আম্মা যখন দরজাটায় টোকা দিয়ে ভিতরে এসে আমার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বললো “এবারও বিয়েটা ক্যান্সেল হলো” তখন আমি চুপ করে থাকি। আম্মার কথার কোন প্রতুত্ত্যর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করিনা। আমার চুপ থাকা দেখে আম্মা আবার বলতে লাগলো “আচ্ছা তোরে মেয়েরা বিয়ে করতে চায় না ক্যান? পাত্রীর সাথে যখন আলাদাভাবে কথা বলতে চাস তখন মেয়ের সাথে কি বলিস তুই? আমি খেয়াল করেছি কথা বলার আগে মেয়ের চেহাড়া থাকে এক রকম আর কথা বলা শেষে যখন মেয়ের চেহাড়া দেখি তখন অন্য রকম। এই নিয়ে পাঁচ পাঁচটা মেয়ে তোকে প্রত্যাক্ষান করেছে। তোর শরম করে না?” আমি আবারও চুপ করে থাকি। আম্মার সেই করুন চোখের দিকে ভালো করে তাকাই। তার করুন চোখের মাঝে আমার প্রতি এক বিষন্ন ছাপ লেগে থাকার দৃশ্য দেখতে পাই। বিয়ে নিয়ে একজন পুরুষ মানুষের মনে যে আলোচ্ছটা মাথায় ঘুরপাক খায় তার বিন্দুমাত্রও আমি অনুভব করি না। আমি আম্মাকে বলি “চা দিবা এক কাপ?”
আাম্মা ভ্রু কুচকে আমার দিকে রাগ রাগ ভাব নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বিছানা থেকে বালিশটা নিয়ে ওটা দিয়ে কয়েকটা লাগিয়ে বললো “চা না গিলে কলা গাছে ফাসি খা” এইটা বলেই আম্মা রুম থেকে বের হয়ে পড়ে। আমি একটু জোড়ে জোড়েই বলতে লাগলাম “কলা গাছে ফাসি খাওয়া যায় না মা, পৃথিবীর অনেক মানুষ চেষ্টা করেও বৃথা গেছে।” আকাশের অবস্থা ভালো না। বৃষ্টিটা আসলেই আমার ভয় করে। এই ভয়টা কি জন্য, কেন বৃষ্টির প্রতি আমার ভয় জন্ম হয় আমি বুঝে উঠতে পারি না। তবে এটা সত্য এই বৃষ্টিটা আসলেই আমি ঠিক থাকি না। আমার মনে হয় কিছু একটা আমার নিকট তেড়ে আসছে। আকাশের কালো রুপটা ধারন করতেই জানলাটা বন্ধ করে স্তির হয়ে বসে থাকি। আমাকে মনে করিয়ে দেয় সে দিন বা সময় গুলোর কথা।
আমি বিছানায় গা তলিয়ে দেই। উপরে চলন্ত ফেনের দিকে তাকিয়ে অনুধাবন করে মনস্থ করি এই আমি বেঁচে আছি কেন? বেঁচে থাকার কোন অধিকার রাখি না আমি। যে মানুষ অপর মানুষকে বুঝতে পারে না, চিনতে পারে না, মানুষের অনুভুতি উপলব্দি করতে পারে না, ভালোবাসতে জানে না সে মানুষের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। টেবিলের উপরে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলে আমি উঠে মোবাইলের স্ক্রিনে খানিকক্ষন তাকিয়ে থাকি।
রিসিভ করেই বললাম “জ্বি বলুন” ওপাশ থেকে কোন সারা শব্দ পেলাম না। শুধু মাত্র নিশ্বাসের শব্দটা মনে হয় একটু করে শুনেতে পারছি। আস্তে আস্তে জানালার সামনে গিয়ে জানালাটা খুলে দেই। আকাশের অবস্থা এখনো সুবিধা মনে হচ্ছে না। আমি ফের বললাম “কিছু বলবেন মিস জেনিয়া?” এবার সে প্রতুত্ত্যর দিয়ে বললো “আপনি কি কিছু শুনেছেন? আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম “হ্যাঁ কিছুক্ষন আগে আম্মা রুমে এসে বলে গেছে আপনি এই বিয়েতে রাজি না। অবশ্য আমার মত মানুষকে বিয়ে না করে আপনি একজন সুস্থ মস্তিস্ক মানুষের পরিচয় দিয়েছেন। তা আপনি যে আমাকে প্রত্যাক্ষান করেছেন এখন আমি কেমন বোধ করছি তা নিশ্বচয় জানার জন্য ফোন দিয়েছেন?” সে একটু রেগে গিয়ে আমাকে বলে “আপনি এগুলা কি বলছেন? আপনার মাথা একদম ঠিক নেই। আপনাকে ফোন দেওয়াটাই আমার উচিৎ হয়নি।
নিজেকে একজন ইডিয়ট মনে হচ্ছে” আমি বললাম “সত্যটা স্বীকার করার জন্য ধন্যবাদ।” পরক্ষনেই বুঝতে পারলাম মিস জেনিয়া রেগে ফোন রেখে দিয়েছে। আমি যখন জেনিয়াকে দেখতে গেলাম প্রথম দেখেই ওকে আমার প্রজাপতির মত মনে হলো। গাড়ো চকলেট কালারের লিপিস্টিক দেয়া আর চুল গুলো খোলা। তার চোখে মুখে লজ্জামাখা চাউনি আর কোকড়ানো চুলগুলো কি রকম একটা রঙ মাতানো আভা পরিবেশটায় ছড়িয়ে ছিল আমি তখনই তা অনুভব করে শুধু তাকিয়ে ছিলাম আর ও লজ্জায় চোখ দুটো নিচে করে ছিল। লজ্জার মাত্রাটা যখন তীব্র মাত্রা ছড়িয়ে গেল সে এক মনোহর ভঙ্গিতে চুল কানে গুজে দেয়। তবে তার এমন সব রঙ মাতানো পরিবেশটা একটা জায়গায় বেমানান লেগেছে যে এই রকম সেজে কেউ গাড়ো লিপিস্টিক দেয়?
তখনি ওকে আমি মনে মনে ইডিয়ট বলে আখ্যায়িত করেছিলাম। সে যে কানে চুল গুজেছিল তার চুল গুজে দেওয়ার দুটো অর্থ বুঝায়, “এক” এভাবে তাকিয়ে থাকবেন না, লজ্জা করে। “দুই” ব্যাটা চোখ নামা জীবনে মেয়ে দেখস নাই? এই ভাবে ড্যাব ড্যাব করে কি দেখিস?” সে কোন অর্থ বুঝিয়ে ছিল আমার জানা নেই। আমার বুকের অতল গভীরে যে শব্দ তৈরি হয় আমি তা অন্য কাউকে প্রকাশ করার জন্য অপেক্ষায় থাকি কখন আবার কাউকে জানাবো আর সে পুলকিত হয়ে আমাকে শান্তনার সহিত প্রত্যাক্ষান করবে। এই প্রত্যাক্ষান নামক শব্দটা আমাকে মনে করিয়ে দেয় আমি অন্য মানুষজনের মত না। ভালোবাসাহীন একজন মানুষ। তবুও এই শহরের আলো, ছায়ায় নিজেকে বিধে রাখি একটা সকালের রোদ্দুর আলোচ্ছটা স্পর্শ করার। কিন্তু আমারে দেয়ালে কখনো রোদের আলোটা এসে সম্পৃক্ত হয় না।
প্রিয় পাঠক এই মুহুর্তে আমি অবস্থান করছি আদনান ভাই এর ডেস্কের সামনে। আজকে একটা বিশেষ দিন বলা যেতে পারে। যন্ত্রনার মধ্যেও একটা নির্ভল কাব্য তৈরি করা যায় এই মানুষটার সান্নিদ্য না পেলে অনুভব করতে পারতাম না। আমাকে মেয়েরা কেন প্রত্যাক্ষান খাতায় লিপিবদ্ধ করে সে কথাগুলা একদিন বলবো কথা দিচ্ছি। প্রতি বছরের মত আদনান ভাই আমাকে নিয়ে এই দিনটায় বাহিরে বের হয়। ধানমন্ডি লেকের সামনে এসে যত ছোট ছোট টোকাইদের দেখবে তাদেরকে একত্রিত করে রেস্টেুরেন্টে নিয়ে গিয়ে পেট ভরে খাওয়াবে। আমি একদিন জিঞ্জেস করেছিলাম এই রকম করার কারনটা কি? আদনান ভাই শুধু বলেছিল “তার অনেক ভালো লাগতো” এই “তার” নামক ব্যক্তিটা কে তাকে জানার জন্য আমার আগ্রহ বেড়ে যায়। যথারীতি আমি তাকে ফের প্রশ্ন করলে সে জানায় এই মানুষটা আদনান ভাই এর বউ, তার ভালোবাসার মানুষ। কিন্তু তার এই ভালোবাসার মানুষটা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। পাঁচ বছর প্রেম করে তাদের সম্পর্ককে একটা নাম দিয়েছিল বিয়েতে আবদ্ধ হয়ে। কিন্তু এই সম্পর্কের তৈরি হওয়া সব অনুভুতি দুটো ভাগে আলাদা হয়ে ছড়িয়ে গেছে।
আদনান ভাই আমাকে বলে “জাহেদ চল যাই। হাতের যা কাজ ছিল সেড়ে ফেলেছি বাকি গুলা এসে ধরবো।” আমি চুপ হয়ে তার সাথে করে গাড়িতে গিয়ে বসি। আদনান ভাই গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতেই বললো “বুঝলি জাহেদ ভালোবাসা বিষয়টার মাঝে একটা আলাদা ব্যাপার আছে। দুইটা মানুষই একে অপরকে ভালোবাসে। কিন্তু তাদের এই দুজনের মধ্যে যে অনুভূতি গুলো তৈরি হয় তা ভিন্ন। কষ্ট গুলা ভিন্ন। আনন্দ গুলো ভিন্ন। দুজনে সমান ভাবে বা একই ভাবে তা গ্রহণ করতে পারে না। তুই যদি কাউকে ভালোবাসিস তাহলে বুঝতে পারবি এই প্রান্ত থেকে যদি তুই তোর ভালোবাসার মানুষ্টাকে মিস করিস অপর প্রান্তু থেকে তোর ভালোবাসার মানুষটা তোকে মিস করতে নাও পারে।
তবে সে তোকে ভালোবাসবে। ভালোবাসা জিনিসটাই এই রকম।” আমি আদনান ভাই এর দিকে না তাকিয়েই তার কথার প্রসঙ্গ বদলিয়ে বললাম “ভাবী তোমাকে ছেড়ে কেন চলে গিয়েছে?” সে চুপ করে থাকে। তার প্রশান্ত আকাশের সময়টা যেন আমি আটকে দিয়েছি বা তার কাব্যর নগরীতে আমি ধুলো হয়ে তাকে বিরক্ত করছি। আদনান ভাই এর চুপ থাকা দেখে আমি আবার বললাম “ভালোবাসাটা পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকেই একই রকম। কিন্তু মানুষ গুলা তো একই রকম না। তাই তাদের অনুভূতি, কষ্ট, আনন্দ ভিন্ন রকম। স্থান, কাল, সময় আর পরিস্থিতি এই গুলো একেক স্থানে একেক রকম বিরাজমান। আমি যদি কাউকে এই প্রান্ত থেকে মিস করি তখন অপর প্রান্তের মানুষটা সময় আর পরিস্থিতির মাঝে অন্য কাজে মগ্ন থাকতে পারে সে অনুযায়ী অপর প্রান্তের মানুষটা আমাকে মিস না করাটাই স্বাভাবিক।” আদনান ভাই কিছু না বলে চুপ করে গাড়ি চালাতে লাগলো। আমিও আর কিছু বললাম না।
শেষ বিকেলের এই সময়টায় আমার মনকে বিষন্নতা করতে একটা শান্তু পরিবেশই যথেষ্ট। আমার জীবনের গল্পটা আমি চাইলে অন্য রকম করে সাজাতে পারতাম। কিন্তু আমার মন কেন যেন সায় দেয়নি। হঠাৎ আদনান ভাই একটু ইতস্তত হয়ে বলতে লাগলো “তোর ভাবী চলে যাওয়ার পিছনের কারন আমি। আমাদের পাঁচ বছরের সম্পর্কটাকে যে রুপ দিয়েছিলাম তার মাঝে একটা কিছুর অপূর্ণতার অনুভব করছিলাম। আর সেটা ছিল একটা সন্তানের জন্য। আমাদের সন্তান হচ্ছিল না। এতে তোর ভাবীর কোন দোষ নেই। দোষটা আমার। জানিস আমার খুব খারাপ লাগে যখন এই গুলা মনে পড়ে। খুব ছোট মনে হয় নিজেকে। আমি বলেও ছিলাম একটা সন্তান দত্তক নিলে কেমন হয়। কিন্তু সে অসম্মতি দেয়। ঐ যে তোকে বললাম ভালোবাসা এক। তবে দুটো মানুষের অনুভূতি, কষ্ট, আনন্দ ভিন্ন।
মানুষটাকে আমি বাধা দেইনি। বাধা দেওয়ার কোন অধিকার নেই আমার। সবার জীবনে একটা স্বাধীনতা আছে। আমার জীবন থেকে সে আলাদা হয়। আমার জীবন থেকে জোৎস্না গুলোকে হারিয়ে ফেলি। আমার আকাশের মেঘ গুলো সরে যায়।” এই গুলা বলে আদনান ভাই গাড়িটা থামায়। আমি আদনান ভাই এর হাতটা ধরি। উনি আমার দিকে তাকিয়ে আবার বলতে লাগলো “ জাহেদ আমি ভালো নেইরে একদম ভালো নেই। কি পরিমান যন্ত্রনা আমাকে তাড়া করে বেড়ায় একমাত্র আমিই জানি। আমি কাউকে বুঝতে দেই না। বলিনা। আমার খারাপ লাগে।” আদনান ভাই কান্না করতে থাকে। আদনান ভাইকে আমার কি বলা উচিৎ আমি বুঝতে পারি না। আমি আদনান ভাইকে জড়িয়ে ধরি। মনে মনে তাকে শুধু এইটুকুই বলি দুঃখিত আদনান ভাই তোমার মন খারাপ করে দেওয়ার জন্য।
ইদানিং আমার কেন যেন ইচ্ছা করে মিস জেনিয়াকে ফোন দিতে। তাকে জানাতে ইচ্ছা করে এইভাবে লিপিস্টিক দিবেন না। এইভাবে লিপিস্টিক দিলে আপনাকে বোকা বোকা লাগে। কিন্তু মনের সংকোচের জন্য তাকে জানানো হয় না। প্রিয় পাঠক আপনাদের কথা দিয়েছিলাম আমাকে কেন মেয়েরা প্রত্যাক্ষান করে তা বলবো। আমিও একজনকে ভালোবাসতাম। খুব চাইতাম তাকে। তার আকাশে আমি কাক হয়ে কা কা করে ঘুরে বেড়াতাম। ভালোবাসার মায়াজালে বেঁচে থাকার বাকী জীবনে এই শহরের নীল আলোয় অবিরাম আকাশ হওয়ার প্রয়াশ ছিল।
আমার এলোমেলো পথে একটা আলোর তীর আহ্বান হয়ে এসেছিল স্বপ্ন হয়ে। তায়িফা ছিল তার নাম। তখনও আমি চাকরিতে যোগদান করি নি। আমার মনের শহরের আনাচে কানাচে যে স্বপ্ন, আলো, বা ভালোবাসা বয়ে যেত আমি তার নামকরন করেছিলাম তায়িফা। আমি তাকে দেখার জন্য প্রতিটা দিন মুখিয়ে থাকতাম। তার বাসার নিচে অযথা অকারনে এপাশ অপাশ হাটাহাটি করে নিজের অনুভূতিকে শান্তনা দিতাম। তার জানালার বারান্দায় উদ্ভেগপূর্ণের সহিত তাকিয়ে আমার শহরেরর আগমন হওয়া আলোটাকে খুঁজতাম। বিষয়টা তায়িফা নিজেও লক্ষ্য করেছিল। একদিন আমাকে বললো “আপনি রোজ রোজ এখানে কি করেন?” আমি কিছু বলতে পারিনি। একটা ভয় আমাকে আকড়ে ধরেছিল। অন্তমিলে না বলার অব্যক্ত কথা বলতে আমার একটুও সাহস হয়নি।
এই ভাবেই আমি চার মাস অতিক্রম করি। তাকে আমার ভালোলাগার কথা জানানো হয়না। কিন্তু আমার এই শহরে যে বিষাদের ছাপ পড়বে তা আমার জানা ছিল না।আমার ভিতরে ভালোবাসার যে শহরটা তৈরি হয়েছিল তা কেপে উঠেছিল। এমন একটা কিছু হয়ে যাবে বা আমি শুনতে পাব এটা কখনও আশা করি নি। পুরো শহরটা জেনেছিল, শহরের প্রতিটা অলি গলির দেয়াল, এই জরাজীর্ন যান্ত্রিক শহরের কাক থেকে শুরু করে সবাই জেনেছিল। ওর কলেজের কয়েকজন ছেলে মিলে ওকে ধর্ষিত বা সতীত্বনাশ করেছিল। আমি হাসপাতালে গিয়ে দুর থেকে ওর দিকে তাকিয়েছিলাম। পুরো মিডিয়া, সংবাদপত্রের মানুষের আনাগোনা দেখে আমার জগৎটা নাড়া দিয়ে উঠেছিল।
আমার কি করার উচিৎ ছিল আমি বুঝতে পারছিলাম না। মিডিয়া সম্পৃক্ত ভাইদের বললাম “ভাই দোহাই আপনাদের, এইটা পাবলিশ করিয়েন না। পারিবারিক দিক থেকে আইনি ব্যবস্থা নিবে ওরা।” কেউ আমার কথা শুনেনি। সারা রাত নিশব্দ হয়ে আমি কান্না করতাম। আমি ঘুমাতে পারতাম না। যাকে নিয়ে এতো ভাবনা/ কল্পনা করতাম তাকে নিয়ে কেন যেন ভাবতে আমার কষ্ট লাগা শুরু হলো। কিন্তু যতদিন ও হাসপাতালে ছিল আমি প্রত্যেহ ওকে দেখতে যেতাম। চারদিনের মাথায় ওর মা করুন মুখ নিয়ে আমাকে বলে “বাবা তুমি ওর কি হও? প্রতিদিন দেখছি আমার মেয়েটাকে তুমি দেখতে আসো।” ঐদিন আমি কিছু বলিনি। ওর মা আমার চুপ থাকা দেখে আবার বলেছিল “ওর সাথে কি কথা বলবে?” আমি তারপরও চুপ করেছিলাম। তার কিছুক্ষনপরই আমি ভিতরে যাই।
ওর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আমি চোখ সরিয়ে ফেলি। আমি তাকাতে পারি না। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে তায়িফা আমার দিকে তাকিয়ে বলে “কেমন আছেন আপনি?” একটা মানুষ এই পর্যায়ে থেকেও আরেকটা মানুষের ভাল মন্দ জিজ্ঞেস করে কি করে? আমি অনেকটা পুলকিত অনুভব করছিলাম। সে আবার বলতে লাগলো “আজকে নিয়ে যতদিন আমি হাসপাতালে আছি ততদিন আমার কেন যেন মনে হতো আপনি আমার আশে পাশে আছেন, আমাকে দেখতে আসেন। এই অনুভবটা কেন হয়েছে আমি জানি না।” আমি নিচের দিকে তাকিয়েছিলাম। কতবার কল্পনা করেছিলাম প্রিয় মানুষটার চোখে চোখ রেখে আমার ভালোলাগার কথা পেশ করবো। কিন্তু সেদিন এই মানুষটার চোখে চোখ রাখতে আমার ভয় করেছিল। আমার এমন নিচের দিকে তাকানো দেখে সে আবার বলেছিল “আমার শরীরটা এখন একটা পচা শরীর জানেন। আমি কি অনেক ঘৃনিত? যে মানুষটা আমাকে দেখার জন্য, আমি কি করি, কোথায় কখন যাই সব খোঁজ খবর রাখতো সেই আজ আমার থেকে মুখ লুকিয়ে রাখে।”
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। আমি যেই রুম থেকে বের হতে যাবে তায়িফা ডাক দিয়ে বললো “শুনুন, আগামীকাল বাসায় চলে যাব, আমাকে একটা দিন দিবেন? প্রতিদিনের মত আমার বাসার সামনে এসে হাটাহাটি করবেন। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবো। নিজে বলতে না পারেন অন্তত লিখে জানাইয়েন আমাকে আপনার ভালো লাগার কথা। পারবেন?” আমি তায়িফার কথা রাখিনি। তাকে একটা দিন দেইনি। তাকে আমার ভালোলাগার কথা জানাইনি। দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম কি করবো। কোন অনুভূতি আমাকে আর্কষ্ট করেনি। যেদিন তাকে একটা দিন সময় দেওয়ার কথা তার পরদিনই মেয়েটা ছাদ থেকে লাফ দিয়ে মারা যায়। আমার আকাশটা কালো রুপ ধরে। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামে। তার মৃত্যুতে আমাকে জানিয়ে দেয় আমি একটা স্বার্থপর। ভালোবাসাহীন মানুষ।
কাউকে ভালোবাসার অধিকার রাখি না আমি। ভালোবাসতে জানি না। ভালোবাসলে প্রিয় মানুষটার দুঃখ আনন্দের সময় থাকতে হয়।কিন্তু আমি তার আয়ত্তায় নই। একটা অপ্রাপ্তির গল্প আমার জীবনে জায়গা দখল করে। নিজের প্রতি তীব্র ঘৃনা জন্ম হয়। বাসার কাউকে বুঝতে দিতাম না। ঠিক মত খেতাম না। তারপর থেকেই আমি স্বাভাবিক ছিলাম না প্রায় এক বছর। একটা সময় আব্বা আম্বার কথা ভেবে নিজেকে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিতে চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু আমাকে সব সময় তাড়া করে বেড়ায় আমি একটা ভালোবাসাহীন মানুষ। আম্মা যখন মেয়ে দেখা শুরু করলো আমি অবজ্ঞা করে চলতাম। কিন্তু সব সময় তাদের অবজ্ঞা করতে পারতাম না। যখনি কোন মেয়ে দেখতে যেতাম, পাত্রীকে আলাদা ভাবে আমার এই অপরির্পর্ণ জীবনে কথা জানাতাম। বলতাম আমি ভালোবাসাহীন একটা মানুষ আমাকে বিয়ে করিয়েন না। এই গুলা শুনেই মেয়েগুলা আমাকে প্রত্যাক্ষান করতো। তবে তাদেরকে বলতাম আমার পরিবারের কাউকে আমার কথা গুলো জানাবেন না।
অফিসে এসে নিজের ডেস্কের উপর একটা খাম দেখতে পাই। খামটা খুলেই চোখ বুলিয়ে আদনান ভাই এর কাছে গিয়ে বলি “আদনান ভাই তুমি আমাকে সিলেক্ট না করলেও পারতে।” আদনান ভাই আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো “সব কাজ সবাইকে দিয়ে হয় না জাহেদ, আর আমি ভালো করেই জানি কাকে দিয়ে কোন কাজটা হবে। ২০ তারিখ তোর ফ্লাইট, হাতে তেমন সময় নেই, যা যা ডকুমেন্ট গোছানোর দরকার গুছিয়ে নে।” আমি আর আদনান ভাইকে কিছু বলি না। আমার আধার ঘরে আলো আসলেও সময়টা থেমে থাকে। ভয় গুলা জমা হয়ে আমাকে ঘিরে থাকে। তবুও আামি অন্য আর পাঁচটা মানুষের মত চলতে চেষ্টা করি। আমাকে চেষ্টা করতেই হবে সামনে যে কতটা পথ রয়ে গেছে। ভাবছি আমি আজকে একটা সাহসের কাজ করবো। মিস জেনিয়াকে ফোন করবো।
