“তুমি যদি ডিসিশন নাও তবে ভালো,নাহয় আমাকেই ডিসিশন নিতে হবে।” ৬০ বছর বয়সী স্ত্রীর এই কথা শুনে হো হো করে হেসে দিল ৬৫ বছরের সামাদ সাহেব। সামাদ সাহেব,একজন শিক্ষিত,শান্ত মেজাজের,স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ।প্রতিদিন সকালে উঠে স্ত্রী কে নিয়ে হাঁটতে যান,স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খান,বিকেলেও হেঁটে এসে মাগরিবের নামাজ পড়ে ঘরে ঢুকতেই মিসেস বীণার(স্ত্রী) এমন কথা শুনে হাসি ই পেয়ে গেলো। আজ ৪২ বছরের সংসার সামাদ সাহেব ও মিসেস বীণার।
কত সুখ দুঃখ,ঝড় ঝঞ্জাট পাড় করে আজ প্রায় জীবনের শেষ প্রান্তে।এখন তাদের বেশ স্বচ্ছল সংসার,সব সন্তানেরা বড় হয়ে বিয়ে করে আলাদা জায়গায় সেটেল হয়েছে, নাতি-নাতনী আছে।এখন তাঁদের বুড়ো-বুড়ির কেবল বিশ্রামের সময়। প্রতি ভোরে এখনো তারা একই সাথে হাত ধরে হাঁটতে বের হয়,প্রতিটা সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে চা খায়,চাঁদনী রাতে ভাঙা গলায় রবীন্দ্র সংগীত শুনায় বীণা। ৪২ টা বছর কিভাবে যেন চোখের পলকে চলে গেলো ভাবাই যায় না।এখনো সেই অল্প বয়সের কথা মনে পরে বীণা বেগমের। বরিশালের গ্রামের মেয়ে ছিল বীণা,বেশিদূর পড়াশুনা করার আগেই ঢাকা শহরের বুয়েট থেকে পড়া ছেলের প্রস্তাব আসতেই বিয়ে দিয়ে দিল তার পরিবার। বাঁসর রাতে রুমে ঢুকে সামাদ নামের শুকনো ছেলেটা কেমন কাঁচুমাচু করছিল বিছানায় বসবে নাকি বসবে না বুঝে উঠতে পারছিল না।এদিকে মাথায় ঘোমটা দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে শ্যাম বর্ণের কিশোরী মেয়েটা।
-বি বীণা,কাঁদছো কেন?বাড়িতে যাবে? কান্না করো না।তোমায় কাল ই দিয়ে আসবো নাহয়। কেমন যেন বোকার মত কথাগুলো বলে দাঁড়িয়ে ছিল সামাদ। একটু থেমে আবার বলল- তুমি যদি ডিসিশন নাও তবে ভালো,নাহয় আমি ই ডিসিশন নিয়ে নিব।কাল তোমায় বাড়িতে দিয়ে আসবো,তবুও কেঁদো না এভাবে।প্লিজ। মেয়েটা মাথার ঘোমটা সরাতেই কাজল লেপটানো এক মায়াময়ী মুখ ভেসে আসলো সামাদের সামনে,এতোটা মায়া যে সে চোখ ফেরাতে পারল না। “আপনে আমারে বাড়িতে দিয়া আইবেন কেন?আমারে ছাইড়া দিবেন?” এই কথা শুনে সম্বিত ফিরে পেলো সামাদ।
-ইয়ে না,কি বলো এইসব।ছাড়বো কেন তোমারে।
আমরা তো ২দিন পর ই বরিশাল থেইকা ঢাকা চইলা যাবো,তাই জিজ্ঞেস করলাম তুমি কি বাড়িতে যাবা কিনা ২ দিনের জন্য। চুপ করে রইল বীণা।এতক্ষণে ঘরের দিকে তাকালো বীণা,একটা টিনের ঘর,জড়ি দিয়ে সাজানো,চোখমুখ মুছে এইসব শাড়ি-গয়না নিয়েই শুয়ে পরল সে।কারণ এই এক রুমের ঘরে জামা কোথায় পাল্টাবে সে বুঝতে পারছিল না। লঞ্চের ভোঁতা শব্দটা মনে হয় বীণার কান্নার শব্দ টা কে একদম দমিয়ে দিল।লঞ্চ ছুটে চলেছে,বীণার বুকের ভেতর টা খুব বেশি খালি খালি লাগছিল।এতটাই খালি লাগছিল,মনে হচ্ছিল এক নতুন দুনিয়ায় তার জন্ম হতে যাচ্ছে আবার! বীণা কখনো স্বপ্নেও ভাবে নাই সামাদ নামের শহুরে শিক্ষিত ছেলেটা এতোটা ভালো হবে।বুকের ভেতরের প্রতিটা খালি জায়গা যেন এক এক করে ভরে দিল সে ভালোবাসায়।ঢাকা শহরের ২রুমের ঘরে ভালোবাসার অন্ত ছিল না তাদের। সামাদ যেন দিন দিন বীণা তে আসক্ত হতে লাগল। প্রতি রাতে বীণা সামাদের বুকের উপর ঘুমাতো,কখনো বা সামাদ কবিতা শুনাতো,কখনো বা বীণার গানের সুরে ভেসে যেত তাদের নিখাদ ভালোবাসার ঘর।
ইঞ্জিনিয়ার সামাদ একে একে বাড়ি গাড়ি করল,এর ভিতর তাদের ৩ ছেলে এক মেয়ে হলো। বীণা একা হাতে কিভাবে যেন সব সামলে নিল,৪টি সন্তান বড় করে শিক্ষায় দীক্ষায় একদম প্রতিষ্ঠিত বলতে যা বুঝায়। ৪২ বছরের সংসার জীবনে যেমন ছিল ভালোবাসা,তেমনি ছিল ব্যস্ততা,তেমনি ছিল কাছের মানুষগুলো হারানোর যন্ত্রণা। সামাদের মা বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন,কিন্তু বীণার মা বাবা বিয়ের ১০ বছর পর মারা যান। বীণার বড় একটিমাত্র ভাই,গত বছর ডিসেম্বরে তাঁর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে দুই বুড়ো বুড়ি রওনা হলো বরিশালে।দরকার ছাড়া তারা তেমন সময় পায়নি বরিশাল যাবার। ৪ ছেলেমেয়ের পরীক্ষা সামলাতে সামলাতেই বছরের পর বছর ঘুরে যেত। এখন আর কারো পরীক্ষা সামলাতে হয় না।।
বরং এখন তাদের ছেলেমেয়েরা নাতি-নাতনীদের পরীক্ষার জন্য তাদের বাসায় আসার সময় কম পায়। এখন কোনো পিছুটান নেই,তাই বীণা ভাবলো মাস খানেক থাকবে গ্রামের বাড়িতে।বীণার বড় ভাই মারা যাবার ৫দিন পর হঠাত সামাদ সাহেবের ঢাকা থেকে জরুরী ফোন আসলে তিনি বীণা কে বরিশাল রেখে চলে যান ঢাকা।বরিশাল কে এখন কেমন যেন অচেনা লাগে বীণার কাছে। তার ভাইয়ের এক নাতি আছে ক্লাস টেনে পড়ে,নাম সুপ্রভ।খুব সুন্দর হয়েছে দেখতে,একদম তার বড় ভাই এর মত। সুপ্রভ কে নিয়ে প্রায় ই বের হয় বীণা বেগম। আজ বিকেলে সুপ্রভ কে নিয়ে বের হলো।মা,বাবা,ভাই এর কবরের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে কেমন যেন এক অদ্ভুত শান্তি পায় সে। ফিরে আসার সময় হঠাত এক জায়গায় চোখ আটকে গেলো,একজন হাঁড় জিরজিরে বৃদ্ধ কে আরেকজন লোক প্রায় কোলে করেই রিকশায় উঠতে সাহায্য করছেন।বুকের ভিতর কেমন যেন ধুক করে উঠলো বীণার।লোকটাকে কেমন যেন খুব বেশি পরিচিত মনে হচ্ছে।
-সুপ্রভ,এই বৃদ্ধ লোক টা কে?চিনো তুমি উনাকে?
-চিনব না কেন দাদু? উনি তো উত্তর পাড়ার আলম দাদা,উনাকে ছোট থেইকাই চিনি।কারণ উনি এই বুড়া বয়সেও বাচ্চাদের সাথে আইসা গল্প করে,চকোলেট দেয়,বউ বাচ্চা কেউ নাই তো তাই।গত ১বছর ধইরা অবশ্য খুব দুর্বল হয়া গেছে।
-কেন?বউ কোথায়?
-উনি তো বিয়া করে নাই দাদু। হঠাত করেই যেন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেলো বীণার।এ কি শুনলো সে! গুলশান,ঢাকা: মাগরিবের পর বসে আছে বীণা ও সামাদ সাহেব।
-কি হলো আবার তোমার?কি ডিসিশন শুনি।সেই ৪২ বছর আগের আমার দেয়া ডায়লগ তুমি দিচ্ছ,ব্যাপার কি বলো তো?
-সামাদ,এখন আমি তোমাকে যা বলব,তা হয়তো তোমার শুনতে খারাপ লাগতে পারে,অবাক লাগতে পারে,অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে।কিন্তু আমি যা বলব সব সত্যি।
– আচ্ছা,এই বুড়া বয়সে ভনিতা না করে বলো শুনি।
-তোমার সাথে বিয়ের আগে,আমি যখন স্কুলে পড়তাম,আমাদের পাশের গ্রামে আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই থাকতো,নাম আলম ভাই।আমার চেয়ে ১০/১২ বছরের বড় হবে।প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতো,আমাকে পড়াতো ও উনি প্রায় ই।
একটা সময় বুঝতে পারতাম উনি আমার জন্যই রেগুলার কোনো না কোনো অজুহাতে আমাদের বাড়ি আসে।আমাকে প্রায়ই গল্পের বই পড়তে দিত,উপহার দিত। কিন্তু আমার বয়স কম ছিল,তাই কখনো মুখ ফুটে কিছু বলেনি।তবে আমি বুঝতে পারতাম।সেই ছেলেবেলায় আমিও হয়তো মনে মনে পছন্দ করতাম,তাকে ভালোবাসা বলে কিনা জানি না। তবে তোমার সাথে যখন আমার বিয়ের কথা শুরু হয় তখন উনি একটা বই উপহার পাঠায় আমার চাচাত ভাই এর হাতে,যে বই এর প্রথম পাতায় লিখা ছিল- “নিজের ভেবে অনেক যত্নে লালন করা কোনো ফুলের চাড়া থেকে যখন ফুল হয় আর সেই ফুলের অধিকার যখন অন্য কারো হয়ে যায়,তখন সেই গাছের মালির জীবনে আর কখনো ফুল ফুটে না।” সেদিন অল্প বয়সে সেই লিখার মানে বুঝতে পারিনি,যা কিছুদিন আগে বুঝতে পেরেছি।
-বাহ!বেশ ইন্টারেস্টিং তো,এই বুড়ো বয়সে বুড়া বউ এর ছোটোকালের প্রেম কাহিনী শুনছি,হো হো হো।
-হাসছো?
-তবে আর কি করব বলো।আচ্ছা,চলো চা খাই।
-না,আমার কথা শেষ হয়নি।
সেই লিখার অর্থ আমি তখন বুঝিনি,এখন বুঝেছি,আলম ভাই আজ পর্যন্ত বিয়ে করেন নি!।শুধু আমার জন্যে সামাদ!
শুধু আমার জন্যে। আজ উনি একা।উনাকে দেখার কেউ নেই।উনার জীবন টা নষ্ট হয়ে গেলো শুধু আমার জন্যে! কথা গুলো বলতে বলতে গলা ধরে এলো বীণার।
-আচ্ছা,শান্ত হও তুমি।এভাবে বলছো কেন।আল্লাহ যা ভাগ্যে রেখেছিলেন।
-না,আমাকে আজ বলতেই হবে।
সামাদ,তোমার প্রতি আমার পূর্ণ সম্মান রেখেই বলছি,তোমাকে আমি সত্যি ই অনেক ভালোবাসি কিন্তু আজ আমার বাঁধন খুলে দাও। এতগুলো বছর একসাথে দিন কাটিয়েছি,পাশপাশি ঘুমিয়েছি,সন্তানদের বড় করেছি।বিয়ের পর থেকে আমার একটিবারের জন্য ও আলম ভাই এর কথা মনে হয়নি,কারণ তুমি এমন একজন মানুষ যে কিনা আমাকে সুখে ভরিয়ে রেখেছিলে সর্বক্ষণ। আমি আজ কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়েছি,তুমি আমাকে স্বেচ্ছায় ডিভোর্স দাও,নাহয় আমি ই দিতে বাধ্য হবো।আমি আলম ভাই কে বিয়ে করবো!
