অনেক বারণ করেছিল শুভ,কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়েটা তাঁকে করতেই হলো।আর আজকে তার বিয়ের প্রথম রাত,ঘরে ঢুকে শুভ দরজা বন্ধ করলো,দেখলো পরিণীতা কিঞ্চিত নড়েচড়ে বসলো বিছানার উপর। শুভ শুনেছে যে পরিণীতা একটা পাবলিক স্কুলে পড়ায়, বিয়ের পর সে নাকি চাকরিটা ছেড়ে দেবে এরকম কথা দিয়েছে তার বাবা মা কে,শুভ শুনে একটা বাঁকা হাসি হেসেছিল।শুভ গিয়ে বিছানায় বসে,পরিণীতা ঘোমটা টেনে মাথা নিচু করে বসে আছে। শুভ মেয়েটা সম্মন্ধে প্রায় কিছুই জানে না,নাম ছাড়া,সবই বাবা মায়ের পছন্দের।শুভ পেশায় একজন Theoritical physicist, প্রচন্ড ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল,অন্যের অভিভাবক দের দুঃখ থাকে যে ছেলেমেয়ে ঠিকঠাক পড়াশোনা করছে না ইত্যাদি,কিন্তু শুভর বাবা মা কোনোদিন সেই দুঃখ প্রকাশ করার সুযোগ পায়নি,কিন্তু তাদের দুঃখ অন্য জায়গায়।অক্লান্ত পরিশ্রম করতো শুভ পড়াশোনার পিছনে, শুভর মা ছিল ভীষণ কড়া,যৌথ ফ্যামিলি তে সবাই যেমন শুভর বাবা ,কাকা,কাকিমা,বোন,ঠাকুমা,ঠাকুরদা সবাই শুভর মা নিলিমাদেবী কে একটু ভয় পেয়ে চলত,কিন্তু নিলিমাদেবীর মনোভাব শুভর প্রতি অন্যরকম ছিল।
বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থাকার পর শুভ খুবই সাধারণ ভাবে বলে ” সারাদিন তোমার উপর দিয়ে অনেক ধকল গেছে,tired লাগলে তুমি শুয়ে পর”,পরিণীতা নরম সুরে বলে ” না আমি ঠিক আছি!”,শুভ সোজাসাপ্টা জানায় “দেখো পরিণীতা আমার জন্য তোমার sacrifice এর কোনো দরকার নেই,তুমি বিয়ের পর তোমার স্বামীর কাছে হয়তো অনেক কিছু আশা করেছ,কিন্তু আমি তোমাকে এটুকু বলতে চাই যে আমার কাছ থেকে তুমি বেশি কিছু আশা করো না ,তাতে তুমি নিরাশ হবে,আর হ্যাঁ তুমি তোমার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে,যা মন চায় করতে পারো,যেমনটা তুমি বিয়ের আগে করতে”,কথাগুলো একটানা বলে খুব শান্ত মুখে শুয়ে পড়ল শুভ,এতগুলো ভারী ভারী কথা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না পরিণীতা, সে অনেকটা অবাক হয়,রাগও হয় তার, তারপর শুয়ে পরে।
পরের দিন পরিণীতার ডাকে ঘুম ভাঙে শুভর,চোখ খুলে দেখে পরিণীতা চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,শুভ কাপটা টেবিলে রাখার ইঙ্গিত করে,একটু রাগ হয় শুভর ঘুম ভাঙানোর জন্য ,কিন্তু সে মেনে নিয়েছিল যে বিয়ের পর তার daily life এর একটু পরিবর্তন আসবেই,যেমন মেয়েটারও এসেছে,তাই রাগ করাটা যুক্তিহীন। চা খেয়ে একটু ল্যাপটপ নিয়ে বসে কিছুটা কাজ সারে, তারপর ঘড়ির দিকে চেয়ে উঠে গিয়ে স্নান করে রেডি হয়। পরিণীতা এসে জানায় “মা ডাকছে,সবাই অপেক্ষা করছে খাবার টেবিলে”,শুভ জানায়”ঠিক আছে,তুমি চলো আমি যাচ্ছি”,পরিণীতা দাঁড়িয়ে থাকে,শুভ দেখে পরিণীতা একটু ইতস্তত করছে,তারপর পরিনতা বলে”আজকে একটু তাড়াতাড়ি আস্তে পারবে ,আসলে আমার কিছু বান্ধবী আসবে আজকে ,ওরা বিয়েতে আস্তে পারিনি তাই আমি আজকে আসতে বলেছি”,।শুভ একটু চুপ থাকে,তারপর মাথা নেড়ে খাবার টেবিলে যায়,স্বভাবতই চুপচাপ খেয়ে সে উঠে পড়ে,পরিণীতা লক্ষ্য করলো বাড়ির সবাই কিছু না কিছু কথা বলছে খাবার টেবিলে বসে,কিন্তু শুভ পুরো চুপ আর কেউ ওকে যেন ঘাটাতেও চায় না।
শুভ বেরিয়ে পরে,বেরোনোর সময় পরিণীতা কথাটা আবার মনে করিয়ে দেয়,ঠিক এই কারণেই তো শুভ বিয়ে করতে চাইনি।সে দেখেছে কিভাবে তার প্রিয় kc স্যার এর জীবন নষ্ট হয়ে গেছে বিয়ের পর,নানা ঝামেলার পর শেষে ডিভোর্স,university এর bb স্যার এর ও একই কারণ,তার কলিগ মনোব্রত কীরকম ডিসটার্ব থাকে,resarch এর কাজ ঠিকঠাক করতে পারে না সে এখন,এদের সবার পিছনে একটাই কারণ সময় না দিতে পারা। তাছাড়া সে দেখেছে কিভাবে তার মা ছোট ছোট কাজের জন্য বাবা কে বকাবকি করতো,বাজার করতে একটু ভুল,ভুল করে চায়ের কাপ অন্যত্র রেখে দেয়া ইত্যাদি ছোট ছোট কাজের জন্য সারাদিন বাড়িতে চলত ছোট ছোট অশান্তি।কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখতো বাবা নির্বিকার থাকতো,যেন কিছুই হয়নি,ভেবেছিল বিয়ের পর হয়তো সব ছেলেরাই এরকম হয়ে যায়,তাই যা হোক বিয়ে সে করবেনা ঠিক করেছিল।
একটু তাড়াতড়ি বাড়ি ফিরে শুভ দেখে বাড়িতে 7-8 জন ছেলেমেয়ে,অনুমান করে এগুলোই বোদহয় পরিণীতার friends।শুভ ফ্রেশ হয়ে আসলে,পরিণীতা এগিয়ে এসে শুভর হাত ধরে নিয়ে আসে তার বন্ধুদের সামনে ,বলে”this is my husbend☺️”,শুভ একটু কৃত্তিম হাঁসি হেঁসে সবাই কে হায়, hellow করতে থাকে,মনে মনে ভাবে এত বন্ধু কারোর হতে পারে।শুভ যতটা সম্ভব নর্মাল থাকার চেষ্টা করে,খুবই বিনয়ী ভঙ্গিতে কথাবাত্রা বলতে থাকে সবার সাথে,মনে মনে ভাবে পুরো রাতটাই গেল বোধহয়, আজ আর কোনো কাজ করা যাবে না।
এরকম ভাবেই চলতে থাকে তাদের জীবন,যেন সমান্তরাল সরল লেখার মতো ,দূরত্ব কমে না।পরিণীতা অনেক বার তাঁকে তাড়াতাড়ি বাড়ি আস্তে বলেছিলো,বা কোনোদিন কাজে না যেতে বলেছিলো,প্রথম প্রথম শুভ শুনলেও পরে কিন্তু আর অতটা শোনেনি। পিরিনিতা লক্ষ্য করেছিল যে তাঁদের এই সম্পর্কে শুধু সে আছে শুভ নেই।কিন্তু শুভর উপর রাগ করতেও মন চায় না তার,আজ পর্যন্ত কোনো খারাপ ব্যাবহার করেনি সে,কোনো অভাব নেই তার, পরিণীতা বোঝে যে শুভ শুধু দায়িত্ব পালন করছে ,মন থেকে তা আসছে না,পরিণীতার নিজেকে বোঝা বোঝা মনে হয়। এরকমই একদিন শুভ বাড়ি ফেরে ,প্রচন্ড ডিসটার্ব, একমাস করা প্রজেক্ট টা পুরোপুরি ভুল, এমন সময় পরিণীতা বলে “চলো না আজকে একটা সিনেমা দেখে আসি”,প্রচন্ড রাগ হয় শুভর সেদিন আর সেটা আয়ত্তের মধ্যে আনতে পারেনি,দুচার হৃদয় ভঙ্গন কথাও বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে। পরের দিন চোখ খুলে দেখে আজ আর পরিণীতা দাঁড়িয়ে নেই চা নিয়ে,7 মাসের প্রতিনিয়ত এই ঘটনাটা আজকে না ঘটার জন্য শুভ অবাক হয়, তারপর এতসব না ভেবে সে উঠে রেডি হয়ে খাবার টেবিলে যায়,কাল সারারাত বসে সে প্রজেক্ট complete করেছে,আজকে যেন টেবিলে সবাইকে একটু বেশিই চুপচাপ দেখে সে।
