প্রথম বিয়োগ

প্রথম বিয়োগ
আমি বাথরুমে ঢুকবো আর ফোন বাজবে না, তা কী করে হয়! আম্মাকে ডেকে বললাম, ফোনটা তুলো। আমি ঘষামাজা করে গোসল দিচ্ছি আর গলা ছেড়েছি, বন্ধু আইলাই না…রে, ও বন্ধু আইলাই না….রে। আম্মা ফোনে কথা বলছে। কথার ভঙ্গিমা শুনে বুঝতে পারলাম বড় খালার ফোন। বড় খালা আজব প্রকৃতির মানুষ। তার কর্মকান্ডে বরাবরই কিছু অস্বাভাবিকতা থাকে। ভাবছি, হঠাৎ আমাকে কেনো ফোন করলো। একটু পর আম্মা চেঁচালো, এবার বের হ রে অমানুষ। গান গাইতে গাইতে গলা ছিঁড়ে রক্ত বেরুলেও বাথরুমে কোনো বন্ধু আসবে না। আমি তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলাম, আম্মা, কে ফোন করলো গো? তোর বড়ো খালা। কি বলেছে? বলেছে তুই গোসল শেষে একবার যেনো ফোন করিস। খুব দরকার তোকে। আমি বড় খালার নাম্বার ডায়াল করলাম। বন্ধ জানাচ্ছে। কি মুশকিল, মাত্রই না ফোন করলো। এখন আবার সুইচড অফ!
আমি আম্মাকে ডেকে বললাম, বড় খালার নাম্বারে কল যাচ্ছে না। সুইচড অফ। আম্মা ওরুম থেকে উঁচু গলায় বললো, ফাইজার নাম্বার ডায়াল করে দেখ না। খুব দরকার বললো যে। ফাইজা হচ্ছে বড় খালার একমাত্র মেয়ে। সবে কলেজ পাশ করেছে। অত্যন্ত মেধাবী এবং সুশ্রী। তবে আমি তাকে সহ্য করতে পারি না। এবং সহ্য করতে না পারার প্রধান কারণ হচ্ছে, এই গ্রহে এর মতো বাচাল আমি আর দ্বিতীয়টি দেখি নি। যাহোক, উপায় না দেখে ওকেই ফোন করলাম। হ্যালো আরে ভাইয়া যে, আসসালামু আলাইকুম। হুম, খালাকে ফোনটা দে তো। আগে সালামের উত্তর দাও। তারপর ভাবছি। উত্তর দিয়েছি তো মনে মনে। মনে মনে উত্তর দিলে হয় না। সালাম প্রদানকারীর মনে তৃপ্তি আসে না। পরের বার থেকে জোরগলায় উত্তর দিবা, ঠিকাছে? আচ্ছা ঠিকাছে। এবার ফোনটা তো দে খালাকে।
আরে আরে, এতো তাড়া কিসের? কতদিন পর কথা হচ্ছে তোমার সাথে। আমি ফোন করলে তো তুলোই না। আর এখন নিজে থেকে ফোন করে তাড়াহুড়ো করছো কেনো? আমাকে জিজ্ঞেস করো ভালো আছি কি না, সব ঠিকঠাক আছে কি না আমি রুক্ষ অথচ স্থির কন্ঠে বললাম, ফাইজা, কেমন আছিস তুই? সবকিছু ঠিকঠাক চলছে তো? সে ফিক করে হেসে বললো, হ্যাঁ হ্যাঁ, সব ঠিকই আছে। তবে একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। শুনবে? আমি সচ্ছল কন্ঠে সম্মতি দিলাম, নিশ্চয় শুনবো। তবে তার আগে খালার কাছে ফোনটা দে। জরুরি আলাপ আছে। পরে ফোন কেটে দিবা না তো? না। আচ্ছা একটু দাঁড়াও, আম্মুকে ডেকে দিচ্ছি। হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম খালা। তোমার ফোন অফ কেনো? ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি খেয়াল করি নি রে। ইদানীং খুব সমস্যা করছে ফোনটা। যাহোক, যে জন্য ফোন করেছিলাম, তোকে একবার আসতে হয় যে বাপু। আমি মনে মনে একটু হতাশ হয়ে বললাম, কেনো? খালা প্রচণ্ড উৎসাহের সঙ্গে বললো, একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। আত্মীয়স্বজন সকলে কালকের মধ্যেই চলে আসবে। তুইও চলে আয় কালকে। আসতেই হবে কিন্তু। আমি এবার পুরোপুরি হতাশ হলাম। তারপর বললাম, কিসের অনুষ্ঠান বলো তো খালা?
পরিষ্কার করতে গিয়ে আমাদের টিভিটা মেঝেতে পড়ে গেছিলো। তারপর আর কি, গুঁড়ো গুঁড়ো। এখন একটা নতুন টিভি কিনেছি, অনেক বড়ো। ছাপ্পান্ন ইঞ্চি। এই উছিলায় একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। তুই কালকে সকাল সকাল চলে আসবি। এখন রাখছি। ফাইজা দ্রুত ফোনটা নিয়ে হ্যালো হ্যালো বলছিলো, আমি খট করে কেটে দিলাম। ভাবছি, এবার খালাকে একটা ডাক্তার দেখানো জরুরি হয়ে পড়েছে। কি সব আজগুবি কথা! টিভি কিনেছে তাই অনুষ্ঠান করতে হবে, তাও সব আত্মীয়স্বজন দাওয়াত করে। কিছু করার নেই। আয়োজনে সামিল হতেই হবে। সকাল সকাল উঠেই রওনা করলাম। নেত্রকোনা টু ঢাকার জার্নিটা খুব ছোট নয়। বাসেই যাচ্ছি। মহাখালী নেমে সিএনজি নিলাম। খালার বাসা মিরপুর-১০ নাম্বার। বাসায় গিয়ে কলিং বেল চাপলাম। দরজা খুললো ফাইজা। দরজা খুলে আমাকে দেখেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, আহ্ ভাইয়া, ঘেমে গিয়েছো কেনো? আমি দরজায় দাঁড়িয়েই বললাম, অনেক গরম পড়েছে আজ, তাই। ফাইজা আবার প্রশ্ন করলো, অনেক গরম পড়েছে কেনো? অনেক রোদ তাই। অনেক রোদ কেনো?
এবার আমি চেঁচিয়ে খালাকে ডাকলাম। খালা এগিয়ে এসে বললো, কি রে, আয় ভেতরে আয়। তোর মার সাথে কথা হলো মাত্র। তোর গলা শুনেই বলে দিয়েছি, তুই এসে গেছিস ঠিকঠাক মতো। সন্ধ্যে হয়ে এলো। প্রায় সকল আত্মীয়স্বজন এসে জড়ো হয়ে গেছে। বাড়িতে আনন্দের সীমা নেই। আমি চুপচাপ এক কোণায় বসে রইলাম। আমার এতো ভিড় কখনোই ভালো লাগে না। তাছাড়া এতো বড়লোক আত্মীয়স্বজন এসেছে সব, তাদের সামনে না চাইলেও নিজেকে কেমন ছোট ছোট লাগে। তাদের সাথে কথা বলতে গিয়ে কেমন আটকে যাই, কারোর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারি না, সামনে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাই। সবসময় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। তবে ফাইজাকে কোনোমতেই ফাঁকি দিতে পারি না। সবসময় ঘুরঘুর করে আর কানের কাছে বগড় বগড় করে। এখন বুঝতে পারছি, খালা কেনো যে আধ-পাগল হয়েছে।
কিছুক্ষণ আগে সে আমার রুমে এসে নরম সুরে বললো, ভাইয়া তোমাকে আমি কিছু বলতে চাই। আমি ওর দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম। এই প্রথম আমি ওকে ফাজলামো ছাড়া কথা বলতে দেখছি। চেহারা বেশ গম্ভীর, এমন যেন, সে খুব ভয় পেয়েছে মাত্রই। আমি বললাম, কী বলবি বল। সে নির্ভয়ে বলতে লাগলো, জানি না তুমি কী ভাববে বা কিভাবে নেবে বিষয়টা। কিন্তু আমি না বলে থাকতে পারছি না। আমি ছোটবেলা থেকেই দাঁড়া দাঁড়া, আমি তাড়াহুড়ো করে ওকে আটকে দিলাম। তারপর বললাম, এবার বের হ, যা। আর কিছু বলতে হবে না। আমি ওকে ঠেলে বের করে দিলাম। ও কোনো প্রতিবাদ করলো না। শুধু স্বচ্ছ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমি দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ বিষয়টা নিয়ে ভাবলাম।
