আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে, আজ প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর ধরে ভাইয়ার বাসায় থাকছি। শুধু যে একা আমি তাও না সাথে আমার একটা মেয়েও আছে। কখনো যেন ভাইয়া বা ভাবী কিছু বলতে না পারে সেজন্য আলাদা সতর্কতায় আমি সবসময়ই থাকি। তাও হুটহাট একটু আধটু অসতর্কতা হয়েই যায়। যার জন্য আমি ভাবীর কিছু শক্ত কটু কথা শুনতে প্রস্তুত থাকলেও আমার মেয়েটাকে কখনো এসবে জড়াতে দেই না।
আমার মেয়েটা এখন ভালো বড় হয়েছে, দশম শ্রেণীতে পড়ে। একজন মেয়ের খরচ কী পরিমাণ হয় তা একটা মেয়েই বুঝতে পারে। আনুষাঙ্গিক খরচ বাদ দিয়েও লেখাপড়ার খরচ ধরতে গেলে অনেক টাকা পয়সার বিষয়। যা অনেক সময়ই আমার ভাইয়ার কাছ থেকে চাইতে গেলে ভাবীর মুখ টা দেখার মতো হয়ে উঠে।আমার স্বামী থাকাকালীন আমার মেয়েকে যে স্কুলে পড়াতাম বা যেভাবে সে চলাফেরা করতো তা চাইলেও আমি বদলাতে পারবো না। হয়তো আমি মানিয়ে নিয়েছি কিন্তু আমার মেয়েটা তার বাবা থাকাকালীন যেরকম পোশাক পড়তে চাইতো বা যেরকম খাবার খেতে চাইতো আজও তার বিপরীত নয়। আর আমি চাইও না আমার মেয়েটা কষ্ট করে জীবন পাড়ি দিবে। লাগলে আমি কষ্ট করতে রাজি আছি। বাবা-মা মারা যাওয়ার পরে এই বাসাটায় আমি কখনো আমার নিজ বাসা হিসেবে কোনো অনুভূতি পাই নি। মনে হতো এটা অন্য কারো বাসা। যদিও ভাইয়া মাঝে মাঝেই বুঝাতো –
~ তোর ভাবী ওই একটু আধটু বলবেই সেগুলা কানে নিলে চলবে নাকি। তুই তোর বাসায় থাকিস এখানে তোর ছোট হয়ে থাকার কিছুই নেই। আমি যতদিন আছি তুই আর হিয়া নিঃসংকোচে এ বাসায় থাকতে পারবি। ভাইয়ার এসব কথা যেন আমাকে আরও বেশি দুর্বল করে দেয়। আমি শক্ত হতে যেয়েও শক্ত হয়ে উঠতে পারি না। মাঝে মাঝেই ভাবি কেন আমার সাথেই এমন টা হলো। আমার কষ্ট তখন আরও বেশি যখন আমার মেয়ের সামনে আমার ভাইয়া তার মেয়েকে আদর করে। সেটা দেখে আমার মেয়েটার মনে একটু হলেও কষ্ট জন্মায় তা আমি বুঝতে পারি কিন্তু কিছুই যে করার নাই। কিছুদিন আগে ভাবী কথায় কথায় বলেই উঠলো –
~ এবার তো বিয়ে করা উচিত তোমার। আমার স্বামী আর কতদিন তোমাকে আর তোমার মেয়েকে টানবে। তার কী নিজ সংসার নাই। তার উপর তোমার মেয়ের যেই খরচ রে বাবা! অন্তত তুমি বিয়েটা করলে তো, তোমার খরচ চালানো থেকে আমার স্বামী টা বাঁচবে! আমি কী করে বুঝাবো যে আমার মেয়ের সুখের জন্যই আমি অন্য বিয়ে করতে রাজি হচ্ছি না। এখন তো শুধু ওর বাবা নেই পাশে যদি আমিও চলে যাই তাহলে আমার মেয়েটা যে নিঃস্ব হয়ে যাবে। এসব কথা কেউ যেন বুঝতেই চায় না। তবুও অনেক কষ্ট করে আমি দ্বিতীয় বিয়ে থেকে বিরত আছি। বেশিদিন হয়নি এই কথাগুলো ভাবী আমাকে বলেছে এর মধ্যেই দেখি আমার মেয়ের জন্য পাত্র খোঁজা শুরু করলো। আমি তো অবাক। আমার বিয়ে দিতে পারছে না বলে আমার মেয়েকে বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছে। তাদের বাসায় থাকি বলেই এতো কিছু। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আর আমার মেয়ে চলে যাবো। অন্য কোথাও থাকবো ছোট্ট একটা বাসা নিয়ে। আমি সেলাই কাজ বা ক্রাফটের কাজ শুরু করবো।
যেই ভাবলাম অমনি দুই মাসের মাথায় সব রেডি করে ফেললাম। আমার স্বর্নের কিছু গহনা ছিল সেসব বিক্রি করে একটা ছোট বাসা নিলাম এবং সেলাই কাজ করার জন্য মেশিন কিনলাম। এইসব কিছুই ভাইয়া কে বলেছি আমি। উনি আমাকে একবার ও বারণ করে নি যে তোর বাসা থেকে তুই কেন চলে যাবি বা কিছু কী হয়েছে কি না।
আমিও আর কিছুই বলি নি। ভাইয়া কিছু টাকা দিলো ক্রাফটের কাজ শুরু করার জন্য। সেগুলো আমি ফেরত দিতে চেয়েছি কিন্তু ভাইয়া নেয় নি। ভাবীকে আমি চলে আসার সময় দেখলাম খুব খুশি। খুব সুন্দর করে কথা বলছে। আর হিয়াকে বারবার চুমু খাচ্ছে। যেটা এই প্রথম আমার দেখার সৌভাগ্য হলো। সবাইকে বললাম দোয়া রেখো যেন সামনের পথ এগোতে পারি। নতুন বাসায় উঠলাম আজ পনেরো দিন হলো। সবকিছুই মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে এখন। আমার মেয়েটা একদমই মানিয়ে নিতে পারছে না। তবুও খুব কষ্ট করে আমি মানিয়ে নেওয়ার ট্রাই করছি। সেলাই মেশিন দিয়ে কাপড় বানানো শুরু ও করেছি। দিনকে দিন কাপড়ের অর্ডার ভালোই আসছে।
হুট করেই মনে পড়লো আমার মেয়েটাও ক্রাফটিং ভালোই পারে আর আমিও মোটামুটি। তো দুইজনে মিলে একটা অনলাইন বিজনেস শুরু করলে কেমন হয়। সেই থেকে অনলাইন বিজনেস শুরু করার জন্য লেগেছিল প্রায় সাড়ে তিন মাস। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমি আমার বিজনেস কে ভালোভাবে নিয়ে যেতে পারবো বলে আশা রাখছি।
আমার মেয়েটার কষ্ট এখন একটু কম হয়। ভাবীর কটু কথা, চোখমুখ কালো করে কথা বলা বা হেয়ভাবে দেখা এইসব কোনোটার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না। ভাইয়া মাঝে মাঝে দেখে যায় তবুও নিজ ইচ্ছায় না জোর করেই আসে তা বুঝি।
আমি ভাইয়াকে বলেছি, ধীরে ধীরে এতো বছরের সব খরচ শোধ দিয়ে দিবো কিন্তু ভাইয়া রাজি হয় নি। আমি তবুও ভাবীর কাছে প্রায়ই কিছু টাকা দিয়ে দেই। হয়তো বেশিদিন আমার মেয়ের পাশে থাকতে পারবো না কিন্তু যতদিন পারি থাকবো। দ্বিতীয় বিয়ে তো মুখেও আনবো না। আমার মেয়েও মাঝে মাঝে বলে চলো আম্মু তোমাকে বিয়ে দেই। আমি হাসি আর বলি এখন তো সময় তোমার মামণি।
গল্পের বিষয়:
গল্প