তিনজন যুবক শিউলিকে এমনভাবে দেখছে যেন ও একটা বাজারের পণ্য। ওরা তিনজন চুপিসারে শিউলির দেহের পরিমাপ করছে আর নিজেদের ভেতর চাপা গলায় কথা বলছে। দুপুরবেলা হঠাৎ করে শিউলির বাবা জানালো যে ওকে দেখতে ছেলে আর ছেলের দুই বন্ধু আসবে। বাড়িতে রান্নাবান্নার ধুম লেগে গেল। পাত্রপক্ষ আসবে বলে কথা! বাড়ির মহিলাদের যেন দম ফেলবার জো নেই।
শিউলি ক্লাস সিক্সে পড়ে। ওরা পাঁচ বোন। ও সবার ছোট। ওর বড় চারটা বোনকেই দরিদ্রতার কারণে বাবা অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাতে শিউলির বাবা কোনো সুফল পাননি কারণ তার চারটা মেয়েই অল্প বয়সে সন্তান প্রসব করে রোগা হয়ে পড়েছে, ওদের সারাবছর রোগ লেগে থাকে। সংসারের অভাবও যায় না। আর সবচে’ বড় সমস্যা হলো মাঝে-মাঝেই ওদের শ্বশুরঘর থেকে এটা-ওটা চেয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু শিউলির দরিদ্র কৃষক বাবা এত উপঢৌকন পাঠানোর মতো স্বচ্ছল নয় বলে তার রোগা মেয়েদের কপালে আরও ভয়াবহ নির্যাতন জোটে। কিন্তু, যুগ-জামানা ভালো না বলে শিউলির বাবা আজমল মিঞা তার ছোট মেয়েকেও অল্প বয়সে বিয়ে দিতে ইচ্ছুক। তাই কেউ তাকে এই বিয়ের সিদ্ধান্ত থেকে রুখতে পারেনি। শিউলি প্রচণ্ড ঘামছে। অবশ্য বাইরে কড়া রোদ। টিনের চাল উত্তপ্ত হয়ে সেই তাপ এসে যেন কিশোরী শিউলির অন্তরটাকেও পুড়িয়ে দিচ্ছে। সেই উত্তাপের বহিঃপ্রকাশই এই ঘাম। বাড়ন্ত দেহের শিউলিকে চোখ দিয়ে পুরোপুরি মেপে নিয়ে পাত্রপক্ষ বলল মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে। বিয়ের কথা পাকা হোক।
শিউলি ঘরে ফিরে প্রচণ্ড অস্বস্তিবোধ করলো। আজ তাকে দেখতে আসা তিনজন শিক্ষিত ছেলের চোখের ভেতর সে যেন রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো ঐ উত্তক্তকারী গাঁজাখোর ছেলেগুলোকে দেখেছে। যারা প্রতিদিন শিউলিকে কুপ্রস্তাব দেয়, চোখ টিপে ইশারা করে বিশ্রী ইঙ্গিত দেয়… অথচ আজ সভ্য সমাজের লোক দ্বারা সে উত্তক্ত হলো! সন্ধ্যা হতেই শোনা গেল শিউলির বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। পাত্রপক্ষ খুব বেশি দাবি না করলেও নগদ ৮০ হাজার টাকা দাবি করেছে। কথাটা শুনে শিউলি তার বাবার কাছে ছুটে গিয়েছিল, কিন্তু বিয়েতে আপত্তি জানানোর অপরাধে তার শ্যামলা রঙের মুখের উপর বাবার হাতের পাঁচ আঙ্গুল বসে গিয়েছে। ভোর হয়েছে চারদিকে হরেক রকম পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। পাখিদের সাথে-সাথে গ্রামের উত্তর দিকের ছোট্ট জনপদটাও নব উদ্দামে জেগে উঠেছে। শিউলির বাবা তার একমাত্র ফসলের জমিটা বিক্রি করতে গ্রামের মেম্বরের বাড়ির দিকে যাবে বলে বাড়ি থেকে বের হয়েছে।