রাতে বাড়ি আসে,এখনো একবারও পরিণীতা কে দেখতে পায়না সে,প্রোজেক্ট টা ঠিকঠাক জমা পড়েছে তাই মন টাও বেশ শান্ত আজ তার,কিন্তু তাও ভালো লাগছে না।এমন সময় শুভ দেখে যে তার বাবা ঘরে ঢুকছে,শুভ উঠতে গেলে তার বাবা তাকে বসিয়ে দিয়ে পাশে সোফায় বসে পরে।তারপর শুভকে উদ্দেশ্য করে বলে” পরিণীতা আজ সকালে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে,যাওয়ার সময় সে বলেছে যে তোমার মত ছেলে হয়না,সে ভাগ্যবান যে সে তোমাকে স্বামী হিসাবে পেয়েছে,কিন্তু সে বলেছে সে হয়তো তোমার জন্য উপযুক্ত নয়”। শুভ বিস্বয় এ হতবাক হয়ে যায়,প্রতিদিন দু থেকে তিন বার ফোন করা পরিণীতা আজকে একবার ও তাকে ফোন করেনি,শুভ চুপ করে থাকে।
একটু সময় পরে শুভর বাবা আবার বলতে শুরু করে” দেখো শুভ, তুমি physicist,সব কিছু যুক্তির মাধ্যমে খাঁড়া করতে চাওয়া তোমার স্বভাব,ছোটবেলা থেকেই তোমার চিন্তাভাবনা আর পাঁচটা ছেলের থেকে অনেক আলাদা,তোমার আজকে যা সাফল্য তা হয়তো অনেকেই সারাজীবন এও অর্জন করতে পারবে না,যেমন ধর আমি, কিন্তু এতকিছুর পরও তুমি কি খুশি?,তুমি নিজেকে যেখানে দেখতে চেয়েছিলে আজ তুমি ঠিক সেখানে দাঁড়িয়ে আছো, কিন্তু তুমি সবার থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছ, সফল তুমি আজকে ভবিষৎতে আরো হবে সেই আশা রাখি,কিন্তু কী মানে সেই সফলতার যেটাকে ভাগ করার মতো কেউ থাকবে না পাশে,তুমি ভাব আমরা কেউ তোমাকে বা তোমার কাজ কে বুঝিনা,আমি বলি তুমি ভুল,আমরা চেষ্টা করি কারণ একজন বিজ্ঞানী বা তার কাজ কে বোঝা একটা সহজসাধ্য কাজ নয়,কিন্তু তুমি কি কখনো আমাদের বোঝার চেষ্টা করেছ?”,একঝাঁক প্রশ্ন রেখে উঠে পড়েন শুভর বাবা,শুভর মাথাও তালগোল পাকিয়ে গাছে,কিছুক্ষন বসে থাকার পর সে উঠে পড়ে,চাবি নিয়ে ড্রাইভে করে যায় পরিণীতা এর বাড়ির উদ্দেশ্যে, তার মাথা এখন পরিষ্কার ,সব প্রশ্নের উত্তর সে আজ পেয়ে গেছে।
বেল বাজাতেই দরজা খোলে পিরিনিতার মা,কিছু বলতে চাইছিলেন ভদ্রমহিলা শুভ বাধা দিয়ে বলে পরিণীতা কোথায়?,ভদ্রমহিলা একটা ঘরের দিকে ইঙ্গিত করলে শুভ সেদিকে পা বাড়ায়,বুকটা ঢিপঢিপ করে ওঠে তার।শুভ কে ঘরে ঢুকতেই উঠে দাঁড়ায় পরিণীতা,কিছুক্ষন চুপচাপ।শুভ লক্ষ্য করে পরিণীতার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে,মুখ তো একটু ফলা ফলা লাগছে,শুভ কি বলবে বুঝতে না পেরে পরিণীতা কে বলে”চলো বাড়ি চলো”,পরিণীতা অনড়, চুপ।শুভ বুঝতে পারে এই নিস্তব্ধতার কারণ সে এগিয়ে আসে পরিণীতা র খুব সামনে,মাথা নিচু তাঁর বোধহয় চোখের জল লুকানোর চেষ্টা ,শুভ পরিণীতার কাঁধে হাত দিয়ে বলে” ভুল হয়ে গেছে রে,আর একবার সুযোগ দে শোধরাবার, নিজের হাতে গড়িয়ে নে আমাকে নিজের মনের মতো করে, কী রে বল কিছু?”,মুখ তোলে পরিণীতা দেখে শুভর চোখ ছলছল করছে,শুভকে নিজের চোখের সামনে কাঁদতে দেখার মতো মানসিক শক্তি নেই তার মনে,সে জড়িয়ে ধরে শুভকে তারপর অনেক দিনের চাপা যন্ত্রণা যেন নদীর জলের মতো বেরিয়ে আসতে থাকে তার চোখ থেকে,শুভ বাধা দেয় না,মনে মনে বলে”যত কাঁদা র কেঁদে নে কারণ এরপর আর কাঁদা র অবকাশ তুমি পাবে না। সেদিন হয় তাদের শুভ-পরিণীতা।