ভুল পদ্ধতি

ভুল পদ্ধতি
ঢাকায় আমার মামার বাসায় গিয়ে আমি রীতিমত নির্বাক। আমার একমাত্র মামাতো বোন মারজিয়া মাহজাবিন তখন আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজে ক্লাস সেভেনে পড়ত। সে প্রায় প্রতিদিন স্কুলে হয় স্কেল, নয় কলম, নয় খাতা রেখে চলে আসত। মাঝেমধ্যে তার ব্যাগ থেকে বইও মিসিং হয়ে যেত। ব্যাপারটা নিত্য নৈমিত্তিক একটা ঘটনা ছিল। আমার মামী ওকে কিছুই বলত না। সাথে সাথে আরেকটা বের করে দিত। আমার কাছে বিষয়টা মোটেও ভালোলাগেনি। আমার ভালোলাগা নিয়ে কিছু বলছি না। তাদের একমাত্র মেয়ে, কিছু বললে মনে কষ্ট পাবে, সেজন্য হয়তো চুপ করে থাকতেন। এবার যখন দেখলাম পড়তে বসলে কোনোভাবে যদি কলমটা টেবিলের নিচে পড়ে যায় বা হারিয়ে যায় ও আর সেটা তুলত না। ড্রয়ার খুলে আরেকটা বের করে নিত। কারণ সব প্রয়োজনীয় জিনিসই মামা বেশি করে কিনতেন। এবার আমার কাছে বিষয়টা দৃষ্টিকটু লাগল। মনে হতো এটা কোনোভাবেই সঠিক পদ্ধতি না। মামী কিছু মনে করতে পারেন সেজন্য কখনো কিছু বলা হয়নি। এখন ওরা আমেরিকায় থাকে, জানি না জীবনযাপনে কোনো পরিবর্তন এসেছে কি-না!
আমরা যখন স্কুলে পড়তাম, আব্বা রিম হিসাবে কাগজ, ডজন হিসাবে কলম আনলেও, আমার আম্মা কলমের কালি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আরেকটা কলম কখনোই বের করে দিতেন না। কখনো ভুলে স্কুলে কলম হারালে টিচারকে নালিশ করতাম, সারা ক্লাসে কলম খুঁজতাম। কখনো কখনো খুঁজে না পেলে মায়ের বকার ভয়ে কান্নাও করতাম। কাগজ কলমের অভাবের কারণে এটা করতাম না। এটা একটা সিস্টেম ছিল সেজন্যই করতে হতো। এবার আমার বাচ্চাদের পেন্সিল দিয়ে হাতে খড়ি হলো। মেয়ে লিখবে সেই খুশিতে ওর আব্বু পাঁচ ডজন পেন্সিল, অগুনিত ইরেজার ও শার্পনার নিয়ে আসল। দেখা যাচ্ছে ওর স্বরে -অ বর্ণ শেখার আগেই ওর পেন্সিল, শার্পনার কিছুই নেই। কিছু ওদের খেলনার বক্সে, কিছু খাটের নিচে, কিছু জানালা দিয়ে বাইরে, কিছু ভাঙা বাকিগুলো কোথায় রেখেছি খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। বলার সাথে ওর আব্বু আবার নিয়ে আসল। খাতারও একই অবস্থা।
এবার পাশের রুমে ওদের কাজিন ওহী, ওদের থেকে বছরখানিক বড় হবে। সেও লিখতে শিখেছে, স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে। ওর আম্মুর কাছে মোটামুটা জিনিসপত্রের অভাব নেই। ওর খালামনি জার্মান থেকে বস্তাভরে বাচ্চাদের প্রয়োজনীয় জিনিস ওকে গিফট করে। ওর আব্বু দেশের বাইরে গেলে তো আনেই। ওর জন্মদিনে গিফট পড়ে। চাচ্চুরা,ফুফিরা দেয়। সব মিলিয়ে সারাজিবন পেন্সিল দিয়ে লিখলেও সব শেষ হবে না। অথচ ওর আম্মু ওকে পেন্সিল বক্সে একটা পেন্সিল আর একটা ইরেজার দেন। লিখতে লিখতে পেন্সিল শেষ হয়ে গেলে এবার পিছনে কলমের ক্লিপ দিয়ে বড় করে দেন, তারপরও পুরোপুরি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আরেকটা দেন না। চকও শেষ হয়ে গেলে ছোট টুকরো একটা বক্সে রাখেন।
নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসের ক্ষেত্রে তিনি এতটাই সিস্টেম মেনটেইন করেন। অথচ ওর মা মোটামুটি ঐশ্বর্য নিয়ে বড় হয়েছে। ওর নানাভাই ব্যাংকের প্রিন্সিপ্যাল অফিসার ছিলেন। ও এতটা অসাধারণ বাচ্চা, মাশাল্লাহ কী বলব! আপনি ইচ্ছে করলেও ওর দোষ খুঁজে পাবেন না। ভাই বোনদের সাথে ওর কোনোদিনও খেলনা নিয়ে, খাবার নিয়ে মনোমালিন্য হয়নি। বাচ্চাদেরকে সঠিক পদ্ধতিতে মানুষ করতে হয়। আমি খুব করে ভাবীকে ফলো করার চেষ্টা করি, জানি কখনো পারব না। কিছু মানুষ এতটাই সুশৃঙ্খলিত হয়। এদেরকে নিয়ে গর্ব করতে হয়। কিন্তু চেষ্টা করেও ওদের মতো হওয়া যায় না।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত