প্রতিবার গ্রামে ছুটি কাটানোর মধ্যে আলাদা একটা মজা খুঁজে পাই আমি। শহরের ব্যস্ততা এবং অতি আধুনিকতা আমায় টানে না বলে প্রতিবার কলেজ বন্ধ হলেই ছুঁটে আসি গ্রামের বাড়ীতে। আমাদের গ্রামের বাড়ী মেঘনা নদীর তীর ঘেষে অবস্থিত। গ্রামে আসার পর নদীতে দৌড়-ঝাপ আর মাছ ধরেই সময় কেটে যায় প্রতিবার। রাতের বেলা মাঝ নদীতে মাছ ধরাতেও অন্য রকম মজা আছে। গতবার আমিসহ মোট সাত জন মধ্যরাতে গিয়েছিলাম মাছ ধরতে। সেবার প্রচুর মাছ পেয়েছি। তাই এবার বাড়ী আসতেই গতবারের মত মধ্যরাতে মাছ ধরার নেশা চেপে গেল। মাছ ধরার প্রস্তাব দিতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল।
শিমুল ছাড়া আর কেউ রাত্রিবেলা মাছ ধরতে রাজি হলো না। অগত্যা শিমুলকে নিয়েই আমাকে সন্তুষ্ট থাকতে হলো। রাত কিছুটা গভীর হতেই মাঝারি সাইজের একটা নৌকা আর একটা মাছ ধরার জাল নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম আমরা। আমি নৌকার দাঁড় বাইছি। শিমুল জাল নিয়ে নৌকার মধ্যখানে বসে রয়েছে। নৌকার দাঁড় বাইতে বাইতে আমি শিমুলকে জিজ্ঞাসা করলাম, “হ্যাঁ রে শিমুল, গতবার সবাইকে বলতেই এক পায়ে খাড়া ছিল মাছ ধরার জন্য। কিন্তু এবার ওদের কি হলো?” শিমুল বলল, “হেরা ডরাইছে ভাইজান” “কেন?” “কিছুদিন আগে মিঠু ভাই মাঝ রাত্রিতে মাছ ধরতে গিয়া নদীতে ডুইবা মারা যায়। সকালে যহন আমরা হের লাশ খুইজা পাই তহন হের পায়ে শিকলের দাগ আছিল।
গ্রামের সবার ধারণা নদীর দেও মিঠু ভাইরে শিকল দিয়া টাইনা নিয়া পানিতে চুবাইয়া মারছে। তারপর থ্যাইকা গ্রামের কেউ রাত্রিবেলা নদীতে মাছ ধরতে আহে না” গ্রামেরই ছেলে ছিল মিঠু। আমাদের থেকে দু’বছরের বড় হওয়ায় আমরা তাকে মিঠু ভাই বলে ডাকতাম। মিঠু ভাই ভালো সাতার জানতো। তারমত একজন মানুষ নদীতে ডুবে মরবে এটা রীতিমতো অবিশ্বাস্য বেপার। আমি শিমুলকে বললাম, “তাহলে তুই এলি কেন আমার সাথে? তোর ভয় লাগে না?” “না ভাইজান, এইসব দেও-দানব বলতে কিছু নাই। এগুলো সব ভুয়া কথা।” “তাহলে মিঠু ভাইয়ের পায়ে শিকলের দাগ এলো কি করে?” আমার প্রশ্ন শুনে চুপ করে রইলো শিমুল। এর উত্তর তার জানা নেই।
চাঁদের আলোয় নদীটাকে সাদা বালুর মরু উউদ্ দানের মতো মনে হচ্ছে। নদীর পাশে থাকা ছোট-বড় চরের বালুর উপর চাঁদের আলো পড়ে বালুগুলো চিক চিক করছে। যতদূর চোখ যায় শুধু জলরাশি চোখে পড়ে। আজ মনে হয় আমরা ছাড়া আর কেউ মাছ ধরতে আসেনি। আসার কথাও না। গ্রামের মানুষ মিঠু ভাইয়ের মৃত্যু নিয়ে বেশ আতঙ্কিত হয়ে রয়েছে। মাঝ নদীতে পৌঁছেই আমরা মাছ ধরায় লেগে পড়লাম। শিমুল আর আমি পালা করে নদীতে জাল ফেলতে লাগলাম। বেশ ভালোই মাছ উঠতে লাগলো জালে। একটা সময় শিমুল বলল, ভাইজান চলেন ফিইরা যাই। মাছ তো মেলা ধরলাম। জাল উঠিয়ে আমরা ফিরে চললাম। এবার শিমুল দাঁড় বাইছে। আমি মাছের ঝোলা নিয়ে নৌকার মাঝখানে বসে আছি।