হঠাৎ রাস্তার বিপরীত দিক থেকে শিউলি তার উস্কোখুস্কো চুল উড়িয়ে পাখির মতো ছুটে আসলো। আজমল মিঞা সদ্য বিয়ে ঠিক হওয়া মেয়েকে এমন এলোমেলো হয়ে ছুটে আসতে দেখে খেকিয়ে উঠে বলল, “ঐ পোড়ামুখী? আজ বাদে কাইল তোর বিয়ে আর তুই আউলা হয়ে বিয়ান বেলা নাইচে বেড়াচ্ছিস? ঘরে যা কচ্চি।” কিন্তু শিউলি সে কথা কানে না তুলে বাবার একটা হাত আঁকড়ে ধরে করুণ স্বরে বলল,”তুমি যা কবা তাই শোনবো, আগে একবার পাশে বাড়ির মজিদির উঠোনে চলো। একবার আব্বাজান, চলো বলেই বাবার হাত ধরে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে একটা নারীকণ্ঠের তীব্র কান্নার দিকে টেনে নিয়ে চললো। মজিদের উঠানে এসে শিউলি ওর বাবার হাত ছেড়ে দিয়ে উঠানে পড়ে থাকা শাড়ি পরা, রক্তাক্ত একটা কিশোরী মেয়েকে দেখিয়ে বলল, “ঐ দেহো, বিয়ান বেলা মজিদ তার বউ ফুলিরে যৌতুকির বাকি টাকার জন্যি মাইরে আইধমরা কইরে ফেলিছে।
আমারও এই রহম হবে না তো আব্বাজান? দেহো, ওর নাক ফাইটে রক্ত বাইর হচ্ছে, আমি যে রক্ত বড় ভয় পাই। আমি যে বড় ছোট! ও আব্বাজান, আব্বাজান? আজমল মিঞা উঠানে পড়ে থাকা রক্তাক্ত, আধমরা ফুলির দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শিউরে উঠলেন। তারপর খপ করে মেয়ের হাত ধরে টান দিয়ে বললেন, “বাড়ি চল মা। তোরে কেউ মারবে না। আমি যৌতুক দিয়ে তোর বিয়ে দেবো না। আইজই ওগের না কইরে দেবো।” শিউলি খুশি হয়ে বলল, “আব্বাজান? মজিদ ভাইরে কও না, যেন ফুলিরে আর না মারে?” আজমল মিঞা গলা তুলে মজিদকে বললেন, “ওরে আর মারিসনে বাপ। তোর বুনিরা যদি তাগের শ্বউর ঘরে ইরাম মার খায়ে পড়ে থাহে তো কিরাম লাগবেনে তোর? তোর পায়ে পড়ি বাপ। আর মারিস নে।”
মজিদ আড়চোখে তাকিয়ে কথাগুলো শুনে কোনো জবাব দিলো না। ঘরের দুয়ারে মাটির উপর নিরুত্তর বসে রইলো। তবে শিউলিরা বাড়ি থেকে বের হতেই সে আবার রাগে গজরাতে লাগলো। তারপর চরম ঘৃণা নিয়ে উঠানে পড়ে থাকা তার বালিকা বধুর দিকে দৃষ্টিপাত করলো আজমল মিঞা রাস্তায় এসে হঠাৎ শিউলির গালে হাত বুলিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বললেন, “কাইল খুব ব্যথা পাইছিলি, তাই না মা?” শিউলি মৃদু হেসে বাবার হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “না, আব্বাজান। আমার একটুও ব্যথা লাগিনি, ব্যথা লাগিছে ফুলির।” কথাটা শুনে সবার অন্তরীক্ষে একটা বাবার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস পড়লো।
গল্পের বিষয়:
গল্প