যাহোক, রাতের খাবার শেষ হলো। কয়েকজন মিলে একসাথে বসলাম। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প হচ্ছে। আমি শ্রোতা সেজে বসে ছিলাম, তবে কিছুক্ষণ যাবৎ টুকটাক কথায় সামিল হচ্ছি। বড়লোকদের দূর থেকে যতটা রুক্ষ মনে হয়, কাছাকাছি আসলে তারা ততটাই অমায়িক। তবে সবার ক্ষেত্রে নয় অবশ্যই। কথায় কথায় একটা খেলা খেলবার প্রস্তাব দেয়া হলো। সবাই নিজের সম্বন্ধে এমন একটা তথ্য দেবে, যেটা সম্পর্কে অন্যরা অবগত নয়। সকলের কথা উল্লেখ করে লাভ নেই। অযথা সময় নষ্ট। নিজে যেটা বললাম সেটাই বলি। আমি মাথা নিচু করে বললাম, আমি কবিতা লিখতে পারি। আমার কথা শুনে কেউ চুপ থাকলো, কেউ বাহবা দিলো, আর কেউ ফিক করে হেসে ফেললো। হয়তো কেউ অপমান করে নি, তবুও নিজে নিজে কেমন অপমানবোধ করলাম।
পরদিন সকালে ছাদে এসে দাঁড়ালাম। আমি জানতাম ফাইজা আমার পিছু পিছু ছাদে উঠবে। কথা বলার সুযোগ খুঁজবে আবার। তবুও আমি ছাদে এলাম। কেনো এলাম জানি না। ছাদের একপাশে ছায়া, অন্যপাশে রোদ। আমি ছায়াতে গিয়ে দাঁড়ালাম। ফাইজা কাছে এসেই দু হাত জোড় করে অনুরোধ করলো, ভাইয়া প্লিজ আমাকে দু মিনিট সময় দাও। দেবে? আমি স্থির গলায় জবাব দিলাম, তুই যা বলতে চাস তা আমি জানি। ভালোভাবেই বুঝি। তাহলে এড়িয়ে যাচ্ছো কেনো? কারণ এটা কখনোই সম্ভব নয়। তোর প্রতি আমার অমন অনুভূতি আসে না। তুই আর ভুলেও এসব চিন্তা মাথায় আনিস না। আনলে আমি আজই বাড়ি চলে যাবো। না ঠিকাছে, তোমার বাড়ি যেতে হবে না। এই বলে সে ধীরেধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে। আমি তাকিয়ে রইলাম। প্রত্যেকটা সিঁড়ি পার হতে এক সেকেন্ড করে সময় নিচ্ছে। আমি কেনো জানি কিছু ভাবতে পারছি না। অস্বস্তি লাগছে খুব।
খালাকে গিয়ে হাসিমুখে বললাম, খালা, আমার আজ যেতে হবে। কিছু কাজ পড়ে আছে। সেকি রে, সবেই তো এলি। আর দুদিন থাক না। না খালা। পরে আবার আসবো না হয়। তোর আর আসা! যাহোক, যাবার সময় আমাকে মনে করাস তো একটু, তোর মায়ের জন্যে একটা শাড়ি কিনেছিলাম, দিয়ে দেবো সেটা। আচ্ছা খালা। চলে আসার সময় একবার ফাইজার রুমে উঁকি দিতে গিয়েছিলাম। চুপচাপ বসে আছে। আমি ‘আসি’ বলাতে সে সহজলভ্য উত্তর দিলো, আচ্ছা, ভালো থাকবে। আর সাবধানে যেয়ো। শেষ মুহূর্তে আবার ডেকে বললো, ভাইয়া একটা কথা। ওর কন্ঠটা ভেজা। আমার কোথায় যেন বিঁধে গেলো। আমি ফিরে তাকিয়ে বললাম, বল কি কথা। সে মাথা নিচু করে বললো, তোমার ব্যাগে একটা পত্র রেখেছি। প্লিজ এটা ফেলে দেয়ার আগে একবার পড়ে নিয়ো অন্তত।
আমি কিছু না বলেই পা বাড়ালাম। বাসে বসে পত্রটা খুললাম। প্রিয় কবিমশাই শুনো, এটা আমার লিখা প্রথম পত্র। তোমাকে আর কেউ কবি বলে স্বীকার করুক আর না করুক, আমি মন থেকে করেছি। গতরাতে তোমার ব্যাগ থেকে ডায়েরি পড়েছি। সেখানে অনেক কবিতা পড়েছি তোমার। একটা কবিতা পড়ার সময় ভেবেছি, এটা যদি আমাকে উৎসর্গ করে লিখা হতো, তাহলে আমার আর কিছু চাওয়ার ছিলো না। কোনটা জানো? ‘কে ওখানে? কে? নীরবচারী হয়ে নিরলস দাঁড়িয়ে, শরতের সন্ধ্যের মতো নীরবতা ছড়িয়ে যাচ্ছো। কে তুমি? আমার কোমল হিয়াতে বারংবার আঙুল ডুবিয়ে, সদ্য যৌবনা কিশোরীর মতো হেসে উঠছো। কে ওখানে? কে? মুক্ত বাতায়নের ওপাশে প্রদীপ জ্বালিয়ে, চুপিসারে আমাতে ঢের তাকিয়ে আছো। ওখানে কে? আমার কবি-সত্ত্বায়?
প্রকৃতির অনিয়মে তোমার রূপের নেশা ছড়িয়ে, আমাকে দিয়ে এরূপ কলম চালিয়ে নিচ্ছো। কে তুমি জোছনাকুমারী? চন্দ্রের মতো আমার অনুভবে জোছনা মাখিয়ে, আমাকে ধীরেসুস্থে একমুঠ দাসত্ব দান করছো।’ ভাইয়া মনে আছে তোমার? আমি তখন নবম শ্রেণিতে। আমার জন্মদিনে এসেছিলে তুমি। রাত বারোটায় সর্ব প্রথম তুমি আমাকে উইশ করতে গিয়ে প্রচণ্ড ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। আমি ভয় পেয়ে বেহুশ চিৎকার করে তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। সেই থেকে শুরু। হ্যাঁ, সত্যিই সেই থেকে শুরু। এর শেষ কোথায় জানি না। আমার বন্ধুরা বলে এই সবকিছুই পাগলামি, সাময়িক ভালো লাগা। কিন্তু জানো, এই সাময়িক ভালো লাগাতেই চারটে বছর কেটে গেছে। বেঁচে থাকলে হয়তো চার শতকও কাটবে। তুমি যখন আমাকে এড়িয়ে যাও, তখন আমার সবকিছু কেমন অন্ধকার হয়ে আসে। প্রচণ্ড কাঁদতে ইচ্ছে করে। জানো তো, কাঁদার কথা লিখতে গিয়েও কেঁদে ফেললাম। আম্মু ঠিকই বলে, আমার ছেলেমানুষিটা আর গেলো না। ভালো থেকো।
ইতি
জোছনাকুমারী
আমি বাস থেকে নেমে সোজা বাসায় গেলাম। ফ্রেশ না হয়েই চুপচাপ বসে রইলাম। ফাইজার কথা খুব ভাবছি। মনের কোণে কেমন যেন একটা মায়া জন্মেছে ওর জন্যে। হঠাৎ আম্মা এসে জিজ্ঞেস করলো, কিরে এখনো কাপড়চোপড় পাল্টাস নি যে? আমি আম্মাকে ডেকে কাছে এনে ফাইজার ব্যাপারটা খুলে বললাম। আম্মা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললো, তোর কী ইচ্ছে? আমি বললাম, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমি কনফিউজড। আম্মা বললো, বরং ভালো এইসব চিন্তা বাদ দে। আমার মতের কথা জিজ্ঞেস করলে আমি অমত পোষণ করবো। তোর খালাও এসব শুনে খুশি হবে না।
আমি সত্যিই বাদ দিয়েছিলাম। কিছুদিনের মধ্যে স্বাভাবিকও হয়ে গেলো সমস্ত কিছু। একটু আগে ক্রিকেট খেলে এসে বাথরুমে ঢুকলাম। গলা ছেড়ে গান ধরেছি, বন্ধু আইলানা…রে, ও বন্ধু আইলানা….রে। কিন্তু আমি বাথরুমে ঢুকবো আর ফোন আসবে না, তা কী করে হয়? যথারীতি আম্মা ফোন ধরলো। আজকে আবারো বড় খালার ফোন। আম্মা বাথরুমের দরজার কাছে এসে নির্দ্বিধায় বলে গেলো, তোর খালা জানালো আগামী সপ্তাহে ফাইজার বিবাহ। তোর খালা তোকে ডেকেছে। কালই যেতে বললো। হঠাৎ সবকিছু কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে এলো। এই গরমের মধ্যেও প্রচণ্ড শীত আসলো, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। আমি চোখ বন্ধ করে বাথরুমের মেঝেতে গুটিসুটি মেরে বসে আছি। ভাবছি, আমার জীবনের প্রথম বিয়োগ এটা।
গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত