কেউ! বোঝা যাচ্ছে যে, কেউ তা স্টাডি করছে।
না, আর নিতে পারলাম না। আতঙ্কে গলা শুকিয়ে গেল। বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে বাইরে এলাম। হাতের চ্যানেল টা আগেই খোলা হয়ে গেছিল। কিন্তু দৌড়তে গিয়ে স্যালাইন বোতল টা মেঝেতে পরে ভেঙে গেল। একটা ভিন গ্রহের অস্ফুট আওয়াজ শুনলাম। তার পর করিডোর দিয়ে ছুটতে লাগলাম প্রাণ ভয়ে। একটা আই. সি. ইউ র সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঘরে মোট আট টা বেড। তার চার টে তে রোগী নেই। অথচ মনিটরিং হচ্ছে! মনিটরে প্রতিনিয়ত হৃত স্পন্দন, পেশার আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় মাপ দেখাচ্ছে। এ কি করে সম্ভব! রোগী নেই। অথচ মনিটরিং হচ্ছে? আমার মুখ থেকে আওয়াজ আর বেড় হচ্ছে না। মেরুদণ্ড বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত ক্রমাগত ওঠা নামা করছে। মনে হয় যে কোন মুহূর্তে পড়ে যাব। সোহম ? আমি এই দিকে। — হঠাৎ পরিচিত একটা আওয়াজ পেয়ে পিছনে ঘুরলাম। শেফালী পিসি!
— তুমি এখানে? কবে থেকে? বেশ সাহস পেলাম পিসি কে দেখে।
— আমি তো গত পরশু রাতে এসেছি। কিন্তু এখানে এসে তো দেখছি ভুতের উপদ্রব! সন্ধ্যা থেকে ই চলছে। বুঝতে পারছি না ডাক্তার, সিস্টার, আয়ারা কোথায়?
— আমি ও তো তাই ঘর থেকে পালিয়ে এসেছি। থাকা যাচ্ছে না।
— সে কি তোর ঘরেও আমি গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়লাম। তার পর পিসির দিকে তাকিয়ে বললাম– তুমি এখন কেমন আছ?
— আমার তো প্রচণ্ড জ্বর আর শ্বাস কষ্ট হচ্ছিল। এখন ভাল ই আছি। বাড়ি যেতে পারলে বাঁচি। ছেলের পথ চেয়ে বসে আছি। কখন আসে দেখি। আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, আর ও তিনটে বেডে তিন জন মহিলা রয়েছে। তার মধ্যে দু জনের এখন ও মনিটরিং হচ্ছে। অন্য জনের টা বন্ধ রয়েছে। এমন সময় কয়েক টা পায়ের আওয়াজ। অদৃশ্য কারা যেন ঘরে ঢুকল। একটা হৈ হট্টগোল শোনা গেল। যদি ও তা খুব আস্তে। আমি ছুটে গিয়ে শেফালী পিসির বেডের কাছে গেলাম। একটা পায়ের আওয়াজ ঘরের মধ্যবর্তী টেবিলের পাশে একটা চেয়ার টেনে বসল। শেফালী পিসির চোখে মুখে আতঙ্ক। এখানে ও ফাইলে কিছু লেখা হচ্ছে। একটা অস্ফুট মহিলা কণ্ঠস্বর। অপর প্রান্তে ও একজন কিছু বলল। কিন্তু কাউকে দেখা গেল না। কিন্তু একজনের মাথার উপরের মনিটরিং হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। ভদ্রমহিলার অক্সিজেন মাক্স খুলে গেল নিজে নিজে। ভদ্রমহিলা আস্তে আস্তে উঠে বসলেন। তার পর অবাক চোখে বন্ধ মনিটারের দিকে তাকিয়ে ভয়ে চিৎকার করে উঠল।
— মনিটর টা কে বন্ধ করল?
—যেই হোক, সে কোন মানুষ না। — শেফালী পিসি গম্ভীর হয় বলল ভদ্রমহিলা কে।
আমি ভয়ে ডুকরে গিয়ে বললাম, — পিসি, এখানে যা চলছে, তাতে এখানে থাকা টা উচিত হবে না। চল আমরা বাইরে চলে যাই। আমার কথায় পিসি আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নামল। বলল– আমার তো বাতের ব্যাথা। পারব কি হাঁটতে? না পারলে ও যেতে হবে। যদি তোমার ছেলে আসে, তবে বাড়ি ফিরে যেও। কথা বলতে বলতে আমরা আবার করিডোরে এলাম। এর পর নিচে নামার সিঁড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। বেশী দূর যেতে হল না, একটা ছায়ামূর্তি দেখে শ্বাস রোধ হবার উপক্রম। অবাক হয়ে দেখলাম, ছায়া মূর্তি টাও আমাদের দেখে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর পিছন ফিরে দৌড়ে অদৃশ্য হল। শেফালী পিসি আর আমি থমকে দাঁড়ালাম। পিসি বলল, –অন্য দিক দিয়ে চল সোহম।
— কোন দিক দিয়ে যাব পিসি? ওই পাশের করিডোর ধরেই তো আমি পালিয়ে এসেছি।– আমি অসহায় হয়ে বললাম।
— কিন্তু লিফট টা কোথায়? আমি লিফট ছাড়া নামতে পারব না।
পিসির কথায় লিফট খুঁজে বার করলাম। পিসি কে নিয়ে ভিতরে ঢুকতে গিয়ে দেখি পাশের বেডের ভদ্রমহিলা ও আছেন! তার চোখে মুখেও আতঙ্ক। আমরা লিফটে ঢুকে কিছু করার আগেই দেখি লিফট নামতে শুরু করল! ব্যাপার টা আঁচ করে পিসি ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। কেমন যেন শরীরে অস্বস্তি হতে লাগল সবার।
গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামার আগেই লিফট ফার্স্ট ফ্লোরে দাঁড়িয়ে পড়ল। একটা অস্পষ্ট মূর্তি কে দেখলাম বেড়িয়ে যেতে কোন রকমে নিচে নামলাম সবাই। দেখলাম পুরো রিশেপসান ফাঁকা। সবাই কি বাড়ি চলে গেল? দাড়োয়ান ই বা কোথায়? পিসিদের রিশেপসনের বাইরে বসতে বলে আমি দোতলা তে সুপারের ঘরে ঢুকতে গেলাম। দেখলাম দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। নিশ্চয়ই ভিতরে কোন মিটিং হচ্ছে। তাই বাইরে বেড়িয়ে ভাবলাম, রহিম চাচার কাছে যাই। সে তো পুরো একলা রয়েছে। যখন রহিম চাচা কে নিয়ে আসা হয়েছিল, তখন আমি খুব অসুস্থ ছিলাম। ক্লাস নাইনে পড়ি। সেদিন কোচিন থেকে বাড়ি যাবার সময় পিছন থেকে একটা ট্রাক ধাক্কা মারে। যন্ত্রণা তে অজ্ঞান ই হয়ে যাই। তার পর মাঝে মাঝে ই জ্ঞান এসেছে আর গেছে। তার মধ্যে ই রহিম চাচা এল। ডাক্তার রা সন্দেহ করছিল “করোনা”। রোগ টা নাকি একদম নতুন। আগে শুনিনি। শুনলাম রহিম চাচা কে নাকি অন্যত্র ট্রান্সফার করা হবে। কারণ এই রোগ টা ছোঁয়াচে।
কেবিনে আসতে হাঁপিয়ে উঠলাম। গিয়ে দেখলাম, রহিম চাচা নেই। বোধ হয়, অন্যত্র ট্রান্সফার করা হয়েছে। কিন্তু ঘরের মেঝেতে একটা কফিন সদৃশ বস্তু। কোন বডি কে পলিথিনে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। কার বডি এটা? বাইরে বের হতেই নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষর একটা পোস্টার দেখলাম। এই মাত্র সাটিয়েছে। জরুরী ঘোষণা– এত দ্বারা সমস্ত জন সাধারণ এর উদ্দেশ্যে জানান যাচ্ছে যে, করোনা আক্রান্ত রোগী দের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়িতে থাকায় আপাতত এই নার্সিংহোম টিতে শুধু করোনা রোগী দেরই চিকিৎসা হবে। অন্য রোগী দের অন্যত্র চলে যাবার অনুরোধ করা হচ্ছে। রোগীর বাড়ির লোকজন কে নিচের অফিস থেকে সমস্ত কেস হিস্ট্রি এবং ডিসচার্জ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে অনুরোধ করা হচ্ছে ।
—-অনুমত্যানুসারে
বিজ্ঞপ্তি টি পড়ে আমি খানিকক্ষণ থমকে দাঁড়ালাম। আচ্ছা আমার বাড়ির লোক এখানে আসছে না কেন? ওরা কি জানে না, যে আমি সুস্থ হয়ে গেছি। নিচের অফিস রুমের পথ ধরলাম। ভাবলাম, নিজের কেস হিস্ট্রি নিজেই সংগ্রহ করে বাড়ি চলে যাব। বাড়ির লোকের ভরসা তে থাকব না। কিন্তু বাড়ি যাব ই বা কিভাবে? আমার তো পকেটে কোনও টাকাই নেই! অফিস রুমে আসার আগে নিচে লিফটের সামনে আবার একটা বিজ্ঞপ্তি। এত দ্বারা আমাদের সমস্ত ডাক্তার, মেডিকেল স্টাফ আর সিস্টার দের প্রতি নিবেদন এই যে, অযথা ভৌতিক কোন ইস্যু নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াবেন না। সামনে আমাদের কঠিন মিশন। প্রচুর রোগী ভর্তি হচ্ছে। আগামী দিনে আরও হবে। আমাদের আরও মানবিক হতে হবে। ভাল ভাবে রোগী দের চিকিৎসা করতে হবে। যাতে বেশীর ভাগ কে সুস্থ করা যায়। আর যারা ইতিমধ্যে মারা গিয়েছেন। তাদের যাতে বাড়ির লোকের সাহায্যে যথাযথ ভাবে সৎকার করা যায়, সেই দায়িত্ব ও নিতে হবে।
—– সুপার ‘ভৌতিক ইস্যু’! তার মানে আমরা যা দেখছি, তা কর্তৃপক্ষ কার্যতঃ স্বীকার করে নিল। যাই হোক অফিস ঘর হাট করে খোলা। কেমন যেন গা ছমে ছমে পরিবেশ। মাঝরাত বলে নাকি? কোন ডাক্তার বা সিস্টার কে দেখতে পাচ্ছি না তো! সবাই কি ভূতের ভয়ে পালালো নাকি? নাকি করোনা র ভয়ে সব বন্ধ?
তবে হ্যাঁ দুটো সেল্ফে ভর্তি ফাইল রাখা। হয়তো কাল সবাই এগুলো ই নিতে আসবে। যারা মারা গেছেন, তাদের একটা লিস্ট টানানো দেওয়ালে। তিনবার নম্বর নাম টা দেখেই চমকে গেলাম। “শেফালী সরকার”! আরে, এতো আমার পাড়ার শেফালী পিসি! কিছুক্ষন আগেই কথা বলে এলাম। সে তো দিব্যি সুস্থ! মনে হয় অন্য কোন শেফালী সরকার হবে। এক নাম কি আর কারোর হয় না? মোট আট জনের নাম ছিল। তালিকার সপ্তম নাম টা দেখে ও বুক টা ছ্যাঁত করে উঠল। “রহিম চৌধুরী”! এ আমার পাশের বেডের রহিম চাচার না তো? এরপর অাট নম্বরে পেশেন্ট আছে। কিন্তু নাম লেখা নেই। শুধু বয়স দেওয়া পনেরো। তার মানে এটা বেওয়ারিস বডি। মন টা বিষণ্ণ হয়ে গেল। ঠাকুর করে ওরা যেন ভাল থাকে। যাই হোক নিজের ফাইল টা খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু আমার নামে কোন ফাইল পেলাম না। ব্যাপার টা আমার মাথায় ঢুকছিল না। এরা কি আমার নাম জানে না? কিছুক্ষন পর অবশ্য এরকম একটা নাম, গোত্র হীন ফাইল পেলাম। নাম্বার 39
নাম — জানা যায় নি।
বয়স – আনুমানিক পনেরো।
ঠিকানা–জানা নেই।
কেস হুস্ট্রি– দুর্ঘটনা তে মাথায় অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে মৃত্যু। নিচে ডাক্তার ব্যানার্জীর সাক্ষর। ফাইল টা হাতে নিয়ে মাথা টা ঘুরতে লাগল। এটা কার ফাইল? আমার? হা, হা, হা, — আমি তো বেঁচে। তবে এটা কার? যদিও তথ্য গুলো মিলছে। নিচে বডি মর্গে রাখা আছে বলে দেওয়া আছে। কৌতূহল বশতঃ নিচের মর্গে গেলাম। এখানে ও কোন গার্ড নেই। পুরো হসপিটাল যেন জন শূন্য হয়ে গেছে করোনার ভয়ে।
সবাই বলে এখানে নাকি ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা হয়। কই আমার তো কিছু তেমন বোধ হচ্ছে না। তবে গা ছম ছম করছে ঠিক ই। একটা একটা করে ট্রে গুলো বার করছি। আর ঢুকিয়ে রাখছি। পচা গলা সব দেহ। হঠাৎ একটা তে এসে চোখ টা আটকে গেল। কেস নম্বর 39 এক অদম্য আগ্রহে ট্রে টা ধীরে ধীরে খুললাম। একটা আমার বয়সী ছেলে। উপুর করা বডি। যেখানে বাকি গুলো চিৎ করা। নিজের অজান্তে ই সেই সময় হৃতস্পন্দন দ্রুত হতে লাগল। জামা আর প্যান্ট টা তো আমার। এক পাটি জুতো টাও আমার। কাঁপা কাঁপা হাতে বডি টা উল্টে দিলাম। মাথা টা ভয়ঙ্কর ভাবে ই থেঁতলে গেছিল সেদিন। আমার হাত আর কাঁপছে না বিশেষ। মনের মধ্যে একটাই চিন্তা, কোন ভাবে বাড়ির লোক কি আমাকে সনাক্ত করতে আসবে না?