এই শহরের আলোটা হারিয়ে গিয়ে যখন সন্ধ্যাকে আমন্ত্রন জানায় ঠিক তখনি আমি মিস জেনিয়াকে ফোন দিয়ে বললাম “আমাকে চিনতে পেরেছেন?” সে বললো “জ্বি বলুন” আমি অনেকটা ইতস্ততার সহিত তাকে জানাই “আপনাকে ফোন করে আমার বিরক্ত করার কোন ইচ্ছা নেই। আপনাকে শুধু এইটুকু বলার জন্য ফোন দিয়েছি আপনি গাড়ো লিপিস্টিক দিবেন না। লিপিস্টিক দিলে আপনাকে বোকা বোকা লাগে।” সে আমার কথা শুনে খানিকট ঝিম মেরে ছিল তারপর বলে “এরকমটা কেন মনে হলে জাহেদ সাহেব?” আমি চুপ করে থাকি। সে আবার বলতে লাগলো “জানেন জাহেদ সাহেব আপনি মানুষটা অনেক ভালো। সহজ সরল। আপনি চাইলে আপনার জীবনের কথা গুলো আামার কাছে লুকাতে পারতেন, কিন্তু আপনি তা করেননি। আপনি নিজেকে একজন ভালোবাসাহীন মানুষ ভাবেন।
এমনটা ভাববেন না। এই পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছে তাদের প্রিয় মানুষটার কথা কারো সাথে শেয়ার করতে চায় না। আপনার প্রিয় মানুষটার সাথে যখন এমন ঘটনা ঘটে গেল আপনার মন তা মেনে নিতে পারেনি। কারন আপনি তাকে অনেক চাইতেন। একটা সময় ঠিকি তাকে মেনে নিলেও নিতেন। তবে অনেক সময় লাগতো। কিন্তু এই সময়টা আপনার নিকট আসেনি।” আমি কি বলবো বুঝতে পারিনা। আমি যেই বলবো আচ্ছা আমি রাখি ভালো থাকবেন কিন্তু তখনি জেনিয়া যেটা বললো সেটার জন্য আমি প্রশ্তুত ছিলাম না। সে অনেকটা ইতস্তত হয়ে বললো “একটা কথা বলার ছিল” আমি বললাম “জ্বি বলুন” সে চুপ করে থাকে। আমিও চুপ করে থাকি। সে যেন কথাটা বলার জন্য নিজেকে প্রশ্তুত করছিল।
সে বললো “আপনি নিজেকে একজন ভালোবাসাহীন মানুষ ভাবেন, আমি যদি এই ভালোবাসাহীন মানুষটাকে আবার নতুন করে ভালোবাসা শিখাতে চাই আপনি কি আমাকে দায়িত্বটা দিবেন?” আমি চুপ করে থাকি। আমার চোখে জল চলে আসে। এই শহরের অনেক ভোর পার হওয়ার পর আমার বিষাদ ছায়ায় রোদ্দুর আলোচ্ছটা হঠাৎ ছড়িয়ে পড়লে আমার অনুভূতি জাগ্রত করতে কেন যেন আমার মন একটুও সায় দিতে চায় না। আমার আঁকা সব আলপনা জীবন্ত হতে গিয়ে যেন বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমি তাকে জানাই “দেশে ফিরে এসে আপনাকে প্রতুত্ত্যর দিব, ততদিন ভালো থাকবেন মিস জেনিয়া।” আমি সেই দিন ক্ষনের অপেক্ষায় থাকি ভালোবাসার একটা নতুন স্বপ্নের সাতরঙ্গা রংধনু আমার চিলেকোঠায় জায়গা দিতে…
গল্পের বিষয়:
গল্প