-বীণা!
তুমি যা বলছো ভেবে বলছো?তোমার কতগুলো ফুটফুটে নাতি-নাতনী,তাদের সামনে তুমি এভাবে আমার কথা একটিবার ভাব্বে না বীণা!? আমি কি করব এই শেষ বয়সে একা এই বিশাল বাড়িতে? বীণা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে শুধু বললো-পেপার টা কি তুমি পাঠাবে নাকি আমি? বলে উঠে রুমে চলে গেলো। সারারাত দুইজনের মনের ভেতর কতটা ঝড় গেলো সেটা শুধু তারাই জানে,একই খাটে ২জন ২ প্রান্তে ১মাস পর, আলম নামের সেই বৃদ্ধ একটু ছোট্ট অন্ধকার ঘরে শুয়ে আছে,বীণা ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে আলম কে নিয়ে ঢাকা যাবে চিকিৎসার জন্য।আলমের কথা মুখে আটকে যায়,অনেক কথাই বোঝা যায় না ভালোভাবে,কিন্তু বীণা বুঝে নেয়। আলম অনেক পুরানো এক স্যুটকেস থেকে এক রূপার চুড়ি বের করলো।চুড়ি টা সেই ৪৫ বছর আগে বীণার ছিল,সেটা আলম লুকিয়ে নিয়ে এসেছিল বীণার জন্য চুড়ির মাপ দিয়ে চুড়ি বানাবে বলে।
সেই চুড়ি আজো রেখে দিয়েছে সে। চুড়ি টা হাতে নিয়ে কেঁদে দিল বীণা। নিজের ভেতর এক চরম অপরাধবোধ কাজ করতে লাগলো, কিন্তু সে এখন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আজ থেকে সে স্ত্রী হিসেবে যতটা সম্ভব আলম কে সুখে রাখবে। আলম এর বাবার রেখে যাওয়া অনেক সম্পত্তি,কিছু বিক্রি করে ঢাকায় একটা দখিন হাওয়া আসে এমন সুন্দর নিরিবিলি এক জায়গায় ফ্ল্যাট কিনে ফেলল বীণা।নতুন করে সংসার সাজালো বীণা,আলম লাঠি ভর করে সারা ঘড় হাঁটে আর অবাক হয়ে দেখে। এই বয়সেও বীণা সুন্দর করে শাড়ি পরে চুলে বেলী ফুলের মালা পরে আলমের সাথে বসে গল্প করে।আলম অবাক হয়ে শুধু দেখে আর গল্প শুনে,আর যেন প্রশান্তির হাসি দেয়! এভাবেই ৩মাস কেটে গেলে,এক সকালে বীণা ঘুম থেকে উঠে আলম কে ডেকে তুলতে গিয়ে বুঝতে পারল আলম আর নেই!
হাসি মুখে শুয়ে আছে বিছানায় নিথর দেহ! বীণাও কাঁদেনি। এখন বীণা কে সকলেই আঙুল তুলে কথা বলে,ছি ছি করে।কি করলো সে এই বৃদ্ধ বয়সে।তার ছেলেমেয়েরা অবশ্য কিছু বলে না,তবে তারাও লজ্জিত তাদের মায়ের এমন ডিসিশনে। কিন্তু বীণা বিশ্বাস করে,তার ৪২ বছরের অপরাধবোধ আজ আর তার মাঝে নেই।আলম অন্তত ৩টা মাস ভালোবাসায় বেঁচেছিল,মৃত্যুটা তার হাসিমুখে হয়েছিল প্রিয় মানুষের পাশে।এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।তার চেয়ে বেশিকিছু এই মুহুর্তে ভাবে না সে!
গল্পের বিষয়:
গল্প