এই নিয়ে তৃতীয়বার তার বাবার পচ্ছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে রাজী না হওয়ায় আরশীকে মোটা বেতের লাঠি দিয়ে একনাগাড়ে পেটাতে থাকেন আদনান সাহেব। মেয়েকে এলোপাথাড়ি মারতে দেখে আরশীর মা রাখী বেগম ছুটে আসেন। মেয়েকে কোনরকমে স্বামীর হাত থেকে বাঁচিয়ে জড়িয়ে ধরেন। ততক্ষণে আরশী আধো জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা। কপাল কেটে রক্তের বন্যা বইছে। ঠোঁটের কোণ কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। অতিরিক্ত কান্নার ফলে চোখ দুটো ফুলে গেছে। রাখী বেগম আরশীর মাথায় হাত বুলিয়ে স্বামীর মুখের দিকে ছলছল চোখে তাকায়।
—আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? মেয়েটা এতো বড়ো হয়ে গেছে এখনো তার গায়ে হাত তুলবেন? ছোটবেলা থেকে তো শুধু মেরেই আসলেন! বিয়ের বয়স হয়েছে এবার তো রেহাই দিন মেয়েটাকে? রাখী বেগম চিৎকার করে কান্নারত গলায় কথাগুলো বলে উঠলো। আরশী মায়ের চিৎকারে সামান্য কেঁপে উঠলো।
—মেরে ফেলবো আমি ওকে। জীবনে মস্ত বড় ভুল করেছি ওর মতো মেয়েকে বাঁচিয়ে রেখে। ছোটোবেলাতেই যদি ওর পিঠে না মেরে গলাটা টিপে দিতাম তাহলেই ভালো হতো।
—বাহ্ চমৎকার কথা বললেন তো! মেয়েটা কি এমন করেছে যে তাকে মেরে ফেলতে হবে? আপনি বাবা নাকি জল্লাদ? রাখী বেগম চিৎকার করে কথাগুলো বলেন। আদনান সাহেব ঠোঁটে আঙুল দিয়ে স্ত্রীকে চুপ করতে বলেন।
—তুমি এই ব্যাপারে একটা কথাও বলবে না। আমি আমার মেয়েকে কি করবো না, আর কি করবো আমি বুঝবো। তুমি এই বিষয়ে মাথা গলাতে আসবে না একদম। মেয়ের কাছে বসে চুলের মুঠি চেপে ধরে।
—শোন আমি তোর বাবা জন্ম যখন দিতে পেরেছি, তখন মেরে ফেলতেও আমার একটুও হাত কাঁপবেনা। যদি বাঁচতে চাস বিয়েটা করে নে। তা না হলে একটু একটু করে পুড়িয়ে মারবো তোকে আর তোর মাকেও! মনে আছে তো তোর সেদিনের কথা? আরশী তার বাবার চোখে চোখ রাখে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নারত অবস্থায় হালকা মাথা নাড়ায়। মনের মধ্যে ভয়টা আরও বেশী চেপে বসে। সেদিনের ঘটনাটা যে আজও তার গায়ে কাঁটা দেয়। তার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণী যে বাবা। আদনান সাহেব মেয়েকে শাসিয়ে উঠে চলে যান। রাখী বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন।
—মারে আর কতো সহ্য করবি বলতো? বিয়ের বয়স হয়ে গেলো এখনো এতো মার খাস। আমার যে সহ্য হয়না মা তোকে এভাবে দেখতে। মা এর কান্নারত মুখটা দু হাতে ধরে চোখের পানি মুছিয়ে দেয় আরশী।
“আমি কি করবো মা? আমার কি করার আছে? “
“তোর বাবা যেটা বলছে তুই সেটাই কর। অনন্ত প্রাণ খুলে শ্বাসটাতো নিতে পারবি! “
“না মা আমি এই বিয়েটা করলে প্রাণ খুলে শ্বাস না দমবন্ধ হয়ে মারা যাবো।”
“তাহলে মরে যা। আমি তোদের বাবা মেয়ের মাঝে আর আসবো না। এখানে থাকলেও বাঁচবিনা, তুই মরতে চাস অন্য কোথাও গিয়ে মর। আমার চোখের সামনে থেকে চলে যা।” আরশী মায়ের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। ” আরশী মা আমার কথা শোন বিয়েটা করে নে। এতে তোর ভালো হবে। আমি তোর বাবার সাথে কথা বলছি।”
আরশী তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারেনা। অবশেষে বিয়েটা হয়েই যায় ওর বাবার পচ্ছন্দের ছেলে বাংলাদেশের টপ বিজনেসম্যান আমান চৌধুরীর সাথেই। তাহলে মিস উহু না মিসেস আমান আরশী চৌধুরী বিয়েটা তাহলে হয়েই গেলো কি বলো? আরশী ফুলে সজ্জিত বিছানায় বসে নিঃশব্দে কেঁদে চলেছে। আমান ওর কোলে মাথা রেখে ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে।আরশীর ডান হাতের আঙ্গুল গুলো নিয়ে খেলতে থাকে আমান। “কি যেনো বলেছিলে মরে গেলেও আমাকে বিয়ে করবে না তাই তো? ” আমান আরশীর একটা আঙুল জোরে চেপে ধরায় আরশী ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে চিৎকার করে । “এই চুপ থাকো। হ্যা আর কি যেনো বলেছিলে? হুম তোমার মন চাইছিলো আরও তিন চারটা থাপ্পড় আমাকে মারতে?”
আমান উঠে বসে আরশীর চোখের পানি মুছিয়ে দেয়। “কিন্তু সোনা এবার যে আমি তোমাকে থাপ্পড় মারবো! সকাল, দুপুর, বিকাল, সন্ধ্যা, রাত্রি! ভালো লাগবে? ও হ্যা ভালো না লাগলেও তোমাকে লাগাতে হবে তাই জন্যই তোমাকে আমার কাছে এনে রাখা! যাতে তোমার ওই ফর্সা গালটা সর্বদা লাল করে রাখতে পারি! ” আরশী একপলক আমানের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। “তুমি আমাকে লম্পট বলেছো? জানো আমি তুড়ি মারলে কতোগুলো মেয়ে আমার কাছে আসবে! আর তুমি আমাকে সেখানে একটা চরিত্রহীন বানিয়ে দিলে! ঝাঁসির রাণী তো তুমি! না কিছু বুঝে না বিচার বিবেচনা করে তুমি আমার গায়ে দাগ লাগিয়ে দিলে?” আরশী আমানের সামনে হাত জোড় করে তোলে। “আমি তো সেদিনের ভুলের জন্য আপনার কাছে ক্ষমা চেয়েছি অনেকবার, তারপরেও কেনো এমন করছেন আমার সাথে?”
“তুমি যেটা করেছো সেটা ভুল নয়, তাকে বলে অপরাধ! অপরাধ যখন করেছো শাস্তি তো পেতেই হবে তাই না? “
“শাস্তি, কি শাস্তি দিবেন আমায়? ” ” কি শাস্তি পাবে সেটা সময় হলেই দেখতে পেয়ে যাবে। তুমি জানো আমার বাবা আমার সাথে কথা বলে না? আমি ছোটো থেকেই সুখী পরিবার দেখে এসেছি। আমার বাবা মা আমাকে যে শিক্ষাটা দিয়েছেন তাতে আজ পর্যন্ত আঙুল তুলে কেউ কিছু বলতে পারেনি আমাকেও না। কিন্তু তুমি দুই পয়সার একটা মেয়ে হয়ে আমার বাবাকে আমার নামে কমপ্লেন করলে। ‘স্যার আপনি আপনার ছেলেকে ঠিকমতো মানুষ করতে পারেন নি?’ এটাই বলেছিলে তো? আজ ছয়টা মাস বাবা আমার সাথে এক টেবিলে বসে খায় না। তুমি উনাকে এতোটা বেশিই আঘাত করে ফেলেছো যে উনি এখন প্রায়ই হার্টের সমস্যা হয়। কেনো জানো? তোমার ওই একটা বলা কথা আজ আমাদের বাবা ছেলের সম্পর্কের মাঝে দেওয়াল তুলে দিয়েছে। “
আরশী বিস্ময়ে আমানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর সামান্যতম একটা ভুল এতো ক্ষতি করতে পারে??
“আমি উনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিবো। আমি উনাকে “হুম ক্ষমা তো তোমাকে চাইতে হবেই প্রতি পদে পদে। একটা সুখী পরিবার এর বিচ্ছেদ করেছো তুমি শাস্তি তো পেতেই হবে। ” আরশীর হাতের বাহুটা শক্ত করে চেপে ধরে বিছানা থেকে নামিয়ে দেয়। “প্রস্তুত হয়ে নাও শাস্তি পাওয়ার জন্য। যাও ওখানে গিয়ে শুয়ে পড়ো। ” আমান আঙুল দিয়ে আরশীকে ফ্লোরে থাকা গোলাপের পাপড়ি মেলে রাখা জায়গায় শুতে বললো। আরশী সামান্য অবাক হলো গোলাপের পাপড়িতে শুতে বলছে কেন?? তবে মনে মনে ভাবলেও আরশী মুখে কিছুই আমানকে বললো না। কাল রাতে বেতের আঘাত গুলো শরীরে এখনও দগদগে হয়ে আছে। মাঝে মাঝে যন্ত্রণাও হচ্ছে। শরীরটা ভীষণ অবশ, ক্লান্ত হয়ে গেছে। ধীর পায়ে এসে শুয়ে পড়লো কিন্তু সাথে সাথেই চিৎকার করে উঠে বসলো। দগদগে ক্ষততেই সূচের মতো হাতে পিঠে কিছু গেঁথে গেলো। আমানের ঠোঁটে মুচকি হাসি। আরশী হাতে নিয়ে দেখলো মোটা মোটা গোলাপের কাঁটা।
গল্পের বিষয়:
গল্প