দাঁড় বাইতে বাইতে শিমুল হেরে গলায় “মাঝি বাইয়া যাও রে” গানটা ধরলো। নদীর মিষ্টি হাওয়া আর শিমুলের গান, দুটো মিলিয়ে মন বেশ ঝরঝরে হয়ে উঠলো। আমাদের নৌকা যখন বড় চরের কাছে পৌঁছালো তখন চাদের আলোয় মনে হলো চরের পাড়ে কিছু একটা নড়ছে। শিমুলের হাবভাব দেখে বুঝতে পারলাম সেও দেখেছে। চরের কাছাকাছি যেতে দেখলাম একটা মহিলা কোলে ছোট বাচ্চা নিয়ে আমাদের ইশারায় ডাকছে। এত রাতে চরে কোনো মহিলাকে বাচ্চা কোলে নিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে যে কেউ অবাক হবে। শিমুল আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। আমি নৌকা চরের দিকে নিতে বললাম। পাড়ে নৌকা ভেড়াতেই মহিলা লাফ দিয়ে উঠে এলো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “এত রাতে আপনি এখানে কি করছেন?” মহিলা কোনো কথা বলল না। নীরবে আমার মাছের ঝোলার পাশে গিয়ে বসলো। নৌকা আবার মাঝ নদীতে চলে এলো। আমি আর শিমুল পেছনের দিকে বসে রয়েছি। শিমুল দাঁড় বাইছে আর সন্দেহের চোখে মহিলার দিকে তাকাচ্ছে। কাপড় দিয়ে মুখ ডেকে রাখায় মহিলার চেহেরা দেখিনি।
এখন আমাদের দিকে পিঠ দিয়ে বসে রয়েছে। হঠাৎ শিমুল আমাকে খোচা দিয়ে বলে, ভা-ভাইজান। এরপর সে আমাকে তার হাতের দিকে ইশারা করে। তাকিয়ে দেখি ও দাঁড় বাইছে না। অথচ নৌকা আগের মতই চলছে! বোকা বোকা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে শিমুল। যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ আমার খেয়াল হলো মহিলা যে চর থেকে নৌকায় উঠেছে সে চরে গ্রামের পুরোনো কবরস্থান ছাড়া আর কিছু নেই! মহিলা উঠে দাড়ালো। বাচ্চাটা নৌকার পাটাতনে রেখে নদীতে ঝাপ দিল। ভয়ের একটা শিহরণ আমার শিরদাড়া বেয়ে নিচে নেমে গেল। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখলাম ছোট বাচ্চাটা ঝোলার পাশে বসে ঝোলা থেকে মাছ খাচ্ছে। আতঙ্কিত শিমুল পাশ থেকে নড়ে উঠলো।দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাটাকে নদীতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আমাকে দাঁড় বাইতে বলল আমি প্রাণপনে দাঁড় বাইতে লাগলাম। কিন্তু নৌকা একটুও নড়লো না। এদিকে শিমুল ভয়ে কাঁপছে। আমিও কিছু বুঝতে পারছি না। খেয়লা করলাম ঝোলাতে আধ খাওয়া কিছু মাছ পড়ে রয়েছে। শিমুলের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম।
চাঁদের আলোয় ওর পেছনে মহিলাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম। মহিলার মুখে কাপড় নেই। দেখলাম মহিলার চোখ দুটোর জায়গায় ফাঁকা কোটর। ঠোটও নেই। দুপাটি দাত ভয়ংকর ভবে বেরিয়ে রয়েছে। তুই আমার বাচ্চাকে নদীতে ফেলেছিস, তোকে আমি ছাড়বো না। ভয়ংকর একটা চিৎকার দিয়ে শিমুলের দিকে তেড়ে আসে মহিলা। শিমুল কিছু বুঝে উঠার আগেই মহিলা ওকে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “অনেকদিন বাচ্চাটা না খেয়ে রয়েছে। এবার পেট ভরে খেতে পারবে।” আমার চোখের সামনে থেকে বাতাসের সাথে মিলিয়ে গেল মহিলাটি। আতঙ্কিত চোখে আমি নৌকার পাটাতনে তাকিয়ে আছি। ছোট বাচ্চাটা আমার দিকে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। মুখে ভয়ংকর হাসি। মহিলার মত বাচ্চাটিরও চোখ এবং ঠোট নেই।