আট-নয় বছরের একটা বাচ্চা ছেলে আমার হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে দৌড় দিলো।আমি ভার্সিটি থেকে বাসায় যাচ্ছিলাম।বাচ্চ াটির কান্ড দেখে অবাক হলাম।কাগজে এমন কি আছে যা দিয়েই সে নিজেই উলটো দৌড় দিলো।বাসায় গিয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে আমি কাগজটি খুললাম।কাগজটিতে বড় বড় অক্ষরে কিছু লেখা আছে।লেখাগুলো যে ওই পিচ্চিটাই লিখেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।বড় বড় অক্ষরের বাকা বাকা লাইনের লেখা।চার পাঁচ লাইনের লেখাকে এক পৃষ্ঠায় লিখে ভরেছে।
কাগজটিতে লেখাঃ আপনাকে খুব ভালো লাগে আমার।আপনি খুব শুন্দর(সুন্দর বানানে ‘স’ এর জায়গায় ‘শ’ লিখেছে)।আপনি খুব বালো (ভালো শব্দে ‘ভ’ না লিখে ‘ব’ লিখেছে)।আমার নাম মিহিম।আমি চতুরথ শ্রেণীতে পড়ি (চতুর্থ বানানে ভুল লিখেছে)।আমি বড় হলে আপনাকে বিয়ে করবো। কাগজটি পড়েই আমি হেসে কুটিকুটি।বাচ্চা একটি ছেলের এই কান্ড দেখলে যে কেউ-ই হেসে ফেলবে।স্কুল লাইফ থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত কোনো লাভ লেটার পাই নি। ভার্সিটি লাইফে উঠে এই প্রথম লাভ লেটার পেলাম তাও আবার একটি পিচ্চি ছেলের!বিষয়টা যতোবারই মনে পরেছে নিজে নিজেই মনে মনে হেসে উঠেছি।যেই পিচ্চি ছেলেটির কথা বলছি সেই পিচ্চি ছেলেটি আমাদের পাশের বিল্ডিং এ থাকে। সপ্তাহ খানেক হবে নতুন ভাড়া এসেছে।আমি যখন ভার্টিসি যাই ছেলেটিও তখন ওর বাবার সাথে স্কুলে যাওয়ার জন্য রওনা হয়। পরদিন পিচ্চিটা স্কুল যাওয়ার সময় আমাকে দেখেই ওর বাবার পেছনে লুকালো।হয়তো লজ্জা পাচ্ছে না হয় ভয় পাচ্ছে।
হয়তো ভাবছে আমি ওর বাবাকে ওর দেয়া চিঠির ব্যাপারে কিছু বলে দিবো।আমি শুধু পিচ্চিটার দিকে হাসির ভঙ্গিতে তাকালাম। কিছু দিন পরের কথা।পিচ্চি ছেলেটির মা আমাদের বাসায় এলো। মাকে বললো তার ছেলে মিহিমের জন্য সে একজন টিচার খুঁজছে।আমি তার ছেলেকে সময় করে পড়াতে যেতে পারবো কি না।ভার্সিটি থেকে বাড়ি এসে অবসর সময়টাতে টিউশনি করলে আমার সময় কাটবে কাজেই আমি মানা করলাম না।পরের মাসের প্রথম তারিখে মিহিমকে পড়াতে ওদের বাড়ি গেলাম।বাচ্চা ছেলেটি সেদিন আমাকে ওর প্রাইভেট টিউটর হিসেবে দেখে খুশী হয়েছিলো কি না জানি না।প্রথম দিন ভয়ে ভয়ে আমার সামনে বইয়ের প্রতিটা পড়া পড়েছে সে।তবে ভয়টা আপনা আপনিই কেটে গেলো ওর।পরেরদিন খুব আগ্রহ নিয়ে আমাকে প্রতিটা হোমওয়ার্ক দেখালো।হাতের লেখা প্র্যাক্টিস এর জন্য দুই পৃষ্ঠা লিখতে দিয়েছিলাম সেটাও ঠিকঠাক মতো লিখেছে।পৃষ্ঠায় সাইন দিয়ে বড় করে ‘Good’ লিখে দিলাম।পিচ্চিটা মারাত্মক খুশী হলো।তখনি পকেট থেকে একটি ফুল বের করে আমার কাছে এগিয়ে দিয়ে বললো-
-ম্যাম,এইটা আমাদের বাগানের ফুল।আম্মুকে না দেখিয়ে লুকিয়ে ছিঁড়ে এনেছি। আমি সামান্য কঠিন হয়ে বললাম-
-মায়ের কথা অমান্য করলে কেন মিহিম?ভেরী ব্যাড।
-আর করবো না ম্যাম।এইটা আপনার জন্য ছিঁড়েছি ম্যাম। আমি ফুল হাতে নিলাম।ছেলেটির দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম-
-আমি এই ফুল নিয়ে কি করবো!তুমি এইটা তোমাকে কাছে রাখো। মিহিম মাথা নাড়িয়ে বললো-
-আমার কাছে রাখলে আম্মু বুঝে ফেলবে এইটা গাছ থেকে ছিঁড়েছি।আপনি রাখুন। ওর জেদ এর কাছে হার মেনে ফুলটা নিজের কাছেই রাখলাম। পরদিন আরেকটি কান্ড।মিহিম ওর হোমওয়ার্ক এর খাতায় একটি ছবি এঁকেছে।বাচ্চা মানুষ যখন হাতে কলম ধরার পর প্রথম প্রথম মানুষের ছবি আঁকার চেষ্টা করে তখন নাক মুখ বিহীন ছবি একে সেটাকে কার্টুন বানিয়ে ফেলে।ঠিক তেমনি কার্টুন আকারের একটা ছবি মিহিম এঁকেছে।দুইটা চোখ বড়,নাক নেই,গলা নেই,হাত দুটি পাখির পাখার মতো।আমি মিহিমকে বললাম-
