প্রমোশন

প্রমোশন

ই প্রজেক্টে যদি ভালো করে কাজ করা যায়.তাহলে আর আমায় পেছন ফিরে তাকাতে হবেনা.এখন তো সামনে আর কোনো পথের কাঁটাও নেই”. নিজের ফ্ল্যাটে রাত্রিবেলা শুভদীপ তার ল্যাপটপটা সামনে রেখে কথাটা ভাবলো আর তার সঙ্গে তার প্রাক্তন সহকর্মী এবং বন্ধু পরিতোষের উদ্দেশ্যে একটা ক্রুর হাসি হাসলো. শুভদীপ কলকাতার এক খ্যাতনামা তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মচারী আর পরিতোষ ছিল তার সেই অফিসের প্রাক্তন সহকর্মী.শুভদীপ আর পরিতোষ দুজনেই একই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র ছিল.ফাইনাল ইয়ারে কলেজের ক্যাম্পাসিংয়ে দুজনেই একই কোম্পানিতে চাকরি পায়.

সেই কোম্পানিতে শুভদীপ এখনও কর্মরত হলেও দুর্ভাগ্যবশত পরিতোষ টিকতে পারেনি.কারণ পারিতোষের চাকরিটা চলে গেছিলো.এরপর অনেক জায়গায় চাকরির চেষ্টা করেও নামজাদা কোম্পানি থেকে বহিস্কৃত হওয়ার বদনাম কপালে নিয়ে ঘোরার অপরাধে তিন মাসে হাজার চেষ্টা করেও নতুন একটা চাকরি জোগাড় করতে পারলোনা পরিতোষ. পাড়ার কাকিমা জেঠিমাগুলো পরিতোষের মা কে বারবার ছেলের চাকরির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়া শুরু করলো.লজ্জায়, অপমানের জ্বালায় অবসাদগ্রস্ত পরিতোষ তাই একদিন অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে পৃথিবীকে চিরবিদায় জানালো.

পরিতোষের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে শুভদীপ নিতান্তই দুঃখ প্রকাশ করলেও মনে মনে তাকে পরিতোষের এই করুণ পরিণতি ভালোই তৃপ্তি প্রদান করেছিল.কারণ কর্মক্ষেত্রে শুভদীপের পথের কাঁটা ছিল পরিতোষ.পরিতোষের কাজের প্রতি নিবেদন এবং নিষ্ঠা শুভদীপের থেকে অনেক বেশি ছিল.তাই পরিতোষ যদি এখনও শুভদীপের সাথে সেই একই কোম্পানিতে চাকরি করতো সেক্ষেত্রে শুভদীপের প্রমোশন পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিলনা .কারণ তখন প্রমোশনটা পরিতোষেরই হতো. শুভদীপ তার বর্তমান প্রজেক্টের পর যদি প্রমোশন পেয়ে যায় তবে এবার তাকে আরও বড়ো প্রজেক্টে কাজ করানোর জন্য আমেরিকাতে পাঠানো হবে.তখন তার উন্নতি আর কেউ আটকাতে পারবেনা.এই কথাগুলো মাথায় রেখেই প্রবল উৎসাহের সাথে সে প্রজেক্টের প্রোগ্রামিংয়ের কোডিং করছে.কিন্তু কোডিংটা কিছুতেই এক্সেকিউট করাতে পারছেনা সে.প্রথমবার দ্বিতীয়বার তৃতীয়বার বারংবার চেষ্টা করেও সেই একই ব্যাপার.কোড এক্সেকিউট করাতে যাচ্ছে আর সেটা এরর দেখাচ্ছে.

-“কি হলো ব্যাপারটা?কোনো কোড ল্যাঙ্গুয়েজে ভুল হচ্ছেনা তো ? ” কথাটা চিন্তা করে কপালে খানিকটা ভাঁজ পড়লো এবার শুভদীপের.কারণ হাতে সময় খুব কম.পরশুদিন ক্লায়েন্টের কাছে প্রজেক্টের প্রেসেন্টেশন জমা দেওয়ার শেষ দিন.তাই কালকের মধ্যে সমস্ত প্রোগ্রামিংয়ের কোড এক্সেকিউট করে ফ্রেমেওয়ার্ক কমপ্লিট করে প্রেসেন্টেশনটা তৈরী না করতে পারলে,প্রমোশন আর আমেরিকা যাত্রা তো বহুহস্ত দূরের কথা.ক্লায়েন্টের সামনে শুভদীপের বস আর তার সন্মানটাকে আস্ত রাখবেনা.এর আগের প্রজেক্টগুলোতে তার বাকি প্রজেক্টের কোড কপি পেস্ট করে কিছু ল্যাঙ্গুয়েজে পাল্টে দিয়ে পার পেয়ে গেছে.কিন্তু এইবারের প্রজেক্টটা একটু অন্য ধরণের প্রজেক্ট.তাই এক্ষেত্রে আগের প্রোগ্রামিংয়ের থেকে প্রোগ্রামিং গুলো একটু আলাদা ধাঁচের . তাই শেষপর্যন্ত এবার সে গুগলের শরণাপন্ন হলো.সে ঠিক করলো যে গুগল থেকে হাইবারনেটের কিছু প্রোগ্রামিং কোড দেখে সেটা আইডিয়া নেবে. গুগুলে টাইপ করে সার্চ অপশনে এন্টার প্রেস করতে যাবে শুভদীপ আর ঠিক তখনই তার ল্যাপটপের স্ক্রিনটা দপ করে কালো হয়ে গেলো.

-“একি…এ আবার কি হলো?হ্যাং করলো নাকি ল্যাপটপটা”? কথাটা ভেবে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে শুভদীপ ভাবলো ল্যাপটপটা রিস্টার্ট করবে .এমনিতেও যতটুকু কাজ সে করেছে সেটা ল্যাপটপের ফোল্ডারে সেভ আছে তাই ল্যাপটপ শাট ডাউন হলেও কোনোকিছু ফরম্যাট হওয়ার চান্স নেই.তাই সে ল্যাপটপের ব্যাটারিটা একবার খুলে তারপর ব্যাটারিটা ল্যাপটপে লাগিয়ে পুনরায় ল্যাপটপটা চালু করলো.কিন্তু তখনও স্ক্রিন সেই আগের মতো কালোই দেখাচ্ছে. -“এই তো ছমাস আগে ৫০০০০ টাকা দিয়ে কিনলাম ল্যাপটপটা.এরমধ্যেই খারাপ হয়ে গেলো?” কথাটা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ তার কানে একটা পরিচিত গলার স্বর ভেসে এলো. -“কারোর সর্বনাশ করে কখনও বেশিদূর এগোনো যায়না শুভ”. কথাটা কানে আসতেই চমকে উঠলো শুভদীপ. -“কি হলো?ফ্ল্যাটে তো আমি একা থাকি.কে কথা বললো.গলাটা যেন ভীষণ চেনা লাগছে.” কথাটা ভাবতে ভাবতে আবার সেই পরিচিত গলা বলে উঠলো ,

-“আমার কাছে সাক্সেসের চাবিকাঠি ছিল ডেডিকেশন আর তোর কাছে সাক্সেসের চাবিকাঠি হলো শর্টকাট.যার জন্য তোর আজ এই অবস্থা.সামান্য একটা হাইবারনেটের প্রোগ্রাম কোড এক্সেকিউট করতে তোর কালঘাম ছুটে যাচ্ছে.” আগের কথাটা শুনে সেই গলার আওয়াজটা কোথা থেকে এলো সেটা জানার জন্য সে কান পেতে রেখেছিলো.তাই এইবারের কথাটা শোনার পর সে বুঝতে পারলো যে গলার স্বরটা তার ল্যাপটপের থেকে আসছে. গলার স্বরটাও অত্যন্ত চেনা পরিচিত কারোর গলার স্বর মনে হচ্ছে.কিন্তু এ কিভাবে সম্ভব?ল্যাপটপ আবার কথা বলে নাকি?এসব ভেবে মাথায় সবকিছু কিরকম গুলিয়ে যাচ্ছিলো শুভদীপের. এমনসময়ে শুভদীপের সাথে এমন এক ঘটনা ঘটলো যেটা তাকে বিদ্যুতের মতো চমকে দিলো রীতিমতো. তার ল্যাপটপের স্ক্রিনে সে দেখলো পরিতোষ তার দিকে তীব্র ক্ষোভের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে. শুভদীপের সারাশরীর ভয় ঘামছে.সে হয়তো কোনো অশনিসংকেতের আন্দাজ করতে পেরেছিলো তাই সে ল্যাপটপে পরিতোষকে দেখে ভীতস্বরে বললো,

-“ভাই বিশ্বাস কর.আমি সেদিন যা করেছিলাম শুধুমাত্র চাকরিতে উন্নতি করবো বলে.কিন্ কিন্তু বিশ্বাস কর  আ আমি এটা কখনই চায়নি যে তুই মরে যা.ভাই প্লিস আমায় ক্ষমা করে দে.পরিতোষ ভাই আমার ছেড়ে দে আমায়.আমি তোর মৃত্যু চায়নি.” ল্যাপটপের ওপার থেকে ক্ষিপ্ত পরিতোষের আত্মা এবার শুভদীপের উদ্দেশ্যে বললো, -“শাট আপ ইউ ব্লাডি লায়ার.ইউ হ্যাভ রুইনড মি.আমার এই পরিণতির জন্য এই যে তুই শুধু তুইই একমাত্র দায়ী.তুইই আমায় মৃত্যুর কাঠগড়ার দিকে ঠেলে দিয়েছিস.একটা প্রজেক্টের তথ্য অন্য প্রজেক্টের টিম মেম্বারদের সাথে শেয়ার করা নিষিদ্ধ.তুই সেটা জানতি.আর আমার ল্যাপটপ থেকে তুই আমার নাম করে সমস্ত ডাটা অন্য টিম মেম্বারদের এবং তোর চেনা আলাদা একটা কোম্পানিতে কর্মরত বন্ধুকে ফাঁস করেছিস.” কথাগুলো শুনে শুভদীপ বললো, -“মা …মানে?” পরিতোষের আত্মা পাল্টা বললো,

-“অভিনয় হচ্ছে?সেদিন তুই আমার বাড়িতে এসে বললি তোর মেইল আইডি নাকি হ্যাক হয়েছে.সেদিন তাই আমি আমার ল্যাপটপ থেকে তোর মেইল আইডি টা চেক করার জন্য আমার মেলবক্স খুলেছিলাম তোকে রাফ মেইল কম্পোস করে দেখার জন্য যে তোর আইডিটা ঠিক আছে কিনা.ঠিক তখনই তুই বললি তোর জন্য জল আনতে.সেদিন আমার মা বাড়ি ছিলোনা তাই আমাকেই যেতে হলো তখন আমি আমার মেলবক্সটা ল্যাপটপে খোলা রেখেই চলে গেছিলাম.তোকে বিশ্বাস করতাম আমি.তাই কখনও ভাবিনি যে তুই আমার পিঠে ছুরি মারবি.আমি যেই নিচে তোর জন্য জল আনতে গিয়েছিলাম তুই তখন তোর পেনড্রাইভেটা থেকে আমাদের প্রজেক্টের সমস্ত গোপন তথ্য আমার মেলবক্স থেকে আমার নামে ফাঁস করে দিয়েছিলি.যাতে আমি ধরতে না পারি সেই প্রমাণও নষ্ট করে দিয়েছিলি.কি ঠিক তো ?”

শুভদীপ এবার কাঁদো কাঁদো গলায় পরিতোষের আত্মার কাছে প্রাণ ভিক্ষা করতে শুরু করলো, আমায় ক্ষমা করে দে.তুই তো আমার সেই -“কলেজের বন্ধু.আমাদের এই বন্ধুত্বের খাতিরে আমায় মাফ করে দে ভাই.” এবার পরিতোষ তীব্র ক্ষোভমিশ্রিত এক পৈশাচিক হাসি হেসে বললো, “কলেজে প্রত্যেকটা সেমিস্টারে তোর রোল নম্বর অনুযায়ী তোর সিট আমার পেছনের সিটেই পড়তো.প্রত্যেকটা সেমিস্টারে তুই নিজে যা না পড়াশোনা করতিস তার থেকে আমার ভরসাতেই পরীক্ষা দিতে আসতিস .তারপর ভালো নম্বর পেয়ে পাস করার পর নিজে ক্রেডিট নিতিস .তখন বন্ধুত্বের খাতিরে কাউকে বলতামনা যে তুই যে রেজাল্টের ক্রেডিট নিজে নিচ্ছিস আসলে আদৌ তুই তার যোগ্য নয়.সেদিন যখন অফিসে আমায় সবার সামনে অপরাধের মিথ্যে আরোপের জন্য বাজে ভাবে অপমান করা হচ্ছিলো সেদিন যদি তোর দিকে আমার চোখ না যেত আর তোর সেই ঠোঁটের তির্যক ক্রুর হাসিটা আমার নজরে না যেত,তাহলে ব্যাপার আলাদা ছিল.আমার এত বড়ো সর্বনাশ করার পর তোকে তো আর আমি বাঁচতে দেওয়া যায়না শুভ.”

এরপর ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে দুটো হাত বেরিয়ে এসে ক্রমশ শুভদীপের গলা উদ্দেশ্য করে এগিয়ে আসছে.মৃত্যু আসন্ন দেখে ভয়ে শুভদীপ এবার ঘর থেকে উঠে দৌড়ে পালাতে চাইলো.কিন্তু পারলোনা.তার দুটো পা যেন কেউ শক্ত করে ঘরের মেঝের সাথে আটকে রেখেছে.তার সাথে গোটা ঘরে পরিতোষের অপার্থিব পৈশাচিক হাসি তীব্র হয়ে উঠছে যেটা শুভদীপের কানে তীব্র যন্ত্রনার সৃষ্টি করছে.দুহাত দিয়ে কান দুটো চেপে ধরে আছে শুভদীপ.ততই যেন সেই দুটো হাত লম্বা হয়ে আরও এগিয়ে আসছে একেবারে শুভদীপের গলার কাছে . -“আমায় ক্ষমা ”,কথাটা শুভদীপ পুরো শেষ না করতেই লম্বা হাতজোড়া এবার শুভদীপের গলাটা সাঁড়াশির মতো চেপে ধরলো.

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত