স্বামী আমার অনেক গম্ভীর, বদ মেজাজী, আবার খানিকটা সহজ সরল। তার মাঝে সব চরিত্রই বিদ্যমান। তার মেজাজের অনেক কারণ থাকলেও তার মধ্যে একটা কারন হচ্ছে আমি আমার স্বামীকে কেন ভাইয়া বলে ডাকি। অবশ্য এই ভাইয়া ডাকা টা বহুদিনের অভ্যাস। মানুষের সাথে যদি কোন অভ্যাস কিশোর বয়স থেকেই ছায়ার মত মিশে থাকে সেই অভ্যাস অত সহজেই পরিত্যাগ করা যায় না। আমার বেলাও এর ব্যতিক্রম নয়। এই ভাইয়া ডাকা অভ্যাস টা সেই ছোট বেলা থেকেই আমার সাথে মিশে আছে। কিছুক্ষন আগে যখন ও অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল তখন আমায় ডাক দিয়ে বললো ”জুহি কি করছো তুমি?
একটু এদিকে আসো। আমার হাত ঘড়িটা পাচ্ছি না। একটু খুজে দিবা? কোথায় রাখছি খেয়াল নেই। আমি রান্না ঘরে হাতের কাজ রেখে বললাম হ্যাঁ আসছি। গতকাল অফিস থেকে আসার পর হাতের ঘড়ি খুলতে মনে ছিল না ওর। সেই ঘড়ি পড়েই খাওয়া, বাহিরে বের হওয়া, টিভি দেখা, এরপর ঘুমিয়ে যাওয়া। আমি ঘড়িটা খুলে ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম। রুমে গিয়ে ড্রয়ার থেকে ঘড়িটা এনে ওকে বললাম “ভাইয়া আপনার ঘড়ি ধরেন। গতকাল রাতে ঘড়ি পড়েই ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন। আমি খুলে রেখেছিলাম” সে বিরক্তকর একটা মনোভাব চেহারায় তৈরি করে আমার হাত থেকে ঘড়িটা নিয়ে বলে “স্টুপিড কোথাকার।” আমার মনে হয় আমার স্বামী আর কোন বকা দিতে পারে না। যখনি আমার প্রতি রাগ দেখাবে শুধু একটা কথাই বলবে “স্টুপিড কোথাকার“ মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় উনাকে আমি একটু বকা দেওয়া শিখাই।
অবশ্য এই স্টুপিড ডাকটার প্রতি প্রথম প্রথম খুব বিরক্ত ছিলাম। কিন্তু এখন কেন যেন মনে হয় ডাকটা আসলেই আমার সাথে মানায়। তা না হলে কেউ তার স্বামীকে ভাইয়া বলে ডাকে? সে ঘড়িটা হাতে পড়তে পড়তেই বললো দুনিয়াটাকে এতো ইজি ভাবে নিও না। দুনিয়ার মানুষ সব এক না। একেক মানুষের মনে একেক রকমের চিন্তা ভাবনা কাজ করে। তুমি কোন কাজকে সহজ ভাবে মেনে নিলেও অন্য মানুষ গুলা তা সহজ ভাবে না ও নিতে পারে।মাঝে মাঝে উনি আমাকে সুযোগ পেলেই লেকচার শোনায়। তবে তার কথা গুলা ফেলে দেওয়ার মত না। মানুষটার মনেও একটা চাপা কষ্ট কাজ করে। যার প্রভাব গত দু মাস আমার উপর বয়ে গেছে। অবশ্য আমি সব সহ্য করে গিয়েছি। আমি গ্রামের মেয়ে। আর গ্রামের মেয়েরা অনেক ধৈর্য্য শক্তি নিয়ে জন্মায়। গ্রামের মেয়েদের সব হজম করার শক্তি থাকতে হয়। আমি চুপ করে রইলাম। চুপ করে থেকেই তার অফিস ব্যাগটা টেবিলের উপর রাখলাম। তারপর রান্না ঘর থেকে খাবারের টিফিন বাটি এনে তার ব্যাগে রেখে বললাম “লাঞ্চের জন্য তিতা করলা ভাজি, ডিম আর ডাল দিয়েছি। ঠিক সময়ে খেয়ে নিবেন।
আমার মা নেই। এমনকি কোন ভাই বোন নেই। আমার বয়স তখন সাত বছর। মা বাবা আর আমি এই তিনজনকে নিয়েই ছিল আমাদের আলোর সংসার। সেই আলোর সংসারটা আরো আলোকিত করার জন্য মার গর্ভে একটা বাবু একটু একটু করে বড় হচ্ছিল। আমার মনে তখন প্রফুল্লতার বাতাস বয়ে বেড়াচ্ছে। একদিন মাকে বলি ”আচ্ছা মা আমার বোন হবে না ভাই হবে?” মা বলে “আমি জানি না, আল্লাহ জানে।” তখন আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি। আম্মাকে আবার বললাম ”মা সে কি আমার সাথে খেলবে? আমার সাথে কি একসাথে স্কুলে যাবে?” আম্মা বলে চুপ থাক এতো কথা বলিস ক্যান? এতো কথা বললে তোর সাথে খেলবে ও না স্কুলেও যাবে না।” মন খারাপের আভা মনকে ছুয়ে দেয়। আমি চুপ করে থাকি। বাবা আসলে আমায় ডাক দেয়।
আমি চুপ করে থেকে বাবার সামনে যাই। বাবা অনেক কথা বলে আমি শুধু মাথা নেড়ে হ্যা না এইসব বুঝিয়ে উত্তর দি। বাবা মাকে বলে “কি হয়েছে ওর?” মা হাসতে হাসতে আমার চুপ করে থাকার কারণ জানায়। বাবাও হাসতে থাকে। এই হাসার সংসারে কে জানতো আালোর রং টা পাল্টে যাবে। কে জানতো দেয়ালের প্রতিটা কোনায় তীব্র যন্ত্রনা গ্রাস করবে। অনুভূতি গুলো নীল হয়ে যাবে। যে নীলের রং বিষাদ হয়। মার গর্ভে আগমন হওয়া সেই আলো/বাবুটাই ডেলিভারি হওয়ার সময় তার সাথে করে মাকেও দুর্বার গতিতে ওপারের দেশে নিয়ে যায়। যে দেশের মানচিত্র কখনো কেউ দেখেনি। বাবা আমাকে বুঝতে দেয় না। বুঝতে দেয় না তার চোখের কান্নার প্রতিটা জলের হাহাকার। রাত্রির নির্জনে অন্ধকার ঘরে শীতল বাতাস শো শো করে জানালা ভেদ করে বদ্ধ দেয়ালে মিশে যেত আর শূন্যতা ছড়িয়ে যেত আমাদের আলোর সংসারে। যে শূন্যতায় প্রতিটা রাতে আমি বাবাকে কাঁদতে দেখেছি।
সময় বদলায় তার ক্রমান্বয়ে দিন বদলায়। দিন যতই বদলায় আমার দুরন্তপনার মাত্রা কমে যায়। নির্দিষ্ট বয়সে একটা মেয়ে অনেক চুপ হয়ে যায়। সে বুঝে তার বয়স বাড়ছে। তাকে সবার সাথে সাবধানে চলতে হয়। কোন কথাটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক তা ভেবে চিন্তে প্রকাশ করতে হয়। সব কিছু ঢেকে বা পরিপাটি হয়ে চলতে হয়। আমি এর ব্যাতিক্রম নই। যখন ক্লাস সেভেনে উঠি তখন অনুধাবন করলাম প্রত্যেক মানুষের জীবনে কেউ না কেউ থাকতে হয়। সেই তুলনায় আমার বাবা একা একাই জীবন কাটাচ্ছে। মার গত হওয়ার পর বাবা আর বিয়ে করেনি। আমার মা, ভাই, বোন, বন্ধু বলতে সবই ছিল আমার বাবা। আমি আমার বাবার জন্য নিজে নিজে পাত্রী খুঁজতে লাগলাম। একজন মেয়ে হয়ে তার বাবার জন্য পাত্রী খোজা বিষয়টা কেমন জানি। বাবা আমায় বুঝায় আমি যা করছি তা একদম সঠিক না। আমি বাবাকে বলি কোনটা সঠিক আর কোন বেঠিক একটু হলেও বুঝি বাবা। বাবা হাসতে থাকে আর বলে “আমার মেয়ে দেখছি অনেক বড় হয়ে গেছে।” আমার স্বল্প কল্পনার ঘরে বিশালতার তৃপ্ত আশা অপ্রাপ্তিই হয়ে থাকে।
বাবারা ছিল দুই ভাই। আমার বাবাই ছিল পরিবারের বড় সন্তান। ছোট চাচা পড়ালেখার জন্য চট্টগ্রাম থাকতো। ভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে সেখানেই চাচীকে বিয়ে করে। পরে দাদা জানতে পেরে ছোট চাচাকে বাসায় জায়গা দেয় নি। বাবা চুপি চুপি ছোট চাচাকে হেল্প করতো। বছর তিনেক বা চারের পর যখন জাহেদ ভাই চাচীর কোলে দুনিয়ায় আগমন হয় তখন এই খবর শুনে দাদার সব রাগ অভিমান হাওয়ায় বিলীন হয়ে যায়। যেমন টা আমি আমার বাবার কাছ থেকে শুনেছি। পরে ছোট চাচা শহরেই শিফট হয়ে থেকে যায়। ওখানেই চাকরি সংসারটা স্থায়ী ভাবে পরিনিত হয়। আমার বাবার বিয়ের মাস খানেক পর দাদা গত হয় । দাদা আমাকে দেখে যেতে পারে নি। আমার ভাগ্যটাই কত নির্মম।
প্রতি বছরে ঈদের ছুটিতে চাচা, চাচী, জাহেদ ভাই বেড়াতে আসতো। মা মারা যাওয়ার পর আমার উপর অনেক টা চাপ আসে। কিন্তু চাচা চাচীরা যখন বেড়াতে আসতো চাচীই সব কিছুই করতো। জাহেদ ভাইকে নিয়ে এপথ ওপথ ঘুড়তে যেতাম। বাশের সাকো পার হই। অবশ্য সেই সাকো এখন আর নেই বললেই চলে। বরশি ফেলে মাছ ধরি। মাঝ রাতে জাহেদ ভাই আমার জানালার ফাকে এসে ডাক দিয়ে বলতো “এই জুহি উঠো” আমি বিরক্ত মুখে ইশারা দিয়ে বুঝাতাম কি হয়েছে? উনি বলতো বাহিরে আসো। আমি বলতাম পারবো না। কিন্তু ঠিকি বের হতাম। আর এটা প্রতি বছরেই হতো। পরে বুঝলাম এটা প্রতি বছরের কোন নির্দিষ্ট সময়ের রুটিন। বের হয়ে সে আমায় পুকুর পারে নিয়ে যেত, ফানুস উড়াতো।এইসব আয়োজন কখন করতো বুঝতেই পারতাম না। পুকুরে পা ডুবিয়ে বসে থাকতো। এই অনুভুতি গুলা প্রথম প্রথম আমায় স্পর্শ করেনি।
আমি বলি “ভয় করে আমার” উনি হাসতে হাসতে বল “ তুমি না গ্রামের মেয়ে, গ্রামের মেয়েরা ভয় পায় “ আমি কিছু বলি না। চুপ করে থাকি। প্রতি বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ের এই রুটিন আমায় অনুভূতি/মায়ার বন্ধনে জড়াতে থাকে। চলতে থাকা রুটিন চলতে চলতে এদিকে আমার অনার্স ফাইনাল এক্সাম চলে আসে। গত বছর যখন জাহেদ ভাইয়ারা আসলো আমি জাহেদ ভাইয়ার চেহারায় গম্ভীর মন খারাপের আভা চেহারায় মিশে থাকার ছায়া পাই। মাঝ রাতে আমি অপেক্ষা করি কখন আমায় ডাকবে জুহি বের হও। কিন্তু সে আমায় ডাকেনি। হুট করে যেন রুটিন টা বদলিয়ে যায়। সকালে তাকে বলি “আপনার কি মন খারাপ?” সে চুপ করে থাকে। আমার সাথে কথা বলে না। তার না বলা বাক্য শোনার জন্য আমি তীব্র অপেক্ষা করি। ছটফট করি চাচীকে গিয়ে বলি “জাহেদ ভাইয়ার কি কিছু হয়েছে? কেমন যেন চুপচাপ দেখাচ্ছে।” চাচী বলে “আমিও জানি না মা, কি যেন হয়েছে আমার ছেলেটার।
এখানে তো আসতেই চায় নি। তোর চাচা জোর করে নিয়ে এসেছে।” আমার মনে কৌতুহল তৈরি হয়। ব্যার্থ কৌতুহল নিয়ে বিকেল বেলা তার কাছে গিয়ে বলি “ঘরে বসে কি করেন একা একা” উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে কিছু না। ভালো লাগছে না শুয়ে আছি “ আমি বললাম “কি করে ভালো লাগবে এই ভাবে ঘর বন্ধি হয়ে থাকলে। আসার পর থেকেই ঘরেই চুপচাপ হয়ে বসে থাকেন। চলেন ঘুরে আসি।” সে বলে যাওয়ার ইচ্ছা নেই। আমি বলি কি হয়েছে আপনার?” সে বলতে চায় না। আমি জোর করাতে সে জানায় তার ভালোবাসার মানুষের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়েছে। আমি চুপ হয়ে যাই। আমার নিশ্চুপতা চারপাশের দেয়ালে আকড়ে ধরে। শূন্যতা ঘিরে আসে আমার অতল সুরে। আমি তাকে শান্তনা দেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ভালোবাসায় এরকম ভুল বুঝাবুঝি হয়। কাউকে না কাউকে নিজে থেকে সব কিছু ভুলে গিয়ে সামনে অগ্রসর হয়ে তার হাতটা ধরতে হয়।
আমাদের মাঝে একটা ইগো কাজ করে আর ইগো টা মানুষকে অনেক অবনতির দিকে ঠেলে দেয়। আপনি তার কাছে যান। তাকে বলুন আপনি ভালো নেই। তাকে ছাড়া আপনি অচল।” সে জানায় চেষ্টার কমতি ছিল না। আমি আমার রুমে চলে আসি। জানালার ফাক দিয়ে আকাশের দিকে তাকাই। অপূর্ণতা ছুয়ে শিহরিত করে আমার শরীর। নিঃশব্দ কান্নায় আমার চোখের কোনায় জল চলে আসে। এই জল আসার কারণ আমি বুঝতে পারি না। কেন আমার মনে যন্ত্রনার কাব্য খেলা করে। আকাশে বিদুৎ চমকায় আমার মন খারাপের মত। আমি কবিতা সাজাই তীব্র অচেনা আঘাতে অবাধ্য ক্রন্দনধ্বনি ফোটা ফোটা বৃষ্টি জল আচমকা বজ্রপাত বুক চেপে শান্ত হই হৃদয় ছন্দে বৃষ্টি ধুয়ে নিয়ে যা মন খারাপের ভুল নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনি। রাতের বেলা সবাই যখন কথা বলছিল চাচী আমায় বললো ”জুহি মা একটু ভিতরে যা তো “
আমি কিছু বুঝতে পারি না। চুপ করেই ভিতরে চলে যাই। দরজা বন্ধ করে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকি। চাচী বাবাকে বলে “ভাইজান একটা কথা বলতে চাই। বাবার নিঃশব্দতা শুনে বুঝলাম বাবা চুপ করে আছে। বাবার চুপ করে থাকা দেখে চাচী আবার বললো “আসলে ঘুড়িয়ে প্যাচার কিছু নেই। সোজাসুজিই বলে ফেলি আপনার মেয়েটা আমাকে দিবেন? দরজার আড়ালে দাড়িঁয়ে যেন আকাশে বিদুৎ চমকানোর শব্দ শুনলাম। চারপাশের দেয়াল গুলোতে যেন নিরবতা ছুয়ে যায়। যেন মনে হয় মধ্যে রাত।
জাহেদ ভাইয়ের সামনে আমার আর যাওয়া হয় না। নিজেকে আড়াল করে রাখি। সেও ঘরে একা একা থাকে। সন্ধ্যার নাগাত সে আমাকে ডাক দেয় তারপর বলে… “তুমি কিছু শুনেছো?” আমি বললাম ”কি? ”বাবা, মা তোমাকে নিয়ে কিছু ভাবছে। আমি চুপ করে থাকি। আমার কি বলা উচিৎ আমি জানি না। তবুও মাথা নেড়ে বুঝালাম আমি জানি না। সে বললো ”আমি কখনো চাই না এমনটা হোক। এমন অনুভূতির গভীরে যেতে চাই না।”
বাবা আমাকে বললে আমি জানাই এমনটা কখনো সম্ভব না বাবা। মাস খানেক কেটে যায়। নীরবে নিভৃতে প্রস্ফুটিত প্রেমের পদ্ম কাছাকাছি এসেও অপ্রকাশিত হয়ে অনুভূতি গুলো বদ্ধ দেয়ালে বন্ধি। হৃদয় সরোবরে উত্তোলন হয় ছায়া যুক্ত স্মৃতি। সেই ছায়ার মাঝে হাবুডুবু খাই। মাস চারেক পর তারা আবার হাজির হয়। মনে প্রশ্ন জাগে কেন এসেছে তারা। রাতে বাবা আবার সেই একই বিষয় নিয়ে আমার সাথে কথা বলে। উনি জানায় জাহেদ ভাইয়া রাজি। আমি ফিরিয়ে দি। ঘন্টা খানেক পর চাচী এসে বলে তোর সাথে কিছু কথা ছিল। আমি বলি.. কেন এসেছেন আমি জানি চাচী। আপনি যেটা চান সেটা ঘুনোক্ষরে সম্ভব না। যে আলো রং এর আশা করছেন সেই আলো রং এ গিয়ে আমি শান্তি পাব না। সেই আলো রং এ আমার প্রতি কোন অনুভূতি থাকবে না। বরং তীব্র ঘৃনা জন্মাবে। চাচী চুপ হয়ে যায়। একটু পর চাচী হাসতে হাসতে বলে কি আবল তাবল বলছিস এসব তুই। পাগলি সব মেয়েরাই প্রথম প্রথম এই রকম বলে। কেন আমার ছেলে কি দেখতে খারাপ?
আমি চুপ করে থাকি মনে মনে বলি চাচী তোমার ছেলের মনে যে অন্যজন বাস করে। কি করে ওখানে আমার জায়গা হবে? রাতে বাবা এসে বুঝায় “কদিন বা আমি বাজবোরে মা। আমার কিছু একটা হয়ে গেলে তখন কে তোকে এতো আপন করে দেখবে? তাছাড়া আমাদের ঘরের ছেলে।” ছোট চাচা বললো “ আমি তো তোর বাবার মতই। এতো আপত্তি ক্যানরে তোর? আমি কিছু বলি না। জাহেদ ভাইয়ার কাছে আমি যাই না। তাকে জিজ্ঞেস করি না কেন হঠাৎ রাজি হলেন? এর কয়েকদিন পরই বিয়ে টা হয়ে যায়। বাসর রাতে আমি চুপ করে বিছানায় বসে ছিলাম। সে আসলে তাকে বলি “একটা কথা বলবো?” সে বলে “আমি জানি তুমি কি বলতে চাও। কিন্তু আমি বলতে চাই না। আমি আবার বলি “আপনার কাছের মানুষ টা কই? সে জানায় তার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি আর কিছু বলি না। সারা রাত আমি জেগে ছিলাম। বিছানায় চুপ করে বসেছিলাম। সেই বিয়ের পর থেকেই এখনো তাকে স্বামী বা জাহেদ বলে ডাকার সাহস পাই না। তাকে ভাইয়া বলেই সম্মেধন করি।
অফিস থেকে আসলেই তার মুখে ক্লান্তির ছায়া ভেসে উঠে। এমনিতেই বিয়ের পর থেকে তার চেহারায় প্রফুল্লতার ছবি দেখি নি। অফিস থেকে এসে ব্যাগ টা সোফায় রাখে সে। আমি ব্যাগ টা রুমে নিয়ে গিয়ে বলি “ফ্রেশ হয়ে নিন। আর চা দিব ভাইয়া? সে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো “বিষ আছে বিষ? আচ্ছা তোমাকে বলেছি আমাকে ভাইয়া বলে ডেকো না। এতে পারা প্রতিবেশি নানান কথা বলে। তুমি কি তা বুঝো না? বাহিরে নানান মানুষের কথা আমাক শুনতে হয়। ” আমি কিছু না বলে তার জন্য চা এনে দি। তার নিকট বাড়িয়ে দিলে সে চায়ের কাপ টা ফেলে দেয়। আমি চুপ করে তাকিয়ে থাকি। আমি বলি আপনি কাজটা ঠিক করেন নি। সে বলে “ঠিক বেঠিক আমাকে বুঝাতে এসো না। আমি কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললাম “ঠিক বেঠিকের বুঝেন কি আপনি? আপনি একটা প্রতারক। আমাকে আমার অধিকার থেকে ঠকাচ্ছেন এবং ঠকিয়ে যাচ্ছেন। কি মনে করেছেন আমায়? আপনার এক্স গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে হয়ে যাওয়াতে, তার সাথে রাগে অভিমানে আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন। স্বার্থপর আপনি।
সে কিছু না বলে চুপ করে থাকে। আমার কাছে এমন কিছু শুনবে আশা করে নি। আমিও আর কিছু না বলে কান্নার ঘোঙ্গরানি দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যাই। চাচি এসে বললো “কি হয়েছেরে জুহি? এই রকম চিৎকার চেচামী হচ্ছে কেন?” আমি চাচীর দিকে তাকিয়ে থেকে কান্না করতে করতে জড়িয়ে ধরে বললাম ”আমি বাবার কাছে যাবো।” চাচী আমায় শান্তনা দিতে থাকে।
আমি বাবার কাছে চলে আসি। বাবাকে কিছু বুঝতে না দিলেও বাবা ঠিকি বুঝে আমার আসার কারণ। দু দিন পার হয়ে যায় সে আমার খোঁজ খবর নেয় না। আমার কল্পনার ঘরে এমন যন্ত্রনার শব্দ কেন? আমি তো এমনটা চাইনি। নির্জন রাত্রিতে নিঃশব্দ ভাবে চোখের শোক পরিত্যাগ করে বিছানায় শুয়ে থাকি। আমার ঘুম আসে না। হঠাৎ জানালায় শব্দ ভেসে আসে, জানালায় ভেদ করে পাথর নিক্ষেপ করে।
আমি কাছে যেতেই দেখি একটা ভাজ কাগজের টুকরা পরে আছে। আমি আস্তে আস্তে এটা তুললাম। কয়েক লাইনের কিছু লেখা ”তোমার স্বপ্ন ঘরে আমার জন্য কি কোন সিট খালি আছে? পুকুর পারে অপেক্ষা করছি। আমি সেই আগের মত প্রতিটা রাত না হোক, মাসে একবার, তাও যদি না হয় বছরে একবার সেই পুরানো দিনের রাত গুলো ফিরে পেতে চাই। ইতি তোমার জাহেদ ভাইয়া।। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না আমার চোখে জল বেয়ে আসে। এই জল কিসের আমি জানি না। কেন যেন একটু হাসি পেল শেষের কথাটার জন্য, ইতি তোমার জাহেদ ভাইয়া। খুব শিঘ্রই এই ভাইয়া থেকে স্বামীতে সম্মেধন করতে হবে। না যাওয়া যাক জাহেদ ভাইয়ার নিকট দুরুত্বের রোদ কাছে পাবার আশায়…
গল্পের বিষয়:
গল্প