-হোমওয়ার্কের খাতায় ছবি আঁকা নিষেধ।আর কখনো এই কাজ করবে না।ড্রয়িং করার জন্য এক্সট্রা খাতা বানিয়ে রেখো।
-ম্যাম,এইটা আমি আপনাকে এঁকেছি।
-আমাকে?
-হু।আম্মুকেও দেখিয়েছিলাম।কেমন হয়েছে ম্যাম? আমি ওকে খুশী করানোর জন্য বললাম-
-খুব-ই ভালো হয়েছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে আমাকে অবাক করে এই বাচ্চা ছেলেটি। একবার মিহিমকে বললাম-
-মিহিম তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও? পিচ্চিটা ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে বললো-
-ম্যাম,আমি বড় হয়ে আপনাকে বিয়ে করতে চাই। মিহিমের কথা শুনে মিহিমের মা আর আমি দুজনেই হেসে উঠলাম। মিহিম এর মা মিহিমকে বললো-
-তুমি ভালোভাবে পড়াশুনা করলে ম্যাম তোমাকে বিয়ে করবে। পচা রেজাল্ট করলে কিন্তু করবে না। মিহিমের মা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।আমিও হেসে ফেললাম।
পরশু নাকি মিহিমের বার্থডে।ছোট খাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।ওর মা আমাকে বলেছে ওর বার্থডেতে আমিও যেন থাকি।মিহিমকে একটি চকোলেট বক্স আর তিনটা গল্পের বই গিফট করলাম।তিনটা বইয়ের প্রথম পাতায় লিখেছি “Your loving mam”মিহিম সেদিন আমার দেয়া গিফটগুলো দেখে খুব খুশী হয়েছিলো।ফোনের ক্যামেরা ধরে ওর মাকে বললো তার সাথে আমার একটা ছবি তুলে দিতে।পিচ্চিটার বাচ্চামিগুলো দেখতে ভালোই লাগে।পড়ালেখায়ও বেশ ভালো।ভালো রেজাল্টও করে।ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত ছেলেটিকে আমি পড়িয়েছি।এরপর আর পড়াতে পারি নি।তখন আমার বিয়ে হয়ে যায়।আর আমার বিয়ের কয়েক মাস পর মিহিমরাও সেই বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলো।শুনেছি,মিহিমের বাবাকে নাকি চাকরিতে ট্রান্সফার করা হয়েছে তাই ওরা চলে গিয়েছে। এরপর মিহিমের সাথে আমার আর দেখা হয় নি। কেমন যেন হুট করেই সময় কেটে গেলো।আমার বিয়ের এখন বাইশ বছর চলছে।আমার বড় ছেলে অস্ট্রেলিয়া থেকে পড়ালেখা করছে।আমার ছোট ছেলেটাকে রোজ স্কুলে দিয়ে আমি আমার অফিসে যাই।গাড়ি থেকে নেমে অফিসে যাবো ঠিক ওই মুহূর্তে কে যেন পেছন থেকে বললো-
-কেমন আছেন? আমি পেছনে তাকিয়ে দেখলাম কোট পরা আর চোখ দুটো সানগ্লাসে ঢাকা এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। আমি বুঝতে পারছি না সে আমাকে কেন ডাকলো।চিনি না,জানি না এমন একটি ছেলে আমাকে জিজ্ঞেস করলো কেমন আছি! আমি বললাম-
-সরি।আমি আপনাকে চিনতে পারলাম না। ছেলেটি চোখ থেকে সানগ্লাস খুলতে খুলতে বললো-
-আপনি ঠিক আগের মতোই আছেন।একটুও বদলান নি।আগে চশমা পরতেন না কিন্তু এখন পরেন পার্থক্য শুধু এইটুকুই।
-কে আপনি?আমি আপনাকে এখনো চিনতে পারছি না। ছেলেটি আনন্দিত স্বরে বললো-
-ম্যাম,আমি মিহিম।ছোটবেলায় আমি আপনার কাছে পড়েছিলাম। একদিন রাস্তায় আপনাকে দেখেই আপনার হাতে চিঠি দিয়ে দৌড় দিয়েছিলাম।মনে আছে? আমি কিছুটা অবাক হয়ে মিহিম ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার এখনো চিনে উঠতে কষ্ট হচ্ছে যে সেই ছোট্ট মিহিম এখন এতো বড় হয়ে গেছে।আমি অবাক কন্ঠে বললাম-
-কতো বছর পর দেখা হলো..কেমন আছো মিহিম?তোমার মা কেমন আছে?
-আম্মু ভালো আছে ম্যাম।আমিও ভালো আছি।জানেন ম্যাম,আমি আপনাকে এখনো ভুলি নি।যখন শুনেছিলাম আমরা ওই বাসা থেকে চলে যাবো তখন আপনার জন্য আমি খুব কেঁদেছিলাম।
-তুমি এখানে কি করে?
-এখানে আমার জব হয়েছে ম্যাম।
তাই এখানেই ফ্যামিলি নিয়ে সেটেল হয়ে যাবো। মিহিম ওর গাড়ির ভেতর থেকে কাকে যেন ডেকে বললো- “এই..জলদি বের হও।দেখো এসে কে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।” খেয়াল করে দেখলাম মিহিমের গাড়ির ভেতর থেকে একটি মেয়ে বেরিয়ে আসলো।মেয়েটির হাত ধরে গুটি গুটি পা ফেলে আসছে দুই-তিন বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে।মিহিম আমাকে দেখিয়ে মেয়েটিকে বললো-
-তোমাকে যেই ম্যাম এর কথা আমি প্রায়ই বলি।ইনিই হচ্ছেন সেই ম্যাম। মেয়েটি উল্লাসিত কন্ঠে বললো-
-ওই যে,ছোটবেলায় যেই আপুটার হাতে লাভ লেটার দিয়ে দৌড় দিয়ে পালিয়েছিলে সে?
-হ্যা..হ্যা..ইনিই সেই ম্যাম। মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে বললো-
-ও সবসময় আপনার কথা বলে।এই পর্যন্ত কয়েক লক্ষবার আপনার গল্প ওর কাছ থেকে শুনেছি। মিহিম আমার দিকে তাকিয়ে বললো-
-ম্যাম,ও আমার স্ত্রী। বাচ্চা মেয়েটাকে দেখিয়ে বললো-
-এইটা আমাদের মেয়ে।ম্যাম,মেয়েটার নামও রেখেছি আপনার নামে।আয়না।
-বাহ..আজ তো আমাকে সারপ্রাইজ দিলে।অনেক বছর পর তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে। ওদেরকে দেখে মনে হলো পৃথিবীর সকল সুখ বুঝি এখানে এসেই জড়ো হয়েছে।মিহিম ব্যাস্ত হয়ে বললো-
-ম্যাম,আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে একটা কাজে বেরিয়েছিলাম। আমাদেরকে যেতে হবে এখন।ম্যাম,দোয়া করবেন আমাদের জন্য। এই বলে মিহিম ওর স্ত্রীকে নিয়ে গাড়িতে উঠে গেলো। আমিও আমার অফিসের দিকে যেতে লাগলাম। মনে হলো কিছুক্ষনের জন্য আমি একটা কল্পনার ঘোরে আটকে গেলাম।হঠাৎ কল্পনায় ভাসাতে লাগলাম মিহিমের বাচ্চাকালের মুখটিকে।মনে হচ্ছে না যে বছর বছর কেটে গেছে।আমার কাছে মনে হচ্ছে এই তো কিছুদিন আগের ঘটনা সেই পিচ্চি মিহিম আমার হাতে একটি চিঠি ধরিয়ে দিয়ে দৌড়ে।
গল্পের বিষয়:
গল্প